পরিবেশ আন্দোলনের সকল ধারা মিলিত হোক দেউচায় কয়লা তোলার আস্ফালনের বিরুদ্ধে, আদিবাসীদের জমি কেড়ে নেওয়ার হিংস্রতার বিরুদ্ধে। লিখলেন শুভ প্রতিম।
Groundxero | March 11, 2025
“চাইলে আগামিকাল অর্থাৎ বৃহস্পতিবার থেকে দেউচা পাচামিতে কাজ শুরু করা যেতে পারে। সমস্ত পরিকাঠামো তৈরি।” ঠিক এই গর্বিত ঘোষণা দিয়ে বাণিজ্য সম্মেলনের মুখবন্ধ তৈরি করে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। গত ৫ ফেব্রুয়ারি, কানায় কানায় ভর্তি প্রেক্ষাগৃহে শিল্পপতি ও মিডিয়ার সামনে। করতালিতে ফেটে পড়েছিল প্রেক্ষাগৃহ। অদূরে বীরভূমের মহম্মদবাজার ব্লকের দেউচা-পাঁচামির আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামগুলির ললাট লিখন সেদিনই লেখা হয়ে গিয়েছিল।
এর আগের কয়েক সপ্তাহ ধরেই প্রশাসনিক মহলে গুঞ্জন ছিল দেউচা-পাঁচামিতে কয়লা উত্তোলনের প্রাথমিক কাজ শুরু হবে। কিন্তু তা যে বাণিজ্য সম্মেলনের মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করবেন, তা অনেকেই ভাবেননি। অনেকের কথা নিয়ে তাঁর চলে না। তিনি চলেন নিজের পরিকল্পনায়, প্রকল্পে। এই বঙ্গে তিনিই যে শেষ কথা! তাই, ‘ওটা দিতে হবে’। ঘোষণার পরদিনই, ৬ ফেব্রুয়ারি বীরভূমের জেলাশাসক বিধান রায় বলেন, ‘‘চাঁদা মৌজায় সরকারি খালি জমিতে কাজ শুরু হয়েছে। কয়লা তুলতে গেলে আগে ব্যাসল্ট সরাতে হবে। আজ থেকে সেই কাজ শুরু হয়ে গেল।’’ অর্থাৎ ‘বাবু যত বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুণ’। ঘোষণার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই শুরু হয়ে গেল জঙ্গল কেটে সাফ করার আর জমি খোঁড়ার কাজ।
প্রতিরোধের ‘চড়কা’
কয়েক মিটার খনন তখন হয়ে গিয়েছে। গর্তের পাশেই ভিড় তখন আদিবাসী মহিলাদের। ঠিকাদার সংস্থার কর্মীরা তাঁদের প্রতিবাদী মুখ দেখে পিছিয়ে গেলেন। স্লোগান উঠলো, ‘রক্ত দিতে হয় দেবো, জন্মভূমি ছাড়বো না, কয়লাখনি হবে না’। গর্ত থেকে উঠে আসা মোরামের স্তূপে পোঁতা হল ‘চড়কা’। ‘চড়কা’ হল আদিবাসীদের আপত্তির প্রতীক। ‘চড়কা’ পুঁতে দেওয়া মানে বন্ধ করে দেওয়া।
গত ৪ মার্চ, ‘দেউচা পাঁচামি গ্রামসভা’-র পক্ষ থেকে সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত হয় –
“দেউচা পাচামির চাঁদা, সাগরবান্দি গ্রামে যে কয়লা খনির কাজ বেআইনী ভাবে শুরু করেছিল সরকার সেই কাজ আজ সকালে আদিবাসী মহিলারা মিলে চড়কা দিয়ে আটকে দিয়েছেন। ওনারা জানিয়ে দিলেন
১। কয়লাখনি প্রকল্প অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে
২। কেউ উচ্ছেদ হতে চান না
৩। আর গ্রামসভার সম্মতি না নিয়ে বেআইনি ভাবে খনন করা যাবে না।
৪। কোনো রকমের প্যাকেজ চান না
সকলে পাশে দাঁড়ান। পুলিশ প্রশাসনের তাণ্ডব রীতিমত বেড়ে গিয়েছে এলাকায়। গ্রামের মানুষকে আজকের মধ্যে চড়কা (অবরোধ) তুলতে বলেছে পুলিশ। নাহলে ওনারা কঠোর ব্যবস্থা নেবেন বলে গ্রামে থ্রেট দিচ্ছে খোদ মহম্মদ বাজার থানার ওসি।
এই খবর যত পারবেন ছড়িয়ে দিন।”
গত ৬ মার্চ, ‘দেউচা পাঁচামি গ্রামসভা’-র পক্ষ থেকে সামাজিক মাধ্যমে আবার প্রচারিত হয়-
“আজ দেউচা পাচামির সাগরবান্দি গ্রামে সব গ্রামের মানুষ একত্রিত হয়ে আলোচনা করার কথা ছিল। জানা যাচ্ছে, সকাল থেকেই প্রতিটা গ্রামের লোককে পুলিশ বাধা দিচ্ছে ও বিভিন্নভাবে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে যাতে আজকের জমায়েত না করতে পারে। চতুর্দিকে পুলিশ ব্যারিকেড করে রেখেছে। এলাকায় এখনও গতকাল থেকে ইন্টারনেট বন্ধ যাতে এলাকার খবর বাইরে না আসতে পারে। সকলে এগিয়ে আসুন, জল জঙ্গল জমি, তথা পরিবেশের এই আন্দোলনের পাশে দাঁড়ান।”
গ্রামের মেয়েরা সামনে আসেন, প্রতিরোধ গড়ে তোলেন পাড়ায় পাড়ায়, গ্রামে গ্রামে। ধামসা মাদলের দ্রিমি দ্রিমি জানান দেয় প্রতিবাদে পথে নেমেছে দেউচার মানুষ।
বাইক মিছিল, থ্রেট কালচার ও তিহার ফেরতে হোমরা-চোমরা
৬ মার্চ আন্দোলনের তীব্রতায় প্রমাদ গোনে প্রশাসন। নির্দেশ আসে সর্বোচ্চ স্তর থেকে, নেমে পড়ে প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব। তৃণমূলের মোটরবাইক মিছিল ঘোরে গ্রামে গ্রামে। চরম পর্যায়ের হুমকি দেওয়া হতে থাকে গ্রামবাসীদের। নামানো হয় পুলিশ বাহিনীকে।
আসরে নামেন বীরভূমের ডেপুটি সুপারিন্টেনডেন্ট অফ পুলিস, অয়ন সাধু। প্রকাশ্যে হুমকি দেন উনি। সরাসরি বলেন, “আগে যখন সমস্যা (আন্দোলন) হয়েছিল তখন সাদি হাঁসদার ভাইয়ের জীবন গেছিল।” অর্থাৎ সাদি হাঁসদার ভাইয়ের মত অবস্থা হবে দেউচার আন্দোলনকারীদের। উল্লেখ্য, ২০২২ সালের আন্দোলনে প্রাণ যায় হাবরা পাহাড়ির ধনা হাঁসদার।
পুলিশ-প্রশাসনের পাশাপাশি শাসকদলের বাড়ি বাড়ি গিয়ে থ্রেট চলতে থাকে। গ্রামবাসীরা জানান আসরে নেমেছেন রাজ্যসভার সাংসদ সামিরুল ইসলাম। ৬ মার্চের রাতের অন্ধকারেই মথুরাপাহাড়ি গ্রামের কিছু সংখ্যক আদিবাসীদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বিডিও অফিসে। সেখানে জেলাশাসকের উপস্থিতিতে তৃণমূলের বীরভূম জেলার সভাপতি, তিহার ফেরত অনুব্রত মণ্ডল গ্রামবাসীদের সঙ্গে কি কথা বলেন তা সহজেই অনুমেয়। মিটিং শেষে মথুরাপাহাড়ি গ্রামের কালিচরণ মুর্মু বলেন অনুব্রত মন্ডল তাঁদের আশ্বাস দিয়েছেন যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। বুঝতে বাকি থাকে না থ্রেট কালচার-এর গভীরতা। কোন অধিকারে একজন রাজনৈতিক নেতা পুলিশ নিয়ে, প্রশাসনের অফিসে বসে গ্রামবাসীদের ‘বোঝানো’-র দায়িত্ব নেন? হুমকি দেওয়া হয় অন্যত্রও। হুমকির মাত্রা এতটাই যে জনৈক গ্রামবাসী বলেন, “আত্মহত্যা করতে হবে আর কোন পথ নেই আমাদের।” এখনও অব্দি যা যা ঘটনা হয়েছে বলে প্রকাশ তা সন্ত্রাসের ভগ্নাংশ মাত্র। সারা মুহম্মদবাজার ব্লক, মল্লারপুর ষ্টেশন, দেউচা ঢোকার বিভিন্ন রাস্তা জুড়ে সাদা পোশাকের পুলিশ নজর রাখছে সবকিছুই।
কেন দেওচা-পাচামিতে কয়লা উত্তোলনের বিরোধিতা করা দরকার? কেন এই প্রকল্প একই সঙ্গে মানবাধিকার এবং পরিবেশ রক্ষার বিরুদ্ধে এক বৃহত্তর ষড়যন্ত্র তা নিয়ে আলোচনার সময় এসেছে। এই লেখায় সামসাময়িক কয়েকটি গবেষণা ও সমীক্ষার সাহায্য নেওয়া হয়েছে। এই রিপোর্টটিতে স্থানীয় মানুষের জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে এবং পরিবেশের নিরিখে খোলামুখ কয়লাখনি কত বড় বিপদ তা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
‘যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু’
একটু ইতিহাসে ফেরা যাক। আমরা যে তথ্য পাচ্ছি তা হল, ১৭৭৮ সালে প্রথম খনন শুরু হয় রানিগঞ্জ-ঝরিয়া অঞ্চলে। প্রায় আড়াইশো বছর আগের সেই সময়ে না ছিল পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার জন্য কোনও আইন, না ছিল শ্রমিকদের নিরাপত্তা সম্পর্কিত কোনও আইন। ইংরেজ শাসনের সেই সময়ে বেশিরভাগ ভূগর্ভস্থ খনিতেই অগভীর খননকার্য হওয়ার পর সেই খনিগুলি এখন মিথেন গ্যাসে পরিপূর্ণ, পরিত্যক্ত ও জলমগ্ন হয়ে ছোট ছোট পিলারের ওপরে দাঁড়ানো।
পিলারগুলি বয়সের ভারে দুর্বল ও ভঙ্গুর, ফলত প্রতিনিয়ত ধসের সম্মুখীন। মিথেন গ্যাস থেকে খনিতে আগুন লেগে, বিপদ বেড়েছে কয়েক গুণ। ৪৭-এ ইংরেজ শাসনের অবসানের পর মালিকানার বদল হয়, কয়লা খনিগুলি ব্রিটিশ কোম্পানিদের হাত থেকে বিভিন্ন দেশীয় পুঁজিপতিদের মালিকানায় বদল হয়। শুধুমাত্র মুনাফা অর্জন— এই লক্ষ্য ব্রিটিশ বা ভারতীয় সকল কোম্পানিই বজায় রাখে।
১৯৭৩ সালের ১ মে Coal Mines (Nationalization Act), 1973, এই আইন আনুসারে বেসরকারি বাণিজ্যিক খননের একচেটিয়া রাজত্ব খতম করে কয়লা খনিগুলির জাতীয়করণ করা হয়। ১ নভেম্বর, ১৯৭৫-এ সরকারি কোম্পানি কোল ইন্ডিয়া (Coal India) স্থাপিত হয়। এর অধীনে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে পূর্বতন কয়লা কোম্পানিগুলিকে নিবন্ধিত করা হয়। কোল ইন্ডিয়ার অধীনে থাকে ভারত কোকিং কোল লিমিটেড, ইস্টার্ন কোল ফিল্ড লিমিটেড, ওয়েস্টার্ন কোল ফিল্ড লিমিটেড ইত্যাদি সংস্থাগুলি। কিন্তু নয়ের দশকে ভারতে নয়া-উদারবাদী নীতি গ্রহণ করা হয়, বলা যেতে পারে নতুন করে ‘কোম্পানি রাজ’-এর শুরু হয় সেই সময়। খনিগুলি থেকে আরও মুনাফার লক্ষ্যে বেসরকারি খোলামুখ কয়লা খনির অনুমতি দেয় কয়লা মন্ত্রক। সুড়ঙ্গ কেটে নয়, ডিনামাইট ফাটিয়ে খোলামুখ খনি থেকে কয়লা তোলার ফলে তাদের খরচ কমে, কিন্তু ব্যাপক ক্ষতি হতে থাকে পরিবেশের। ধস, গ্যাস, আগুন সঙ্গী হয় কয়লাঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষের।
খোলামুখ খনন এবং অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বেআইনি খননের ফলে পরিত্যক্ত পুরনো খনিতে, যেখানে আগে থেকে মিথেন গ্যাস রয়েছে, সেখানে আগুন লেগে ধসের ঘটনা ঘটছে। ICML, Bengal Emta ইত্যাদি বেসরকারি, এমনকি সরকারি ECL-এর খনিগুলিতে যে কেউ গেলেই দেখতে পাবেন, খনিতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। ঝাড়খণ্ডের ঝরিয়া এলাকায় বিস্তীর্ণ এলাকা এভাবেই জ্বলছে। অত্যধিক তাপমাত্রার ফলে আশেপাশের গাছপালা গেছে শুকিয়ে। ঝরিয়া শহর তো বহুদিন থেকেই সম্ভাব্য ধস নামার জন্য খালি করে দেওয়ার কথা, পুরো শহরটাই যেকোনও দিন খাদে তলিয়ে যেতে পারে। এসবের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে আশেপাশের মানুষ, গাছপালা, জীবজন্তুদের ওপর। প্রতিদিন হাওয়ায় মিশছে বিষাক্ত গ্যাস, যা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে বহু বর্গ কিলোমিটার পর্যন্ত। এছাড়াও অতি গভীর খোলামুখ কয়লাখনির কারণে জলস্তর নেমে যাচ্ছে উদ্বেগজনকভাবে। মানুষ জলকষ্টে ভুগছেন।
কোল ইন্ডিয়া হোক বা রাজ্য সরকার, তাদের এসব জানা নেই, তা নয়। পরিত্যক্ত কয়লা খনি থেকে কয়লা চুরি এই অঞ্চলের ‘অর্থনীতি’-র বড় ‘শরিক’। তার ‘মধু’ পানে সক্রিয় রাজনৈতিক মদতপুষ্ট কয়লা-মাফিয়ারা। কয়লা-মাফিয়ারা এখন রাজনৈতিক ক্ষমতারও শরিক। রাজ্যের শাসক দলের নেতাদের পকেটে হোক বা দলীয় ফান্ডে, কয়লা চুরির টাকা এই আমলের দুর্নীতির অন্যতম বড় দিক। বিগত ১০ বছরে কয়লা চুরি পশ্চিমবঙ্গের এই প্রান্তে প্রায় ‘বৃহৎ শিল্প’-এ পরিণত। তবে মাফিয়া-নেতার আঁতাতের ক্ষেত্রে আজকের দিনে বলা যায়, এখন কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসক দল দু’টির আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিনের আলোর মত পরিষ্কার। এসবের প্রতিকার চেয়ে আন্দোলন হয়েছে বহুবার, আসানসোল-রানিগঞ্জ এলাকায়, বহু স্থানে। আন্দোলন দমন করতে পুলিশ ও মাফিয়াদের গুন্ডাবাহিনির অত্যাচার, মিথ্যা মামলা দায়ের, নিরবচ্ছিন্ন সন্ত্রাস চলছে প্রান্তিক মানুষদের ওপর। পশ্চাৎপট এই। এখন দেখা যাক একটি সমীক্ষার নির্যাস।
একটি সমীক্ষার নির্যাস
‘পিপলস কালেকটিভ ইন্ডিয়া’ একটি সমীক্ষা চালায় ঝাড়খণ্ডের একটি খোলামুখ কয়লাখনি এলাকায়। ফেব্রুয়ারি, ২০২১-এ সমীক্ষার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা চিকিৎসক ও গবেষকদের দল সমীক্ষা করেন কয়লা এবং সংশ্লিষ্ট শিল্পের ৩ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে চারহি, দুরুকাস্মার, তাপিন, দুধমাটিয়া— রামগড় জেলার এই প্রত্যন্ত চারটি গ্রামে। এই রামগড়েই আছে সেন্ট্রাল কোলফিল্ড এবং টাটা স্টিলের কোলিয়ারি। সবই খোলামুখ।
তাদের সর্বমোট ২৩৫৩টি সমীক্ষিত স্বাস্থ্য তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে এখানের মানুষের প্রধান দশটি রোগের কথা। সেগুলি হল, ব্রঙ্কাইটিস (হাঁপানি সহ); সিওপিডি/কার্ডিওভাসকুলার (নিশ্বাসের সমস্যা); যক্ষা; ত্বক (কালো/সাদা দাগ, চুলকানি, আলসার); চুল (পতন/হ্রাস, বিবর্ণ); চোখ (জল পড়া ও লাল); পা/পায়ের পাতা (ফাটা, আলসার); কোমরে ব্যাথা, বাত এবং পেটের অসুখ। এই এলাকার বায়ু, জল, মাটি আর পলি পরীক্ষা করে পাওয়া গেছে মারাত্মক দূষণ, বিভিন্ন বিষাক্ত ভারী ধাতু। বায়ুদূষণ (পিএম ২.৫) যা ভারতীয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও মার্কিন নিয়ন্ত্রক নির্দেশিকার সীমা অতিক্রম করেছে। বাতাসে যে পরিমাণ ম্যাঙ্গানিজ, নিকেল ও সিলিকন পাওয়া গেছে তা স্বাস্থ্য নির্দেশিকার নির্দিষ্ট মাত্রার অতিরিক্ত। মাটিতে ক্রোমিয়াম, ভ্যানাডিয়াম, আর্সেনিক, ক্যাডিয়াম পাওয়া গেছে, যা পরিবেশ রক্ষায় নির্দেশিত কানাডীয় মৃত্তিকা নির্দেশিকার মাত্রা অতিক্রম করেছে। বিষাক্ত ক্রোমিয়াম ও নিকেল পাওয়া গেছে পলিতে, ফলে জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব সঙ্কটে। অ্যালুমিনিয়াম, লোহা, ম্যাঙ্গানিজ পাওয়া গেছে জলে, যা ব্যুরো অফ ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড নির্দেশিত মাত্রার বাইরে।
আবার জীবাশ্ম জ্বালানি
আবার একটু তথ্য ও ইতিহাসে চোখ রাখা যাক। আমরা জানি, জলবায়ুর বর্তমান আপৎকালীন অবস্থার প্রধান কারণ জীবাশ্ম জ্বালানি। সেই শিল্পবিপ্লবের কাল থেকে কার্বন নিঃসরণের ৮০ শতাংশ উৎস হল কয়লা, পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস। কয়লা উত্তোলন সম্পর্কিত যাবতীয় কাজ খনন, ওয়াশিং থেকে পরিবহণ, শিল্পে ব্যবহার অর্থাৎ কয়লার দহন ক্রিয়া বায়ুমণ্ডলে বিষাক্ত গ্যাস নির্গমন করে। বিশেষত খোলামুখ কয়লা খনি হল এক বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ পদ্ধতি। খোলা মুখ খনি মানেই মাটির ভিতরের বর্জ্যর পাহাড়। শুধু ধস নয়, এর ফলে স্থলজ ও জলজ বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি হয় ব্যাপক। এর ফলে শুধু ওই এলাকার নয়, এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলের কৃষিজ-বনজ উৎপাদন ও পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হয়। আসানসোল থেকে কলকাতা ২১৩ কিমি আর মুহম্মদবাজার থেকে ২০৯। অদূরেই শান্তিনিকেতন, দূষণের শিকার কিন্তু সকলেই।
ভারত সহ কয়লা উৎপাদক দেশগুলির ওপর সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, বিষাক্ত দূষক যা কয়লা থেকে নির্গত হয় তা হল, ভারী ধাতুর মধ্যে কঠিন বর্জ্য হিসাবে আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম, সীসা, পারদ এবং বায়ুমণ্ডলীয় কণার মধ্যে সালফার ডাইওক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড এবং গ্যাসীয় নির্গমনের মধ্যে ওজোন।
সত্যি আজ বড় বিপদ। দুনিয়া জুড়ে ৪৩২টি নতুন কয়লা প্রকল্প (২,২৭৭ মিলিয়ন টন প্রতি বর্ষে) অনুমোদিত হয়েছে। এর বেশিরভাগ অংশ এই চারটি দেশে— চিন (৬০৯), আস্ট্রেলিয়া (৪৬৬), ভারত (৩৭৬) ও রাশিয়ায় (২৯৯)। আবার ভারতের প্রকল্পগুলির বেশিরভাগ ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ ও ছত্রিশগড়ে, যা পুরো দক্ষিণ এশিয়ার কয়লার ৭৭ শতাংশ।
দেশের আদিবাসী জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশের বসবাস এই চারটি রাজ্যে। আমাদের দেশে বিগত দশকগুলিতে ৬ কোটি আদিবাসীর মধ্যে ৪০ শতাংশ মানুষ উৎখাত হয়েছেন বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে। কোল ইন্ডিয়া জানাচ্ছে আগামী পাঁচ বছরে তারা ৫৫টি নতুন খনি খুলতে চলেছে যা তাদের উত্তোলন ক্ষমতা ১৯৩ শতাংশ বৃদ্ধি করবে। ‘ল্যান্ড কনফ্লিক্ট ওয়াচ’ জানাচ্ছে সারা দেশে ৭০৩টি জমি নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে যা ৬৫ লক্ষ মানুষের জীবন ও জীবিকা বিপর্যস্ত করেছে। উন্নয়ন মানে শুধু আদিবাসী উচ্ছেদ এবং জীবাশ্ম জ্বালানির প্রকল্প।
দেউচা-পাচামি: আবার বিষ, আবার উচ্ছেদ
এই প্রেক্ষিতে আসা যাক, দেউচা-পচামি প্রসঙ্গে। আমরা জানি, বীরভূমের মুহম্মদবাজার ব্লকের ১১,২২২ একর এলাকা জুড়ে এই কয়লা ব্লক। যার পরিমাণ বলা হচ্ছে ২.২ বিলিয়ন টন। প্রথমে ইস্টার্ন কোল ফিল্ডকে কয়লা উত্তোলনের দায়িত্ব দেওয়া হয়, কিন্তু তারা কোনও উদ্যোগ নেয় না। ২০১৪ সালে কেন্দ্র সরকার পশ্চিমবঙ্গ সহ ছয়টি রাজ্যে এটি নেওয়ার প্রস্তাব দেয়, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসে না। ২০১৮-তে কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গকে এই খনি দেয়।
ইতিমধ্যেই এই এলাকা পাথর খাদানের দূষণে দূষিত। পাথর খাদান এই অঞ্চলের মানুষের জীবনে কোনও আর্থিক উন্নতি ঘটায়নি। উপরন্তু ক্ষতি করেছে তাঁদের চাষবাস, তাঁদের সংস্কৃতির। প্রশাসন মানেনি আইন। যেমন, খনিজ ছাড় সুবিধা আইন, ১৯৬০ এবং খনিজ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন আইন ১৯৮৮-এর ২০০৩ সালের সংশোধনী অনুসারে খাদান বুজিয়ে ফেলা সংক্রান্ত বিধি এখনও অবধি দেওচা-পাচামিতে মানা হয়নি। খনন-উত্তর জমি, জলের মান উন্নয়ন, বায়ুর মান উন্নয়ন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, মৃত্তিকার উপরিভাগ বিষয়ক ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি সংক্রান্ত নির্দেশিকা পালন করা হয়নি। এখানে অতি গভীর খাদান ও অন্যদিকে বর্জ্য ও ধুলোর পাহাড়গুলো পড়ে আছে বহুদিন। সেখানকার রাস্তা মানেই চার পাঁচ ইঞ্চির ধুলো যা মানুষের শরীর ও প্রকৃতির ক্ষতি করে আসছে কয়েক দশক। চারিদিকে সবুজহীন ধূসর প্রান্তর। এই সবুজহীনতা আর ধুলোও কিন্তু আদিবাসী সংস্কৃতি পরিচ্ছন্নতার পরিপন্থী, যা এঁদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরসঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে ‘এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম কয়লা ব্লক’ থেকে কয়লা উত্তোলনের আস্ফালন।
এলাকাটি আদিবাসী অধিকার রক্ষাকারী সংবিধানের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তফসিলের অধীনে নেই। অথচ বীরভূমের এই এলাকায় আদিবাসীদের গ্রাম আছে। ঝাড়খণ্ডে সাঁওতাল পরগণা এবং ছোটনাগপুর এলাকায় আদিবাসীদের জমির রক্ষাকবচ হিসাবে যথাক্রমে সাঁওতাল পরগণা টিনেন্সি অ্যাক্ট, ১৯৪৯ এবং ছোটনাগপুর টিনেন্সি অ্যাক্ট, ১৯০৮ আছে। এই আইন বলে আদিবাসীদের জমি অ-আদিবাসীদের বিক্রি করা যায় না। প্রতিবাদী মিটিঙে বহুবার এই দাবি উঠেছে, এলাকাটি যাতে সংবিধানের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তফসিলভুক্ত হয় বা উক্ত দুটি আইনের মতো নির্দিষ্ট কোনও আইন প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু কোনও আমলেই তা করা হয়নি। জমি-ডাকাতরা এর সুযোগ নেবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
‘উদ্ধত মূর্খের অসহ্য দম্ভ’
এর প্রেক্ষিতে আমরা দেখবো আজকের দেউচার চিত্র, যা এই লেখাটির শুরুতে এসেছে। বাস্তব হল, নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুরের জমি আন্দোলন থেকে রাজনৈতিক মুনাফা তোলা বর্তমান শাসক দল দেউচা নিয়ে যে ভূমিকা নিয়েছে তা এক কথায় জমি-ডাকাতের ভূমিকা। আর নগ্ন বাস্তব হল সেই সময় অধিকার রক্ষাকর্মী হোন বা সুশীল সমাজ ছিল প্রতিবাদী কাতারে আর আজ তাঁদের একটা বড় অংশ হয় ২১শে জুলাইয়ের মঞ্চে অথবা ফিল্ম উৎসব, কবিতা উৎসব, গান মেলা নামক হাজারো উৎসবের জৌলুষে। তাঁদের কাজ রাজ্য সরকারের যাবতীয় কর্ম, অকর্ম, অপকর্মকে ন্যায্য প্রমাণ করা। এরা আর জি কর থেকে যাদবপুর, এরা শিক্ষা-দুর্নীতি থেকে দেউচা সর্বত্র আছে বিভিন্ন ভূমিকায়। এরা গণশত্রু।
১৮৯৫ সালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছিল ‘উলগুলান’, আদিবাসীদের সর্বাত্মক বিদ্রোহ। পাতাজোড়া বিজ্ঞাপনে হুল, উলগুলান নিয়ে বিশেষ বিশেষ দিনে বাণী দেন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী। দিতেই পারেন। দেউচায় এই সব শব্দাবলি অবশ্য উচ্চারণ করা যাবে না, করলে ‘মাওবাদী’, ‘নকশাল’ ইত্যাদি প্রভৃতি। উদ্ধত বুদ্ধ-সরকারের পতন দেখেছে পশ্চিমবঙ্গ। ফ্যাসিস্ট মোদির করজোড়ে ‘কৃষি আইন প্রত্যাহার’ দেখল দেশ, বিশ্ব। ভারতের সংবিধান, বনাধিকার আইন, ২০০৬ আদিবাসীদের জমি রক্ষার গ্যারান্টি দিয়েছে। দেউচাকে সবুজ থাকতে দিন। আদিবাসী উচ্ছেদ বন্ধ হোক।
আর পরিবেশ আন্দোলনের সকল ধারা মিলিত হোক দেউচায় কয়লা তোলার আস্ফালনের বিরুদ্ধে, আদিবাসীদের জমি কেড়ে নেওয়ার হিংস্রতার বিরুদ্ধে। অযোধ্যা পাহাড়, জলঙ্গি নদী, যশোর রোডের গাছ, জলাভূমি বাঁচানোর সকল আবেগ, লড়াই মিলিত হোক।
কৃতজ্ঞতা – ‘দেউচা পাঁচামি গ্রামসভা’, জুঁই কোলে এবং উদ্ভাস দাস
তথ্যসূত্র-
১। দেওচাঃ বাতাসে বিষের গন্ধ, শুভ প্রতিম, ৪ নম্বর প্লাটফর্ম, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২১
২। ‘চাইলে আগামিকাল থেকেই দেউচা পাচামিতে কয়লা উত্তোলন! বাণিজ্য সম্মেলনে বড় ঘোষণা মুখ্যমন্ত্রীর’, সংবাদ প্রতিদিন, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
গণ আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার / নচেৎ এই মানুষখেকোদেড় বিরুধ্যে কিছু করা যাবেনা। দরকার পড়লে সশস্ত্র আন্দোলন দরকার