তালিবান প্রশাসনের মন্ত্রীর সাংবাদিক সম্মেলনে থাকার অনুমতি না পাওয়া ন্যক্কারজনক, কিন্তু তার থেকেও বোধহয় ন্যক্কারজনক দেশের ভেতরে আগ্রাসী পৌরুষ, পিতৃতন্ত্র, লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য এবং হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদে মহিলা সাংবাদিক, সঞ্চালক সকলেই যেভাবে নিজেদের প্রতিদিন উজ্জীবিত করে চলেছেন তা থেকে চোখ ঘুরিয়ে থাকা।
সুদর্শনা চক্রবর্তী
সম্প্রতি ভারতের মহিলা সাংবাদিকদের সঙ্গে এক বৈষম্যমূলক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে খুব বিস্তারিতভাবে না হলেও, কিছুটা আলোচনা হয়েছিল, তাঁদের সমমর্যাদা ও সমানাধিকার নিয়ে। আপাতত সব তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার মতোই সেই সামান্য কথাবার্তাটুকুও থিতিয়ে গেছে। যদিও এই ঘটনা আদপেই কোনোও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বলে আমার মনে হয়েছে। একজন পেশাদার মহিলা সাংবাদিক হিসাবেই এই ধারণা এবং নিজের ও সহকর্মীদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তা আদপেই ভ্রান্ত বলে মনে হয় না।
অক্টোবর মাসে আফগানিস্তানের তালিবান প্রশাসনের বিদেশমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি ভারত সফরে আসেন। এ দেশে পৌঁছে তিনি দিল্লিতে আফগান দূতাবাসে যে সাংবাদিক সম্মেলন করেন সেখানে ভারতীয় মহিলা সাংবাদিকদের উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ জানানো হয়নি অথবা আরোও স্পষ্টভাবে বললে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়নি। শোনা যাচ্ছে মুত্তাকির সঙ্গে সফররত তালিবান সরকারের অন্যান্য প্রতিনিধিরা তাঁদের সিদ্ধান্তের কথা জানান। ভারত সরকার সেই সিদ্ধান্তই মানতে বাধ্য হন। কারণ আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী অতিথি ও আয়োজক দেশ যৌথ উদ্যোগে এই ধরনের সাংবাদিক সম্মেলনগুলি করে থাকলেও, আয়োজক দেশ এই রকম সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপের জায়গায় খুব একটা থাকেন না। সুতরাং এই বিষয়টি যে নিয়ম বর্হিভূত হয়েছিল তা নয়।
কিন্তু নীতি বর্হিভূত তো বটেই। গণতন্ত্রের, সমানাধিকারের নীতি বর্হিভূত। যে কারণে সাংবিধানিকভাবে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের দেশ ভারতবর্ষে খুব স্বাভাবিকভাবেই মহিলা সাংবাদিকদের সম্মেলন থেকে বাদ দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এবং ফলস্বরূপ তার এক দু’দিনের মধ্যেই মুত্তাকি আরেকটি সাংবাদিক সম্মেলন করতে বাধ্য হন, যেখানে প্রথম সারিতে ছিলেন মহিলা সাংবাদিকেরা। অর্থাৎ মহিলা সাংবাদিকদের সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত থাকার ‘অনুমতি’ দেওয়া হয়।
সমাজ মাধ্যম, বিকল্প গণমাধ্যম, মূল্ধারার গণ মাধ্যমের কয়েকটিতে এবং মূলত সেগুলির ডিজিটাল মাধ্যমে মহিলা সাংবাদিকদের অনুপস্থিতির বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রত্যাশিতভাবেই তথাকথিত ‘গোদী মিডিয়া’ এই তালিকায় ছিল না। কারণ যে চূড়ান্ত পিতৃতান্ত্রিক বৈষম্যমূলক ও দমন-পীড়নমূলক মানসিকতার জায়গা থেকে তালিবান প্রশাসন আফগানিস্তানে স্বৈরাচারী শাসন চালিয়ে নারীদের স্বাধীনতা সর্ব অর্থেই কেড়ে নিয়েছে, সেই মানসিকতারই আরেকটি রূপ, সনাতনের দোহাই দেওয়া ভারতের বর্তমান বিজেপি-শাসিত কেন্দ্র সরকারের মধ্যেও প্রকট। সুতরাং আপাতত ‘জিও-পলিটিক্স’-এর অজুহাতে নিজেদের ‘দায়’ এড়াতে চাওয়া কেন্দ্র সরকার ‘দায়িত্ব’ এড়াতে পারে না।
তালিবান প্রশাসনের ভারত সফরে ভারতের কেন্দ্র সরকারের রাজি হওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত সেই বিতর্ক অন্য লেখার বিষয়। যেমন গাজার গণহত্যায় ভারতের সরকারের পরোক্ষ সমর্থন কিংবা নৃশংসতম গণহত্যা যখন গাজায় সংঘটিত হচ্ছে তখন ইজরায়েল-এর অর্থমন্ত্রীর সেপ্টেম্বর ২০২৫-এ ভারত সফরে ভারতের কেন্দ্র সরকারের রাজি হয়ে যাওয়াও।
যাইহোক, মহিলা সাংবাদিকদের প্রতি তালিবান প্রশাসনের কাছ থেকে এই ব্যবহারে আমি মোটেই অবাক হইনি। এ তাদের স্বভাব বিরূদ্ধ নয়। অস্বাভাবিক নয় তালিবানি মানসিকতার প্রতি ভারতের বিজেপি শাসিত সরকারের প্রচ্ছন্ন সমর্থন। যে পিতৃতান্ত্রিক, পশ্চাদপদ, অমানবিক, স্বৈরাচারী, ধর্মীয় মৌলবাদী ভাবধারায় চলে তালিবান প্রশাসন তার প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে সমগোত্রীয় বিজেপি সরকারেরও। ফলত তাঁরা এই আচরণকে মনে মনে আদপেই খারাপ বলে মনে করেনি বলেই আমার ধারণা।
এই ঘটনা ঘটার পর আসলে আমার মাথায় ঘুরতে থাকে ভারতে মহিলা সাংবাদিকদের গত এক দশকে কী ধরনের পরিবেশ, পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে এবং সেখানে কর্মক্ষেত্রে তাঁদের যে ধরনের বৈষম্য, পিতৃতান্ত্রিক পরিবেশ-পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয় এবং ধীরে ধীরে তাঁদেরও একটা বড় অংশ যেভাবে রাজনৈতিক-সামাজিক পুরুষতন্ত্রের ধারক-বাহক হয়ে ওঠেন। মূলত মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যমে মহিলা সাংবাদিকদের কথাই এক্ষেত্রে বলতে চাইছি। যাঁদের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি নিয়ে এই বিতর্ক দানা বাঁধে।
এই ভাবনাটিকে লেখায় রূপ দিতে গিয়ে আমার মূল উপজীব্য হয়ে ওঠে ২০২১ সালে গবেষক সাংবাদিক হিসাবে একটি গবেষণায় অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা। ‘নেটওয়ার্ক অফ উইমেন ইন মিডিয়া, ইন্ডিয়া’ নামক স্বাধীন মহিলা সাংবাদিকদের একটি স্বাধীন জাতীয় স্তরের সংগঠনের উদ্যোগে গণমাধ্যমের উপর পর্যবেক্ষণের একটি গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি হয়। যার বিষয় ছিল – “এম থ্রিঃ ম্যান, মেল, ম্যাসকিউলিন – স্টেজিং ম্যাসকিউলিন অ্যাগ্রেসন”। এই গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল কীভাবে ধীরে ধীরে ভারতের গণমাধ্যমে পৌরুষের বহিঃপ্রকাশ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। কীভাবে পৌরুষ বা বলা যেতে পারে পৌরুষের আগ্রাসন প্রভাব ফেলছে বিজ্ঞাপন থেকে সংবাদ সব কিছুর উপরেই তা নিয়ে বিশদে চর্চা হয়েছিল এই গবেষণায়।
এক্ষেত্রে মূল বিষয় ছিল ভারতের বিভিন্ন ভাষার টেলিভিশন সংবাদ। টেলিভিশন সংবাদ পরিবেশনায় কীভাবে আগ্রাসী পৌরুষ সংবাদ পরিবেশক থেকে সাংবাদিক সবার মধ্যেই ছড়িয়ে দেওয়া হয় তা আজ আমাদের সামনে স্পষ্ট। আর এইসবের মধ্যে যা অনেক ক্ষেত্রেই আলোচনার বাইরে রয়ে যায়, তা হল কীভাবে একজন মহিলা সাংবাদিক, সংবাদ উপস্থাপিকা ধীরে ধীরে সুনির্দিষ্টভাবে ঠিক এই আগ্রাসনেরই প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন।
এই বিশ্লেষণমূলক গবেষণাটির জন্য পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল ১২টি ভারতীয় ভাষায় ৩১টি টেলিভিশন চ্যানেলে ১৮৫টি সংবাদ ও টক শো। এর আওতায় আনা হয়েছিল নির্দিষ্ট ঘটনা বা প্রতিবেদনের কেস স্টাডি ও সামাজিক মাধ্যমে যে ধরনের সংলাপ তৈরি হয় (মিম, পোস্ট, রিলস ইত্যাদি) তার বিশ্লেষণ।
এ কথা সত্যি এক অংশের দর্শক যেমন এই মানসিকতার পেছনে কাজ করতে থাকা নারী বিদ্বেষমূলক হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডা, রাজনৈতিকভাবে আগ্রাসী মানসিকতার প্রচার-প্রসারকে নিয়মিত সমালোচনা করে চলেছেন, তৈরি হয়েছে বিকল্প সংবাদমাধ্যম, তেমনি ক্রমাগত এই ধরনের মিডিয়া পুঁজিপতিদের টাকায় ফুলে-ফেঁপে উঠে নিজেদের অ্যাজেন্ডাকে মতামত তৈরিতে প্রভাব ফেলতে পারে জনসংখ্যার এমন অংশের উপর প্রভাব বিস্তার করছে।
যে মূল বিষয়গুলি এই গবেষণায় উঠে এসেছিল তার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য এইটা বোঝার জন্য যে ভারতের বিভিন্ন ভাষার মূলস্রোতের সংবাদ মাধ্যমে কীভাবে পিতৃতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা ও আগ্রাসনকে স্বাভাবিক করে তোলা হয়েছে ধীরে ধীরে এবং প্রতিদিন সকাল থেকে রাত দর্শকেরাও সংবাদ, আলোচনা ইত্যাদির নামে তাকেই গ্রহণ করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। গত এক দশকে ‘গোদী মিডিয়া’র বাড়-বাড়ন্তে এই ট্রেন্ড-ই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
- সংবাদ পরিবেশনে তেমনভাবে না হলেও আলোচনা বা বিতর্ক, প্যানেল, টক শো – ইত্যাদিতে আগ্রাসী পৌরুষের প্রকাশ লিঙ্গ পরিচিতি নির্বিশেষে উপস্থাপক, সঞ্চালকের মধ্যে বেশি থাকে
- প্রায় অর্ধেকের বেশি নিউজ শো-তে আগ্রাসন থাকলেও টক শো-এ এই আগ্রাসনের মাত্রা প্রায় ৮৫%
- বেশির ভাগ টক শো-এর যে কাঠামো সেখানে একাধিক অতিথি বা বক্তা থাকেন, ফলে যেন খুব সহজাতভাবেই সঞ্চালকের আচরণ, শো-এর নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখতে পুরুষালী হয়ে ওঠে
- সংবাদ ও টক শো – দু ক্ষেত্রেই আবহ, গ্রাফিক্স ইত্যাদি দিয়ে পরিবেশটিকেই আগ্রাসী করে তোলা হয়
- কন্ঠস্বরের ব্যবহারকেই সবচেয়ে বেশি আগ্রাসন প্রকাশের মাধ্যম হিসাবে দেখা গেছে, যা প্রায় ৭৬.৭৬%। (এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার রীতিমতো প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রতিটি সংবাদমাধ্যমে উপস্থাপক, সঞ্চালকদের এই নির্দিষ্ট ধরনের স্বর প্রক্ষেপণ, উচ্চারণ ইত্যাদি শেখানো হয় এবং তা মেনে চলা চাকরি ধরে রাখার জন্য বাধ্যতামূলক।)
- উপস্থাপনার সময়ে কথা বলার ধরনে এই আগ্রাসন পুরুষদের ক্ষেত্রে যেখানে ৭৮.১৩%, সেখানে মহিলাদের ক্ষেত্রে তা ৭৫.২৮%
- লিঙ্গ-সাম্যের ক্ষেত্রে ইতিবাচক মানসিকতা দেখা গেছে মাত্র ২৩.৩৮% শো-তে। সেখানেও যেসব ক্ষেত্রে মহিলা উপস্থাপক তাঁরা ৪১.৫৭% ক্ষেত্রে ইতিবাচক মানসিকতা দেখিয়েছেন, যা পুরুষদের ক্ষেত্রে মাত্রই ৩৫.৪২%
- ‘ম্যানেল’ শব্দটির সঙ্গে আমরা এখন কম-বেশি সকলেই পরিচিত। অর্থাৎ যেসব প্যানেলে মহিলা বা অপর লিঙ্গ পরিচিতির কারোর উপস্থিতি থাকে না। টেলিভিশনেও দেখা গেছে এই ধরনের আলোচনায় মহিলা অতিথি বা বক্তার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কম। এমনকি লিঙ্গ পরিচিতিভিত্তিক কোনোও আলোচনার ক্ষেত্রেও
এই ধারা অনুসরণ করেই আমরা অঞ্জনা ওম কাশ্যপ, নবিকা কাপুরদের মতো উপস্থাপকদের উত্থান দেখতে পাচ্ছি। বাংলা মূলস্রোতের টেলিভিশন সংবাদ মাধ্যমেও এহেন উপস্থাপকদের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েছে। একটি বিষয় মাথায় রাখা প্রয়োজন সঞ্চালক, উপস্থাপক ও সাংবাদিকদের মধ্যে যে বিভাজন তা ক্রমশ মিটিয়ে দেওয়া হচ্ছে। রভিশ কুমার বা প্রণয় রায়ের মতো একাধারে সাংবাদিক ও উপস্থাপক হওয়ার মতো চর্চা, শিক্ষা ও প্যাশন – এঁদের কারোরই নেই।
অন্যদিকে মূলস্রোতের সংবাদ মাধ্যমের নিউজ রুম ও সংস্থায় যে ধরনের নারীবিদ্বেষী ও বৈষম্যমূলক আচরণ চলতে থাকে, তা কখনোই বন্ধ দরজার বাইরে আসে না। অথচ যৌন হেনস্থা, পেশাদার জায়গায় দক্ষতা ও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও মহিলা বলে প্রাপ্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ঘটনা শুধু বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে জানা তাই নয়, ২০২০ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন প্রিন্ট ও অডিও-ভিশ্যুয়াল সংবাদ মাধ্যমের মহিলা সাংবাদিক, চিত্র সাংবাদিকদের উপর করা অপর একটি সমীক্ষার সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে আরোও গভীরে গিয়ে জানা-বোঝার পরিসর তৈরি করে।
সুতরাং যাঁরা অবাক হচ্ছেন, কেন প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে পুরুষ সাংবাদিকেরা উপস্থিত হলেন, কেন প্রতিবাদ করলেন না, তাঁরা ভুল ভাবছেন। এই সহকর্মীদেরই অনেকে নিজের মহিলা সহকর্মী যাতে যোগ্য সুযোগ না পান, বাই-লাইন কম পান, গুরুত্বপূর্ণ অ্যাসাইনমেন্ট না পান – সেরকম মানসিকতা লালন-পালন করেন। অফিসে প্রকাশ্যে বা পরোক্ষে যৌন হেনস্থার খবর শুনলেও চাকরি বাঁচাতে চুপ করে থাকেন। অথবা তাঁদেরই একাংশ নিউজ রুম-এ প্রাথমিক ভাবে প্রবল কাজের চাপ কাটানোর জন্য অস্বস্তিজনক ‘স্ল্যাং’ ব্যবহার করা, নিউজ-এর তথাকথিত ‘অ্যাড্রিনালিন রাশ’ বজায় রাখার জন্য মহিলা সহকর্মীর অসুবিধা হচ্ছে কি না তার খেয়াল না করে কু-শব্দ ব্যবহার থেকে বিরত হতে পারেন না – শুধুমাত্র পুরুষ হওয়ার কারণে।
অন্যদিকে নেট ওয়ার্ক অফ উইমেন ইন মিডিয়া, ইন্ডিয়া-র একজন সদস্য হওয়ার সুবাদে জানি, ভারতের প্রতিটি প্রান্তের বিভিন্ন রাজ্যের মহিলা সাংবাদিক, স্বাধীন, মিডিয়া সংগঠনে কর্মরত – তাঁদের বিভিন্ন সময়ে কত রকম অসুবিধা, সমস্যা, হেনস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। সেখানে নারী পরিচিতি, ধর্মীয় পরিচিতি, জাত-পাত, সমানাধিকারের প্রশ্ন, যেকোনোও ধর্মীয় মৌলবাদের বিরূদ্ধে প্রশ্ন তোলা, রাষ্ট্রীয় শোষনের বিরূদ্ধে প্রশ্ন তোলা, এমনকি বিভিন্ন মিডিয়া সংগঠনের যে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও দুর্নীতি থাকে তার বিরূদ্ধে প্রশ্ন তুললেও কিভাবে তাঁদের ব্যক্তিগত ও পেশাদার জীবন সমস্যাজনক করে দেওয়া হয়। সেইগুলি খুব কমই আলোচনার পরিসরে আসে। তালিবান প্রশাসনের মন্ত্রীর সাংবাদিক সম্মেলনে থাকার অনুমতি না পাওয়া ন্যক্কারজনক, কিন্তু তার থেকেও বোধহয় ন্যক্কারজনক দেশের ভেতরে আগ্রাসী পৌরুষ, পিতৃতন্ত্র, লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য এবং হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদে মহিলা সাংবাদিক, সঞ্চালক সকলেই যেভাবে নিজেদের প্রতিদিন উজ্জীবিত করে চলেছেন তা থেকে চোখ ঘুরিয়ে থাকা। গোদী মিডিয়ার কোনোও মহিলা সাংবাদিক, উপস্থাপক এ বিষয়ে মুখ খোলেননি। অথচ বর্ষীয়ান সাংবাদিক আম্মু যোসেফ নিউজলন্ড্রি-তে নিজের মতামত ও পর্যবেক্ষণ লিখেছেন, যা ব্যপকভাবে প্রচার হওয়া প্রয়োজন।
দ্বিতীয় সাংবাদিক সম্মেলন করে মহিলা সাংবাদিকদের প্রথম সারিতে বসতে দেওয়ার আয়োজনটি ব্যক্তিগতভাবে আরোও বেশি বৈষম্যমূলক মনে হয়েছে। সেখানে কারা গেলেন, কী প্রশ্ন করলেন তা যেমন দেখা প্রয়োজন, তেমনি বোঝা দরকার এই মন্ত্রীদের খুব শক্ত প্রশ্ন করেও বিশেষ লাভ নেই, যেহেতু তারা নিজেদের ধর্মীয় মৌলবাদ দ্বারা চালিত ও তার বাইরে কোনোও প্রশ্নের উত্তর দিতেই চান না। তাছাড়া এই যে ভারতে তাঁরা প্রবেশের অধিকার পেলেন, সরকারি অভ্যর্থনা পেলেন – এতে যে ভারতের বর্তমান কেন্দ্র সরকারের মানসিকতা প্রকাশ পেল – সে নিয়ে কে প্রশ্ন তুলবে? না কি এই বৃহত্তর প্রশ্ন তোলা যাবে না?
নারীবাদের প্রশ্নে ‘সিলেক্টিভ’ হয়ে যাওয়া, কারা মূলস্রোতের সাংবাদিকতার অংশ আর কারা নন, কারা রাষ্ট্রের পক্ষে কারা নন, কারা হিন্দুত্ববাদী ও মৌলবাদী চিন্তাধারার পক্ষে ও কারা নন তা ভাবতে গেলে এই ধরনের ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটবে।
শেষ করব যে গবেষণাটির কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম তাই দিয়ে। সেখানে দেখা গেছে, ২০২১ সালের ১৫ অগাস্ট তালিবানরা আফগানিস্তান পুনর্দখল করার পরে ভারতের গণমাধ্যমে যে সকল প্রতিবেদন সম্প্রচারিত হয়েছিল তা ছিল অসম্ভব আগ্রাসী। সামগ্রিকভাবে প্রতিবেদনগুলিতে লিঙ্গবৈষম্য দেখা না গেলেও এই সংক্রান্ত বিতর্কের শো-গুলিতে প্যানেল-এ মহিলাদের অনুপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। শুধুমাত্র ইন্ডিয়া টু ডে তাদের একটি টক শো-তে আফগান ছাত্রীদের সম্মানসূচক জিজ্ঞেস করেছিলেন সেই পরিস্থিতিতে তাঁদের ভয় ও ভাবনার কথা। তবে সামগ্রিকভাবে তালিবানদের দ্বারা পুনর্দখলের পর আফগানিস্তানে মহিলাদের অবস্থা কী হতে চলেছে তা নিয়ে কোনোও গভীর আলোচনা বা প্রতিবেদনই সামনে আসেনি।
সুতরাং সাংবাদিক হিসাবে এহেন সংবেদনশীলতার অভাব যতদিন থাকবে, ততদিন এভাবেই লিঙ্গবৈষম্য দেখতে হবে এবং কোনোও এক অদৃশ্য ‘অনুমতি’ সাপেক্ষে নিজেদের জয় হচ্ছে ভেবে নিতে হবে।
________________
সুদর্শনা চক্রবর্তী একজন স্বাধীন সাংবাদিক এবং গ্রাউন্ডক্সেরো সম্পাদকীয় দলের সদস্য।

