হিমালয়-লাগোয়া উত্তরবঙ্গে জমি লুটের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য প্রতিরোধ আন্দোলনের অভিমুখে


  • March 23, 2025
  • (0 Comments)
  • 211 Views

ভারত সরকারের নীতি পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এ রাজ্যের অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ সরকারও ক্রমাগত নিজেদের বাগিচানীতি ও ভূমিনীতি বদলাচ্ছেন। ‘সামাজিক পরিকাঠামো ও পরিষেবা’র নামে জমি নিয়ে ফাটকাবাজি ও রিয়েল এস্টেটের প্রোমোটারি ব্যবসাকে আইনি বৈধতা প্রদান করা হচ্ছে।

 

সৌমিত্র ঘোষ

March 22, 2025

 

হিমালয়-লাগোয়া উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতে গত বিশ-পঁচিশ বছর ধরে অবাধ জমিলুঠ বা জমিদখল (ল্যান্ড গ্র্যাব) চলছে। এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভূমি ব্যবহারকে চূড়ান্তভাবে বিপর্যস্ত করে, এলাকার আদি বাসিন্দাদের নিরাশ্রয় নির্ঘর জীবিকাচ্যুত করে, লুন্ঠন-শোষণ-মুনাফাবাজির যে ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া ঔপনিবেশিক সায়েব-সময়ে শুরু হয়েছিলো, এক অর্থে তার-ই যেন পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।

 

সায়েব-সময়ে বন ঘাসবন নদী পাহাড় চাষজমি দখল করে বিস্তীর্ণ এলাকায় চা-বাগিচা, সিনকোনা বাগিচা এবং তৈরি করা বন (প্ল্যান্টেশন) বানানো হয়েছিলো, নিতান্তই পুঁজিবৃদ্ধির প্রয়োজনে, এক শ্রেণীর মানুষের মুনাফাবৃদ্ধির জন্য। বাগিচার বাইরের প্রায় সমস্ত চাষজমি বন্দোবস্ত করে দেওয়া হয়েছিলো বড় বড় জোতদারদের মধ্যে।

 

এই জমিদখল চলাকালীন যে আদিবাসী-মূলবাসী মানুষেরা উচ্ছেদ হয়েছিলেন, বাইরে থেকে যে শ্রমিকদের প্রায়শই জবরদস্তি করে ধরে নিয়ে আসা হয়েছিলো, তাঁদের অধিকার, মর্যাদা, জীবিকা এবং সর্বোপরি সার্বভৌমত্বের কথা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র ও তার সায়েব-প্রশাসকেরা ভাবে নি। উল্টে, গোটা এলাকায় বাগিচা-মালিক ও বড় ভূস্বামীদের যে রাজত্ব তৈরি হয়েছিলো, রাষ্ট্র সেখানে বড় একটা মাথা গলাতো না। ভারতবর্ষ রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করার পরের বেশ কিছু বছর ধরে, মূলত সায়েব-সময়ের শেষদিকে শুরু হওয়া দীর্ঘস্থায়ী শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনের প্রত্যক্ষ অভিঘাতে এই অবস্থা ধীরে ধীরে বদলায়। জমিদখলের প্রক্রিয়ায় সরকারি নিয়ন্ত্রণ জারি করার চেষ্টা হয়, বাগিচাশ্রমিক এবং কৃষকদের স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যেও একাধিক নতুন আইন তৈরি হয়। চা-বাগিচা মালিকদের রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার জন্য ১৯৫৩ সালে ভারতীয় চা আইন (টি য়্যাক্ট) চালু হয়, চা চাষ, উৎপাদন ও বিক্রির গোটা ব্যবস্থায় সরকারি লাগাম পড়ে। চা-বাগিচা শ্রমিকদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার্থে ১৯৫৫-য় প্ল্যান্টেশন লেবার য়্যাক্ট বা বাগিচাশ্রমিক আইন চালু হয়। রাজ্যস্তরে ১৯৫৫ থেকে পরবর্তী তিরিশ বছরে একাধিক ভূমি সংস্কার আইন এনে ছোট কৃষক, বর্গাদার ও ভূমিহীন চাষিদের স্বার্থরক্ষার চেষ্টা হয়, ভূমি পুনর্বন্টনও চলে। জমিদারি-উচ্ছেদ আইন এনে জমিদারি ব্যবস্থা ও মধ্যসত্ত্বভোগীদের উচ্ছেদ করা হয়।

 

এই নতুন আইনি ব্যবস্থা নিশ্ছিদ্র ও ত্রুটিহীন ছিলো না। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে যে তথাকথিত কল্যাণকামী রাষ্ট্র বা ওয়েলফেয়ার স্টেট এই ব্যবস্থা চালু করে, তা একইসঙ্গে পুঁজিমালিকদের ও সামন্তপ্রভুদেরও স্বার্থরক্ষা করতে থাকে, ফলে জনকল্যাণমুখী কোন আইনই যথাযথভাবে রূপায়িত হয় না। ঔপনিবেশিক শোষণ-লুন্ঠনের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রক্রিয়া অন্য চেহারায় অন্য কায়দায় চলতেই থাকে। এ সত্বেও, অংশত বিভিন্ন আইন বলবৎ থাকার কারণে, অংশত গণ-আন্দোলনের চাপে, ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় খানিক বদল আসছিলো, পুঁজিমালিক ও সামন্তপ্রভুদের ইচ্ছায় ও প্রয়োজনে এই অঞ্চলের ভূমি-ব্যবহার আর সম্পূর্ণভাবে নির্ধারিত হচ্ছিলো না।

 

গত দু-তিন দশকের মধ্যে উত্তরবঙ্গের পাহাড়-সমতলের প্রায় সর্বত্র ভূমি বা জমি তার শ্রমজীবী-কৃষিজীবী ব্যবহারকারীদের দখল থেকে বেরিয়ে পুরোপুরি পুঁজিবাজারের কব্জায় চলে গিয়েছে। এই ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করছি অহরহ। বড় শহরের পাশে, যথা শিলিগুড়ি বা দার্জিলিং, একের পর এক চা-বাগিচার জমিতে অবৈধ নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। কুড়ি বছর আগে চাঁদমণি বাগিচা উচ্চ্ছেদ হবার পর থেকে, শিলিগুড়ি মহকুমার বিভিন্ন বাগিচার জমিতে নির্বিচারে চা-চাষ ভিন্ন অন্য কাজ হচ্ছে। এর উল্টোদিকে, এমনকি উর্বরা চাষজমি দখল করেও নতুন ছোট-বড়-মাঝারি বাগিচা তৈরি হচ্ছে, কুড়ি বছর আগেও যাদের কোনরকম আইনি বৈধতা ছিলো না।

 

চাষজমি লুঠ হচ্ছে আরো নানান পদ্ধতিতে, প্রক্রিয়ায়। পশ্চিমে মেচি নদী থেকে পূর্বের সঙ্কোশ পর্যন্ত সমগ্র তরাই-ডুয়ার্স এলাকায় যথেচ্ছ লুঠ চলছে, নদী পারের উর্বর পাললিক মাটি কেটে বেআইনি ইঁটভাটা তৈরি হচ্ছে। নদীর বুক থেকে ক্রমাগত পাথরবালি তোলা হচ্ছে তো হচ্ছেই। এর সঙ্গে সঙ্গেই চাষজমিতে, বাগিচার জমিতে, এমনকি চিহ্নিত নথিভুক্ত বনভুমিতেও বিভিন্ন রকমের হোটেল-রিসর্ট জাতীয় পর্যটনকেন্দ্র গড়ে উঠছে অপরিকল্পিত ও বেআইনি ভাবে।

 

এই সব ঘটনা ঘটছে কেন, কিভাবে? এলাকার অর্থনীতি ও সামাজিক জীবনের ওপর, সর্বোপরি পরিবেশের ওপর এই ঘটনাগুলির দীর্ঘমেয়াদি ও আশু প্রতিক্রিয়াই বা কি? এই ছোট লেখার মধ্য দিয়ে খুব সংক্ষেপে বিষয়টিকে আমরা বুঝতে চাইবো।

 

জমিলুঠের ঘটনা ঘটছে প্রধানত দুটি কারণে। এক, ঔপনিবেশিক সময় থেকেই এই অঞ্চলের যাবতীয় ভূমি ও অন্যান্য প্রাকৃতিক পরিসর নির্বিচার ও বিবেচনাহীন লুন্ঠনের মুখোমুখি হয়। প্রায় জলের দামে কিংবা বিনামূল্যে বড় বড় জমি/জোত প্রথমে সায়েবী ও পরে ধনী স্থানীয়দের কাছে বন্দোবস্ত করা হয়। চাবাগিচার সমস্ত জমিকে দেখানো হয়েছিলো পোড়ো জমি হিসাবে, যাতে নামমাত্র খাজনায় জমি ছেড়ে দেওয়া যায়। দলিলে যে পরিমাণ জমির উল্লেখ থাকতো, বাস্তবত তার চাইতে অনেক বেশি জমি বাগিচামালিকদের হাতে চলে যায়। একইভাবে এলাকার বন ঠিকাদারদের বন্দোবস্ত করে দেওয়া হয় প্রায় বিনি পয়সায়।

 

সায়েবসময়ের এই জমিলুঠের ধরণ কার্যত এখনো বিশেষ বদলায়নি। জমির যে ব্যবহার থেকে দ্রুত মুনাফা করা সম্ভব, জমি সেভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। যেখানে চাবাগিচার জমিতে হোটেলরিসর্ট বা পর্যটন কেন্দ্র, এমনকি উচ্চবিত্তের জন্য আবাসন বানালে চা চাষের চেয়ে তা বেশি লাভজনক, সেখানে তা-ই ঘটছে। শিলিগুড়ির উপান্তে দার্জিলিং তরাই-এর প্রথম বাগিচা নিউ চাম্পটা টি এস্টেটের বিপুল এলাকা নিয়ে বিলাসবহুল হোটেল তৈরি হয়েছে। পাহাড়ে, কার্শিয়াং-এর প্রসিদ্ধ মকাইবাড়ি বাগিচায় বড় হোটেল ও রিসর্ট গড়ে উঠেছে, কার্শিয়াং-এরই জংপানা বাগিচায় রিসর্ট বানানোর কাজ চলছে। শিলিগুড়ি লাগোয়া দাগাপুর, মাটিগাড়া ও নিশ্চিন্তপুর বাগিচার জমিতে একের পর এক নির্মাণ কাজ চলছে।

 

উত্তরবঙ্গের বনগ্রাম বা ফরেস্ট ভিলেজগুলির বেশিরভাগই এখন বনাধিকার আইন ২০০৬ অনুযায়ী রাজস্বগ্রামে পরিণত হয়েছে। আশা করা হয়েছিলো, এই গ্রামগুলির প্রান্তবাসী আদিবাসী মানুষেরা দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক শোষণের কবল থেকে বেরিয়ে নিজেদের বাস্তু ও চাষজমির স্থায়ী মালিকানা পাবেন। কার্যত, তা হচ্ছে না।  দার্জিলিং তরাই থেকে ডুয়ার্স এবং দার্জিলিং ও কালিম্পঙ পাহাড়ের প্রায় সর্বত্র বনগ্রামের জমিতে বহিরাগতরা এসে পর্যটন ব্যবসা শুরু করেছেন। যে জমি অধিকার, জীবন ও জীবিকা ছিলো, তা নিতান্ত বাজারি পণ্য হয়ে উঠছে।

 

দুই, উত্তর-ঔপনিবেশিক সময়ে যে সব জনকল্যাণমুখী এবং পুঁজি-নিয়ন্ত্রক আইন চালু হয়েছিলো, তার প্রায় সবগুলিকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হচ্ছে, কিম্বা তা সংশোধন বা বাতিলের প্রক্রিয়া চলছে। যথা, ১৯৫৩-র ভারতীয় চা আইন বাতিলের চেষ্টা চলছে। এই আইনের ১২ থেকে ১৬ নং ধারা, যেখানে চাবাগিচার যাবতীয় ভূমি ব্যবহার বিষয়ে সরকারি টি বোর্ডের অনুমোদন/সম্মতির প্রয়োজনের কথা বলা ছিলো, ২০২১-এর মাঝামাঝি ভারত সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রক এক বিজ্ঞপ্তি জারি করে সেগুলোকে ‘মুলতুবি’ বা সাসপেন্ডেড ঘোষণা করে। ফলে বাগিচামালিকরা যেমন তাদের বাগিচার ফাঁকা জমিতে চা চাষ করতে পারবেন, বাগিচার বাইরের চাষজমিতে নতুন বাগিচা তৈরির ক্ষেত্রেও কোন বাধা থাকছে না। একইভাবে, সরকারের কাছ থেকে সর্তাধীনে ইজারা নেওয়া বাগিচার জমিতে চা চাষ ছাড়া অন্য যে কোন রকম কাজও করা যাবে।

 

বাগিচার জমিতে চা চাষ না করে ‘অন্য’ লাভজনক কিছু করার চেষ্টা দীর্ঘদিনের। আইনগত বাধা থাকায়, চাঁদমণি বাগিচার জমি তৎকালীন বাগিচামালিকের কাছ থেকে সরকার ফেরত নেয়, বা ‘রিজিউম’ করে। সেই জমিই পরে আবাসন ইত্যাদি বানানোর জন্য অন্য এক ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে জলের দরে দিয়ে দেওয়া হয়। শিলিগুড়ি শহর লাগোয়া অঞ্চলের সবকটি বাগিচা এর ফলে বিপদাপন্ন হয়ে পড়ে। চাঁদমণি ‘মডেল’ অনুযায়ী এখনো অবধি অন্য কোন বাগিচার পুরোটা আবাসন বা অন্য কিছু বানানোর জন্য হস্তান্তরিত হয়নি বটে, কিন্তু বাগিচাগুলির জমি জমিবাজারের হাতে চলে যাচ্ছে ক্রমশ।

 

ভারত সরকারের নীতি পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এ রাজ্যের অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ সরকারও ক্রমাগত নিজেদের বাগিচানীতি ও ভূমিনীতি বদলাচ্ছেন। প্রথমে, ২০১৯-এর শেষের দিকে এবং ২০২৫-এর ফেব্রুয়ারি মাসে সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানানো হয়েছে, বাগিচার ফাঁকা (যেখানে চা চাষ নেই) জমিতে মালিকেরা প্রয়োজনমাফিক বাইরের পুঁজি নিয়ে এসেও নির্মাণ কাজ করতে পারবেন। যদিও এই বিজ্ঞপ্তির মূল কথা চাবাগিচায় পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা, অর্থাৎ চা-পর্যটন বা টি ট্যুরিজমের বিকাশ, বিজ্ঞপ্তিতে বহুবিধ কাজকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, “অনুমোদিত ব্যবসায়িক কাজের মধ্যে পড়বে চা পর্যটন, পশুপালন, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র, বাগিচা বা প্ল্যান্টেশন, অপ্রচলিত শক্তি, সামাজিক পরিকাঠামো ও পরিষেবা।” ‘সামাজিক পরিকাঠামো ও পরিষেবা’ বলতে কি বোঝানো হয়েছে তার উপযুক্ত ব্যাখ্যা নেই। সম্ভবত উদাহরণস্বরূপ শিক্ষাকেন্দ্র, হাসপাতাল, নার্সিং হোম ইত্যাদির কথা বলা আছে। ওই একই ধারায়, বড়সড় আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলায় নীতিপদ্ধতিগত অসুবিধা থাকছে না, অর্থাৎ ‘সামাজিক পরিকাঠামো ও পরিষেবা’র নামে জমি নিয়ে ফাটকাবাজি ও রিয়েল এস্টেটের প্রোমোটারি ব্যবসাকে আইনি বৈধতা প্রদান করা হচ্ছে।

 

বাগিচার জমি চা-চাষ ভিন্ন অন্য কাজে ব্যবহার করার চেষ্টা চলছে বহুদিন। বাগিচামালিকদের দাবি মেনে এর আগে রাজ্য সরকার ২০০৫ সালে ও ২০১৩ সালে বাগিচা এলাকায় পর্যটন শুরু করার অনুমতি দিয়ে দুটি পৃথক বিজ্ঞপ্তি জারি করে। মালিকেরা এতে খুশি হন নি, কেননা পর্যটনপ্রকল্পে ব্যবহারযোগ্য জমির উর্ধসীমা ধরা হয়েছিলো পাহাড়ের ক্ষেত্রে ১.৫ একর ও সমতলে ২ একর। ২০১৯-এর বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী বাগিচার মোট ইজারা-এলাকার শতকরা ১৫ ভাগ পর্যটন ও অন্যান্য ব্যবসার জন্য ব্যবহার করা যাবে, পাহাড়-সমতল নির্বিশেষে বাগিচাপ্রতি ১৫০ একর অবধি, যদি তা ওই ১৫ শতাংশের মধ্যে পড়ে।

 

বিজ্ঞপ্তিতে যদিও বলা হয়েছে বাগিচায় চা চাষ ভিন্ন অন্য প্রকল্প চালু করতে গেলে চা গাছের ক্ষতি করা যাবে না বা গাছ কাটা যাবে না, এবং প্রত্যেক প্রকল্প সরকারনিযুক্ত একটি কমিটির অনুমোদন সাপেক্ষ, বাগিচা বাগিচায় যে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে প্রকল্প চালু হচ্ছে, বোঝাই যায় ওই ‘অনুমোদন’ বিষয়টি নেহাৎই নিয়মরক্ষা মাত্র। বড় হোটেল ব্যবসায়ী (যথা তাজ, মেফেয়ার) এবং রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীরা (নেওটিয়াদের বেঙ্গল অম্বুজা) বাগিচা অঞ্চলে পুঁজি ঢালছেন, বাগিচার ঠিক মধ্যেই বিশাল নির্মাণকাজ চলছে।

 

বাগিচার জমিতে বাড়িঘর বানানোর এই প্রক্রিয়া কোথায় গিয়ে থামবে, বলা মুশকিল। যথা, বাগিচাপিছু ১৫০ একরের বর্তমান উর্ধসীমা ধরে হিসেব করলে দেখা যায়, এক আলিপুরদুয়ার জেলারই ৫২টি ৯০০ একর বা তার বেশি জমির বাগিচার মোট ১০৫৮৫৯.০৬ একর জমির নিদেনপক্ষে ৭৮০০ একর জমিতে চায়ের সঙ্গে সংযুক্ত নয় এমন বিভিন্ন নির্মাণকাজ শুরু হয়ে যেতে পারে। উর্ধসীমা বাড়লে জমির পরিমাণও বাড়বে। অর্থাৎ, আরো আরো জমির ভূমিব্যবহার বদলাতে থাকবে।

 

আলিপুরদুয়ারের উদাহরণ দেওয়া হলো। বড় বাগিচা বা এস্টেট যে সব জেলাতে আছে, সবগুলোতেই একই অবস্থা। বেশিরভাগ বড় এস্টেট থেকে পুঁজি বেরিয়ে যাচ্ছে, বাগিচায় নতুন লগ্নি হচ্ছে না বললেই হয়। ফলে কাগজেকলমে চা চাষ দেখানো থাকলেও, বাস্তবে এস্টেটের মধ্যে উৎপাদনশীল বাগিচা এলাকা ক্রমশ কমছে। এর ধাক্কা গিয়ে পড়ছে চা অর্থনীতিতে, এবং সেই অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত যাবতীয় চা-শ্রমিকদের ওপর। উৎপাদনশীল চা এলাকা কমামাত্র, শ্রমিক সংখ্যা হয় কমতে থাকে, নাহয় শ্রমিকপিছু মালিকের যে খরচ করার কথা (মজুরি ও অন্যান্য সুবিধা), তা কমিয়ে দেওয়া হয়। শ্রমিকদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করাটা বাগিচামালিকের আইনি দায়বদ্ধতা। চা-পর্যটন কিম্বা বাগিচায় অন্য ব্যবসা প্রসারের প্রয়োজনে শ্রমিক বাসস্থান (বাগিচার ভাষায় কুলি লাইন) সরিয়ে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হবে, সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে এমন বলা আছে। ফলে, বাগিচার জমিতে চা চাষ ছাড়া অন্য কিছু করার অভিঘাতে শ্রমিকদের জীবিকাই শুধু বিপন্ন হয়ে পড়ছে না, তাঁদের বাসস্থানের সংকটও দেখা দিচ্ছে। আলিপুরদুয়ারের যে ৫২টি এস্টেটের কথা বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সরকারি হিসেব অনুযায়ী সেখানে প্রায় ৭০০০০ বাগিচাশ্রমিক কর্মরত। বাগিচায় বসবাস করেন এমন অ-শ্রমিক হবেন এর তিন থেকে পাঁচ গুণ। শুধু আলিপুরদুয়ার কেন, গোটা উত্তরবঙ্গের কোন বাগিচাশ্রমিক পরিবারের নিজস্ব বাস্তুজমি নেই। বাগিচার মধ্যের যে খালি জায়গায় শ্রমিকরা চাষাবাদ করতেন, সে জমির অধিকাংশ বাগিচামালিকদের কব্জায় চলে গেছে। ১৯৫৫ সাল থেকে আজ পর্যন্ত রাজ্য সরকারের ভূমি ও ভূমি সংস্কার দপ্তর বাগিচামালিকদের কাছ থেকে ইজারা-বহির্ভূত যত জমি ‘খাস’ বা ‘রিজিউম’ করেছে, তার এক ছটাকও বাগিচাশ্রমিকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়নি। উত্তরবঙ্গের বাগিচাঅঞ্চলের প্রকৃত ভূমিব্যবহার নিয়ে রাজ্য সরকারের কাছে কোন প্রামাণ্য তথ্য আছে কিনা বোঝা যায়না। ফলে বাগিচার জন্য ইজারা দেওয়া মোট সরকারি জমির কত অংশে চায়ের চাষ বাস্তবিকই আছে, তা বোঝা সম্ভব নয়। অথচ, হাজার হাজার একর জমি রাজ্য সরকার বাগিচামালিকদের ব্যবসা ও লাভ করার জন্য নির্বিবাদে দিয়ে দিচ্ছেন। শ্রমিকদের বাস্তু বা চাষজমির মালিকানার প্রসঙ্গে অতীত এবং বর্তমান সরকার নিরুদ্বেগ ও নিরুত্তাপ। ধরেই নেওয়া হয়েছে জমি, এমনকি সরকারি জমির ওপরেও প্রাথমিক অধিকার বাগিচামালিকদের এবং ভূমি-ব্যবসায়ী ফাটকাবাজদের, বাগিচাশ্রমিকরা বাহুল্য মাত্র, তাঁরা কোন জমির ওপরেই অধিকার দাবি করতে পারেন না।

 

জমি নিয়ে ঔপনিবেশিক সায়েবরা ইচ্ছামতো লুটপাট চুরিজোচ্চুরি করেছিলেন। মানুষদের, তাঁদের শ্রম নিয়েও যথেচ্ছ অপব্যবহার করা হয়েছে। সায়েবরা দেশ ছেড়ে চলে যাবার পঁচাত্তর বছর পরেও সেই এক অন্যায় চলছে। অন্যায় চলছে তার একটা বড় কারণ, হিমালয়-লাগোয়া উত্তরবঙ্গের বাস্তব ভূমিব্যবহার কি, সে সম্পর্কে ভূমিদপ্তরের কাছে উপযুক্ত কেন, আংশিক তথ্যও নেই। অবিভক্ত দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলার অধিকাংশ জমি বাগিচামালিক ও বনদপ্তরের আওতায়, আজ পর্যন্ত সেই জমির আধুনিক ও যুগোপযোগী সমীক্ষা হয়নি। ফলে, কোন জমিতে কি হচ্ছে, সেই জমির উপর বিভিন্নভাবে নির্ভরশীল পরিবর্তন জনসংখ্যা ঠিক কত, সে বিষয়ে তথ্য নেই। সায়েবসময়ের পুরোনো ভূমিমানচিত্র দিয়ে কাজ চলছে। সেই মানচিত্রে কি আছে বনদপ্তরের আমলা এবং বাগিচামালিক ছাড়া কেউ তা জানেন না। সুতরাং, এই বিস্তীর্ণ এলাকা কার্যত যাবতীয় সরকারি ভূমিসংস্কার কর্মসূচির বাইরেই থেকে যাচ্ছে দশকের পর দশক। জমিদারিপ্রথা লুপ্ত হয়ে যাবার সত্তর বছর পরেও বনাঞ্চলে ও বাগিচায় জমিদারি চলছেই, ওই অঞ্চলে বসবাসকারি লক্ষ লক্ষ মানুষের তাঁদের নিজেদের বাসভূমির ওপর আইনি ও সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বনাঞ্চলে বন অধিকার আইন মাফিক বেশির ভাগ বনগ্রাম রাজস্বগ্রামে পরিবর্তিত হলেও, শুধুমাত্র উপযুক্ত মৌজা ম্যাপ না থাকার কারণে, নতুন ভূমিসমীক্ষার কাজে বনদপ্তরের আমলারা গাজোয়ারি করে ঢুকে পড়ছেন, গ্রামের জমি জবরদস্তি নিজেদের বলে দেখাচ্ছেন। বনদপ্তর যথাযথ তথ্য না দেওয়ার কারণে চারটি জেলার ৩৪টি বনগ্রাম এখনো রাজস্বগ্রামে রূপান্তরিত হয়নি। বাগিচা অঞ্চল যেহেতু এই আইনের চৌহদ্দির বাইরে, সেখানে নতুন ভূমিসমীক্ষার কাজ শুরুই হয়নি।

 

প্রশ্ন তোলা দরকার, স্বাধীন দেশের মানুষের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসা ‘গণতান্ত্রিক’ কোন সরকারের আসল কাজ কি হওয়া উচিত? যে ভূমি মানুষের জীবনের, সংস্কৃতির, অস্তিত্বের আধার, সেখানে মানুষ যাতে মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকতে পারেন তা নিশ্চিত করা, না সেই ভূমিকে কিছু দায়িত্বজ্ঞানহীন মুনাফাবাজদের হাতে তুলে দেওয়া? প্রশ্ন, রাজ্য সরকার, এবং পাহাড় এলাকায় জিটিএ কতৃপক্ষ, যৌথভাবে কেন নতুন আইন তৈরি করে, বা পুরোনো আইন সংশোধন করে সমস্ত বাগিচাশ্রমিকদের হাতে বাস্তুজমি ও চাষজমির অধিকার তুলে দিচ্ছেন না? কেন বন অধিকার আইন যথাযথভাবে রূপায়িত করায় উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না? কেন বনাঞ্চল ও বাগিচাসহ জেলার সমস্ত জমি নিয়ে নতুন সমীক্ষার আয়োজন করা হচ্ছে না? এই অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কাজগুলি করার পরিবর্তে কেন বাগিচা ও বনের জমিতে পর্যটন প্রসারের নামে যথেচ্ছ নির্মাণ চলতে দেওয়া হচ্ছে?

 

আরো প্রশ্ন, এলাকাজুড়ে পরিকল্পনাহীন ভূমি ব্যবহার ও বেলাগাম নির্মাণকাজের ফলে পরিবেশের কি ক্ষতি হতে পারে, কি ইতিমধ্যেই হচ্ছে, সে বিষয়ে রাজ্য সরকার ও জিটিএ-র কাছে কোনরকম তথ্য আছে কি? প্রাকৃতিক ভূমিবিন্যাস নষ্ট করে নেহাৎই পুঁজিবৃদ্ধির প্রয়োজনে যেভাবে পাহাড়ে সমতলে বাগিচা বসানো হয়েছিলো, শহর জনপদ তৈরি হয়েছিলো, একের পর এক আদিম বনাঞ্চল লোপাট করা হয়েছিলো, ঔপনিবেশিক সময়ের সেই পাপ এখনো এই গোটা এলাকার ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে আছে। ধস, বন্যা ও ভূমিক্ষয়, সেই সঙ্গে চাষজমির উর্বরতাহ্রাস, পার্বত্যাঞ্চলে পানীয় সহ সব ধরণের ব্যবহারযোগ্য জলের তীব্র সঙ্কট, এ সবের যুগপৎ অভিঘাতে মানুষ বিপর্যস্ত, সন্ত্রস্ত। পরিবেশ সঙ্কট তীব্রতর হয়ে উঠছে বিশ্ব উষ্ণায়ণ জনিত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে, যে কোন সময়, যে কোন মুহূর্তে ভয়ঙ্কর বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। যাঁরা নির্বাচনে অংশ নেন, সরকারে বসেন, এসব বিষয়ে তাঁদের বক্তব্য কি, পরিকল্পনা কি? কিছু আদৌ আছে কি? একের পর এক নদীখাত ও নদীউপত্যকা এলাকাকে উন্নয়ন ও জাতীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে রঙবেরঙের নির্মাণ সংস্থা, ঠিকাদার ও বানিয়াদের  হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, কোথাও বাঁধ উঠছে, কোথাও রাস্তা তৈরি হচ্ছে, কোথাও রেলপথ। সমগ্র তিস্তা উপত্যকা নিশ্চিত ধংসের মুখোমুখি, বাকি নদীর অবস্থাও তথৈবচ।

 

এই অবস্থা মেনে নেওয়া যায় না। গোটা এলাকার জমির উপর কিছু আমলা ও পুঁজিমালিক ও বেনিয়াদের একচ্ছত্র অধিকার থাকবে, এবং নাগরিকদের কিছু বলার থাকবে না, এই ঔপনিবেশিক ও অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বছরের পর বছর চলতে পারে না। পুঁজির দাসত্ব করা গণতান্ত্রিক সরকারের, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাজ হতে পারে না। বলতে হবে, এলাকার মানুষের এবং পরিবেশের নিরাপত্তা ও মর্যাদা সুরক্ষিত ও সুনিশ্চিত করতে হবে সবচেয়ে আগে, নচেৎ প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়, অর্থনীতির সুষম ও ন্যায়সঙ্গত বিকাশও ঘটতে পারে না।

 

কি করতে হবে এক্ষুণি এক্ষুণি? সরকারের কি করা উচিত? কিছু কাজের কথা, যা এই অঞ্চলের শ্রমজীবী প্রকৃতিনির্ভর মানুষের দাবিও বটে, বলে এই লেখা আপাতত শেষ করা যায়। উত্তরবঙ্গ জুড়ে জমিলুঠের বিরুদ্ধে মানুষ সংগঠিত হতে চাইছেন, আন্দোলনের প্রস্তুতি চলছে পাহাড় তরাই দুয়ারে। খুব শিগগিরই শিলিগুড়ি শহরে বিভিন্ন এলাকার, শহর গ্রাম থেকে শুরু করে বনগ্রাম ও চা বাগিচার লোকজন একসঙ্গে জমায়েত হবেন, বিরুদ্ধতার ও অধিকারের কথা বলবেন। সে সব কথাও আমরা সময় মতো জানাব।

 

জমি লুটের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য প্রতিরোধ আন্দোলনের দাবি

 

১. হিমালয়-লাগোয়া উত্তরবঙ্গে ঔপনিবেশিক ও অগণতান্ত্রিক ভূমিব্যবস্থা বাতিল করতে হবে।

 

২. সমস্ত বাগিচা ও বন এলাকা সহ পুরো এলাকার আধুনিক ভূমিসমীক্ষা চালাতে হবে ও ভূমিব্যবহার মানচিত্র জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে।

 

৩. বাগিচাশ্রমিক ও বনগ্রামের গ্রামসভার বিনানুমতিতে বাগিচা ও বনের জমিতে নতুন ব্যবসায়িক প্রকল্প চালু করা চলবে না

 

৪. ভারতীয় চা আইন বাতিল করা চলবে না। এই আইনের ‘মুলতুবি’ রাখা ধারাগুলিকে দ্রুত চালু করতে হবে।

 

৫. বাগিচা ও বনের সমস্ত শ্রমিকবসতি ও বনগ্রামের বাসিন্দাদের অবিলম্বে তাঁদের বাস্তুভূমি ও চাষজমির ওপর মালিকানা অধিকার দিতে হবে।

 

৬. বাগিচাশ্রমিকদের ভূমির অধিকার স্বীকার ও নথিভুক্ত করার প্রয়োজনে যথাযথ আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হবে। দরকারমতো, পশ্চিমবঙ্গ ভূমি সংস্কার আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধন করতে হবে, বা নতুন আইন আনতে হবে।

 

৭.বনাধিকার আইন যথাযথভাবে রূপায়ণ করতে হবে।

 

৮.বাগিচাশ্রমিকদের জমির অধিকার যতদিন পর্যন্ত স্বীকৃত ও নথিভুক্ত না হয়, এবং সমগ্র বাগিচা ও বন এলাকার আধুনিক ভূমিসমীক্ষার কাজ শেষ না হয়, বাগিচার জমিতে ব্যবসায়িক প্রকল্পের অনুমতি দেওয়া যাবে না।

 

৯. পরিবেশের ক্ষতি হতে পারে, এমন কোন নির্মাণকাজ করতে দেওয়া যাবে না।

 

Share this
Leave a Comment