‘হাম দেখেঙ্গে’ গাওয়া ‘রাষ্ট্র দ্রোহিতা’!


  • May 21, 2025
  • (1 Comments)
  • 3208 Views

পাকিস্তান-বিরোধী হবার অপরাধে যে কবিকে তাঁর জীবনের দীর্ঘ সময় নির্বাসনে কাটাতে হয়েছিল, মুক্তি যুদ্ধের সময় যিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে, তাঁকেই আবার কাঠগড়ায় তোলা হয় ভারত-বিরোধী বলে! তাঁর কবিতা ‘হাম দেখেঙ্গে’ গাওয়ার অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের করেছে মহারাষ্ট্র পুলিশ। 

 

রিপোর্ট: ঊর্মিমালা

 

মহারাষ্ট্রের নাগপুরে গত ১৩ মে ভিরা সাথিদারের স্মরণসভায় ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ-এর বিখ্যাত কবিতা ‘হাম দেখেঙ্গে’ গাওয়ার অভিযোগে সমাজকর্মী পুষ্পা ভিরা সাথিদার সহ তিন জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের করেছে মহারাষ্ট্র পুলিশ।

 

বার্ষিক এই স্মরণসভা অনুষ্ঠানটি ‘বীর সাথিদার স্মৃতি সমন্বয় সমিতি’ দ্বারা আয়োজিত হয়েছিল। এই বছর, সমাজকর্মী উত্তম জায়গীরদারকে বক্তব্য রাখার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়ে। জায়গীরদার বিতর্কিত ‘মহারাষ্ট্র বিশেষ জননিরাপত্তা বিল, ২০২৪’ বিষয়ে আলোচনা করেন। সামাজিক কর্মী এবং গণআন্দোলনের সংগঠকরা মনে করেন যে এই বিলটি যদি পাশ করা হয়, তাহলে মানবাধিকারের স্পষ্ট লঙ্ঘন ঘটবে এবং ভিন্নমত পোষণকারীদের “শহুরে নকশাল” হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। এই অনুষ্ঠানে ফয়েজ-এর কবিতাটি পরিবেশন করেন সমতা কলা মঞ্চের তরুণ সাংস্কৃতিক কর্মীরা।

 

নাগপুরের স্থানীয় বাসিন্দা দত্তাত্রেয় শিরকে নামক এক ব্যক্তির দায়ের করা এফ আই আর-এ অভিযোগ করা হয়েছে, “দেশ যখন বীরত্বের সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে, সেসময় নাগপুরের উগ্র বামপন্থীরা পাকিস্তানি কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ-এর কবিতা গাইতে ব্যস্ত।“FIR –এ শিরকে আরও দাবি করেছেন যে, কবিতাটিতে বলা হয়েছে ‘তখত হিলানে কি জরুরাত হ্যায়” অর্থাৎ সরকার পরিবর্তন করার প্রয়োজন। যদিও কবিতার আসল লাইনটি হল, “স্‌ব তাজ উছালে জায়েঙ্গে / সব তখত গিরায়ে জায়েঙ্গে….”।

 

অনেকেরই মনে থাকতে পারে যে, গত ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ইন্ডিয়ানইন স্টিটিউট অফ টেকনোলজি (IIT) কানপুর ক্যাম্পাসে ছাত্রদের মিছিলে “হম দেখেঙ্গে’-র ঠিক এই পঙতিটি গাওয়াকে ঘিরেই শুরু হয়েছিল বিতর্ক।

 

চিন্তাবিদ ভিরাসাথিদার ছিলেন বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের এক জন সক্রিয় কর্মী, অভিনেতা, লেখক এবং সাংবাদিক। অক্টোবর ২০২০, NIA-র এলগার পরিষদ মামলার সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিটে তথাকথিত “শহুরে নকশাল”-দের লিস্টে ছিল ভিরা সাথিদারের নামও। ২০২১ সালে ১৩ এপ্রিল, কোভিডে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। কিন্তু মৃত অবস্থাতেও “শহুরে নকশাল”-রা বুঝি সমান বিপদজনক থেকে যায়, তাই গোসেবকরা তাঁর স্মরণ সভাতেও সিঁদুরে মেঘ দেখে ডরায়।

 

অনুষ্ঠানের আয়োজক ভিরা সাথিদারের স্ত্রী পুষ্পা সাথিদার এবং বক্তা সহ তিনজনের বিরুদ্ধে ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ১৫২ (ভারতের সার্বভৌমত্ব, ঐক্য এবং অখণ্ডতাকে বিপন্নকারী অপরাধ) ধারার, যা ভারতীয় দণ্ডবিধিতে ‘রাষ্ট্র দ্রোহিতা-র সমতুল্য, ধারা ১৯৬ (বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে শত্রুতা প্রচার), ধারা ৩৫৩ (মিথ্যা বিবৃতি এবং গুজব প্রচার) এবং ধারা ৩ (৫) অধীনে মামলা করা হয়েছে।

 

কিছু দিন আগেই আমরা দেখেছি পহেলগাঁতে সন্ত্রাসবাদী হামলায় সরকারি সুরক্ষা মন্ত্রকের ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অপরাধে, দেখেছি লোক সঙ্গীত শিল্পী নেহা রাঠোর এবং পলিটিকাল কনটেন্ট ক্রিয়েটর মিসমেডুসার বিরুদ্ধে FIR দায়ের হতে। অথচ পহেলগাঁ হামলায় শহীদের স্ত্রীর চরিত্র নিয়ে নির্ভয়ে কুৎসিত হামলা করা যায়, কর্ণেল সোফিয়া কুরেশিকে নিশ্চিন্তে দেগে দেওয়া যায় ‘সন্ত্রাসবাদীদের বোন’ বলে।

 

সাথিদার জীবিত থাকাকালীন সরকার তাকে অপরাধী সাব্যস্ত করার জন্য বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছিল, মৃত্যুর পরেও তাঁর রেহাই নেই। যেমন রেহাই নেই কবি ফয়েজ-এরও। ‘হম দেখেঙ্গে’ কবিতাটি ফয়েজ লিখেছিলেন পাকিস্তানের তৎকালীন স্বৈরাচারী শাসক জিয়া-উল-হকের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে। ১৯৭৯ সালে পাকিস্তান থেকে নির্বাসিত অবস্থায়। “হম দেখেঙ্গে”-তেই একটি লাইন রয়েছে “গুঞ্জে গা আন-আল-হক কা নাড়া”, কবি জাভেদ আখতারের মতে, এই “আন-আল-হক”-র অর্থ ‘অহম ব্রহ্ম’, আমিই ব্রহ্ম, যার উৎপত্তি বেদান্তের দর্শন থেকে। কিন্তু যেহেতু ঘৃণার জিগির তুলতে বেশি তলিয়ে ভাবার প্রয়োজন পড়েনা এবং এজন্য প্রশাসনিক মদত পেতেও কাঠখড় পোড়াতে লাগেনা। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের এটাই চিরকালের দস্তুর। যুগেযুগে দেশে দেশে এমনটাই হয়ে এসেছে। উগ্র জাতীয়তাবাদকে হাতিয়ার করে, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্য রক্ষার অজুহাত সম্বল করে প্রশাসনকে ব্যবহার করে নেমে আসে জাতীয় সন্ত্রাস।

 

আর সে জন্যই পাকিস্তান-বিরোধী হবার অপরাধে যে কবিকে তাঁর জীবনের দীর্ঘ সময় নির্বাসনে কাটাতে হয়েছিল, মুক্তি যুদ্ধের সময় যিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে, তাঁকেই আবার কাঠগড়ায় তোলা হয় ভারত-বিরোধী বলে!

 

আজও “শেষ হয়নি তাঁর নিরবচ্ছিন্ন মৃত্যুর মুহূর্ত, / নূতন শূল তৈরি হচ্ছে বিজ্ঞান শালায়”…বিঁধে যাচ্ছে তাঁর গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে”… … দেশভাগ ঘোষণার কয়েক দিন বাদে ফয়েজ লিখেছিলেন একটি যন্ত্রণাকীর্ণ রক্তাক্ত কবিতা ‘সুবহ্-এ-আজাদী:

 

“ইয়ে দাগ দাগ উজালা, ইয়ে শাব গাজিদা সেহার / ওহ ইন্তেজার থা জিসকা, ইয়ে ওহ সেহের তো নেহি” …অভি চরাগ -এ-সর-এ-রাহ কো কুছ খবর হি নেহি ……..”চলে চলো কি মনজিল অভি নেহি আয়ি ……চলে চলো কি মনজিল অভি নেহি আয়ি।”

 

(এ কোন সকাল? বিবর্ণ রাতের চেয়েও অন্ধকার! / যার জন্য প্রতীক্ষায় ছিলাম এতো সেই ভোর নয় … … মুক্তির দিশা এখনো বেখবর … …ওপরে চেপে বসা বোঝাটার ভার এখনো হালকা হয়ে যায়নি……হাঁটা থামিয়ো না, পা চালাও, এখনো গন্তব্যে এসে পৌঁছোইনি)

 

Share this
Recent Comments
1
Leave a Comment