এক্সোডাস গেঞ্জি কারখানার মহিলা শ্রমিকদের নাছোড় লড়াই দাবি আদায়ের পথ দেখাল


  • March 15, 2025
  • (1 Comments)
  • 1046 Views

ভোর চারটেয় দিন শুরু হয়। সকাল সাড়ে ছ’টার মধ্যে রান্নার পাট মিটিয়ে সংসারের বাকি কাজকর্ম সেরে ৮.১৫-এর মধ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ৮.৫৫তে মূল গেট পেরিয়ে কারখানায় ঢুকে যাওয়া। সারা দিনের কাজ শেষে আবার বাড়ি ফিরে বাড়ির যাবতীয় কাজ, রান্না মিটিয়ে শোওয়া রাত ১১টা-১২টায়। নিজেদের পরিশ্রম নিয়ে আসলে কোনো অভিযোগ নেই এই মহিলা শ্রমিকেদের। নিজেদের শ্রমের বিনিময়ে উপার্জন করেন, এ তাঁদের জোরের জায়গা। লড়াইটা মালিক পক্ষের বঞ্চনা ও ঠকিয়ে নেওয়ার প্রবণতার বিরুদ্ধে, যা শ্রমিক তথা মহিলা শ্রমিকদের আন্দোলনে এ বাংলায় নজির তৈরি করে রাখল। সোনারপুরের রামচন্দ্রপুরে গেঞ্জি কারখানার মহিলা শ্রমিকদের লড়াই নিয়ে সুদর্শনা চক্রবর্তীর রিপোর্ট।

 

Groundxero| 15th March 2025

 

“কাজের এমন চাপ দেব, বাথরুমে পর্যন্ত যেতে পারবে না,”“বাথরুম-টুম সব বাড়ি থেকে করে আসবে, নাহলে ৫.৩০-র পর বাড়ি গিয়ে যাবে,”– বিভিন্ন বিভাগের মহিলা শ্রমিকদের প্রতি এহেন কথা বলা প্রোডাকশন ম্যানেজারদের কাছে খুবই সাধারণ ব্যাপার দক্ষিণ ২৪ পরগণার সোনারপুরের রামচন্দ্রপুরে এক্সোডাস ফিউচারা নিট প্রাইভেট লিমিটেড কারখানায়। আর্থিক বঞ্চনা তো রয়েছেই, তারই সঙ্গে প্রায় ৭০০ মহিলা শ্রমিকেরা যেখানে হাড়ভাঙা পরিশ্রমে কোম্পানির লাভের অঙ্ক বাড়িয়ে চলেন, সেখানে ন্যূনতম শ্রমিক স্বার্থ, মহিলাদের প্রয়োজনীয় সুবিধা-অসুবিধা দেখার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত উদাসীন কোম্পানি কর্তৃপক্ষ।

 

সোনারপুর স্টেশন থেকে টোটো বা অটোতে রামচন্দ্রপুর গেঞ্জি কারখানা বললেই নামিয়ে দেবে। একদিকে গাছপালা, বাগান, অন্যদিকে কারখানা, নির্মাণ কাজ রেখে কয়েক পা এগোলেই চোখে পড়বে বন্ধ কারখানার গেটের সামনে সাময়িক বাঁশের কাঠামো করে বাড়ি থেকে নিয়ে আসা চাদর, শাড়ি দিয়ে ছাউনি বানিয়ে অবস্থানে বসেছেন আন্দোলনকারী মহিলারা। রোজার মাস। হিন্দু-মুসলমান শ্রমিকেরা পালা করে দিনে, রাতে জাগছেন। রাতে থেকে ভোর পাঁচটায় বাড়ি গিয়ে রান্না, বাড়ির কাজ সেরে অবস্থানে আসছেন মুসলিম নারীরা। বিকেলে তাঁদের রোজা ভাঙতে তাড়াতাড়ি পাঠাচ্ছেন হিন্দু সহকর্মী, বন্ধু। বাকিরা নিজেদের বাড়ির দায়-দায়িত্ব সামলে ভাগ করে নিচ্ছেন আন্দোলনে থাকার সময়সীমা। “পান্তা খাওয়া মেয়েরা আর কত কী করবে তোমরা?” শুনতে হয়েছে এমন কথাও।

 

 

অবস্থানকারী মহিলা শ্রমিকদের জবানি

 

তবে রাকিবা খাতুন, জরিনা বিবি, দোলন খাতুন, অপর্ণা ঘোষ, অঞ্জলি নাথ, শিবানী মন্ডল, উর্মিলা মন্ডল, রেখা মন্ডল, অনিতা মন্ডল-রা একটা বিষয়েই একজোট, “আমাদের পিএফ, ইএসআই-এর টাকা জমা তো পড়ছে। আমাদের টাকা আমাদের মিটিয়ে দিক। তারপর যা করে করুক।” মাসুদা খাতুন বলছেন, “আমাদের বেসিক যা ছিল তাই করতে হবে, আর মাইনে বাড়িয়ে যা করা হয়েছে তা কমানো যাবে না।“

 

স্বপ্না দাস নিজে বাড়ির আর্থিক অসুবিধায় বেশি পড়তে পারেননি, দুই মেয়েকে পড়াচ্ছেন। ছোট মেয়ে দ্বাদশ শ্রেণী, বড় মেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত অনার্স নিয়ে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। “বড় মেয়ে আমার পড়াশোনায় খুব ভালো। কতদূর পড়াতে পারব জানি না। ও বলে, ‘মা তুমি কত কষ্ট করছো, তুমি পড়তে পারোনি, আমি পড়ব। আন্দোলনের কোনো ফয়সালা না হলে উঠব না,” জানিয়ে দিলেন স্বপ্না।

স্বপ্না দাস

“ওরা আমাদের বাধ্য করেছে, দাবি আদায় না করে উঠব না,” বললেন সুখি ভাওয়াল। “২০২২ সালে আমরা কাজ বন্ধ করেছিলাম। তখন এসে ওই জামরুল গাছতলায় আমরা কয়েক জন বসে থাকতাম, তারপর বাড়ি চলে যেতাম। এবারে সব মেয়েরা আমাদের সঙ্গে আছে। ৭০০ জনের মধ্যে সবাই হয়তো এসে পৌঁছাতে পারছে না, কিন্তু মনে মনে সবার সমর্থন আছে,” বক্তব্য মাধুরি গায়েনের। “চোদ্দ বছর ধরে সবকিছু নিয়ে যুদ্ধ চলছে। আমরা আন্দোলন করছি, ওরা কিছু বোঝাচ্ছে, আমরা মেয়েরা আবার কারখানায় ঢুকে যাচ্ছি। কিন্তু এবারে আর তা হবে না,” জানিয়ে দিলেন মাসুদা বিবি।

 

লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা ছিলই, তবে প্রথমবার এমন দিনরাত বাড়ির বাইরে রাস্তার উপর বসা, রাতেও থাকা অস্থায়ী ঠিকানায়, ভয় নয়, তবে অস্বস্তি হয় না? আন্দোলনকারীরা জানালেন রাতে পুলিশি পাহারা থাকে, তাছাড়া আশেপাশের বাড়ির মানুষেরাও সাহায্য করেন। তাঁদের বাড়ির শৌচালয় ব্যবহার করতে দেন। অনেক মানুষের সমর্থন ভরসা যোগাচ্ছে। তাছাড়া তাঁদের পরিবার, স্বামী-সন্তানদের পাশে থাকাও মনের জোর বাড়িয়েছে অনেকটাই।

 

কলকাতা থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে বাইশ দিনেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে যেখানে এই কারখানার মহিলা শ্রমিকেরা নিজেদের ন্যায্য প্রাপ্য আদায়ের দাবিতে দিন-রাতের অবস্থানে বসেছেন। অথচ, না কোনো মূলস্রোতের সংবাদ মাধ্যম, না কোনও নারী অধিকার, কেন্দ্রীয় শ্রমিক ইউনিয়ন – কেউই বৃহত্তরভাবে এই আন্দোলনকে সামনে নিয়ে আসেনি।

 

কোম্পানি কর্তৃপক্ষের শোষন নীতি

 

কারখানায় কাজের সময় সকাল ৯টা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা। ৮.৫৫-র মধ্যে সবাইকে মূল গেট পেরিয়ে কারখানায় ঢুকে পড়তে হয়। আর বিকেল ৫টা থেকে গেটে নিরাপত্তা আঁটোসাঁটো হয়ে যায়, যাতে কেউ কোনো প্রয়োজনেও সামান্য আগে বেরোতে না পারেন। দুপুর ১২টা থেকে ১.৩০টা পর্যন্ত তিন ভাগে খাবার বিরতি দেওয়া হয়। এর মাঝে আর কিছু খাবার বা বিশ্রামের বিরতি দেওয়া হয় না। কোনো বিভাগে কেউ সামান্য সময়ের জন্যও খালি বসে থাকেন না, হাতের কাজ ফুরোতে না ফুরোতেই অন্য কাজ চলে আসে। যাতে জল খেতে উঠেও সময় নষ্ট না হয়, তারজন্য জল দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মোবাইল ফোন রেখে ঢুকতে হয় খাবার রাখার লকারে। সারা দিনে কারোর সঙ্গে কথা বলার অনুমতি নেই। বাড়ি থেকে কোনো প্রয়োজন হলে কারখানায় ইন-চার্জকে ফোন করে জানাতে হয়। সারাদিনে আধ ঘন্টার খাবার বিরতিতে যেটুকূ ফোন করার ফুরসত মেলে, তা তাড়াহুড়ো করে খাওয়া শেষ করে কাজে ফিরতেই ফুরিয়ে যায়। শৌচালয়ে যাওয়ার বিরতি নিলেও এমন তাড়া দেওয়া হয়, অনেক সময়েই শ্রমিকদের মধ্যে কেউ কেউ পড়ে গিয়ে চোট পেয়েছেন এমনো হয়েছে।

 

ফার্স্ট এইড-এর অবস্থাও তথৈবচ। একজন নিরাপত্তা কর্মী এখন নার্স-এর দায়িত্বে রয়েছেন, যিনি আদপেই প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত নন। প্রয়োজনের সময়ে বিশেষ সাহায্যও পাওয়া যায় না। আগে স্যানিটারি প্যাড-এর ব্যবস্থা থাকলেও এখন তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জ্বর, গা-হাত-পায়ে ব্যথা, পেটে ব্যথার সামান্য ওষুধও পাওয়া যায় না।

 

টানা সাড়ে আট ঘন্টা সপ্তাহে ছ’দিন দাঁড়িয়ে কাজ, যেখানে হাত ও চোখের কাজই মূল, অধিকাংশ শ্রমিকই অসহ্য কোমর, হাঁটু, পায়ের যন্ত্রণা, মাথা ও চোখের ব্যথায় ভুগছেন। অনেকেরই শরীরে নানাবিধ অস্ত্রোপচারের ঘটনা ঘটেছে। তবে তা সত্ত্বেও মানবিকতার ভিত্তিতেও টার্গেটের চাপ কমেনি।

 

প্রতিটি ঘরে রয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা। তাছাড়া ইন-চার্জরা তো থাকেনই। কাজের ফাঁকে নিজেদের মধ্যে সামান্য কথা বলারও সুযোগ হয় না। “গল্প করবে না। কাজ শেষ করো” ক্রমাগত তাড়া খেতে হয়। রাকিবা, জরিনা, অপর্ণারা যখন এই প্রতিবেদককে বলছেন, “কথা বলব কি, বাথরুমেও ছুটে ছুটে যায় নিজেরই জ্বালায়। টার্গেট শেষ করতে হবে। আমার হাত থেকে ওর হাত, তার থেকে আরেক জনের হাত – এতটুকু সময় নেই,” – তাঁদের কথা বলা, অভিব্যক্তিতেই যেন কারখানার অবিরাম টেনশনটা ধরা পড়ে যায়। এই শ্রমিকদের মধ্যে থেকেই মালিক পক্ষের ঘনিষ্ঠ মেয়েদের লিডার বানানো হয়, তাঁদের কাজ চাপ দিয়ে টার্গেট পূরণ করানো। মোট ১৬ জন লিডার আছেন, সব বিভাগ মিলিয়ে, তাঁরা আন্দোলনে শামিল হননি।

 

মূলত যে দাবিগুলি নিয়ে রামচন্দ্রপুর এক্সোডাস গেঞ্জি কারখানার মহিলা শ্রমিকদের অবস্থান চলছেঃ-

 

  • বেসিক পে কোনোভাবেই কমানো যাবে না

 

  • গত ৫ বছরে জমা না হওয়া পিএফ-এর টাকা অবিলম্বে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা দিতে হবে

 

  • কাজ ছেড়ে দেওয়া কর্মীদের গ্র্যাচুইটির টাকা মেটাতে হবে

 

 

কারখানা শুরু, শ্রমিকদের যোগদান ও আন্দোলনের ঘটনাক্রম

 

২০১১ সালের ১ অগাস্ট সোনারপুরে যখন এই কারখানা তৈরি হয়, তখন মাসুদা বিবি, মাধুরী গায়েন, সুখি ভাওয়াল-দের কথায়, এলাকার মহিলারা কিছুই বুঝতেন না। সেই সময়ে, মহিলা শ্রমিকেরা কাজ করতে শুরু করেছিলেন মাত্র ১০ টাকা দৈনিক মজুরিতে, মানে মাসিক বেতন ছিল ৩০০ টাকা। কারখানা খোলার পরে কোম্পানি প্রচার শুরু করে, “মহিলাদের কারখানা হয়েছে, কাজে যাবে?” তখন ১৫০ জন মহিলা একদিনে কাজে যোগ দেন। সেই সময়ে কারওর কোনও সম্যক ধারণাই ছিল না পিএফ কী, তা বাকি আছে কি না, স্যালারি স্লিপ রাখতে হয় কি না ইত্যাদি। টাকাটুকু হাতে পেয়েই তাঁরা খুশি থাকতেন। প্রশিক্ষণ পেয়ে, মেশিন চিনে, নতুন কাজ শেখার উদ্যম ও আগ্রহ ছিল বেশি। “প্রথমে তো কোনও টার্গেট দেওয়া হয়নি আমাদের,” জানালেন ধর্ণায় বসা আন্দোলনকারী মহিলা শ্রমিকেরা। যখন লোকালয় বাড়ে, মহিলা শ্রমিকদের সংখ্যা বাড়ে, কয়েক জন শিক্ষিত মহিলা শ্রমিক যোগ দেন, তখন থেকেই আস্তে আস্তে সামনে আসতে থাকে নানান আর্থিক অনিয়মের বিষয়টি।

 

“গ্রামের মেয়েরা কিছুই জানে না। ঝাড়লন্ঠন আলো তো জানেই না, জোনাকির আলো দেখে তাতেই খুশি। কী জানেন তো দিদি, তখন তো এত পিএফ-টি-এফ কিছুই বুঝতাম না আমরা। মেয়েরা স্যালারিটা হাতে পাচ্ছেন এটাই অনেক ছিল। ৩০০ টাকাটাই অনেক মনে হত। এখন ১১,০০০ টাকা মাইনেতে যত না খুশি, তখন ৩০০ টাকা মাইনেতে কিন্তু তার চেয়ে বেশি খুশি ছিলাম। আমরা মেয়েরা প্রথম কোনো কাজে এলাম, বড় বড় মেশিন দেখছি, সুতো পরানো দেখছি, হাতে টাকা পাচ্ছি তখন এটাই অনেক বড় ব্যাপার ছিল,” মাসুদা বললেন।

সুখি ভাওয়াল, মাসুদা বিবি (মাথায় ওড়না), মাধুরি গায়েন

কারখানায় তৈরি হয় পুরুষ, মহিলা, শিশুদের গেঞ্জির সব রকম প্রোডাক্ট, যা তারপর বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শো-রুমে সাপ্লাই হয়। রয়েছে যে বিভাগগুলি – কাটিং, প্রিন্টিং, এমব্রয়ডারি, লেবেল (সাইজ অনুযায়ী) ক্যাজুয়াল (যেখানে গেঞ্জি, লং প্যান্ট সেলাই হয়), ইন্টিমেট (অর্ন্তবাস তৈরি হয়), তারপর ট্রলিতে দেওয়া হয় তৈরি হওয়া জিনিসগুলি, এরপর পরপর টেবিলে একেকটি পোশাক তৈরি হতে থাকে শোল্ডার ও অন্যান্য অংশ জুড়ে, তারপর আয়রন, প্যাকিং। এছাড়া থাকে চেকিং। তাদের নিজস্ব টার্গেট (যা রোজ ১০০ পিস) ছাড়াও যেদিন যা শিপমেন্ট-এ থাকে সেই প্রোডাক্ট যত পিস-ই (৮০০-১০০) থাকুক চেকিং সম্পূর্ণ করতে হয়। প্রয়োজনে অতিরিক্ত সময় কাজ করে। সমস্ত বিভাগ মিলিয়ে কত সংখ্যক উতপাদন হয়, তা বলা সম্ভব না হলেও, যেমন জানা গেলো রাউন্ড নেক গেঞ্জির ক্ষেত্রে চলতি বছরে টার্গেট ঠিক হয়েছে একদিনে ন্যূনতম ২০০০ পিস।

 

এই প্রতিটি বিভাগে থাকে বিভাগ আনুযায়ী আলাদা আলাদা  ১৫ মিনিটের টার্গেট। এই টার্গেট পূরণের জন্য চূড়ান্ত চাপের মধ্যে কাজ করে যেতে হয় শ্রমিকদের। কোনো বিভাগে যেমন ১৫ মিনিটে ৪০টার টার্গেট থাকে, কোথাও থাকে ২০০-২৫০টার টার্গেট। উতপাদন ও গুণগত মান দু’দিকেই নজর দিয়ে চলতে থাকে টার্গেট পূরণের দৌড়। ক্যাপাসিটি-র উপর নির্ভর করে টার্গেট। যদিও যে বিভাগের শ্রমিকদের যত ক্যাপাসিটি তার থেকে বেশি টার্গেটের চাপ দেওয়া হতে থাকে, তা দু পিস থেকে ১০ পিস বেশি, যা কিছুই হতে পারে। কোনও দিন যদি দিনের শেষে দেখা যায়, কারোর নির্দিষ্ট টার্গেট পূরণ হয়নি, তখন তাঁকে অতিরিক্ত সময় কাজ করে তা পুষিয়ে দিতে হয়, এবং অবশ্যই এরজন্য কোনো ওভার টাইম তাঁরা পান না। কোনো সময়ে যদি কারখানার কোনো কারণে, যেমন মেশিন খারাপ বা ইত্যাদি প্রোডাকশন কম হয়, তখন এমনকি রবিবারে কাজ করেও শ্রমিকদের টার্গেট পূরণ করতে হয়।

 

কাজ বেড়েছে, বেড়েছে টার্গেটের চাপ, সেই তুলনায় বেতন বেড়েছে কতটা? ৩০০ টাকা প্রথম মাসে দেওয়ার পরে, পরের মাস (সেপ্টেম্বর, ২০১১ থেকে) দেওয়া হতে থাকে ১৮০০ টাকা। তখন দেওয়া হত ‘মিড-ডে মিল’ বা দুপুরের খাবার। এছাড়া ছিল অ্যটেডান্স বোনাস ৩০০ টাকা। কেউ সারা মাস কামাই না করলে তাঁকে দেওয়া হত মোট ২১০০ টাকা। কিন্তু, কেউ একদিনও কামাই করলে এই ৩০০ টাকার পুরোটা তো বটেই তার অনুপস্থির দিনের মাইনেও কেটে নেওয়া হত। তারপর বলা হয়েছিল প্রতি মাসে ১০০ টাকা করে মাইনে বাড়ানো হবে, “আসলে একসঙ্গে বাড়ালে তো ওদের (মালিক পক্ষের) গায়ে লাগত, তাই এই ব্যবস্থা করেছিল। তখন থেকে আস্তে আস্তে আমাদের টার্গেট দেওয়াও শুরু করেছিল। ৪টে থেকে ৫টা, ৫টা থেকে ৬টা এরকম করে বাড়াচ্ছিল, যাতে মেয়েরাও প্রথমে বুঝতে না পারে,” জানালেন মাধুরী গায়েন।

 

কারখানা শুরুর বছর দুর্গা পুজোর সময়ে কোনও বোনাস দেওয়া হয়নি। বছরে এই এক সময়েই বোনাস দেওয়া হত, যেখানে মুসলিম সম্প্রদায়ের মহিলা শ্রমিকের সংখ্যাও প্রায় সমান, সেখানে তাঁদের মূল পরব ঈদে কোনো বোনাসের ব্যবস্থা ছিল না। ২০১২তে বোনাস চাইলেও না দিয়ে কোম্পানির গিফট বলে একই সাইজের গেঞ্জি দেওয়া হয় সকলকে, যা অধিকাংশ মহিলাই বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যাননি। ২০১৩তে যা আদপে কোম্পানির নিজস্ব খরচ সেই বড় জেনারেটর শ্রমিকদের বোনাস না দিয়ে সেই খাতে কেনা হয়। এরপরই শ্রমিক অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে বোনাসের দাবিতে, মাইনে বাড়ানোর দাবিতে। ২০১৩তে বিভিন্ন গ্রেড অনুসারে একবারই বড় মাপে মাইনে বাড়ানো হয়, সর্বোচ্চ ১০০০ টাকা। তারপর থেকে খুবই সামান্য পরিমাণে কখনো কখনো মাইনে বেড়েছে। ২০১৫-১৬ পর্যন্ত এর তাও একটি ধারাবাহিকতা ছিল। কিন্তু বর্তমান সিইও সুব্রত বিশ্বাস ২০১৯ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পরেই চূড়ান্ত আর্থিক বঞ্চনা (শ্রমিকদের কথায়, “উনি আসার পর থেকেই মাইনেটা নিয়ে এমন গড়বড় চলছে”) শুরু হয় বলে শ্রমিকদের দাবি।

 

২০২০ সালে আসে কোভিড। এই কোম্পানির নিয়ম অনুযায়ী বেতন বাড়ে জানুয়ারি মাসে, শ্রমিকেরা ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ইঙ্ক্রিমেন্ট-এর টাকা পান। ২০২০-তে অফিশিয়ালি করোনা মহামারী ঘোষণার আগেই কোম্পানির তরফে জানানো হয়, সে বছর মার্চ মাসে ইঙ্ক্রিমেন্ট দেওয়া হবে। মার্চ লকডাউন ঘোষণার পর, জানিয়ে দেওয়া হয়, সে বছর আর বর্ধিত হারে বেতন দেওয়া হবে না লকডাউনের কারণে।

 

কোভিড-এর সময়ে মাত্র সাত দিন বন্ধ ছিল কারখানা। ডাক্তারদের পিপিই, মাস্ক, গ্লাভস তৈরি হত কারখানায়, ফলে নিয়মিত কাজের রুটিনেই চলেছে উৎপাদন। শুধু সেই অতি প্রয়োজনীয় সময়ে বাড়েনি বেতন। শ্রমিক সুখি ভাওয়াল যেমন বললেন, “এটা পুরোটাই ওদের চাল ছিল। আগের থেকে নিশ্চয়ই কিছু বুঝতে পেরেছিল, যেজন্য ইঙ্ক্রিমেন্ট-টা পিছিয়ে দিয়েছিল।“

 

বর্তমানে কাজ বন্ধ রেখে যে অবস্থান বিক্ষোভ চলছে, তার বীজ বপন হয়েছিল ২০২২ সালে। সে সময়ে শ্রমিকেরা জানিয়েছিলেন বেসিক পে অর্থাৎ পিএফ (পিএফ চালু হয় ২০১৩ সাল থেকে), ইএসআই বাদ দিয়ে মাইনে ৫০০ টাকা বাড়াতে হবে, যে দাবি কোম্পানি তখন মেনে নেয়নি। সোনারপুর থানার এক আধিকারিক মালিক ও শ্রমিক পক্ষের মতবিরোধ মেটাতে মধ্যস্থতা করছিলেন, তাঁর পরামর্শে মহিলা শ্রমিকেরা লেবার কমিশন-এর সাথে যোগাযোগ করেন। তাঁদের জানানো হয়, সরকারি নিয়মানুযায়ী মাইনে বছরে দু’বার বাড়ে। আন্দোলনরত শ্রমিকদের বক্তব্য অনুযায়ী বর্তমান সিইও-র জন্যই তাঁদের মাইনে সংক্রান্ত যাবতীয় সমস্যা শুরু হয় আর কোনো সমাধানও বেরোয়নি। এমনকি বছরে ৭০/৮০/১০০ টাকা করে মাইনে বাড়ানো হয়েছে এমন উদাহরণও রয়েছে।

 

মাধুরি গায়েন বলছিলেন, “২০১১-এ কারখানায় কাজে যোগ দেওয়ার পর থেকে এক্সোডাস আর বাড়ি ছাড়া আর কিছুই জানতাম না আমরা। এই সিইও এসে আমাদের থানা, লেবার কমিশন অফিস এসব করতে শিখিয়েছেন। ২০২২ সালে যখন মাইনে বাড়াচ্ছিল না তখন আমরা ওই বাগানের ওখানে এমনি বসে বিক্ষোভ দেখাতাম (বর্তমান অবস্থান স্থল কারখানার মূল ফটকের থেকে কয়েক হাত দূরে কারখানায় ঢোকার রাস্তার পাশেই রয়েছে বাগান।)।“ ২০২২-এর পর মাইনে বাড়ছিল না কোনোভাবেই। ইতিমধ্যে কোনো কোনো শ্রমিক অদক্ষ থেকে দক্ষ শ্রমিকে উন্নীত হন, তবে মাধুরী, সুখী, মাসুদাদের মতো এক বড় সংখ্যক সিনিয়র শ্রমিকদের বেতন একেবারেই বাড়েনি। দীর্ঘ টালবাহানার পরে ২০২৪ সালে মাইনে বাড়ে।

 

ঠিক এখান থেকেই কোম্পানির বঞ্চনার কথা সামনে আসতে শুরু করে। শ্রমিকেরা বুঝতে পারেন চুক্তি অনুযায়ী পিএফ-এর টাকা তাঁরা পাননি। ৪২ মাস কোম্পানির ও ৩৩ মাস শ্রমিকদের তহবিল থেকে এই টাকা সঞ্চয় হওয়ার কথা। কোম্পানি জানায় শ্রমিকদের তহবিলের ৩৩ মাসের টাকা ২০২৪-এর ডিসেম্বর-এর মধ্যে মিটিয়ে দেওয়া হবে আর কোম্পানির ৪২ মাসের টাকা কবে মেটানো হবে তা ২০২৫-এর শুরুতে মিটিং করে জানিয়ে দেওয়া হবে।

 

এরমধ্যে মাইনে বাড়ানো নিয়ে লাগাতার দাবি জানাতে থাকেন শ্রমিকেরা। একটা গোটা দিন কোম্পানি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মিটিং-এর পর একটি ‘সেটেলমেন্ট’-এ পৌঁছানো সম্ভব হয়। সেদিন মুখে আশ্বস্ত করলেও পরবর্তী সময়ে শ্রমিকেরা জানতে পারেন এমনকি তাঁদের সেদিনের মাইনেও কেটে নেওয়া হয়েছে। এই আলোচনার পর যে মাইনে তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ঢোকে তাতে দেখা যায় দাবি আনুযায়ী তাঁদের মাইনে বেড়েছে এবং সেইসঙ্গে কিছু পরিমাণ অতিরিক্ত টাকাও ঢুকেছে, যা কোন খাতে ঢুকল তা শ্রমিকেরা বুঝতে পারেন না। তখনই তাঁরা পে স্লিপ দেওয়ার দাবি জানান, কর্তৃপক্ষ তা না দিয়ে টালবাহানা চালাতে থাকেন। এর মাঝেই তাঁরা জানতে পারেন ম্যানেজিং ডিরেক্ট্র-এর ছেলে নিখিল বাগারিয়া কারখানায় আসবেন ও তাঁদের সঙ্গে বসবেন, তিনি আসেনও। তবে তাঁদের সঙ্গে দেখা না করেই চলে যান। শ্রমিকদের ডেকে পাঠান প্রোডাকশন ম্যানেজার, এইচ আর ম্যানেজার ও কয়েক জন ইন-চার্জ। সেই মিটিং-এ নিখিল বাগারিয়ার সঙ্গে দেখা না হওয়ার জন্য অসন্তোষ প্রকাশ করেন শ্রমিকেরা আর সেখানেই পে-স্লিপ নিয়ে তুমুল অশান্তি হয় শ্রমিক ও কোম্পানি প্রতিনিধিদের মধ্যে।

 

তখনই আলোচনার ঘরে পড়ে থাকা কিছু পে-স্লিপ হাতে পেয়ে যান কয়েক জন শ্রমিক ও চূড়ান্ত বিস্ময়ে দেখেন তাঁদের বেসিক মে (মূল মাইনে) কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, যেখানে আগে বেসিক পে ছিল ৬৮০০ টাকা তা কমিয়ে ৩০০০ টাকা করে দেওয়া হয় যার মানে পিএফ-ও কমে যাওয়া। এবারে সব মিলিয়ে মাইনে করা হয়েছিল ১১,০৬৮ টাকা। তাঁরা দেখেন, পিএফ-এর টাকা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে ও পিএফ অ্যাকাউন্টে অর্ধেক টাকা পড়েছে – ৮০০ টাকার জায়গায় পড়ে ৪০০ টাকা ও বাকি ৪০০ টাকা তাঁদের দৈনিক মজুরি থেকে কেটে নেয়। বেসিক কেটে নিয়ে যোগ করা হয় ট্রাভেল অ্যালাউন্স খাতে কিছু টাকা। পে-স্লিপ হাতে পেয়ে নিজেদের সঙ্গে ঘটতে থাকা আর্থিক বঞ্চনার ছবিটি স্পষ্ট হওয়ার পরেই আন্দোলন শুরু করেন শ্রমিকেরা গত ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে।

 

প্রথমে কারখানার ভেতরে চলছিল প্রতিবাদ আন্দোলন। ২০ তারিখ তাঁদের জানানো হয় তাঁরা যেন কাজ শুরু করেন, মালিক পক্ষ কারখানায় এসে তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন। সকাল ৯টা থেকে ৫.৩০টা পর্যন্ত তাঁদের কাজ চলার পরে তাঁরা জানতে পারেন মালিক ও পুরো ম্যানেজমেন্ট টিম রামচন্দ্রপুর পঞ্চায়েত অফিসে মিটিং করে চলে গেছেন। মালিক ফোন করে দেন ও তাঁর সঙ্গে আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। ২১ ফেব্রুয়ারি কারখানায় এসে শ্রমিকেরা দেখেন কোম্পানি কর্তৃপক্ষ সাসপেনশন অফ ওয়ার্ক-এর নোটিস টাঙিয়ে দিয়েছে গেটে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে। ২২ফেব্রুয়ারি থেকে মূল ফটকের বাইরে অবস্থান শুরু করেন আন্দোলনকারী মহিলা শ্রমিকেরা।

সাসপেনশন অফ ওয়ার্ক-এর নোটিস

ভোর চারটেয় দিন শুরু হয়। সকাল সাড়ে ছ’টার মধ্যে রান্নার পাট মিটিয়ে সংসারের বাকি কাজকর্ম সেরে ৮.১৫-এর মধ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ৮.৫৫তে মূল গেট পেরিয়ে কারখানায় ঢুকে যাওয়া। সারা দিনের কাজ শেষে আবার বাড়ি ফিরে বাড়ির যাবতীয় কাজ, রান্না মিটিয়ে শোওয়া রাত ১১টা-১২টায়। নিজেদের পরিশ্রম নিয়ে আসলে কোনো অভিযোগ নেই এই মহিলা শ্রমিকেদের। নিজেদের শ্রমের বিনিময়ে উপার্জন করেন, এ তাঁদের জোরের জায়গা। লড়াইটা মালিক পক্ষের বঞ্চনা ও ঠকিয়ে নেওয়ার প্রবণতার বিরুদ্ধে, যা শ্রমিক তথা মহিলা শ্রমিকদের আন্দোলনে এ বাংলায় নজির তৈরি করে রাখল।

 

আন্দোলনের ফলশ্রুতি: অবিচ্ছন্ন অবস্থান বিক্ষোভ চালিয়ে যাওয়া ও নিজেদের দাবিতে অনড় থাকা এবং মালিক ছাড়া আর কারোর সঙ্গে আলোচনায় রাজি না হওয়ার কারণে অবস্থানের ২২তম দিনে ১৫ মার্চ মালিক পক্ষর তিন জন প্রতিনিধি ম্যানেজিং ডিরেক্টর অনিল বাগারিয়া, সিইও সুব্রত বিশ্বাস ও এইচ আর ম্যানেজার আন্দোলনকারীদের তরফে ছ’জনের এক প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনায় বসেন সোনারপুর থানায়। সেখানে তাঁদের দাবি মেনে নেওয়া হয় বলে শ্রমিকদের তরফ থেকে জানানো হয়েছে। যদিও অবস্থান তাঁরা তোলেননি। সোমবার ১৭ মার্চ সব শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে তবেই Agreement-এর কাগজে তাঁরা সই করবেন বলেও জানানো হয়েছে এবং পরবর্তীতে যাতে তাঁদের শ্রমিক স্বার্থ কোনোভাবে ক্ষুণ্ণ না হয়, তারজন্য লেবার কমিশনের সঙ্গেও যোগাযোগ করবেন।*

 

 

Share this
Tags :
Recent Comments
1
  • comments
    By: Dilip Kumar Dutta on March 16, 2025

    আন্দোলনের প্রতি বলিষ্ঠ সমর্থন জানাই, এবং তার সঙ্গে আন্তরিক অভিনন্দন রইল।

Leave a Comment