দেউচা-পাচামি-র খনি বিরোধী আদিবাসীদের লড়াই ‘সড়ক সে লেকর সংসদ তক’


  • March 22, 2025
  • (0 Comments)
  • 134 Views

গত ২১ মার্চ দেওচা-পাঁচামিতে কয়লা খনি প্রকল্প বন্ধের দাবিতে বিশাল মিছিল হয় কলকাতায়। মিছিলে দেওচা-পাঁচামি থেকে আসা মানুষ জানান কীভাবে স্থানীয় প্রশাসন মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে, ভয় দেখিয়ে এবং পুলিশি অত্যাচার চালিয়ে সম্মতি আদায় করতে চেষ্টা করছে। সুদর্শনা চক্রবর্তীর রিপোর্ট।

 

Groundxero | March 22, 2025

 

চোখে চোখ রেখে স্পষ্ট গলায় পুতুল কিস্কু জানিয়ে দিলেন “খনি আমরা চাই না। খনি আমাদের দরকার নেই।” আরতি ছোরে নির্দ্ধিধায় বললেন, “যতদিন দরকার এই আন্দোলন চালিয়ে যাব আমরা। আমাদের দাবি যতদিন না মানবে আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব। দরকার হলে সারা জীবন।”

 

দেউচা-পাচামিতে খোলা মুখ কয়লা খনির বিরুদ্ধে জল জঙ্গল জমিন ও আদিবাসী বাঁচাও আন্দোলনের পক্ষে ২১ মার্চ, কলকাতায় মিছিলের আয়োজন করা হয়। প্রায় ৫০০ মানুষ এই মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। শিয়ালদহ ষ্টেশন চত্বর থেকে দুপুর ১২ টায় শুরু হয়ে ধর্মতলার ওয়াই চ্যানেলে মিছিলটি শেষ হয়। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদেনিপুর, ঝাড়গ্রাম এবং বীরভূমের দেওচা-পাঁচামি থেকে বহু মানুষ এই মিছিলে ছিলেন। মিছিলে মুহুর্মুহু শ্লোগান ওঠে সিধু-কানু, চাঁদ–ভৈরব, ফুল-ঝানোর নামে। সাঁওতালি ভাষায় দাবি ওঠে দেওচা-পাঁচামিতে আদিবাসীদের জমি কেড়ে নেওয়া যাবে না, কয়লা প্রকল্প বন্ধ করতে হবে। মিছিলে কোলকাতার বহু অধিকারকর্মী, ছাত্র আন্দোলনের সংগঠক, সাধারণ মানুষ যোগ দেন।

 

তথ্য অনুযায়ী প্রায় ১১ হাজার গ্রামের জমি অধিগ্রহণ করে সেখানে খোলা মুখ কয়লা খনি তৈরির পরিকল্পনা আছে রাজ্য সরকারের। এরফলে সম্ভবনা রয়েছে আনুমানিক ২১ হাজার মানুষের উচ্ছেদ হওয়ার। আন্দোলনকে উপেক্ষা করে ইতিমধ্যেই কিছু জায়গায় প্রাথমিক কাজ আরম্ভও করে দেওয়া হয়েছে। ২১ মার্চের  মিছিলের মূল উদ্দেশ্য ছিল কলকাতার মানুষ ও মূলস্রোতের মিডিয়া, যারা এই আন্দোলন বিষয়ে বিশেষ আলোকপাত করছেন না, তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা।

 

যে বিষয়গুলি নিয়ে আদিবাসীরা আন্দোলন শুরু করেছেন –

 

১) যে ১১,২২২ একর প্রস্তাবিত খনির জমি রয়েছে সেখানে ৯১০০ একর জমি আদিবাসীদের মানে ৮১%

 

২) কয়লা ব্লকটি ১৩.৭ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে প্রস্তাবিত, এবং সেই প্রস্তাবিত এলাকার উপরের ৪১৩৪টি বাড়ি আদিবাসী, তফসিলি জাতি, সংখ্যালঘু ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের।

 

৩) ওপেন-পিট খনি থেকে ড্রিলিং, বিস্ফোরণ, লোডিং ও পরিবহনের ফলে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য সৃষ্টি হয়।

 

৪) দ্বারকা ও ময়ূরাক্ষী নদী অববাহিকার জলসম্পদকে বিপুল পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এই খনি উত্তোলনের কাজ।

 

 

সাবিত্রী মান্ডি সংস্কৃত নিয়ে অনার্স পাস করে আপাতত মাস্টার্স করছেন। বললেন, “আদিবাসীদের জমি উচ্ছেদ করছে এই খনি করা হচ্ছে। পায়ের তলায় মাটি না থাকলে মানুষ কী করে বাঁচবে? সরকার জোর করে আমাদের জমি ছিনিয়ে নিচ্ছে। আমাদের কিছু লাভ হবে না। জমি আমরা ছাড়ব না। এই আন্দোলন আমরা দরকার হলে সারা জীবন চালিয়ে যাব।“

 

এক আন্দোলনকারী কার্তিক সোরেন জানালেন, “আমাদের ওখান থেকে কলকাতায় আসা কিন্তু খুবই কষ্টকর। অর্থ যোগাড় করা ইত্যাদি। এবারে তাই ছাত্রছাত্রীরাই বেশি এসেছে। যাতে কলকাতার মানুষ, মিডিয়া একটু জানেন, তাই আমাদের আসা।“ কলকাতাতেও এ বিষয়ে মিডিয়ার অনীহার কারণ কী জানতে চাওয়ায় মৃদু হেসে জানালেন, “সরকার। আসলে কোর এরিয়ায় আমরা যারা থাকি আর ঠাণ্ডা ঘরে বসে সবকিছু ঠিক করার মধ্যে আকাশপাতাল ফারক থাকে। সরকার সেখান থেকে খনিজ পদার্থ পাচ্ছে। সবই তো অর্থের ব্যাপার। আপনারা যাতে জানতে না পারেন, তারজন্য ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। আদিবাসীদের কথা কে ভাবে?”সারা দেশে জল-জঙ্গল-জমি কেড়ে নেওয়ায় বিজেপি সরকারের পেছনে সবচেয়ে বড় শক্তি আম্বানি-আদানি। পশ্চিমবঙ্গে সরকারের অনম্নীয় মনোভাবের পেছনে কারা রয়েছে বলে মনে করছেন? কার্তিক বললেন, “মাফিয়া। কয়লা মাফিয়া, বালি মাফিয়া, পাথর মাফিয়া।“স্পষ্টভাবেই জানালেন প্রতিদিনই নানা ধরনের ভয়ের আবহে থাকতে হয় তাঁদের? বললেন, “পুলিশ তো আছেই। রাতের অন্ধকারে পুলিশ চলে আসছে। উল্টোপাল্টা বলছে। যারা বেশি কথা বলছেন, তাদের বুঝিয়ে নিজেদের দলে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে।“কার্তিক বলছিলেন, স্থানীয় নেতৃত্বের অনেকেই আন্দোলন থেকে সরে গেছেন, তেমনি আবার অনেক নতুন মানুষ যুক্ত হয়েছেন।

 

মিছিলে থাকা অধিকাংশ মানুষেরই বক্তব্য গত ১৫ বছরে যেভাবে রাজ্যের আদিবাসী মানুষদের উপর অত্যাচার, বঞ্চনা করা হয়েছে, তেমন অভিজ্ঞতা তাঁদের আগে হয়নি। জল-জঙ্গল-জমি, পাহাড়-পর্বত কেড়ে নিয়ে আদিবাসী-বনবাসী মানুষদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।

 

আমোনিলাল সোরেন যেমন বলছিলেন, “আমাদের এক বিঘা জমির জন্য ১৩ লাখ টাকা দেবে বলেছে, অথচ বাইরে দু’কাঠা জমির দামই তো ৮লাখ টাকা। তাহলে আমরা এই টাকা নিয়ে কী করব? কী করে জীবন চলবে? নিজেদের জমি-জায়গা ছেড়ে যাবই বা কেন? এক পরিবারে একজনকে চাকরি দিয়ে অশান্তি তৈরি করছে। মাফিয়াদের হাত রয়েছে বলেই সরকার এতটা অন্যায় করতে পারছে।“

 

বাপি সোরেন বলছিলেন, তাঁরা মনে করেন বর্তমান রাজ্য সরকার যা চালাচ্ছেন তা একনায়কতন্ত্র। “কোন জায়গায় যদি বড় জনকল্যানমূলক প্রজেক্ট হয়, সেখানে একটা জনশুনানি হওয়ার কথা। জনগনের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হচ্ছে। আমি অবশ্যই মনে করি এর প্রভাব আগামী নির্বাচনে ভোটবাক্সে পড়বে। এখানে যেটা হচ্ছে সেটা একতরফাভাবে হচ্ছে। এখানে তো তৃণমূল আর বিজেপি একসঙ্গে এই একনায়কতন্ত্র চালাচ্ছে। আদানি যখন এল, মুখ্যমন্ত্রী তাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। প্রধান বিরোধী দল, দলনেতা কেউ আমাদের বিষয় নিয়ে কোনো কথা বলেন না। মিডিয়া তো পুঁজিপতিদের হাতে, মিডিয়া কী করে আমাদের কথা বলবে!”

 

আগামী দিনে এই আন্দোলন নিয়ে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য ‘সড়ক সে লেকর সংসদ তক’। আদিবাসীদের অধিকার,-কৃষ্টি-ঐতিহ্য কেড়ে নেওয়া, পরিবেশের অভাবনীয় ক্ষতি আর বঞ্চনার বিষয়টি নিয়ে তাঁরা চান লোকসভা, বিধানসভা সব জায়গায় প্রশ্ন উঠুক। আন্দোলনের পরিসর আরো বাড়িয়ে তোলাই তাঁদের আগামী দিনের লক্ষ্য। সংগঠকদের পক্ষে যে লিফলেট বিলি করা হয় তাতে খণ্ডন করা হয় পার্টি-মিডিয়া-সরকারের দেওয়া যুক্তি। লিফলেটে আবেদন রাখা হয় সাধারণ মানুষের প্রতি। এখানে সেই আবেদনটি হুবহু রাখা হল-

 

আমাদের আবেদন-

দেওচা-পাঁচামিতে ১১ হাজার একরের বেশি জমির ওপর খোলামুখ কয়লাখনি প্রকল্প প্রস্তাবিত, সে কারণে প্রায় সাড়ে চার হাজার পরিবারের অন্তত একুশ হাজার মানুষ উচ্ছেদের সম্মুখীন হবেন। কয়লাখনি চলমান জলবায়ু সংকটকে বহুগুণ বাড়িয়ে তুলবে, হাজার হাজার স্থানীয় মানুষকে দূষণপীড়িত হয়ে উদ্বাস্তু হতে হবে, পানীয় জল অমিল হবে, দুটি নদীর জলক্ষেত্র ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রশ্নের মুখে পড়বে আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ।

এই প্রেক্ষাপটে দেওচা-পাঁচামির স্থানীয় মানুষসহ সমস্ত গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষকে দেওচা-পাঁচামিতে প্রস্তাবিত খোলামুখ কয়লাখনি প্রকল্পের বিরোধিতা করার অনুরোধ জানানো হচ্ছে। দেওচা-পাঁচামির স্থানীয় মানুষদের প্রকল্পবিরোধী আন্দোলনের পাশে দাঁড়ান। একইভাবে দেওচা-পাঁচামিতে স্থানীয় প্রশাসন মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে, ভয় দেখিয়ে এবং পুলিশি অত্যাচার চালিয়ে স্থানীয় মানুষকে চুপ করাতে এবং সম্মতি আদায় করতে চেষ্টা করছে। একে ধিক্কার জানান এবং প্রতিহত করুন।

 

সংগ্রামী অভিনন্দনসহ,

জল জঙ্গল জমিন ও আদিবাসী বাঁচাও আন্দোলনের পক্ষে প্রচারিত

 

Share this
Leave a Comment