দিল্লি ভোটে বিজেপি হারল, কিন্তু বিজেপির উগ্র হিন্দুত্বের রাজনীতি কি হারল? আপের ঘোষিত রাজনীতি ঠিক কী? এই প্রশ্নের জবাব নিছক ভোটসংখ্যার হিসেবে মিলবে না, শুধুমাত্র এবারের ভোট দিয়ে তো নয়ই। রাজনীতির যে কোনও প্রশ্নকে আমরা যদি রাষ্ট্র, রাষ্ট্রক্ষমতা এবং ভোটের হিসাব থেকে আলাদা করে দেখতে না শিখি, যে কোনও উত্তরই অবৈধ ও অসিদ্ধ হতে বাধ্য। লিখেছেন সৌমিত্র ঘোষ।
কিছু প্রশ্ন
দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের ফল বেরনোর পর গুটি কয়েক প্রশ্ন সামনে আসছে। যে কোনও নির্বাচনে যেমন, ফল নিয়ে নানারকম কথাবার্তা কাটাছেঁড়া হয়ে থাকে, এবারের প্রশ্ন সে রকম ঠিক নয়, কিছু ভিন্নতর। যথা, দিল্লি নির্বাচনে আপ অর্থাৎ আম আদমি পার্টি জিতেছে ও বিজেপি হেরেছে, কিন্তু বিজেপি হেরেছে এটা কি সংশয়াতীত? অর্থাৎ কিনা, আপের জয় থেকে এই সিদ্ধান্তে কি পৌঁছনো যায় যে বিজেপির উগ্র হিন্দুত্বের রাজনীতি দিল্লির নির্বাচকমণ্ডলী প্রত্যাখ্যান করছেন? দুই, আপ কি আদৌ কোনো রাজনীতির কথা ভোট প্রচার চলাকালীন দলীয় বক্তব্য হিসেবে সামনে এনেছিল? বিশেষত, এমন কোনও রাজনীতি যা বিজেপি, আরএসএস-এর রাজনীতির বিরোধিতা করে? তিন, আপ নেতাদের (যথা স্বয়ং কেজরিওয়াল) মন্দির দর্শন, হনুমান চালিসা পাঠ ও টিকাশোভিত কপাল থেকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছনো কি ঠিক হবে যে আপ এতদ্বারা এক প্রকারের কুসুমনরম, স্নিগ্ধ, বন্ধুত্ববৎসল ও প্রেমময় হিন্দুত্বকে বাজারজাত করে, যা বিজেপি আরএসএস- এর আগ্রাসী, খুনি ও শত্রুতানির্ভর হিন্দুত্বকে প্রতিহত করতে সক্ষম? তিনের পিঠেই চার, নাকি আপের নরম হিন্দুত্ব বিষয়টা আসলে যেমন হয়ে থাকে আরকি, নেহাতই নির্বাচনী গিমিক, ভোটের পর ভুলে যাওয়া হবে? চারের পিঠে মোক্ষম পাঁচ (নাকি প্যাঁচ?), এসব অর্থাৎ বিজেপি ও হিন্দুত্ব-টিন্দুত্ব কিছু নয়, আসল ব্যাপার হচ্ছে কাজ, কাজ ও কাজ, একমনে জনগণসেবা করে যাও, ঝগড়াকাজিয়ায় কদাচ ফেঁসো না।
দিল্লি ভোটের ফল প্রকাশের পর কেজরিওয়ালজি সপরিবার তাঁর সমর্থকদের সামনে এসে যা বললেন এবং তাঁর দলের লোকজন সংবাদমাধ্যমে সাধারণভাবে যা বলছেন, তা থেকে মনে করার পর্যাপ্ত কারণ রয়েছে যে, ওই নির্বিবাদী কর্মযোগই এখন আপ দলের মূল তত্ত্বচিন্তা, এর বাইরে যা-ই জিজ্ঞেস করা হোক, তা স্রেফ প্ররোচনা মাত্র।
দিল্লি ভোটের আগে পরে প্রধান ও অপ্রধান, ছাপা ও অছাপা, ডিজিটাল ও লিনিয়র, যাবতীয় মিডিয়ায় ওপরের প্রশ্নগুলি সাঁইসাঁই বনবন ঘুরপাকরত, বিশেষত তাবৎ বামপন্থী বুদ্ধিজীবীকুল এ নিয়ে যারপরনাই চিন্তিত। দিল্লি বিধানসভা ভোটের ফল অন্য রাজ্যের ভোটে পড়বে কিনা এবং দিল্লি ভোটে বিজেপি-র হার থেকে বিজেপি-আরএসএস-এর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে উঠবে কিনা, সে সব প্রশ্নও উঠছে, ওঠারও কথা। গত ডিসেম্বরে সিএএ-এনআরসি বিরোধী আন্দোলন শুরু হবার পর থেকে যে দুটো বিধানসভা ভোট হয়েছে, ঝাড়খণ্ড ও দিল্লি, দুটোতেই বিজেপি হেরেছে, এর সঙ্গে বাংলায় তিনটি উপনির্বাচনে বিজেপির হার যুক্ত করলে এমন মনে হতেই পারে, বিজেপি বিরোধী রাজনীতির নবপর্যায় সমাগত ওই, গাছে ফল ধরেছে, ফল পাকছে কি পাকো পাকো, যাকে বলে লো হ্যাঙগিং ফ্রুট, টপাস করে পেড়ে ফেললেই হয়।
ভোটের রাজনীতি ও রাজনীতির রকমফের
আমরা কথা বলছি ভোট নিয়ে, ভোটের রাজনীতি নিয়ে। ভোটের রাজনীতির সুবিধা হচ্ছে, ভোট, ভোটে জেতাহারা ও সরকার বানানোর বাইরে বড় একটা না গেলেও চলে, যা বা যে রাজনীতিই হোক, তার আড়ে- বহরে বিস্তার এক ভোট থেকে অন্য ভোট, তার বাইরে আগে পরে কিস্যু নেই। সুতরাং সমাজে যা হচ্ছে, হয়, হতে পারে, সব ভোটে জেতাহারা দিয়ে বুঝে ফেলা যায়। যায় কি? লোকে কখন কাকে কেন ভোট দিচ্ছে তার সঙ্গে সামাজিক টানাপড়েনের একটা সম্পর্ক থাকেই, কিন্তু আজকের গোলমেলে সময়ে সে সম্পর্কের ল্যাজামুড়ো ঠাউরে ওঠা মুশকিল। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের কথা ধরুন। মে মাসে ভোট, ফেব্রুয়ারির গোড়া পর্যন্ত সঙ্ঘ পরিবারের বাইরের কেউ জোরগলায় বলছে না বিজেপি জিতছে, এমনকি গোদি মিডিয়ার করা ওপিনিয়ন পোলেও দেখানো হচ্ছে ত্রিশঙ্কু লোকসভা। তার পরই দুমাদ্দুম পুলওয়ামা বালাকোট ঘরমে ঘুসকে মারা হ্যায়, ঝাঁ করে সব বদলে গ্যালো। ভোটে হইহই করে জিতে এসে মোদিশা কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপ করলেন, সুপ্রিম কোর্ট থেকে রামমন্দির আইনত খালাস হয়ে এল, সিএএ পাস হল, কেন্দ্রীয় সরকারের দমনক্ষমতা বেড়ে গেল বহুগুণ, মোদিশার রাজনৈতিক বিরোধীরা সাড়ে-ছত্রখান পর্যুদস্ত নিশ্চিহ্নপ্রায়, কিন্তু কী আশ্চর্য, মহারাষ্ট্র হরিয়ানার ভোটে বিজেপি সুবিধা করতে পারল না। ভোট এবং ভোটের ফলাফল থেকে সামাজিক ক্ষমতাসম্পর্কের বিন্যাস বুঝতে হবে শাস্ত্রে বলেছে, ভোট সমাজের দর্পণ, সুতরাং উভয়ক্ষেত্রেই নানাবিধ তত্ত্বতালাশ হল। লোকে কেন্দ্রে শক্তিশালী সরকার চায় ও মোদির ছাপ্পান্ন ইঞ্চি, পাকিস্তান মুর্দাবাদ, ফলে পুনর্বার লোকসভায় বিজেপি। কিন্তু রাজ্যে কৃষকদের সঙ্কট, নোটবন্দি, কর্মহীনতা ও অন্যান্য অসুবিধা, রাজ্যে বিজেপি বিরোধিতা। এসব বিশ্লেষণ সর্বদা ভুল ও পরিত্যাজ্য, তা নয়। কিন্তু টিআরপি ও টিকে থাকার তাড়ায় টিভি চ্যানেলগুলোকে দিবারাত্র ডেকে যেতে হয়, ফেসবুকে ট্যুইটারেও হাতে গরম পোস্ট তৎক্ষণাৎ না দিলে সর্বনাশ, আজকের ভোট নিয়ে কাল কিছু বললে লোকে শুনবে না। ফলে ভোটগল্পের বাইরের সমাজ, বিশেষ ভারতবর্ষের বহুসমাজ যে জটিল, বহুস্তরীয় ও বিচিত্র সম্পর্কের জন্ম দেয়, তা নিয়ে আলোচনার সুযোগ থাকে না বললেই হয়। যে আলোচনাটা হয়, তা বর্তমান ও প্রত্যক্ষবাস্তবের বাইরে যায় না, যে প্রশ্নগুলো উঠে আসে তা সামাজিক সম্পর্কের সঙ্গে জড়িত মূলভূত রাজনৈতিক ক্ষমতাসম্পর্কের বিন্যাস ও পুনর্বিন্যাসের অপেক্ষাকৃত দুর্গম পরিসরে ঢোকে না, ফলে যা দেখা হয় ওপর থেকে, আলগোছে।
গোড়ার, অর্থাৎ দিল্লি ভোটে আপের জিত বিজেপির হার প্রসঙ্গে ফিরি। বিজেপি ভোটে হারল, কিন্তু বিজেপির উগ্র হিন্দুত্বের রাজনীতি কি হারল? আপের ঘোষিত রাজনীতি ঠিক কী? এই প্রশ্নের জবাব নিছক ভোটসংখ্যার হিসেবে মিলবে না, শুধুমাত্র এবারের ভোট দিয়ে তো নয়ই। রাজনীতির যে কোনও প্রশ্নকে আমরা যদি রাষ্ট্র, রাষ্ট্রক্ষমতা এবং ভোটের হিসাব থেকে আলাদা করে দেখতে না শিখি, যে কোনও উত্তরই অবৈধ ও অসিদ্ধ হতে বাধ্য।
আপের জন্ম ও স্বশাসনের রাজনীতি
আপ দলটির জন্মের কথা ধরা যাক। যে আন্দোলন থেকে কেজরিওয়াল এবং তাঁর সঙ্গীরা জনসমক্ষে আসেন, তার মোদ্দা কথা ছিল রাষ্ট্র তাঁর নাগরিকদের ন্যায় দিতে সক্ষম নয়, ন্যায়বিচারের জন্য এমন ‘লোকপাল’দের প্রয়োজন, যাঁরা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন নেতামন্ত্রী ও আমলাদের সীমাহীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিবাদের প্রতিনিধিত্ব করবেন। আন্না হাজারের নেতৃত্বে রামলীলা ময়দানে যে জমায়েত হয়েছিল, তার চাপে সংসদে আলাদা করে সর্বদলীয় প্রস্তাব পাশ হয়। ২০১২-তে যখন আপ জন্ম নিচ্ছে এবং পরের বছরেই নির্বাচনে নামছেন কেজরিওয়াল, রাষ্ট্রক্ষমতায় দীর্ঘদিন ধরে থাকা বা তার শরিক হবার ইচ্ছা আপ দলের কাজকর্মে অন্তত ফুটে ওঠেনি। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হবার পর থেকে কেজরিওয়াল ও তাঁর সঙ্গীরা বেশি সময় দিয়েছেন রাস্তার আন্দোলনে। হবার কথাও তাই। কেজরিওয়ালের সঙ্গে যাঁরা প্রথম কিস্তিতে জড়ো হচ্ছিলেন, তাঁদের অনেকেই সামাজিক আন্দোলনের নেতাকর্মী, সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করে তাঁদের পরিচিতি তৈরি হয়েছে বহুদিন ধরে, সরকারে গিয়ে কী করা যায় বা করতে হবে, সে বিষয়ে তাঁদের ধারণা থাকার কথাও না। ফলে সরকার চলল না, প্রথাসিদ্ধ রাজনৈতিক দলেরা জাতধম্মোকুল নির্বিশেষে কেজরিওয়াল ও তাঁর দলকে নৈরাজ্যপন্থী রাষ্ট্রবিরোধী ইত্যাদি বলে গাল পাড়তে থাকলেন। ২০১৫-য় যখন দ্বিতীয়বার দিল্লি বিধানসভায় ক্ষমতায় এল আপ, তার পিছনে আপের সদস্যদের বছর দুয়েকের অক্লান্ত পরিশ্রম ছিল। যেটা বলা একান্তই দরকার, এই পরিশ্রমটা ভোটবাজ দল তৈরির উদ্দেশ্যে নয়। দিল্লির ঝুগগিবস্তিতে ও পাড়ায় পাড়ায় যে মহল্লা কমিটিগুলো তৈরি হল তার সমতুল কিছুর সন্ধান ভারতবর্ষের ইতিহাস-ভূগোল খুঁজে পাওয়া যাবে না। কেজরিওয়াল বা তাঁর আপ সঙ্গীরা আদৌ কোনোকালে নৈরাজ্যপন্থী বা অ্যানার্কিস্ট ছিলেন কিনা, জানা নেই। কিন্তু দিল্লির মহল্লাকমিটির তুলনা চলতে পারে একমাত্র হালফিলের পড়শিসভা বা neighbourhood assembly-র সঙ্গে, আর্জেন্টিনা থেকে শুরু করে গ্রিস স্পেন ফ্রান্স পর্যন্ত যা নৈরাজ্যপন্থী রাজনীতির অচ্ছেদ্য অঙ্গ। দিল্লির মহল্লাকমিটিতে লোকে কথা বলতেন সরকারের কাজ নিয়ে, নিজেদের জীবন নিয়ে, কী করা যায় তা নিয়েও। সরকারি স্কুলের হাল ফেরানো, সাধারণের আয়ত্তাধীন চিকিৎসাব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে মহল্লা ক্লিনিক স্থাপন, পাড়ায় পাড়ায় পানীয় ও নিত্যব্যবহার্য জলের যোগান, কম পয়সায় বা নিখরচায় বিদ্যুৎ, যেসব বহুচর্চিত কাজের কথা এখন সবাই জানেন, তার চালিকাশক্তি ও উৎস ছিল মহল্লাকমিটিগুলো। যে নিওলিবরল বাজারি সময়ে শিক্ষা স্বাস্থ্য জল বিদ্যুৎ সমেত আমমানুষের যাবতীয় প্রয়োজন অবিরল পণ্য, সে সময়ে এই কাজগুলো প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক কাজ, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। মহল্লাকমিটির গঠন ও আপের নির্বাচনী সাফল্যের পিছনে তাদের ভূমিকা প্রমাণ করে যে শুধু বিজেপি নয়, কংগ্রেস সহ সমস্ত প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর রাষ্ট্রবাদের বিপ্রতীপে বিকেন্দ্রিত ও অ-রাষ্ট্রীয় এক অন্য ধরণের রাজনৈতিক ক্ষমতা সংহত হচ্ছিল। তৃণমূল স্তরের গণতন্ত্র অনুশীলনের যে ডাক আপ দেয়, সেখানে আমনাগরিকজন বরাবরের হিস্যাদার বা সহভাগী, পরমুখাপেক্ষী অসহায় জড়সমষ্টি মাত্র নয়। মহল্লাকমিটি নির্ভর আপ দলের উত্থান সেকারণে অন্য যাবতীয় রাজনৈতিক দলের এতাবৎকালের নির্বাচনী নির্মাণকে বিপন্ন করে তুলেছিল। ২০১৩ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত এবং তার পরেও, বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে যে ভাষা ও ভঙ্গিতে আপের ওপর আক্রমণ শানানো হয়, তা থেকে এই বিপন্নতার মূলভূত ধরণটি বোঝা যায়।
২০১৫-য় প্রবল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দিল্লি সরকারে ফেরার পরও আপের কাজের প্রকৃতি বিশেষ বদলায়নি। মহল্লাকমিটি বিষয়টিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবার উদ্দেশ্যে বিধানসভায় বিশেষ আইন পাস হয়, ফলে দিল্লি জুড়ে প্রায় হাজার তিনেক মহল্লাসভা গঠিত হয়, যারা এলাকার উন্নয়ন নিয়ে মতামত দেবে, পরিকল্পনা করবে এমনকী খানিকদূর অবধি খরচখরচাও নিয়ন্ত্রণ করবে। অর্থাৎ সরকারি কাজের এক ধরণের একটা গণমুখী বিকেন্দ্রীকরণ হল, উন্নয়ন বিষয়টি নিয়েও একটা অন্য ভাবনা উঠে এল। এই পর্যন্ত আপের যে কাজ, সেখানে বড় ক্ষমতা, বড় রাষ্ট্র ও বড় পুঁজি নিয়ন্ত্রিত ওপরতলার রাজনীতির উল্টোদিকে একটা নীচতলার রাজনীতি বা ফ্রম দি বিলো পলিটিক্স তৈরি হয়ে উঠছে, এমন মনে করার কারণ ছিল। লক্ষ্যণীয়, এই নীচতলার রাজনীতির নির্মাণ বিষয়টি আপ গঠনের প্রক্রিয়ায় প্রথমাবধি ওতপ্রোত ছিল, বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত যে সব মানুষেরা আপের জন্ম দেন, তাঁদের অনেকেই গান্ধীর গ্রাম স্বরাজ ভাবনার অনুসারী, বা পুরোনো সমাজতন্ত্রী, নানান সময়ে তাঁরা অটোনমি বা স্বশাসনের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন। কেন্দ্রীভূত বড় রাষ্ট্র নয়, স্বশাসিত এলাকার সংযুক্ত পরিসরের মধ্যে এলাকা উন্নয়নের সামগ্রিক প্ৰতর্ককে নতুন করে স্থাপন করার চেষ্টা বিভিন্ন ভাবে হয়েছে গত তিরিশ বছরে, যার সবচাইতে বড় উদাহরণ ব্রহ্ম দত্ত শর্মার (বি ডি শর্মা নামে অধিক পরিচিত) নেতৃত্বে ভারত জন আন্দোলন প্রক্রিয়া, যার অভিঘাতে ভারতবর্ষের সংবিধানের পঞ্চম তফসিলের অন্তর্ভুক্ত আদিবাসী এলাকাগুলিতে স্বশাসিত আদিবাসী অঞ্চল গড়ে তোলার লক্ষ্যে পেসা বা panchayat extension to scheduled areas আইনটি তৈরি হয়। ১৯৯৬-তে পেসা, তার বছর কয় পরে, ২০০৬ সালে বন অধিকার আইন, তা বাদে নরেগা বা কাজের অধিকার আইন, এ সবের মধ্যেই স্বশাসনের বিষয়টির স্বীকৃতি ছিল। আপ দিল্লিতে যে মহল্লাসভা গঠন করে, তার পিছনে রাজনৈতিক অনুশীলনের এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া ছিল, ঘটনাটা আলটপকা হাজির হয়নি।
স্বশাসন না রাষ্ট্রশাসন?
এখানে কিছু কথা খোলাখুলি বলা দরকার। স্বাধীনতা উত্তর সময়ে বা ঔপনিবেশিকতা বিরোধী আন্দোলনের সময়েও বারবার স্বশাসিত, এমনকী স্বনির্ভর গ্রামসমাজের কথা এসেছে, গান্ধী নিজে এ কথা বলছেন বারবার। মুশকিলটা হচ্ছে, গান্ধী ও তাঁর অনুসারীরা এই স্বশাসনের রাজনৈতিক চরিত্র কী হবে, সে তর্কে যাননি। গ্রামসমাজের ভিতরকার যে অসংখ্য সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, তার নিরসন কী করে হবে, তার কোনও দিগদর্শন ছিল না। সবচাইতে ঝামেলার যেটা, আগাপাশতলা জনবিরোধী ও ঔপনিবেশিক একটা রাষ্ট্রকাঠামোর সঙ্গে স্বশাসনের ভাবনা যে খাপ খায় না, তা নিয়ে তাঁরা ভাবিত ছিলেন বলে মনে হয় না। এই রাষ্ট্রের হাত ধরে, তার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ও প্রশ্রয়ে যে স্ব-শাসন, সেখানে রাষ্ট্রের বাইরে কোন ‘স্ব’ আলাদা করে থাকে না, থাকা সম্ভব নয়। হয়তো কিছুদূর পর্যন্ত কিছু উন্নয়নমূলক কাজ করা সম্ভব। মৌলিক রাজনৈতিক বদল আনা সম্ভব নয়। আপ দলটি দ্রুত এই মোদ্দা কথাটা বুঝে ফ্যালে, না বুঝলে তাদের পক্ষে তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসা কঠিন হত। ২০১৩ সালে প্রথমবার সরকারে আসার পর থেকে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের প্রাকমুহূর্ত অবধি আপ বারবার, একরকম নিরবচ্ছিন্নভাবেই, কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত থেকেছে, দিল্লি সরকারের হাতে অধিক ক্ষমতার দাবিতে, দিল্লিকে পূর্ণ রাজ্য করার দাবিতে। আপের যে রাজনৈতিক চলন, স্বশাসনের যে মূল রাজনৈতিক দাবি ঘিরে আপের উদ্ভব, সেখানে এটাই কাম্য ও প্রত্যাশিত। কিন্তু এবারের দিল্লি ভোট থেকে দিব্য বোঝা যাচ্ছে, আপ তার পুরোনো রাজনৈতিক অবস্থান থেকে সরে এসেছে, অথবা আপ নেতৃত্বের বিলম্বিত বোধোদয় হয়েছে যে রাষ্ট্রের সঙ্গে অবিরল সঙ্ঘাতে জড়িয়ে থেকে রাষ্ট্রক্ষমতার শরিক হওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং আপের নেতারা বলে যাচ্ছেন, সঙ্ঘাত নয়, বিরোধিতা নয়, ঝগড়াঝামেলা নয়, শিক্ষা স্বাস্থ্য বিদ্যুৎ জল, মানে কাজ। নতুন রাজনীতি মানে বিরোধহীন কাজের রাজনীতি। বিজেপি-আরএসএস-এর ঘৃণার রাজনীতির বিরোধিতায় আপ নেতারা পথে নামছেন না, শাহিনবাগের লড়াইয়ের পাশেও দাঁড়াচ্ছেন না, কেননা ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতায় বিজেপি, তাকে এবং তার সমর্থকদের চটানো মানে রাষ্ট্রকে চটানো। তাতে শুধু ভোটে হারার ভয় নয়, আরো বড় ভয়, কেন্দ্রশাসিত দিল্লিতে আপ সরকারের কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যাবে। যেহেতু সরকারে থাকাটাই আসল, সরকারে না থাকলে ‘কাজ’ করা যায় না এবং কাজই মোক্ষ, রাজনীতি নামক গন্ডগোলের মধ্যে আপ আর ঢুকবে না। ফলে, বিরুদ্ধতা ও সঙ্ঘাত বর্জিত, পুরোপুরি জীবাণুরহিত যে নতুন স্বশাসন-পরিসর তৈরি হবে, সেখানে রাষ্ট্র বন্ধু শুধু নয়, রাজাও। রাজা যা করেন, তা মঙ্গলের জন্যেই, সুতরাং কাশ্মীর হোক, সিএএ হোক, পুঁজির সুবিধা করে দেওয়া নতুন শ্রম আইন সংস্কার হোক, আপের ‘কাজের’ রাজনীতির সঙ্গে তার বিরোধ ঘটবে না।
হিন্দুত্ব বনাম হিন্দুত্ব না রাষ্ট্র বনাম রাষ্ট্রবিরুদ্ধতা?
পরিচিত ও আপ সমর্থক এক বামপন্থী বুদ্ধিজীবীর লেখায় পড়লাম, আপ ও কেজরিওয়ালের হিন্দুত্ব অনুশীলন আসলে সঙ্ঘ পরিবারের ঘৃণার রাজনীতির জবাব। যে হিন্দু জনসমষ্টির মগজে সঙ্ঘের রাজনীতি ঢুকে আছে, বামপন্থীরা তাঁদের ধারেকাছে পৌঁছতে পারেননি, আপ সেখানে পৌঁছচ্ছে অনায়াসে, যাবতীয় বামপন্থী রেটরিক বর্জন করে, ধর্মবিশ্বাসে আঘাত না করে, তার অংশ হয়ে উঠে। গান্ধী এই কাজটাই করেছিলেন, ফলে হিন্দুত্ববাদীরা তাঁকে শত্রু বলে জানতো। এই কথাটায় আপত্তির কিছু নেই, গান্ধীর ধর্মভাবনার নিজস্ব চরিত্র ছিল, রাষ্ট্রের সঙ্গে তিনি ধর্মের মিশাল ঘটাননি, ফলে হালের রাষ্ট্রীয় হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে তাঁর চিন্তাকে ব্যবহার করা যেতেই পারে। আসল গন্ডগোলটা অন্যত্র। বিজেপি-আরএসএস-এর রাষ্ট্রভাবনার সঙ্গে ধর্মভাবনা মিশে আছে, কিন্তু সেখানেও তাদের গাজোয়ারি ও গুন্ডামির মূলে রাষ্ট্রক্ষমতা। রাষ্ট্রক্ষমতার যে চূড়ান্ত কেন্দ্রীভবন গত কয়েক বছরে ভারতবর্ষে ঘটেছে, দেশের ইতিহাসে ইতিপূর্বে তা ঘটেনি। রাষ্ট্র মনে করছে এই মুহূর্তে সে যা ইচ্ছা করতে পারে, সে সর্বশক্তিধর। ধর্ম অর্থাৎ রাষ্ট্রবাদী হিন্দুত্বের যে নির্মাণ আমাদের সকাল বিকেল উঠতে-বসতে চোখ রাঙাচ্ছে, সে আসলে রাষ্ট্রশক্তিকে পুষ্টি জোগাচ্ছে, রাষ্ট্রের অপশাসনকে সমাজগ্রাহ্য করে তুলছে। রাষ্ট্রের, রাষ্ট্রক্ষমতার নিরবচ্ছিন্ন রাজনৈতিক বিরোধিতা ভিন্ন এই হিন্দুত্বের বিরোধিতা সম্ভব নয়। আপের নির্বিরোধী ‘কাজের’ রাজনীতি দিয়ে তো নয়ই।
শুধু আপ নয়। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসকদল তৃণমূল, প্রধান ও অপ্রধান বামপন্থীদের গরিষ্ঠ অংশ, কংগ্রেস সহ অন্যান্য বিরোধী দল, সবাই বর্তমান সঙ্কটের নিরসন খুঁজছেন রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাষ্ট্রক্ষমতার পরিসরে। ক্ষমতা নিয়ে তাঁদের আপত্তি নেই, আপত্তি ক্ষমতার দলীয় মালিকানা নিয়ে। বর্তমান ও ঐতিহাসিক ভারতবর্ষের বিভিন্ন-বিবিধ সামাজিক গঠনের মধ্যেই কেন্দ্রীভবন ও পশ্চিমী জাতিরাষ্ট্র ভাবনার বিরুদ্ধাচারী নানা স্রোত লুকিয়ে আছে। ১৯৮৯ থেকে ২০১৪ অবধি ভারতে যে জোট সরকারের পরম্পরা চালু হয়েছিল, তার মূল কারণও তাই। সমাজমুক্তির রাজনীতিতে এখনো যে বামপন্থীদের আস্থা আছে, তাঁদের প্রাথমিক ও বুনিয়াদি কাজ এই বিরুদ্ধতার জায়গাগুলোকে জানা-বোঝা, তদনুযায়ী রাষ্ট্রের কেন্দ্রীভবনের বিরুদ্ধে কাজ করা। যে রাষ্ট্র অপেক্ষাকৃত বিকেন্দ্রিত ও অসংহত তা দুর্বল, তাঁর দমনশক্তি কম। আজকের সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে পুঁজির মৌলিক বিরোধ নেই, শক্তিশালী কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র পুঁজির পক্ষে দাঁড়াচ্ছে বারবার। রাষ্ট্রের সহায়তায়, আনুকূল্যে রাষ্ট্রকে দুর্বল করা যায় না। আপ দলের সমর্থকরা এই পুরোনো স্বতঃসিদ্ধটি স্মরণে রাখলে ভালো করবেন।
লেখক সামাজিক আন্দোলনের কর্মী। মতামত লেখকের নিজস্ব।
Supporters of aap are hardly concerned about the alternative that you have hunter. Being under pressure of the social and political crisis they are looking for a solution through aaps victory, that does not put their own economic and social condition stress.