গ্রামের মানুষের ভোটে তৈরি গ্রামের সরকার, গ্রামের ‘নবান্ন’ পঞ্চায়েত এই দু:সময়ে লোপাট হয়ে গিয়েছে। অতএব ভীমরাই এখন প্রশাসনের অন্ধের যষ্ঠি। লিখছেন দেবাশিস আইচ।
আকাল লেগেছে পুরুলিয়ার শবর পাড়ায়। তিনদিন হল চিরুগোড়া শবরটোলার খুনখুনে বৃদ্ধা খান্দি শবরের ঘরে একটা দানাও নেই। তিনদিন খাবার জোটেনি তাঁর। একই হাল গুরুবারি শবরের। রবিবার কেজি তিনেক চাল আর মুড়ির প্যাকেট মিলেছে। খান্দির চোখে জল নেই। চাল ঢালতে ঢালতে ভীম মাহাতর চোখে জল এসে যায়। বিধবা খান্দির ঘরে আকাল বারো মাস। বয়স আশি ছুঁই ছুঁই। বছরের অন্য সময় এর ওর ঘর থেকে কিছু খাবার জোটে এখন তো ঘরে ঘরেই আকাল। কে কাকে খাবার জোটাবে। একই অবস্থা আরেক বৃদ্ধা গুরুবারির। অবশ্য এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। অন্নপূর্ণা যোজনায় ৬৫ বছরের উপর বয়সি বৃদ্ধা-বৃদ্ধাদের মাসে ১০কেজি চাল পাওয়ার কথা। বিগত দু’বছর তা বন্ধ।
শবর পাড়ায় ঢুকলেই মনে হয় যেন দুর্ভিক্ষ লেগেছে। জানালেন ভীম মাহাত। পশ্চিমবঙ্গ খেড়িয়া শবর সমিতির একনিষ্ঠ স্বেচ্ছাসেবী। রবিবার অনেক সাধ্যসাধনা করে জোগাড় করা ৩১ কেজি চাল আর ২৫-৩০ প্যাকেট মুড়ি জোগাড় করে ভীম আর তাঁর ভাইপো মনোজ পৌঁছেছিলেন মানবাজার দুই ব্লকের চিরুগোড়া, কুমারী, তিলাবনি, তামাখুনের চারটি শবর পাড়ায়। গাড়ি নেই, বেরনো বারণ, পুলিশের কড়া নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে ভীম আর তাঁর তরুণ ভাইপো বছর ছাব্বিশের মনোজ দুটি বাইকে মাল চাপিয়ে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার ঘুরে ঘুরে ত্রাণ বিলি করেছেন। এই দু:সময়ে যদি বিডিও, পঞ্চায়েত লকডাউন লকডাউন বলতে বলতে হোম কোয়ারান্টিনে চলে যায় তখন আর ভীমদের কাছে উপায় কী?
চারটি শবর পাড়ায় কমপক্ষে ৬০টি পরিবার। সাধ থাকলেও সবার ঘরে চাল-মুড়ি পৌঁছে দেওয়ার সাধ্য নেই শবর সমিতির। তার উপর লকডাউনের বাজার। স্বাভাবিক ভাবেই অসহায় অভুক্ত অশক্ত বৃদ্ধ বৃদ্ধাদেরই প্রাথমিক ভাবে বেছে নিয়েছিলেন ভীমরা।চিরুগোড়ার চারটি, কুমারীর ছয়টি, তামাখুনের চারটি পরিবারকে ২/৩ কেজি করে দিতে দিতেই চাল শেষ। তিলাবনির ১৪টি পরিবারকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু মুড়ি দেওয়া গিয়েছে। চিরুগোড়া হোক কিংবা তিলাবনি, দিনমজুরিই আয়ের একমাত্র উৎস শবর পরিবারগুলো। অন্তত এক সপ্তাহ হল খেতের হোক কিংবা অন্য মজুরবৃত্তি বন্ধ। যে জনগোষ্ঠীর দুবেলা খাবার জোটাতে পরিবারের শিশু থেকে প্রবীণ সকলকেই প্রতিদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়, যে জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের স্রেফ দুবেলা কোনোরকমে খাবার জোটে তাদের একসপ্তাহ কাজ না-জুটলে চলবে কী করে?
প্রতীচী ট্রাস্ট ও এশিয়াটিক সোসাইটির বাংলার আদিবাসী সমাজের উপর করা সাম্প্রতিক তম এথনোগ্রাফিক স্টাডি ‘লিভিং ওয়ার্ল্ড অব দ্য আদিবাসিজ অব ওয়েস্টবেঙ্গল’ ২০২০, বলছে, বাংলার আদিবাসী সমাজের ৫৩ শতাংশ শিশু, কিশোর, যুবক, বয়স্কদের আয়ের রাস্তা বেছে নিতে হয়। এর পরও সমগ্র আদিবাসী সমাজের ১২ শতাংশ পরিবার দিনে দুবারের বেশি খেতে পায় না (তার মানে ‘ফুল মিল’ নয়)। লোধা শবরদের মধ্যে দুবেলা দু’মুঠো খাবার যোগাড় করতে পারে না ৪৭ শতাংশ পরিবার। পশ্চিম মেদিনীপুরের লোধাদের সঙ্গে পুরুলিয়ার খেড়িয়া শবরদের দুরবস্থার আহামরি কোনও ফারাক নেই।
২০০২ সালে চিরুগোড়ার শবরদের জন্য হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা করতে হয়েছিল শবর সমিতিকে। ২০০০ সালে ইন্দিরা আবাস যোজনায় ৯টি বাড়ি তৈরি করে দিয়েছিল তৎকালীন পঞ্চায়েত। দুটি বর্ষাতেই সেগুলি ধসে পড়ে। আদালতের রায়ে ফের নতুন করে তৈরি করা হয় এগারোটি বাড়ি। ব্যস, বিগত ১৮ বছরে এটুকুই পেয়েছে তারা। বনদপ্তরের জমিতে তাদের বাস। সে বসত জমিরই পাট্টা মেলেনি চাষের জমির তো প্রশ্নই নেই। আবার মাঝে এই জমি থেকে উচ্ছেদ করে দেওয়ার চেষ্টাও হয়েছিল। তাঁদের জমির নীচে নাকি রক ফসফেট ‘পুরুলিয়া ফস’ পাওয়ার সম্ভাবনা। খাদান মালিকরা তো সক্রিয় হবেই। সে প্রচেষ্টা অবশ্য রুখে দিয়েছে সমিতি। বান্দোয়ান-মানবাজার হাইওয়ের ধারে কুমারী শবর পাড়া। ২২টি পরিবারের টোলা। কেউ কেউ জমির পাট্টা পেয়ে তা ভোগ দখল করছে আর যাদের পাট্টা মিলেছে দূরে তারা সেই জমি হাতে পায়নি। তিলাবনি, তামাখুনের অবস্থাও তথৈবচ।
কথায় কথায় জানা গেল ২০০৪ সাল থেকেই এই শবর পরিবারগুলির অন্ত্যোদয় অন্ন যোজনায় বিপিএল রেশন কার্ড রয়েছে। বর্তমানে সারা রাজ্যেই রেশন কার্ড ডিজিটালাইজড করা হয়েছে। ভীম মাহাতো জানালেন অন্তত ১২৫ জন ডিজিটাল রেশন কার্ড পাননি। তার তালিকা ও আবেদনের প্রমাণপত্র তাঁর কাছে রয়েছে।অর্থাৎ, কার্ডহীনরা এখনতো রেশন পাচ্ছেন না এবং আগামী পয়লা এপ্রিল থেকে রাজ্য সরকার তিন মাস বিনামূল্যে যে খাদ্যসামগ্রী দেবে তাও পাওয়ার সম্ভাবনা বিশবাঁও জলে।
চারটি টোলায় অতি অসহায়দের খাবার বিলি করার পরও বসে থাকার সময় নেই ভীমদের। বাড়ি ফিরে খোঁজখবর করে জোগাড় করেছেন পুরুলিয়া জেলা প্রশাসনের হেল্পলাইন। জানিয়েছেন শবরদের জন্য খাবারের আর্জি। সে আবেদনে সাড়া দিয়ে বড়ো থানার ওসি ফোন করেছিলেন ভীম মাহাতকে। ওই থানা এলাকার সবকটি শবর টোলার ৬০ বছরের ঊর্ধ্বের বৃদ্ধা-বৃদ্ধাদের তালিকা তৈরি করে জমা দিতে অনুরোধ করেছেন। গ্রামের মানুষের ভোটে তৈরি গ্রামের সরকার, গ্রামের ‘নবান্ন’ পঞ্চায়েত এই দু:সময়ে লোপাট হয়ে গিয়েছে। অতএব ভীমরাই এখন প্রশাসনের অন্ধের যষ্ঠি। ওই চার টোলা সহ বোরো থানা এলাকায় মোট শবর পাড়া ২৮টি। ১৬-১৭ কিমি চক্কর মেরে ১৬টি শবর পাড়ার ষাটোর্ধ্ব ৭৮ জনের একটি তালিকা তৈরি করেছেন ভীম। করেননি শুধু, জমাও দিয়ে এসেছেন বোরো থানার সেকেন্ড অফিসার গোপাল চক্রবর্তীর হাতে। ভীম জানালেন, বাকি ১২টির তালিকা সোমবারই জমা দেবেন। সামাজিক দূরত্ব ভেঙে, ভয়-আতঙ্কের মুখে ছাই দিয়ে শূদ্রাধিক শূদ্র শবরের মুখে খাবার তুলে দিতে প্রাণপাত করছেন পুরুলিয়ার ভীম মাহাত, জয়দেব মাহাত, ফটিক হেমব্রমরা। গোপীবল্লভ সিং দেও, মহাশ্বেতা দেবীদের স্বপ্ন এই আকালেও ওঁরা মরে যেতে দেয়নি।