ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার ঋণের জালে দেশের গ্রামীণ প্রান্তিক মহিলারা – পশ্চিমবঙ্গের চিত্র অতি উদ্বেগজনক


  • October 31, 2025
  • (0 Comments)
  • 340 Views

মূলত গ্রামাঞ্চলে হওয়া এই সমীক্ষার নিরিখে যে বিষয়টি সামনে উঠে আসে তা হল গ্রামীণ পারিবারিক দারিদ্র্যের বোঝা এসে পড়ছে মহিলাদের উপর এবং তারই ফলস্বরূপ বাড়ছে ঋণগ্রস্ততা। এই দারিদ্র্যকে পুঁজি করেই চলছে ‘ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার লুট’।

 

সুদর্শনা চক্রবর্তী

Groundxero | Oct 31, 2025

 

সারা দেশের ২১টি রাজ্য, ১০০টি গ্রাম, সর্বমোট ৯০০০ মহিলাদের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে করা একটি সমীক্ষায় উঠে এসেছে ভারত জুড়ে ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার ঋণগ্রহীতা মহিলাদের বাস্তব পরিস্থিতি। ইন্ডিয়ান স্কুল অফ উইমেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এবং সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির উদ্যোগে দেশ জুড়ে এই সমীক্ষা করা হয়।

 

বিগত কয়েক বছরে সরকারি ব্যাঙ্কগুলি যেভাবে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ, এবং তারও মধ্যে নির্দিষ্টভাবে মহিলাদের ঋণদানের ক্ষেত্রে ঔদাসীন্য দেখাচ্ছে এবং তা রীতিমতো কঠিন করে তুলছে, পাশাপাশি পুঁজিপতিদের ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক ঋণদান, ঋণমকুব সব ক্ষেত্রেই সরকার ও সরকারি ব্যাঙ্ক যতটা স্বচ্ছন্দ ও তৎপর, সাধারণ নাগরিক, বিশেষত প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠীর মানুষদের ক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকাটি থাকে সম্পূর্ণ বিপরীত। এবং আর্থ-সামাজিক কাঠামোর প্রেক্ষাপটে এর সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ে পরিবারের মহিলাদের উপরেই। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই ক্ষুদ্র ঋণের ক্রমশ বাড়তে থাকা দুষ্ট চক্রের সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হন মহিলারাই।

 

এই সমীক্ষা শেষ হওয়ার পর চলতি বছরের অগাস্ট মাসে দিল্লিতে একটি গণ শুনানির আয়োজন করা হয়। সেখানে সমবেত হন দেশের ২০টি রাজ্যের ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার ঋণগ্রস্ত প্রায় ৫০০ মহিলারা। সেখানেই তৈরি হয় এক দাবিপত্র। এরপর সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি ও ইন্ডিয়ান স্কুল অফ উইমেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-এর উদ্যোগে গত ২৯ অক্টোবর কলকাতায় ‘ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থা ও নারী আন্দোলন’ শীর্ষক একটি আলোচনাসভা ও সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সভায় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার মহিলা প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। আলোচক ছিলেন ইন্ডিয়ান স্কুল অফ উইমেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-এর পক্ষ থেকে অধ্যাপক মালিনী ভট্টাচার্য, অধ্যাপক ঈশিতা মুখোপাধ্যায়, গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির পক্ষে কণিনীকা বোস, সারা ভারত নাবার্ড কর্মচারী সমিতির সর্বভারতীয় সচিব রাণা মিত্র, সারা ভারত ক্ষেতমজুর সমিতির পক্ষে তুষার ঘোষ ও রাজ্য সমবায় বাঁচাও মঞ্চ-র পক্ষ থেকে গণেশ সামন্ত।

 

এই সমীক্ষায় উঠে আসা তথ্যগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের চিত্রটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। সমীক্ষার অন্তর্গত রয়েছে সারা ভারতের ২৫টি জেলা, যেখানে এই ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার মডেল সবচেয়ে বেশি চলছে, তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের রয়েছে ৯’টি জেলা রয়েছে। এই তালিকার শীর্ষে রয়েছে বিহার, সেখানকার ১১টি জেলা এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত। আশঙ্কার বিষয় হল পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ রয়েছে দেশের মধ্যে শীর্ষে, যেখানে ঋণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি – ৪২৩৯ কোটি টাকা। এ রাজ্যে তারপর যে পাঁচটি জেলা রয়েছে, সেগুলি হল উত্তর ২৪ পরগণা (৩১৫৪ কোটি), দক্ষিণ ২৪ পরগণা (২৬৫৭ কোটি), নদীয়া (২২১৫ কোটি), হাওড়া (২১৩৩ কোটি), হুগলি (২১০১ কোটি)।

 

গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে পশ্চিমবঙ্গে গ্রামীণ মহিলাদের বাস্তবে ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে থাকা অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দিকে ও ঋণ নিয়ে তা বিনিয়োগের মাধ্যমে নতুন পুঁজি তৈরি না হওয়ার ক্ষেত্রে যে সমস্যা গড়ে উঠেছে, তার দিকেই স্পষ্ট নির্দেশ করছে এই পরিস্থিতি। গ্রামীণ মহিলারা মূলত এই সমীক্ষার অন্তর্ভুক্ত হলেও, শহরের কিছু অঞ্চলের মহিলারাও এতে শামিল হয়েছিলেন। মূলত গ্রামাঞ্চলে হওয়া এই সমীক্ষার নিরিখে যে বিষয়টি সামনে উঠে আসে তা হল গ্রামীণ পারিবারিক দারিদ্র্যের বোঝা এসে পড়ছে মহিলাদের উপর এবং তারই ফলস্বরূপ বাড়ছে ঋণগ্রস্ততা। এই দারিদ্র্যকে পুঁজি করেই চলছে ‘ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার লুট’। পরবর্তী সময়ে ঋণ উদ্ধারে ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলির যে অমানবিক প্রক্রিয়া, তাতে ঋণগ্রস্ত মহিলাদের মানসিক স্বাস্থ্য ব্যপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অপমান, সামাজিকভাবে হেনস্থা, ঋণশোধের উদ্বেগ ইত্যাদি নানা কারণে এমনকি আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটছে।

 

যে বিষয়গুলি সমীক্ষা পরবর্তী আলোচনায় উঠে আসে তা হল এ রাজ্যে কর্মসংস্থানের সুযোগ ক্রমশ কমে আসা যেমন ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বাড়ার অন্যতম কারণ, তেমনি ভোগবাদী সামাজিক পরিস্থিতিও ঋণ নিয়ে হলেও বিবিধ পণ্য কেনার প্রতি ঝোঁক বাড়াচ্ছে। ব্যাঙ্ক থেকে সহজ শর্তে ঋণ না পাওয়ার কারণে মহিলারা চড়া সুদে হলেও ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থা থেকেই ঋণ নিচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গের এক জেলা প্রতিনিধি আলোচনা সভায় জানান, এক ঋণগ্রহীতা মহিলাকে ক্ষুদ্র ঋণের সমস্যা ও ঝুঁকি বোঝাতে গেলে যখন সাধ ও সাধ্যের মধ্যে ভারসাম্য রাখার কথা বলেন, সেই মহিলা জানান, “এখানে একসঙ্গে ৫০,০০০ টাকা ঋণ পাই। গতরে খেটে সেই টাকা শোধ করি। দরকারে ৪, ৫ জনের থেকেও ঋণ নিই।” মাসে ৫, ৬ হাহার টাকা রোজগার না থাকলেও, মাসিক ৪৫,০০০ টাকা সুদ যেভাবেই হোক শোধ করতে হচ্ছে এমন উদাহরণও রয়েছে। কিস্তি দিতে না পারার কারণে সন্তানদের স্কুল থেকে ছাড়িয়ে এনে পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে বাইরে পাঠিয়ে রোজগারের কথা ভাবতে হচ্ছে – এমন ঘটনাও ঘটছে। সহজে থোক টাকা ঋণ পাইয়ে দেওয়ার যে মনস্তত্ত্ব তা এই গ্রামীণ, কর্মহীন, দরিদ্র মহিলাদের ক্ষুদ্র ঋণের কবল থেকে বেরিয়ে আসার মূল বাধা।

 

এই চড়া সুদে ঋণ নিয়ে সুদসহ কিস্তি শোধের জন্য একের পর এক ঋণের জালে জড়িয়ে পড়তে থাকেন মহিলারা। পূর্ব বর্ধমানের এমনই এক ঋণগ্রস্ত মহিলা কল্পনা রায় ছ’টি ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ঋণ আদায়ের নামে ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার বাউন্সারদের মহিলাদের বাড়ি গিয়ে হেনস্থার ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। সুদসহ কিস্তি দিতে না পারলে বা দেরি হলে গবাদি পশু জোর করে নিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা যেমন রয়েছে, তেমনি সবচেয়ে খারাপ উদাহরণ হিসাবে ঋণ মকুবের জন্য কিস্তি আদায়কারী অফিসারের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে যেতে বাধ্য হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। তাঁদের নিরাপত্তা, মানসিক স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, সামাজিক সম্মান সবই চূড়ান্তভাবে বিপন্ন ও আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে পৌঁছাচ্ছে।

 

এই প্রতিবেদক এক দশকেরও আগের অভিজ্ঞতার নিরিখে জানে, ২০১০-১১ সাল থেকে এ রাজ্যে ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলি ব্যবসা শুরু করে ও তা ছড়াতে থাকে। ক্ষুদ্র ঋণের মূল লক্ষ্যই হল মহিলাদের ঋণ, বিশেষত সুবিধাবঞ্চিত পরিসরের মহিলাদের ঋণ দিয়ে চড়া সুদে ঋণ আদায় করা। সেই সময়ে মহিলাদের এর প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার মূল কারণ ছিল, ব্যাঙ্কের প্রতি ভীতি। সেখানে গ্রাহক-বান্ধব (বিশেষত মহিলাদের ক্ষেত্রে) পরিবেশ না থাকা এর অন্যতম কারণ। ক্ষুদ্র ঋণ অন্যদিকে তাঁদের বাড়িতে, গোষ্ঠী করে সমবেতভাবে ঋণ নেওয়ার প্রক্রিয়াটিকে তাঁদের কাছে প্রাথমিকভাবে সহজ করেছিল। সাপ্তাহিক সুদ দেওয়ার ব্যবস্থাও শুরুর দিকে গায়ে লাগত না। কিন্তু শুরু থেকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষেত্রে এই ঋণ মহিলাদের নিজস্ব উৎপাদনশীল বিনিয়োগের পুঁজি হত না। হয় পারিবারিক বা সাংসারিক নানা কিছুর খরচ মেটাতে, নতুবা সন্তানের লেখাপড়ার খরচ দিতে বা বাড়ির পুরুষ সদস্যর (মূলত স্বামী) রোজগারের উপায় তৈরিতেই এই ঋণের টাকা ব্যয় হত। অথচ ঋণ মেটানোর দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে মহিলা ঋণগ্রহীতার এবং ঋণখেলাপি হওয়ার পুরো ঝক্কিও তাঁরই।

 

আজ দশক পেরিয়ে পরিস্থিতি বদলায়নি বরং তা যে আরও জটিল হয়েছে, এই সমীক্ষা তাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। সরকার ও সরকারি ব্যাঙ্ক আজও মহিলা ঋণগ্রহীতাদের বিষয়ে উদাসীন। অন্যদিকে ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলি কোনোরকম নথিপত্র ঋণগ্রহীতা মহিলাদের দেয় না, যে ফর্ম ইত্যাদি থাকে তা মাতৃভাষায় না থাকার কারণে ও শিক্ষার অভাবে ঋণের শর্তাবলীর বিষয়ে তাঁরা ওয়াকিবহাল থাকছেন না এবং চরম সমস্যা ও শোষনের মধ্যে পড়ছেন।

 

এই রাজ্যের পরিস্থিতি আরোও জটিল। কারণ মহিলাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, রোজগারের মাধ্যমে বিশেষভাবে ব্যহত হয়েছে। কেন্দ্র-রাজ্যের চাপান-উতোরে মনরেগা প্রকল্পে ১০০ দিনের কাজ গত তিন বছর ধরে বন্ধ। মনে রাখতে হবে এই প্রকল্পে প্রায় ৭৫% যোগদান মহিলাদের হত। পাশাপাশি গ্রামে বাড়ছে লিজ চাষীর সংখ্যা। কারণ এতে কৃষিমজুরের খরচ দিতে হচ্ছে না যেহেতু পরিবারের সদস্যরাই কাজে যোগ দিচ্ছেন। সেইসঙ্গে পরিবারে কিছুটা হলেও খাদ্যের সংস্থান হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে উপয়ান্তর না থাকায় ক্ষেতমজুর ও গ্রামীণ শ্রমজীবীদের মধ্যে মহিলাদের সংখ্যা বাড়ছে। দেখা যাচ্ছে ধান রোঁয়ার কাজে ৮০%-ই মহিলা। এই অবস্থার ফলেই গ্রামীণ কৃষিজীবী, কৃষিমজুর মহিলাদের মধ্যে ঋণগ্রস্ত হওয়ার সংখ্যাও ক্রমশ বাড়ছে।

 

এতদসত্ত্বেও মহিলারা কম সুদে সরকারি ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ পাওয়ার পরিবর্তে সেখান থেকে ঋণ পাচ্ছে ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলি এবং তাদের উপর সরকারি তরফে কোনোও নজরদারি নেই। বরং তারা দাবি করছে ২০ হাজার কোটি টাকা তাদের ক্রেডিট গ্যারান্টি দেওয়া হোক এবং গ্যারান্টার হোক খোদ সরকার। এই মুহূর্তে সারা দেশে ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার মোট সংখ্যা ২০৯। পণ্যায়ণ, ভোগবাদী সমাজব্যবস্থায় পুঁজিবাদের ক্ষমতা বিস্তার ও ভোগব্যয় বৃদ্ধি – এই সবকিছুই ক্ষুদ্র ঋণের বাড়-বাড়ন্তের পেছনে অন্যতম কারণ। পাশাপাশি এ দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা পুঁজিপতিদের দখলে চলে যাওয়ায় প্রান্তিক মানুষ ও মহিলাদের অর্থনৈতিক শোষন বেড়েছে বহুগুণ। এই সমীক্ষাতেই এও দেখা গেছে এমন গ্রামও রয়েছে এ দেশেই, এ রাজ্যেও যেখানে একজনও ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতা মহিলা নেই। রাজ্য সরকারের সদিচ্ছা, দুর্নীতিমুক্ত কাজের পরিবেশ তৈরি এবং মহিলাদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও অর্থনৈতিক বিষয়ে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের উৎসাহিত না করা এই সমস্যার সমাধান সহজ নয়।

 

১৯৯২ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা নাবার্ড মহিলাদের স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন করার লক্ষ্যে ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা শুরু করেছিল। যা ছিল ‘এসএইচজি লিঙ্কেজ মডেল’। অথচ এই ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থাই আজ ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলির হাতে একাধিক ঋণ প্রদানের চক্রে পরিণত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট শাসনের শেষে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির উৎপাদিত পণ্যের আধুনিকীকরণ, গুণমান নিয়ন্ত্রণ ও পণ্যের বিনিয়োগ হচ্ছিল না। বর্তমান তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনকালে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলি ঋণদান সংস্থায় পরিণত হয়েছে এবং ঋণের বিনিয়োগ হচ্ছে না।

 

দাবিপত্র –

 

১) কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবিসমূহঃ

 

  • সুদের হার নিয়ন্ত্রণ ও তা নির্ধারিত সীমার মধ্যে রাখার উদ্দেশ্যে একটি আইন প্রণয়ন করতে হবে যা শুধু জাতীয় স্তরের লেনদেনমূলক সংস্থা এবং ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলির ওপরে নয়, মহাজনি কারবারে যুক্ত ব্যক্তিদের ওপরেও প্রযোজ্য হবে।

 

  • ঋণ আদায় সংক্রান্ত ট্রাইব্যুনালগুলিকে নির্ধারিত বাহেট সহায়তার দ্বারা কার্যকরী করে সেগুলির মাধ্যমে পারিবারিক আয়ের দ্বিগুণের অধিক সমস্ত ঋণ মকুব করতে হবে।

 

  • ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থা থেকে ঋণগ্রহীতাদের ত্রাণের জন্য একটি পুনর্বাসনের ফান্ড তৈরি করতে হবে যা থেকে যাঁরা আত্মহত্যা করেছেন বা নিঃস্ব হয়ে গেছেন তাঁদের বা তাঁদের পরিবারের জন্য এক্স গ্রাশিয়া অনুদান এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হতে পারে।

 

  • একক নারী ও নারী পরিচালিত পরিবার সমূহ যাতে লেনদেনমূলক সংস্থাগুলি থেকে শতকরা ৪% বা তার কম সুদে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ঋণ পেতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে।

 

  • শিডিউল ভিত্তিক লেনদেনমূলক সংস্থা, বিশেষত সরকারি ক্ষেত্রের ব্যাঙ্কগুলি থেকে সরাসরি বন্ধকিবিহীন ঋণদানের ব্যবস্থা করতে হবে। আধার বা প্যান কার্ড কিংবা ‘জনধন’ প্রকল্পের নথি দেখাতে পারলেই মেয়েদের ঋণ পাওয়া সুনিশ্চিত করতে হবে। শেষোক্তটি থাকলে ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণ নেওয়ার অনুমতি দিতে হবে।

 

  • ব্যাঙ্ক লিঙ্কেজ প্রোগ্রাম মোতাবেক সরাসরি ঋণদান সুনিশ্চিত করে স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীর ফেডারেশন সমূহকে মজবুত করতে হবে। সিডবি-র থেকে সরাসরি অর্থ সাহায্যের ব্যবস্থাকে আরো ছড়াতে হবে। সমবায় ব্যাঙ্ক সহ বিভিন্ন ব্যাঙ্কগুলির মাধ্যমে নাবার্ড যাতে স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীগুলিকে কম সুদে ঋণ পেতে সাহায্য দিতে পারে সেই উদ্দেশ্যে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের উদ্বৃত্ত সম্পদ থেকে ২৫% নাবার্ড-এর কাছে হস্তান্তরিত করতে হবে। বি ইউ এল এ – বিলটি প্রত্যাহার করতে হবে।

 

  • সরকারি ক্ষেত্রের ব্যাঙ্কগুলিকে মজবুত করার জন্য আরো বেশি করে শাখা খুলতে হবে ও পর্যাপ্ত কর্মী নিয়োগ করতে হবে। প্রতিটি সরকারি ক্ষেত্রের ব্যাঙ্কে একটি মহিলা সেল এবং ক্ষুদ্র ঋণ দানের ব্যবস্থা রাখতে হবে।

 

  • জাতীত আইনি সহায়তা অধিকারকে নির্দেশ দিতে হবে যাতে তাদের স্থানীয় আইনি সহায়তা শাখাগুলি লেনদেনমূলক সংস্থা বা ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থা দ্বারা উৎপীড়িত বা লাঞ্ছিত মহিলাদের প্রয়োজনে পাশে দাঁড়াতে পারে। এ ধরনের অভিযোগের সুরাহা করতে বিশেষ লোক আদালত এবং ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টগুলিকে সক্রিয় করে তুলতে হবে।

 

  • অব্যাহত আয় ও স্থিতিশীল কর্মসংস্থাবের স্বার্থে মনরেগা-র বিস্তার ঘটাতে হবে এবং জাতীয় শহরী কর্মসংস্থান মিশনকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে।

 

২) ভারতের রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে দাবিসমূহঃ

 

  • ২০২২ সালের সর্বোচ্চ নির্দেশাবলী প্রত্যাহার করতে হবে এবং ঐ নির্দেশাবলী অনুযায়ী জাতীয় স্তরের ঋণদান সংস্থা এবং ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলিকে ‘স্বনিয়ন্ত্রণমূলক নজরদারি’র যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তা রদ করতে হবে।

 

  • সুদের হারের উর্ধসীমা বেঁধে সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশ জারি করতে হবে।

 

  • জাতীয় স্তরের ঋণদান সংস্থা ও ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলিকে মহাজনি আইনের অধীনে এনে তাদের কাজকর্মকে নিয়ন্ত্রিত করতে হবে।

 

  • এই সমস্ত ঋণদান সংস্থাগুলির ব্যবিসায়িক ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ পাওয়াকে যেন অগ্রাধিকারমূলক বলে গন্য করা না হয়।

 

  • ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণের ক্ষেত্রে ঋণ গ্রহণে যোগ্যতার মাপকাঠি প্রয়োগ বাধ্যতামূলক করা যাবে না।

 

৩) রাজ্য সরকারের কাছে দাবিসমূহঃ

  • ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থা সহ লেনদেনমূলক সকল সংস্থাজে মহাজনি সংস্থা বলে ঘোষণা করতে হবে এবং রাজ্যের সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ করে তাদের সুদের হার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

 

  • বি ইউ এল এ – বিলটির বিরোধিতা করতে হবে এবং রাজ্যে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর ফেডারেশনগুলিকে কেরালার কুটুম্বশ্রী কর্মসূচীর রাস্তায় সরকারি অর্থ বরাদ্দের মাধ্যমে মজবুত করতে হবে।

 

  • যেকোনোও অপরাধমূলক নির্যাতন বা আত্মহত্যায় প্ররোচিত করার জন্য ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থা সহ এ ধরনের সকল লেনদেন মূলক সংস্থার বিরূদ্ধে রাজ্যকে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

 

  • এ ধরনের অপরাধের যাঁরা ভুক্তভোগী বা তাঁদের পরিবারগুলিকে নিখরচায় আইনি সহায়তা দেবার ব্যবস্থা করতে হবে।

 

  • রাজ্য সরকার, বিশেষত তার নারী ও শিশু বিভাগের পক্ষ থেকে মেয়েদের মধ্যে বিস্তৃত ও লাগাতার প্রচারের মাধ্যমে বেসরকারী ঋণদান সংস্থাগুলি থেকে ঋণ গ্রহণ করলে সম্ভাব্য শোষনের বিষয়টি নিয়ে তাঁদের অবহিত করতে হবে।

 

আলোচনায় উঠে আসে বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি করতে না পারলে গ্রামীণ দরিদ্র মহিলাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা বিপন্নই থাকবে। বিকল্প কৃষি, মহিলাদের সমবায় ব্যবস্থা, সহায়তা কেন্দ্র তৈরি ও যৌথ সংগ্রামকেই সমীক্ষা শেষে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা হিসাবে স্থির করা হচ্ছে। সমীক্ষা শেষে যে দাবিপত্র তৈরি করা হয়েছে তা চূড়ান্ত করার পর, প্রতিটি জেলায় ঋণগ্রস্ত মহিলাদের দিয়ে স্বাক্ষর করানো এবং স্বাক্ষর সম্বলিত দাবিপত্র জেলা শাসকের কাছে জমা দেওয়াও আগামী দিনের কর্মসূচী।

 

 

 

Share this
Leave a Comment