মাতৃত্বের কারণে ট্যুরে না গেলে, ছোট বাচ্চার দেখভালের জন্য বেশি ওভারটাইম করতে না পারলে, শিশুর অসুখে ছুটি নিতে হলে, সেই কারণ দেখিয়ে বছরান্তে মূল্যায়নে মাইনে বাড়া স্থগিত থাকবে, প্রমোশন পিছোনো, তেমন ক্ষেত্রে ছাঁটাই কিংবা ট্রান্সফার। শুধু মেয়ে হবার কারণেই মজুরি বৈষম্য: ২০২৪ সালের মন্সটার স্যালারি ইন্ডেক্স (MSI) বলছে ভারতে লিঙ্গ বেতন বৈষম্য গড়ে ২৭%, আইটি/বিপিও এইসব সার্ভিস সেক্টরে ২৬%। লিখলেন ঊর্মিমালা।
Groundxero | March 19, 2025
গত বছরের ঘটনা দিয়ে শুরু করি। ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের প্রাক্তনী পুনর্মিলন উপলক্ষে একটা সেমিনার এবং খাওয়া-দাওয়া। এক অধ্যাপক বললেন, “শোন, কয়েক জন ছাত্রীর নাম বলতো যারা মঞ্চে অতিথিদের হাতে ফুল-স্মারক ইত্যাদি দিতে-টিতে পারে।” মানে “থালি গার্ল ” চাইছেন আর কি। “শুধু মেয়েরা কেন স্যার? ছাত্ররা থাকলে ক্ষতি কি?” স্যার বললেন, “মঞ্চের ঐসব কাজটাজ ছাত্রীরাই বেটার পারবে। ছাত্র কয়েক জন লাগবে ওই প্রজেক্টর, প্রেজেন্টেশন, ল্যাপটপ সাউন্ডওয়্যার ইত্যাদি মানে টেকটিক্যাল দিকটা দেখতে।” অধ্যাপক নিজে শুধু যে ডিগ্রিধারী ইঞ্জিনিয়ার তাই নন, প্রাক্তন একজন বাম বিপ্লবী রাজনীতি করা লোক। ঘরোয়া সম্মিলনী সভা হোক কি ফাইভ ষ্টার হোটেলে কনফারেন্স, মেয়েরাই কাপে কাপে চা ঢেলে দেবে, বিস্কুট এগিয়ে দেবে। ফুল দেবে, উত্তরীয় পরাবে ইত্যাদি! বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটাই সার্বিক বাঙালি মধ্যবিত্ত মানসিকতা। একজন অধ্যাপকের বাম-বিপ্লবী অতীতও সেই মানসিকতা বদলাতে পারেনি।
এই তো সেদিন চন্দ্রায়ণ-থ্রি অভিযান সফল হলে, বিশেষত খুশি হলাম যখন ইসরো-র মহিলা বিজ্ঞানী খবরের শিরোনামে এলেন। কিন্তু খবরে বড্ডো প্রকট ভাবে বারবার করে দেখানো হল সেটা হচ্ছে এঁরা সকলে শাড়ি, মঙ্গলসূত্র, সিঁদুর, টিপও পরেন, রুটিও বানান আবার রকেট সাইন্স-ও চর্চা করেন। প্রধানমন্ত্রী থেকে বহুজাতিক কোম্পানির সিইও থেকে আমার প্রতিবেশী সকলের সমবেত নারী শক্তির জয়গানে আকাশ বাতাস ভরে গেল। ব্যস সাধারণ আর বাকি নারীদের কপাল পুড়লো। ভবিষ্যতে এঁদের উদাহরণ দিয়েই বলা হবে, ওইতো ওঁনারা কেমন সবকিছু একসঙ্গে সামলাচ্ছেন, তুমি পারো না কেন? চাকরি কর, রাজনীতি কর, প্রতিবাদ কর। সংসার মেয়েদের যেন করতেই হবে। তাই ওই খবরেও এই বস্তাপচা ধারণাকেই প্রতিস্থাপিত করা হল যে বিবাহিত মেয়েদের কান গলা হাত খালি রাখা যাবে না।
অতএব ডাক্তার হও, ইঞ্জিনিয়ার হও, কি পাড়ার মস্তান, যাই হও গে যাও শুনতে হবেই :
– অমুক মেয়ে তো দিব্যি হাতকাটা ব্লাউজ-মিনি স্কার্ট পরে আবার সন্তোষী মার উপোসও করছে, তুমি পারো না কেন?
– তোমার তমুক আত্মীয়া তো পেশায় ডাক্তার অথচ কি সুন্দর চওড়া করে সিঁদুর দেয়, তোমার এতো সমস্যা কিসের?
অধ্যাপিকা ননদের সঙ্গে ধনতেরাসে যাও কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু মুখের ওপর যদি বলে বসো এসব করবো না, তাহলে পায়ের তলার মাটিতে ভূমিকম্প শুরু হয়। সুতরাং ঝামেলা এড়াতে নিজের চিন্তা চেতনা শিকেয় তুলে পরে নাও ভণ্ডামির মুখোশ। টিপ গয়না যত বেশি কিনুন পরুন, সমাজে সেটা স্বাভাবিকত্বের লক্ষণ ধরা হবে। কিন্তু না পরলে সেটা খাপছাড়া অবাধ্যতা। আসলে অফিস যাও, লেট পার্টিতে যাও, যা ইচ্ছে পরো-খাও-ফুর্তি করো, বাড়িতে চুপচাপ ঘোমটা টেনে নারায়ণের সিন্নি দাও, সমাজ তোমায় দশভুজা বলবে। মোট কথা সিস্টেম যেখানে যা চাইছে সেখানে তোমাকে সেভাবে খ্যামটা নাচতে হবে। এটাই ভারতীয় রক্ষণশীলতার নয়া চেহারা।
তা সেই চন্দ্রায়ণ-থ্রি অভিযানের হইচইয়ের আড়ালে যে তথ্যটা শিরোনামে এল না তা হল,1969 থেকে আজ অবধি ইসরো-এ একজনও মহিলা চেয়ারম্যান হননি। দেশের আইআইটিগুলোর একটাতেও ১৯৫০ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত একজনও মহিলা ডিরেক্টর ছিলেন না। তাছাড়া নাট্যদলে বা কোম্পানিতে কি ইউনিভার্সিটিতে, একজন নারীকে প্রধান পদে বসালেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংগঠনটার পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা নির্মূল হয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
২০০৩ সালেও আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের এক অধ্যাপক প্রকাশ্যেই বলতেন, মেয়েদের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আসা মানে একটা সিট নষ্ট করা। কলেজের ফাইনাল ইয়ারে, শিক্ষক থেকে শুরু করে অভিভাবক, শুভানুধ্যায়ী সকলে একসুরে বলেছিলেন, কোর ইঞ্জিনিয়ারিং মেয়েদের জন্য উপযুক্ত না, তাদের সফটওয়্যার কোম্পানিতে যাওয়াই ভালো কিংবা শিক্ষকতা। হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যাল কলেজে ক্যাম্পাসিং-এ এলো। প্রতি ডিসিপ্লিন থেকে মাত্র একজন নেবে। ঠিক আছে, তাই সই। স্যাররা বলেই দিলেন, শুধুমুধু বসছো একজন নেবে, ফলে মেয়েদের নেবার কোনো চান্সই নেই। কোম্পানির রিটেন টেস্ট-এ পাশ করে ইন্টারভিউয়ে ডাক এলো। মৌখিক পরীক্ষায় মেয়েদের কোনো টেকনিক্যাল প্রশ্ন করাই হলো না! বলা হল, বিয়ে করলেই তো হলদিয়া ছেড়ে পালাবে, তোমাকে কেন ট্রেনিং দেবো? তাছাড়া মেয়েদের জন্য শৌচালয় ইত্যাদি পরিষেবা প্লান্ট-এ নেই। কেউ বললেন, এটা কিন্তু ডেস্ক-জব নয়, নিয়মিত প্লান্টের যন্ত্রপাতি ইন্সপেকশন-এ যেতে হবে, মই বেয়ে উঁচু প্লাটফর্মে উঠতে হবে, লেবার সামলাতে হবে, বুঝতে পারছো না বিষয়টা সহজ নয়। এক রসিক ইন্টারভিউয়ার বললেন, গরম ফার্নেসের আশেপাশে কাজ করে গায়ের রং পুড়ে গেলে কিন্তু বিয়ে হবে না, ভেবে দেখো। অতএব কম নম্বর পেয়েও ছাত্ররা বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে চান্স পেয়ে গেলো।
রূঢ় সত্যি হল, ১৯৭৪ সালে জেআরডি টাটাকে চিঠি লিখে একজন সুধা মূর্তির চাকরি জুটলেও তাতে করে দেশের সার্বিক মানসিকতার কোনো পরিবর্তন আসে না, বাকি ৯৯টি সাধারণ মেয়ের অবস্থারও কিছু উন্নতি হয় না। এহেন মেয়েরা কলেজে ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ পাস করলে বলা হত, “আরে ওকে দেখেই তো প্যানেল ধরাশায়ী হয়ে গেছে!” সেই একই জিনিস লক্ষ্য করলাম, অফিসে ঢুকেও। মেয়েরা তাড়াতাড়ি প্রমোশন পেলে, বিদেশ যাবার সুযোগ পেলে, সহকর্মীদের মধ্যে গুজগুজ ফুসফুস।
এমনকি সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের গণতান্ত্রিক কর্মীদেরও একই মানসিকতা।
মেয়েরা সাধারণত অংক পারে না, বিজ্ঞান ভালোবাসে না এমন একটা ধারণা বাতাসে ভেসে বেড়ায় – এমনকি বহুজাতিক কোম্পানির ঝকঝকে বাতানুকূল অন্দরমহলেও। অফিসে এক সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার-এর ক্যালকুলেশনে ভুল ধরিয়ে দেবার পর তিনি আর কখনোই আমার সঙ্গে কথা বলতেন না। অন্যের কাছে নানান বদনামও করতেন।
আত্মজীবনীতে রমনিকা গুপ্ত লিখেছেন, নারীর সিনিয়রিটি বা শ্রেষ্ঠত্বও মেনে নিতে বাধ্য হলে পুরুষরা একরকম প্যাসিভ অ্যাগ্রেসিভ হয়ে ওঠে। আমার অভিজ্ঞতাও তাই। তাহলে কি মেনে নিতে হবে, সংসার হোক কিংবা কর্মক্ষেত্র, সংগঠন, দল, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র কি রাজনৈতিক ক্ষেত্র, “নারী কেবল আঁকড়ে থাকা লতা হয়েই শীর্ষে পৌঁছাতে পারে”?!
সেবার অফিসের কাজে একই ফ্লাইটে বিদেশ যাচ্ছি আমি এবং এক পুরুষ সহকর্মী। এয়ারপোর্টে ঢুকে চেক-ইন ইত্যাদির ঝামেলা মিটলে ফ্লাইট ছাড়ার আগে সহকর্মীটি বৌকে ফোনে যখন অনুযোগ করছে ঠিক করে হ্যান্ডব্যাগটা গোছাওনি, চশমাটা কখনো ওই পকেটে দেয় ইত্যাদি, আমার তখন মাথায় ঘুরছে, বাড়িতে আগামী পাঁচ দিনের মত বাচ্চার পায়ের নখ থেকে চুল, সকালের দুধ, টিফিন থেকে রাতের খাবার সব কিছু রেখে এসেছি। কিছু ভুলে গেলাম না তো। কেউ কিছু খুঁজে না পেলে, এরমধ্যে আয়া কামাই করলে কিংবা বাচ্চার অসুখ হলে কি হবে! ওদেশে গিয়ে দিনে যত ঘন্টাই কাজ করতে হোক না কেন, অফিসের কাজটা পাঁচ দিনে শেষ করতেই হবে। তার পরেও লেপ্টে থাকে মানসিক অপরাধবোধ। ফলে সহকর্মীটি যখন নতুন দেশ এক্সপ্লোর করছে আমি নাক গুঁজে ওভারটাইম করে কাজ শেষ করছি।
মা হবার পর যতবার অফিস ট্যুরে যেতে হয়েছে, সিনিয়র থেকে জুনিয়র নির্বিশেষে প্রশ্ন একটাই।
– বাচ্চাকে ছেড়ে থাকতে তোর কষ্ট হবে না?
– নিশ্চয় করবে। কিন্তু এত ভালো একটা কাজের সুযোগ ছেড়ে দেওয়া যায়? তাছাড়া একটা নতুন দেশ দেখতেও ইচ্ছে হচ্ছে।
কেউ বললেন “এইটুকু ত্যাগ করতে পারবে না তো মা হয়েছো কেন?”
অফিসের বস বললেন – বাব্বা আজকালকার মায়েরা! বেচারা বাচ্চাগুলোর কি কপাল!
বললাম – বেশ তো অফিস যদি ব্যবস্থা করে দেয়, অ্যালাউয়েন্স দেয় আমি তো সানন্দে শুধু বাচ্চা কেন, আরো যত জনকে পারি সঙ্গে নিয়ে যেতে চাই।
অথচ মাতৃত্বের কারণে ট্যুরে না গেলে, ছোট বাচ্চার দেখভালের জন্য বেশি ওভারটাইম করতে না পারলে, শিশুর অসুখে ছুটি নিতে হলে, সেই কারণ দেখিয়ে বছরান্তে মূল্যায়নে মাইনে বাড়া স্থগিত থাকবে, প্রমোশন পিছোনো, তেমন ক্ষেত্রে ছাঁটাই কিংবা ট্রান্সফার। শুধু মেয়ে হবার কারণেই মজুরি বৈষম্য: ২০২৪ সালের মন্সটার স্যালারি ইন্ডেক্স (MSI) বলছে ভারতে লিঙ্গ বেতন বৈষম্য গড়ে ২৭%, আইটি/বিপিও এইসব সার্ভিস সেক্টরে ২৬%।
কেউ বললেন – আচ্ছা আপনার বর, শ্বশুর-শাশুড়ি, ওনারা এটা মেনে নিলেন?
– কেন মানবে না। বর যখন বিদেশে যায় আমিও তো মেনে নিই। আর আপনিও তো আপনার বৌয়ের বাচ্চা ডেলিভারির পরদিনই তাঁদের ছেড়ে ট্যুরে গেলেন, তখন?
কেউ বললেন – আমার বাচ্চার তো মা ছাড়া চলেই না। জন্মে অবধি মার হাতে ছাড়া অন্য কারো হাতে খাবে না, কারো সাথে শোবে না।
বৌমার, অর্থাৎ আমার, এহেন শখ পূরণ করতে দেওয়ায় আমার পিতৃকুল তো শ্বশুরবাড়ির আজন্ম অনুগত ভৃত্য হয়ে পড়লেন। ক্রমে অবশ্য যখন দেখা গেলো, বিলেত ফেরত মেয়ে বা বৌমার একটা সামাজিক দাম তৈরী হচ্ছে, তখন ওপক্ষের উৎসাহ আমার আগ্রহকেও ছাপিয়ে যাবার উপক্রম।
কেউ বললেন – মায়েদের মত বাচ্চা সামলাতে বাবারা কখনো পারে নাকি!
–কেন পারবে না? খোঁজ নিয়ে দেখুন বহু বাবা-ই পারেন।
সন্তানের রেজাল্ট খারাপ হলে, এমনকি জ্বর সর্দি স্বাস্থ্য খারাপ হলেও অবধারিত ভাবে দায়ী মা। মনের মধ্যে এটাই গেঁথে দেওয়া হয়েছে যে আসলে মা মানেই অতিমানবী। দক্ষিণ হোক বা বাম, উগ্রতার গোঁড়ামি নিয়ে দু’পক্ষই ভারতীয় মায়েদের চূড়ান্ত অস্বাভাবিক একটা আদর্শ মূর্তি খাড়া করে।
আর সেই নির্মিত আদর্শের সঙ্গে তাল মেলাতে হিমশিম খায় বাস্তবের রক্ত মাংসের নারীরা। অভিনেত্রী কেতকী দত্তের স্মৃতি চারণায় পাই, “আমার দুটো সত্তা। আমি অভিনেত্রী কেতকী দত্ত। তারপর আমি কারো মা, কারো ভগিনী, কারো স্ত্রী। কিন্তু ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সংঘাত এখানেই যে তারা বলছে – তুমি আগে আমাদের মা। তারপর তুমি অভিনেত্রী। কিন্তু আমি বলছি – আগে আমার অভিনেত্রী সত্তা, তারপর আমার মাতৃসত্তা। এই দুটো সত্তা আমার মধ্যে ঝগড়া করে; প্রচন্ড লড়াই চলে কেতকী এবং কেতকী দত্তের মধ্যে।” এটা শুধু একজন অভিনেত্রীর বা একজন মেয়ের সমস্যা নয়। প্রতিটি মানুষের ভিতরেই থাকে এরকম ভিন্ন সত্তার সমাহার। তাই যেকোনো কৃত্রিম বাঁধনের শেকলেই নড়তে চড়তে ব্যথা লাগে।
চাকরি করলে তবু টাকা দিয়ে, উপহারের উৎকোচ দিয়ে মুখ একটু বন্ধ করা যায়, অফিসের কাজে বা ভোজে দেরির একটা সামাজিক মান্যতা এসেছে।
বাজারের স্বার্থে উপার্জনকারী নারী এখন বিগ হিট। মানে পকেটে দেদার পয়সা থাকলে সামাজিক সম্মতিও কিনতে পারা যায়। কিন্তু রাজনৈতিক মিটিং, মিছিল, আন্দোলনে? বনের মোষ তাড়ানো বিনে পয়সার কাজে সমর্থন পাওয়া বিরল ব্যতিক্রম।
বিয়ের পরপর, রং তুলি কিনতে গিয়েই শিখেছিলাম নতুন পাঠ: কদিনের তো শখ, ওসব কিনে আবার কেউ পয়সা নষ্ট করে নাকি! পুরোনো ট্রাঙ্ক থেকে বেরোলো ঝুলে ঢাকা দেওরের ছোটবেলার স্যাঁতাপড়া রং তুলি। গয়না-শাড়ি যত খুশি যত বেশি দামি কেনো, কারোর কোনো আপত্তি নেই। তার সামাজিক মূল্য আছে, সবাই বলবে দেখতো এতো উদার শিক্ষিত শ্বশুরবাড়ি কজনে পায়! তাও মন ওঠে না! কি মেয়েরে বাবা! এঁদের কি করে বোঝাবো যে, আমার শাড়ি গয়না চাই না, রং চাই, তুলি চাই, সকালে দেরি করে ঘুম থেকে উঠতে চাই।
গত মাসে কলকাতা শহরের সাংস্কৃতিক পীঠস্থান হিসেবে খ্যাত একটা স্কুলের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় বিচারক হয়ে গেছি। সেখানে একটি বাচ্চা ছেলে এগিয়ে আসতেই বিশিষ্ট বিচারকদের সেকি উচ্ছ্বাস! প্রতিযোগিতা শেষে জিজ্ঞাসা করতে সকলেই সমস্বরে বললেন, “ওকে চেনো না! সেকি!” তারপর যা জানলাম যে, বাচ্চাটি একটা জনপ্রিয় টিভি টক শো-তে নিজের মাকে বলেছে, “তোকে এত করে বলি সিঁদুর পর, শাঁখা পর। তুই কিছু পরিস না বলে তোকে কেউ মা বলে বুঝতে পারছে না।” আর সেখান থেকেই সে হয়ে উঠেছে শহরের সকলের হার্ট থ্রব। তার এই রকম এঁচোড়ে পাকা মান্ধাতার আমলের মন্তব্য শোনার জন্য চ্যানেলগুলোর মধ্যে কাড়াকাড়ি হয়। শিহরিত হলাম। সহ বিচারকরা সকলেই চিন্তায় অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। অথচ যে কথা বলার জন্য শিশুটিকে বোঝানো উচিত ছিল যে যেটা বলছো সেটা কতো বড় ভুল, সেখানে উল্টে বিদ্যজনেরা পুলকিত হলেন, দুষ্টু মিষ্টি পাকা ছেলে বলে গাল টিপে দিলেন। ফলে বাচ্চাটা জনপ্রিয় হয়ে আরো শয়ে শয়ে শিশুকে ও তাদের পরিবারকে অনুপ্রাণিত করছে, মায়েদের সংজ্ঞা রচনা করছে। বড় বিপদ এখানেই।
আমাদের বিকৃত সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিচ্ছবিই দেখা যায় এই জনপ্রিয় টক শো, সিরিয়াল, প্রচার ও সমাজ মাধ্যম, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ও তাদের স্টার কালচার, বিজ্ঞাপন, গল্পে, উপন্যাসে। তেমনি এদের ব্যবহার করেই আবার ভাবধারার প্রচার ও সামাজিক মানদন্ড রক্ষিত থাকে। জনপ্রিয়তা নির্মিত হয় বাজারের স্বার্থে এবং সাহায্যে।
আমার এক বান্ধবী শিশুদের নিয়ে কাজ করেন, সেখানে তাঁকে শাড়ি পরে আসতে বলা হয় এইকারণে যে আঁচল না পেলে শিশুরা নাকি বাড়ির মায়ের অভাব বোধ করে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। বলা হয় স্কুলের কোনো অনুষ্ঠানে দয়া করে বরকে আনবেন না, কারণ সিঁদুর-টিপ না পরার ফলে শিশুরা ভাবে আপনি অবিবাহিতা।
মনে আছে, প্রথম সিঁদুর পরা বন্ধ করতে সবার আগে নিজের নাস্তিক প্রগতিশীল মা বাবা-ই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, এটা প্রমান করতে যে সিঁদুর পরেও নাস্তিক প্রগতিশীল এমনকি কম্যুনিস্ট পর্যন্ত হওয়া যায়। তারওপর যেখানে শ্বশুরবাড়ি অমন উদার, চাকরি করা পর্যন্ত মেনে নিয়েছে! সেখানে একটু সিঁদুর দিলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে!? শুনতে হয়েছিল পারিবারিক শান্তি রক্ষা করার জন্য অন্যের মনে আঘাত দেওয়ার মত নিষ্ঠুর কাজ আর কিছু হতে পারে না। কারুর বিশ্বাসে আঘাত দেওয়া যদি অপরাধই হয়, তাহলে সেই একই যুক্তিতে কিন্তু অবিশ্বাসীদের বিশ্বাসেও আঘাত করাটা অন্যায়। মোদ্দা কথা, লোকে কি বলবে! মালিনী ভট্টাচার্যের লেখায় পাই, “১৯৮৯ সালেও কিছু কমরেড মনে করতেন, প্রচারের সময় সিঁথিতে সিঁদুর না দিলে প্রতিপক্ষ আমার নামে কুৎসা রটাবে।”
আমার অনেক পরিচিত পুরুষকেই নানাভাবে বলতে শুনি, “আমি কিন্তু আমার বৌকে সব সুযোগ সুবিধে দিই। ওতো দিব্যি একসঙ্গে সংসার, চাকরিও সামলাচ্ছে আবার রাজনীতিও করছে।” মানে বলতে চায়, বাড়তি কিছু পেতে গেলে নারীকে হতেই হবে কিছু অতিমানবিক ক্ষমতার অধিকারিণী। কিন্তু কোন যুক্তিতে স্বাভাবিক অধিকারটুকু পাওয়াকে কেন বদান্যতা বলে মেনে নিতে যাবো বলতে পারেন? কোন যুক্তিতে বৈষম্য ঢাকতে দ্বিগুন তিনগুন খেটে মরবো? আসলে পিতৃতন্ত্রকে প্রগতিশীলতার মুখোশ পরিয়ে কিছুটা সহনীয় করে, নারীদের সম্মতি অর্জন এবং অতিরিক্ত সার্ভিস আদায় করে নেওয়াটা একটা ফাঁদ।
বহিরঙ্গে মেয়েদের হতে হবে রূপে গুণে গতানুগতিক অর্থে নিখুঁত। এটাই সাংস্কৃতিক স্বৈরাচার। চুল পাকছে এবং রং লাগাচ্ছি না। সকলেই বিরক্ত। উপদেশের বন্যা। সদ্য আলাপ হতেই এক কবি বললেন:
– চুলে রং করেন না কেন?
– ভালো লাগে না।
– আপনার বর কিছু বলে না?
– চুলটা আমার, বরের নয়।
– বাব্বা ধানিলঙ্কা!
এক বাম নেতা বললেন, “একদম ইন্দিরা গান্ধীর মত লাগছে!” ব্ল্যাক লিস্টে নাম উঠে যাবে জেনেও বলতে হল, “কি আশ্চর্য! আপনারও সুভাষিণী আলী কিংবা মেধা পাটকরের কথা মনে পড়লো না! তাই না!” বাড়িতে আমি রান্না করি না, বর-ই করে, শুনে এক পুরুষ কমরেডের মুখ শুকিয়ে যেতে দেখেছি।
প্রথমে শুরুটা হয় মিষ্টি করে, আহা চওড়া করে সিঁদুর পড়লে যেন মা দুর্গা মনে হয়! চোখ জুড়িয়ে যায়! অথচ সেই দুর্গাদের, মানে বাড়ির মেয়ে-বৌদের নাম বংশ লিপিতে উহ্য থাকাই রেওয়াজ। যত মেনে নেবে তালিকা তত দীর্ঘ হতে থাকবে: সাতসকালে বাসি কাপড় ছাড়া, এঁটো মানা, পঞ্জিকা মেনে ব্রত উপোস, সন্তান ধারণ, বাড়ি থেকে ঢোকা বেরোনো, গর্ভধারণের সাথেসাথেই মাদুলি, নিরামিষ খাওয়া ইত্যাদি। সদ্যজাত কন্যাসন্তানের গায়ের রং কিংবা একটু বেশি লোম, নাক যথেষ্ঠ টিকালো হল কিনা, রং যথেষ্ঠ উজ্জ্বল হল কিনা, চুল ঘন হয়নি ইত্যাদি – এসব নিয়ে আজও সমাজ বড়োই ভাবিত। সেখানে প্রগতিশীল অপ্রগতিশীলে কোনো ফারাক নেই।
স্বীকার করি পরিবার, গণসংগঠন, কৌম এসবের মধ্যেই কিছু ইতিবাচক দিক ঐতিহাসিক ভাবেই আছে। আছে মনুষ্যত্ব, ভালোবাসা, যৌথতার উৎস। তাই সব কিছুকেই অস্বীকার করাটা মূর্খামি। কিন্ত বহু সময়েই আমাদের মনে থাকে না যে ঐতিহ্য মাত্রেই স্বতঃসিদ্ধ ভাবে ভালো বা খারাপ নয়। গর্ব করার মত অসংখ্য ঐতিহ্যের পাশেই রয়েছে অজস্র কুআচার, কুপ্রথা, পশ্চাদপদতা। যেমন নৃতত্ত্বের সাধারণ জ্ঞানটুকু থাকলেও জানা যায় যে শাঁখা লোহা সবই শৃঙ্খলের প্রতীক মাত্র। কিংবা আচরসর্বস্ব বিয়ের অনুষ্ঠানটাকেই ধরা যাক: কন্যাদান, লজ্জাবস্ত্র, পানপাতা দিয়ে মুখ ঢাকা, গাঁটছাড়া, সিদুঁর দান, সংস্কৃত মন্ত্র, স্ত্রী আচার: প্রত্যেকটার পিছনে আছে অবমাননার দীর্ঘ পরম্পরা। কিন্তু সপক্ষে যাঁরা, তাঁরা বলবেন, এতো রোমান্স তো রেজিস্ট্রি বিয়েতে নেই, কেউ বলবেন, এত ফটোজিনিক! অথচ সত্যি বলতে ভারতের বিপুল সংখ্যক জনজাতির বিস্তৃত ঐতিহ্যের যেটুকু প্রচলিত ভারতীয়ত্বের ধারণায় স্থান পায়, সেটা আমাদের সাধারণ জ্ঞানের মতোই সীমিত।
কিছুদিন আগে কোনো লিটল ম্যাগাজিনে নিজের লেখা একটা প্রবন্ধ ছাপার পর পড়তে গিয়ে লক্ষ্য করলাম বেশ কিছু জায়গায় আমার অনুমতি না নিয়েই সম্পাদক বাক্য গঠন বদলে দিয়েছেন। জিজ্ঞাসা করতে উত্তর পেলাম, আমার ভাষাটা নাকি বেশি গরম ছিল, সেটাকে মোলায়েম করতেই উনি সম্পাদনা করেছেন। কারণ তাঁর মনে হয়েছে যে একটি মেয়ের কলমে ঐসব কথা পাঠকদের কটু লাগবে। যেখানে লিটল ম্যাগাজিনের ঐতিহ্যই প্রতিবাদে মাথা তোলা সেখানেও ভাষাকে কেন তুলতুলে নরম হতে হবে সেকথা আমার বোধগম্য হয়্ররনি। নাকি নারী বলেই! তাছাড়া মেয়ে হয়ে কবিতা লেখ চলবে, কিন্তু গুরু গম্ভীর প্রবন্ধ লিখলে শুনতে হবে, ওসব তো ওর বাবা লিখে দেন।
জ্ঞান দিয়ে অজ্ঞানতা দূর করার কথা ভাবি, বাস্তবে সেই জ্ঞানের অলিন্দেরই আনাচে কানাচে জমে থাকে কত অন্ধকার! মেয়েদের পূর্ণ মানুষ হিসেবে মনে করতে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা সত্যি কতটা প্রস্তুত? ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মতে, এই বিদেশী ধারণা অফ সেক্স ইকুয়ালিটিই পারিবারিক অসুখের একটা কারণ। অবলীলায় শকুন্তলাকে ব্যভিচারিণী বলে বসেছিলেন নীরদ সি চৌধুরী। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় একসময় বলেছিলেন যে মেয়েরা আবার কবিতা লিখবে কি! সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় লিখে ফেলেন, জীবন যেন বাঁজা মেয়ের গায়ে বেনারসি। অপূর্ব! ফুকোর আলোকপ্রাপ্তির ব্যর্থতার এমন উদাহরণ আমাদের ঘরে বাইরে অজস্র।
আমরা বক্তৃতায় নোয়াম বক্ত চমস্কি উদ্ধৃত করি, কিন্তু জীবনে বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব পালন করি না। কারণ স্রোতের বিপরীতে গেলেই সমাজে কোণঠাসা হয়ে যাবার আশংকা থাকে। তাই কেউ স্রোতে ভেসে যান আর কেউ এড়িয়ে নীরব থাকাকে বেছে নেন। কেউ উত্তরাধুনিক অদৃষ্টবাদী।
বেশিরভাগ ইন্টেলেকচুয়াল পুরুষই ভীষণ ভাবেই মনে করেন, নারীরা রয়েছেন তাঁদের খিদমত খাটতে। বাড়িতে বৌরা, বাইরে ইন্টেলেকচুয়াল মেয়েরা। তারা ফাইল গোছাবে, প্রবন্ধ-বক্তৃতা ইত্যাদি টাইপ করে দেবে, রিসার্চ করে তথ্য সংগ্রহ করে মুখের সামনে ধরে দেবে, হিসেব রক্ষক হবে, একরকম বিনি মাইনের সেক্রেটারি। বা তারও বেশি। হতাশার মধ্যে নারীরা তাঁদের প্রেরণা হবে, মিষ্টি মিষ্টি আশার বাণী শোনাবে। পথ চেয়ে অপেক্ষা করবে। তাঁদের লেখা গল্প কবিতার শ্রোতা হবে। নারী হবে একটা এমন আয়নার মতো, সেখানে নার্সিসিস্ট আত্মমগ্ন পুরুষ নিজের দুগুণ তিনগুন প্রতিফলন দেখতে পাবে। আর সেজন্যই কেউ নিজের অতীত কীর্তির সাতকাহন শুনিয়ে শুনিয়ে উত্যক্ত করে ছাড়বেন। প্রতিটা মিটিং শেষে বাড়ি ফিরেই মহিলা কমরেডকে ফোন করে শুনতে চাইবেন জনতার প্রতিক্রিয়া। শ্রোতার আগ্রহ বা সময় আছে কিনা সেটা নেহাত সেকেন্ডারি বিষয়। চুপিচুপি বলে রাখি, এক্ষেত্রে বাঁচবার সহজতম উপায় অপ্রিয় সত্যিটা মুখের ওপর বলে দিন, অর্থাৎ বক্তৃতাটা অতি খাজা হয়েছে। দ্বিতীয়বার ফোন করার আগে দশবার ইতস্তত করবে।
অফিসে পার্টিতে সংগঠনে মেয়েরা শুধু যেন সুসজ্জিতা হয়ে শোভা বর্ধন করার জন্যই আছে, অথবা সেখানকার গৃহস্থালি দেখাশোনা করা। স্বাধীন মতামত দেওয়া তাদের এক্তিয়ারে পড়ে না। সৃষ্টিশীল কাজগুলো কিংবা তত্ত্ব গঠনতন্ত্রের আলোচনা, কৌশলগত পরিকল্পনা বা দিকনির্দেশ, ওদিকটা পুরুষরা দেখবেন। মেয়েরা শুধু নোট নেবে, ড্রাফট করে দেবে। পুরুষরা সেটা রিভিউ করে নিজের নাম দিয়ে উপরওয়ালাকে পাঠিয়ে পিঠ চাপড়ানি পাবেন। রোজা লুক্সেমবার্গকে কার্ল কাউটস্কি চেয়েছিলেন নিজের নামে কিছু পেপার প্রস্তুত করে দেবার মত একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে। তাঁর প্রতি রোজা-র পরামর্শ ছিলো, টাইপ রাইটার কিনে, স্ত্রীকে টাইপ শিখিয়ে নিতে। নারীদের সূক্ষ অনুভূতি, চিন্তন ক্ষমতাকে গুরুত্ব দেবার আবার কোনো প্রয়োজন থাকে নাকি। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও কখনো জানতে চাননি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ভাবনা কিংবা লেখালেখির খবর।
নাট্যদলের একজন সর্বসময়ের নিবেদিত প্রাণ নারী সদস্যের প্রশংসা করতে গিয়ে বলা হল, বিয়েটিয়ে হয়নি বলেই না এতকিছু করতে পারছেন। আবার বিবাহিত এবং মা হয়েও যদি দলে প্রচুর সক্রিয়তা দেখান, সেক্ষেত্রে শুনতে হবে, “তোমায় বাড়িতে কোনো কাজ করতে হয়না, তাই না? রান্নার লোক রেখেছ বুঝি?”
সেসঙ্গে যেখানেই যে রূপে যাও, বয়স যাই হোক না কেন, নারী সব সময়েই অমুকের মেয়ে, তমুকের স্ত্রী। ক্ষেত্রবিশেষে মা কিংবা পুত্রবধূ। চল্লিশোর্ধ নারীকেও সংগঠনে যোগ দিতে গিয়ে শুনতে হয়, “বাড়িতে জানিয়েছেন তো?” সত্তোরোর্ধ প্রতিষ্ঠিত নাট্যকর্মীকেও শুনতে হয় তমুকের প্রাক্তন স্ত্রী। ওটাই তোমার সামাজিক পাসপোর্ট। কে তোমার মালিক, সেটা স্থির থাকা চাই।
বামপন্থী কমরেডদের মুখেই শুনতে হয়, মহিলা সমিতির মিটিঙে চিরকাল শুধু খালি ওই শাড়ি গয়নার গল্প, পরনিন্দা পরচর্চা আর শ্বশুরবাড়ির নিন্দামন্দ হয়। মেয়ে মানেই ন্যাকাপনা, সাজগোজ, পিএনপিসি এমন একটা ধারণা যেন সকলের অবচেতনে ঢুকে গেছে। অথচ আমার অভিজ্ঞতা বলছে যে, পরনিন্দা পরচর্চা পুরুষরাও কিছু কম করেন না। দেখা হলেই সবার আগে চেহারা, চুল আর পোশাক নিয়ে মন্তব্য পুরুষরাও সমপরিমানেই করে থাকেন।
অতিবাম রাজনীতির ক্ষেত্রেও এক চিত্র। নকশালবাড়ি আন্দোলন সম্পর্কিত আলোচনাগুলোও দেখা যাবে প্রধানত পুরুষকেন্দ্রিক পরিসরে সীমিত থাকে। নারীদের স্মরণ করা হয় মূলত শহীদদের পার্শ্ব সহচরী, প্রেমিকা, বৌ বা মা হিসেবে। সেখানেও বিপ্লবে-আন্দোলনে পুরুষ কখনো হয়তো ভালোবাসার নারীকে নদী, ফুল, পাখির পরিবর্তে দেখতে চেয়েছে বন্যা, বজ্র বা ঝড় রূপে, কিন্তু সেও শুধু বিপ্লবী পুরুষকে সংগ্রামের প্রেরণা দেবার প্রয়োজনে। কিন্তু পাদপ্রদীপের আড়ালে রয়ে যায় সহযোদ্ধার সমমর্যাদায় নারীদের সে সংগ্রামে অংশগ্রহনের কথা।
ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ আঁকার অভিজ্ঞতা বলি। সম্পাদক নাছোড়বান্দা, দিতেই হবে ইত্যাদি। তাগাদার পর তাগাদা। কিন্তু পাঠাবার সাথে সাথেই বললেন, মুখগুলো বাঙালিদের মত হয়নি, টুপিগুলো শিরোস্ত্রান মনে হচ্ছে। অন্যকিছু এঁকে দাও। আবার আঁকলাম। দুটো ছবি পেয়ে, তিনি মত বদলালেন এবং প্রথমটাই নিলেন। কিন্তু ছবিটিকে বিকৃতভাবে ইচ্ছে মত ক্রপ করে, অংশবিশেষ। বাধ্য হয়ে বলতে হল, যে এতে ছবির অর্থ বদলে যাচ্ছে। হয় পুরোটা নিন, নাহলে সানন্দে ওর বদলে অন্য কাউকে দিয়ে পছন্দমত করিয়ে নিন। আধা ঘন্টা ধরে তিনি নানান কুযুক্তি প্রয়োগ করতে লাগলেন, যে তাঁর ওই ক্রপ করা ছবিটি কতজন প্রশংসা করেছে ইত্যাদি। একসময় কড়া করে বলতে বাধ্য হলাম, আমি নিজে যেচে তার পত্রিকায় প্রচ্ছদ করতে চাইনি বা টাকা নিয়ে ছবিটি তাঁকে বিক্রিও করিনি। সুতরাং ছবিটা নিয়ে তিনি যা ইচ্ছে করতে পারেন না। এতে তাঁর মনে হল মহিলাটির কথাবার্তা যথেষ্ঠ নম্র নয়। সবচেয়ে ইন্টারেষ্টিং হল, এরপরেও পরবর্তী সংখ্যার জন্য হাজার বার অনুরোধ উপরোধ। কিন্তু প্রতিবারই সেই একই অভিজ্ঞতা এবং নানান কুযুক্তি। ওই কোণটায় রংটা কম পড়েছে বলে কেটে দিয়েছি, সেখানে একটা ছোপছোপ মনে হচ্ছে।
পরে শানু লাহিড়ীর লেখায় পড়লাম, অধ্যাপক বসন্ত গাঙ্গুলিও কিভাবে ছিঁড়ে মুছে নষ্ট করে দিতেন ওর আঁকা ছবি, আর বলতেন: “by fluke হয়ে গেছে, এটা আবার কর।” তাঁর কলেজ জীবনে, অধ্যাপক ও অন্য অনেকেরই ধারণা ছিল যে ওঁনার কাজগুলো নাকি করে দিতেন ওনার মেজদা নীরদ মজুমদার! এই হল আমাদের কালিঝুলি মাখা চেহারা। কর্মক্ষেত্র থেকে নাগরিক হিসেবে কিংবা সংসারে যেকোনো ভূমিকায়।
নাটক ঘরের সংস্কার হচ্ছে, কিন্তু ঘর সংলগ্ন বাথরুমটি সংকীর্ণ এবং মেয়েদের পক্ষে যথেষ্ট নয়, বলাতে শুনতে হল, “কই আমাদের তো কোনো অসুবিধে হয়না! তাছাড়া আপনার আগে কোনো মেয়ে তো কোনোদিন কমপ্লেন করেনি।” করেনি কারণ তারা জানে মানিয়ে নিতে হয়। বলেনি কারণ তাহলে বুঝিয়ে বলতে হয় যে ছেলে এবং মেয়েরা বাথরুমটা ঠিক এক ভাবে ব্যবহার করে না।
মেয়েদের গাড়ি চালানো নিয়ে কতই না ঠাট্টা! মেয়েরা স্টিয়ারিং ধরলে অনেক প্রগতিশীল পুরুষ পাশে বসতে অস্বস্তি বোধ করেন। মেয়ে ড্রাইভার ওভারটেক করলে আঁতে ঘা লাগে। আজও। সর্বত্রই একটা মাপকাঠি আঁকা আছে। তার বাইরে গেলেই রক্তক্ষরণ। মেয়েরা অনুগ্রহ না চাইলে ঔদ্ধত্য মনে হয়। মেয়েরা মুখের ওপর স্পষ্ট কথা বললে মুখ ঝামটা মনে হয়।
পুরুষের পক্ষে কটা বিবাহ, কটা অবিবাহ, সেটা ইন্টেলেকচুয়াল বাঙালি আড্ডায় বুক বাজিয়ে বলাটা বিরাট পৌরুষের লক্ষণ। মেয়েদের ক্ষেত্রে তা নয়। আবার মঞ্চে পর্দায় অভিনয়ে যে মেয়েরা আসে, যে মেয়েরা পোশাকের ব্যাপারে খোলামেলা, বা ধূমপান করে, বা দামী রেঁস্তোরার পার্টিতে, পুরুষরা ধরেই নেন অনুমতি না নিয়েই তাদের কাঁধে হাত রাখা যায়, মুখের ওপর অতিরিক্ত ঝুঁকে পরে কথা বলা যায়, গা ঘেঁষে বসা যায়, গাল টিপেও দেওয়া যায়। নারী যদি মা, মেয়ে, বৌ, বৌদি ইত্যাকার পরিচয় তথা দাসত্ত্বের ট্যাগ গলায় ঝোলাতে না চায় তাহলে সমাজের চোখে সে সহজলভ্য। বৌকে কেন সঙ্গে আনেন না, একথা এক সহ-অভিনেতাকে জিজ্ঞাসা করাতে উত্তর দিয়েছিলেন, “না না আমাদের বাড়ির মেয়ে বৌদের নিয়ে টানাটানি করা যাবে না।” সন্তানের মা হয়ে পদবি ব্যবহার করতে চাই না শুনলে, বেশিরভাগ মানুষ অবধারিতভাবে বিবাহবিচ্ছেদজনিত কারণ বলে ধরে নেন।
আপাতত এই পর্যন্তই থাক। ঘরে বাইরে এমন প্রতিদিনকার বৈষম্য এবং অবমাননার উদাহরণ দিতে বসলে সারা দুনিয়ার হার্ডডিস্ক জড়ো করেও আঁটানো যাবে না।
সবশেষে যেটা না বললেই নয়, কিছু ব্যক্তিগত ঝাল ঝাড়া এ রচনার উদ্দেশ্যে নয়। তাছাড়া সমাজের সমস্ত অবিচারের বিরুদ্ধে একক অভিযান করে বড়জোর খুব বেশি হলে হিট হিন্দি সিনেমা হতে পারে, নিশ্চিতভাবেই তার থেকে খুব বেশি দূর এগোনো যাবে না। প্রতিটি ব্যক্তি নারীর অভিজ্ঞতার গুরুত্ব এখানেই, যে নারীর ব্যক্তিগত সমস্যাগুলো আসলে প্রতিদিনকার জীবন যাপনের মধ্যে স্বাভাবিকৃত বৈষম্য। আনিয়া লুম্বা-র মতে ব্যক্তির পার্সোনাল আর পলিটিক্যালের সম্পর্কটা জলঅচল না, পরস্পর ঘনবদ্ধ। আর তাই একটি ফ্রন্টে প্রতিটা ছোট ছোট জয় অন্য ফ্রন্টে সাফল্য অর্জনের সম্ভবনাকে ত্বরান্বিত করে। পরিবারের মধ্যেই লিঙ্গ সাম্যের ধারণা বা চর্চা যদি না থাকে তাহলে অন্যক্ষেত্র গুলোতেও তার প্রভাব পড়তে বাধ্য।
দেহগত বৈশিষ্ট্য বাদ দিলে নারী বা পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। কিন্তু আমাদের সমাজ প্রতিটা পূর্ণ মানুষের ওপর একটা কৃত্রিম পৌরুষ বা নারীত্বের ধারণা চাপিয়ে দেয়। ছেলেকে শেখানো হয় তার অন্তরের নারীত্বকে অস্বীকার করতে বা মেয়েদের বলা হয় ভিতরের পৌরুষকে দমিয়ে রাখতে। সে নিয়মেই সমাজ প্রভুদের প্রয়োজন মত কখনো সম্পূর্ণ যৌনতাবর্জিত মাতৃমূর্তি করে, কখনো বা রতির প্রতিমূতি করে আদর্শ নারী মূর্তি গড়া হয়েছে, অনুশাসনের বেড়াজালে বেঁধে। পুরুষ মাত্রেই যেন বলিষ্ঠ, ক্ষুরধার, বুদ্ধিজীবী, উদ্ধত; বিপরীতে নারী মানেই দুর্বল, আবেগময়, বিনীত। একরকম ভাবে এই ব্যবস্থা নারী পুরুষ উভয়কেই অর্ধেক মানুষ করে রেখে দেয়। এইভাবে নারী পুরুষের কৃত্রিম মেরুকরণে ক্ষতি প্রতিটি ব্যক্তি মানুষের। ক্ষতি হয় নারী পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্কেও।
এখনো পর্যন্ত একটা বিষয়ে আজব মিল ধর্মনিরপেক্ষ উদার, বামপন্থী এবং দক্ষিণপন্থীদের আদর্শ নারীর ভাবমূর্তিতে, নারীর কাছে সকলেই চেয়েছে “প্রশ্নহীন পূর্ণ আনুগত্য”। এমনকি দুর্গা বা রণচণ্ডী রূপেও সে পুরুষতন্ত্রের হাতের সুতোয় নাচের পুতুল। অর্থাৎ প্রশ্নটা ক্ষমতা ও ক্ষমতাহীনের সম্পর্কের। প্রশ্নটা যৌনতা ও ক্ষমতার এক অশুভ আঁতাতের। মিশেল ফুকোর আধিপত্য বিস্তারকারী জ্ঞান দিয়ে কোনঠাসা জ্ঞান। কিংবা গ্রামসির আধিপত্যের ধারণা দিয়ে সংস্কৃতির অলিন্দে বিস্তৃত থাকে শাসকের নিয়ন্ত্রণ। নারী বা পুরুষ উভয়ের মধ্যেই রয়েছে নানান গোষ্ঠী, ধর্ম, জাত-বর্ণভিত্তিক, যৌনতা ভিত্তিক এবং শ্রেণী ভিত্তিক পরিচয়। সামন্ততান্ত্রিক, পুরুষতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী সমাজে ক্ষমতাবান মানেই পুরুষ নয়, আবার নিপীড়িতরা সকলেই নারী নন।
সুদূর অতীত নয়, ৬০-৭০-৮০র দশকে সক্রিয় বামপন্থী ও উদ্বাস্তু আন্দোলনে দেখা গিয়েছিলো সাদামাটা বাহুল্যবর্জিত, ক্ষমতার কাছে মাথা না-নোয়ানো, পুরুষের সহানুভুতির কাঙাল নয় এমন দৃঢ় চরিত্রের নারীদের। ১৯৪৩-এ বিধানসভা প্রথম ঘেরাও করেছিল সংগঠিত নারীরাই। একধরণের বিকল্প নারীত্বের সচেতন সাংস্কৃতিক পুনর্নির্মাণ করছিলো সেই মেয়েরা। অর্জন করে নিচ্ছিলো সামাজিক সম্মতি। কিন্তু বর্তমান বামপন্থী কমিউনিস্ট পরিবারগুলোতেও সচেতনভাবে রক্ষিত হয়নি সেই উত্তরাধিকারের ধারাবাহিকতা। যদিও খুঁজলে এখনো এমন দৃঢ়চেতা মেয়েদের যথেষ্ঠ সংখ্যাতেই পাওয়া যাবে, আমাদের আশেপাশে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে। কিন্তু, কোন রসায়নে আদর্শ ভারতীয় নারীত্বের ধারণায় তাঁরা রয়ে গেলেন ব্যতিক্রমী বা ব্রাত্য হয়ে? মুঠোয় করে ধরবার উপযুক্ত নয় বলে? নাকি যথেষ্ট অর্থ উপার্জনকারী নয় বলে? সম্ভবত দুটোই।
সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে মানুষের প্রয়োজনীয়তার প্রসার ও পরিবর্তন ঘটে। পরিবর্তন হচ্ছে বিশ্বায়নের ফলেও। বাঙালি মধ্যবিত্তের সামাজিক মানদন্ড, চাহিদা, পুরোনো মূল্যবোধ, শরীর সম্পর্কে শূচিতার ধারণাগুলো পাল্টে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু কাদের অনুকূলে? নয়া উদারবাদ, নয়া ফ্যাসিবাদের। দৈনন্দিন জীবনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অভ্যাস, অঙ্গভঙ্গি, যৌনতা, চাহিদা থেকে নিজের শরীরের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি – সবই সেই আগ্রাসী ক্ষমতার হাতের পুতুল। বাজার, প্রযুক্তি, ধর্মীয়, জাতীয় চার ধরণের মৌলবাদের চারদিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণে লড়াইটা কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে একটা নয়া রক্ষণশীল ঘেরাটোপ। যেখানে পাশাপাশি জায়গা করে নিচ্ছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং সামন্ততান্ত্রিক অন্ধবিশ্বাস। সাফল্য মানে এসমাজে আরো অর্থ, আরো ক্ষমতা। লাভ লোভ ও হ্যাংলামোর নেক্সাস প্রতিটা মানুষকে উচ্চাকাঙ্খী প্রতিযোগী আত্মকেন্দ্রিক আগ্রাসী আধিপত্যকারী ঘোড়দৌড়ে সামিল করে তুলতে চায়। এই অসীম মুক্তির সমাপ্তি ঘটে অসীম নিঃসঙ্গতা ও উচ্ছৃঙ্খল প্রবৃত্তি সর্বস্ব স্বেচ্ছাচারিতায়। সুতরাং মধ্যবিত্ত শহুরে নারীত্ত্বের বর্তমান প্রচলিত ধাঁচটা অর্থাৎ “বহিরঙ্গে ঊর্বশী এবং অন্তরে সতী সাবিত্রী” সেটা সর্বতোভাবে নয়া উদারবাদ, নয়া ফ্যাসিবাদের অনুকূলে বলেই বর্তমানে সামাজিক অনুমোদন পাচ্ছে।
বর্তমান বিশ্বে অতি দক্ষিনপন্থীদের উত্থান এবং এক রঙে এক ঢঙে সাজানোর পক্ষে এই নারী বা পুরুষের সমাজ নির্ধারিত একমাত্রিক ছাঁচ হয়ে দাঁড়িয়েছে খুবই কার্যকরী। আর এই স্রোতের বিরুদ্ধে গিয়ে নারীত্বের বিকল্প সংজ্ঞা নির্মাণ হয়ে পড়ছে উত্তরোত্তর কঠিন। বর্তমান আর্থিক সামাজিক ব্যবস্থায় যা খাপ খায় না তা হল যৌথতার মধ্যে ভিন্ন স্বরের বেঁচে থাকার অধিকার। এই আগ্রাসী আর্থসামাজিক ব্যবস্থার নিরিখে যা কিছু অলাভজনক, যেমন যৌথতা, মনুষ্যত্ব, পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, সামাজিক দায়বদ্ধতা, ভালোবাসা, যৌথ জীবন, লালন পালন – এসব সমাজের চোখে অপ্রয়োজনীয়, অচল হয়ে ক্রমবিলুপ্তির দিকে এগোচ্ছে। অথচ ঐতিহাসিক ভাবে অর্জিত এই ইতিবাচক গুণগুলো যতটা পুরুষের ছিল, ততটাই নারীরও।
এই আগ্রাসনকে রুখতে গেলে নারী বা পুরুষের নির্ধারিত ছাঁচ ভেঙে সন্ধান করতে হবে এমন একটা ব্যবস্থার, যেখানে স্থান পাবে প্রতিটি স্বতন্ত্র ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ। তাঁদের স্বাভাবিক চাহিদা বা ভিন্ন মতকে অবদমন করে নয়, তার বৈচিত্র স্বাভাবিকতাকে স্বীকার করে নেবার মধ্যে দিয়েই আসতে পারে উত্তরণ। সে সমষ্টিতে যেন প্রতিটি ফুলের স্বতন্ত্র ভাবে সম্পূর্ণ বিকশিত হবার সুযোগ থাকে। এই বিকল্পের সন্ধান করতে হবে গতানুগতিক প্রতিষ্ঠিত ধারণাগুলো সম্পর্কে অন্ধবিশ্বাসী না হয়ে, প্রশ্ন করে ঠিক ভুল যাচাই করে নেবার মধ্যে দিয়ে।
“মঞ্জিল মুঝে মিলে না মিলে ইসকা গম নেহি
মঞ্জিল কি জুস্তাজু মে মেরা কারবা তো হ্যায় ”
(আমি গন্তব্যে পৌঁছতে পারব কিনা তা নিয়ে দুঃখ নেই
অন্তত সেই লক্ষ্যের যাত্রীদের দলে আমিও আছি )
- ঊর্মিমালা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কর্মী
একটাই কথা বলব। আজ নিজের খুব গর্ব অনুভব হচ্ছে কারন ঊর্মির মত একজন সহকর্মী পেয়েছি বলে।