নবম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা মিড ডে মিল পাওয়ার হকদার নয়। একই স্কুলের মধ্যে দুপুরের খাওয়ার ক্ষেত্রে এই ভেদ শুধু বৈষম্যমূলক ও অস্বস্তিকর নয়, শিক্ষার মান উন্নয়নের ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধক। লিখলেন সুমন কল্যাণ মৌলিক।
জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ, স্কুলে নতুন শিক্ষাবর্ষের শুরুর সময়। নতুন বই, খাতা, ইউনিফ; চারিদিকে একটা উৎসবের পরিবেশ। টিফিনের ঘন্টা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রাণ চঞ্চল ছাত্রদের মিড ডে মিল খাওয়ার জন্য ছুট। চেনা ছবি, চেনা কলরোল। নজর পড়ল লক্ষীকান্তের (নাম পরিবর্তিত) দিকে। অন্য দিনের মত দৌঁড় শুরু করল কিন্তু দু পা গিয়েই থেমে গেল দৌড়। চোখাচোখি হতেই লাজুক হাসিতে বলল, স্যার, আমি তো এখন নাইন ক্লাস, আমি তো আর খাওয়া পাবো নাই। মনে পড়ে গেল ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহেও লক্ষীকান্ত মিড ডে মিল খেলেও, আজ থেকে ও ব্রাত্য। লক্ষীকান্তের ধীর পদক্ষেপে শ্রেণি কক্ষে ফিরে যাওয়া দেখতে দেখতে কিছু জরুরি প্রশ্ন মাথায় ভিড় করতে লাগল। দেশে সরকারি শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত সমস্ত পক্ষ জানে যে নবম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা মিড ডে মিল পাওয়ার হকদার নয়। একই স্কুলের মধ্যে দুপুরের খাওয়ার ক্ষেত্রে এই ভেদ শুধু বৈষম্যমূলক ও অস্বস্তিকর নয়, শিক্ষার মান উন্নয়নের ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধক।
ভারতে পড়ুয়াদের জন্য মিড ডে মিলের ইতিহাস সুপ্রাচীন। ১৯২০ সালে চেন্নাই কর্পোরেশন কাউন্সিলের প্রধান ও জাস্টিস পার্টির নেতা পি.ত্যাগরাজ চেট্টি একটি অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল এলাকার প্রাথমিক স্কুলে ছাত্র সংখ্যা বাড়ানোর জন্য মিড ডে মিলের ব্যবস্থা করেন, বরাদ্দ হয় পড়ুয়া পিছু এক আনা। পরবর্তীতে আরো পাঁচটা স্কুলকে এই পাইলট প্রজেক্টের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দেখা যায় ১৯২২-২৩ সালে স্কুলগুলোর শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল ৮১১ যা ১৯২৪-২৫ সালে বেড়ে হয় ১,৬৭১। অবশ্য ব্রিটিশ সরকারের অসহযোগিতার কারণে এই প্রকল্প মাঝপথে পরিত্যক্ত হয়। স্বাধীন ভারতে ১৯৫৬ সালে তামিলনাড়ুর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কে কামরাজ সে রাজ্যে সমস্ত প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য মিড ডে মিল বাধ্যতামূলক করেন। আশির দশকে প্রাথমিক স্তরে কেরালা, গুজরাট, তামিলনাড়ু ও পন্ডিচেরিতে এই প্রকল্পের গতি বৃদ্ধি পায়। নব্বই-এর দশকে আরো বারোটি রাজ্য এই প্রকল্প গ্রহণ করে। ১৯৯৫ সালে এটি কেন্দ্রীয় প্রকল্প হিসাবে স্বীকৃতি পায়। পিপলস ইউনিয়ন অব সিভিল লিবার্টিজের করা মামলায় দেশের সর্বোচ্চ আদালত খাদ্যের অধিকারকে ভারতের সংবিধানের আর্টিকেল ২১ এ উল্লেখিত জীবনের অধিকারের সঙ্গে যুক্ত করে। এই মুহূর্তে ১২ কোটি বাচ্চা নিয়ে এটাই পৃথিবীর বৃহত্তম দ্বি প্রহরের খাওয়ার প্রোগাম।
মিড ডে প্রকল্প তিনটি লক্ষ্য স্থির করেছিল প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে। প্রথমটি হল পুষ্টির ব্যবস্থা, দ্বিতীয়টি হল বেশি সংখ্যক শিশুকে শিক্ষার আঙিনায় টেনে আনা এবং স্কুল ছুটের হার কমানো এবং তৃতীয়টি হল খাদ্য সুরক্ষা প্রদান। নানান চড়াই উতরাইয়ের মধ্যে দিয়ে এই প্রকল্প চলেছে। প্রথম দিকে আর্থিক ভাবে সবল অভিভাবকরা মিড ডে মিলের ফলে পড়াশোনার গঙ্গাপ্রাপ্তি হবে বলে গেল গেল রব তুলেছেন, অনেকে আবার জাত ব্যবস্থার দোহাই দিয়ে প্রকল্পটিকে বিপথগামী করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এইসব প্রতিকূলতাকে অগ্রাহ্য করে মিড ডে মিল শিশুদের জন্য একটি সফল প্রকল্প বলে পরিগণিত হয়েছে। ২০২৪ সালের হিসাব অনুযায়ী ৬-১৪ বছরের শিশুদের মধ্যে স্কুলে ভর্তি হওয়ার হার ৯৮.১ শতাংশ। এক্ষেত্রে পড়াশোনার বিষয়ে অভিভাবকদের আগ্রহ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্কুলে খাবারের নিশ্চয়তা একটা বড়ো কারণ। কিন্তু উল্টোদিকের ছবিটা আবার আশঙ্কার। নবম-দশম শ্রেণিতে স্কুল ছুটের হার ১২.৬ শতাংশ। এক্ষেত্রে মিড ডে মিলের ব্যবস্থা না থাকা একমাত্র কারণ না হলেও, একটা কারণ অবশ্যই। পুষ্টিহীনতা স্বাধীনতার এত বছর পরেও এ দেশের এক জ্বলন্ত সমস্যা। ২০২৩ সালে বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১২৫ টি দেশের মধ্যে আমাদের স্থান ১১১। এ লজ্জার ইতিহাস মুছতে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মিড ডে মিল প্রকল্পের আওতায় আনা একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে।
শুধুমাত্র সমস্ত স্কুল শিক্ষার্থীদের মিড ডে মিল প্রকল্পের আওতায় আনা নয়, একই সঙ্গে আজ প্রয়োজন এই প্রকল্পের খোল-নলচে বদলানো। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হল অর্থের। কেন্দ্রীয় সরকারের সাম্প্রতিক সার্কুলার অনুযায়ী ১ লা মে (২০২৫) থেকে শিশু শ্রেণি ও প্রাথমিকে একটি মিল পিছু বরাদ্দ হবে ৬ টাকা ৭৮ পয়সা এবং উচ্চ প্রাথমিকের ক্ষেত্রে ১০ টাকা ১৭ পয়সা। এই চরম মাগ্গিগন্ডার বাজারে যে কোন মাপকাঠিতে অপ্রতুল। সরকারকে অবশ্যই এক্ষেত্রে বাজেট বাড়াতে হবে। যে দেশে আইন প্রণেতাদের ব্যাপক মাইনে বৃদ্ধি কোন আলোচনা ছাড়াই সংসদে পাশ হয়ে যায়, যেখানে কর্পোরেট কর ছাড়ের পরিমান বছরে একটা ছোট রাজ্যের বাজেটের সমান, সেখানে জাতির ভবিষ্যৎদের জন্য টাকার অভাব, কোন মতেই মানা যায় না। প্রয়োজনে সরকারকে সেস বসিয়ে মিড ডে মিলের বরাত বৃদ্ধি করতে হবে। একই সঙ্গে খাদ্যতালিকা হতে হবে সুষম, বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং পুষ্টিকর। জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন (২০১৩) অনুসারে প্রাথমিকে ৪৫০ গ্রাম ক্যালোরি এবং উচ্চ প্রাথমিকে ৭০০ গ্রাম ক্যালোরি দেওয়ার কথা। প্রোটিন যথাক্রমে ২০ গ্রাম এবং ৪০ গ্রাম। এটারও পরিবর্তন দরকার। ‘সানডে ইয়া মানডে/ রোজ খাও আন্ডে’ – এই বহু বিজ্ঞাপিত সরকারি শ্লোগান আজ স্কুলে কার্যকরী করার সময় এসেছে। একথা সবার জানা যে জ্বালানীর খরচ বৃদ্ধি একটা বড় সমস্যা। এই সমস্যার সমাধানের দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে।
আজ দেশে যে মিড ডে মিল প্রকল্প চলছে তার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে সেল্ফ-হেল্প গ্রুপের দিদিদের। এই কাজের জন্য যে পারিশ্রমিক তারা পান তা হাস্যকর। আজ সরকারকে এই মানুষগুলোর জন্য বাজার দর অনুযায়ী পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা করতে হবে। আজ শুধু পুষ্টি মূল্য ও স্কুলে ভর্তি হওয়ার মধ্যে মিড ডে মিলের গুরুত্ব সীমাবদ্ধ নেই। সারা দেশের রাজনীতি যখন সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্পে আক্রান্ত তখন মিড ডে মিল প্রকল্পে একসাথে খাওয়া, একে অপরকে চেনা, শৈশব থেকে একে অপরের সুখ দুঃখে সাথী হওয়ার বোধকে কিছুটা হলেও জাগায়। এই বিপন্ন সময়ে সেটাও কম প্রাপ্তি নয়!



খুব ভালো লেখা।