এমন মেয়ের গল্প আমাদের সিনেমায় বলা হয়নি। শূচী চমৎকারভাবে বলেছেন। তাছাড়া পুরুষতন্ত্রের নিগড়ে এই ভাবে মেয়েদের গল্প মাইক্রোস্কোপের কাচের সামনে ফেলে মেয়েরাই বলতে পারে। গার্লস উইল বি গার্লস – ছবিটি দেখার অভিজ্ঞতা লিখলেন দেবারতি গুপ্ত।
Groundxero | March 7, 2025
বাংলায় হলে ছবিটার নাম দেওয়াই যেত মা, মেয়ে আর ক্লাস টুয়েলভ। পরিচালক শূচি তালাতি নাম দিয়েছেন ‘গার্লস উইল বি গার্লস’। ছবির আমল আমাদের কিশোর কালের সেই নব্বইয়ের দশক। মোবাইল নেই, বাড়িতে কম্পিউটার – ইন্টারনেট কিছু নেই। মনে হয় যেন হাজার বছর আগের এই সেদিন।
সেই সেদিনের এক ১৭ বছরের ভাল মেয়ে মীরা। আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভাল মা হতে চাওয়া মাঝবয়সী অনিলা। মীরা শুধু ভাল মেয়ে নয়। সে কো-এড স্কুলের প্রথম মেয়ে যে হেড প্রিফেক্ট হয়েছে। পরীক্ষায় কুড়িতে উনিশ। স্কার্টের দৈর্ঘ্য হাঁটুর ওপরে ওঠেনি কোনদিন। স্কুলের প্রিন্সিপাল মীরাকে উদাহরণ করে বাকি মেয়েদের তার মতোন হতে বলে। দেরাদুনের মতো একটি আধা সাহেবি শহরের বোর্ডিং স্কুল। তা এসব স্কুলে যেমন হয়। হেড প্রিফেক্ট মীরা রোজ সকালে মাইকে স্কুল এবং দেশের মর্যাদা রক্ষার অঙ্গীকার করে আর গোটা স্কুল তা আউড়ে নেয়। মেয়েদের হাতে নেলপলিশ থেকে কোন ছেলে বন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা অবধি সব নজরদারির দায়িত্ব মীরার।
তবু তো ক্লাস টুয়েলভ! এটা তো শুধুই মীরার মতোন বোরিং নিয়মনিষ্ঠদের সময় হতে পারে না। এখানে সদ্য ডানা গজানো মেয়ে আর সেই ডানায় হাওয়া দেবার মতো ছেলেরাও আছে। তারা হয়তো সাময়িকভাবে মিষ্টি মেয়ে মীরার নেতৃত্ব মেনে নিয়েছে। তাই বলে তো আর সূর্য পশ্চিমে উঠবে না। ছেলেরা ছেলেই থাকবে। তারা মীরাকে আওয়াজ দেবে, বাকি মেয়েদের স্কার্টের নীচে দৃশ্যমান পায়ের ছবি তোলার চেষ্টা করবে। আর করবে নাই বা কেন? এদের তো বড়ো হয়ে আদর্শ পুরুষ হয়ে উঠতে হবে নাকি! অথচ দিদিমনিদের নিষেধাজ্ঞা সব মেয়েদের ওপর। তাদের ওপর নির্দেশ, ছেলেদের এই অসভ্যতা এড়িয়ে যাওয়াই ভাল।
মীরার এহেন অস্পৃশ্য কৈশোরে শ্রীনিবাস এল হংকং থেকে। সে মীরার দিকে তাকিয়ে হাসে। বিনীত ঔদ্ধত্যে স্কুলের প্রার্থনা অঙ্গীকার উচ্চারণের সময় মুখ টিপে হাসে শুধু। যে পরীক্ষায় মীরা ২০ তে ১৯ পায় তাতে শ্রীনিবাস মোটে ৮ পায় তবু মীরার দিকে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তাকিয়ে থাকে। স্কুল করিডোরে নোটিসবোর্ডের সামনে এসে স্নিগ্ধ চতুরভাবে ফ্লার্ট করে যায়। এরপর মীরার আর মীরাবাঈ হওয়া হয় না। হালকা রাধাভাব দেখা দেয়। বোর্ডিং এর ছাতে শ্রীনিবাসের উদ্যোগে অ্যাস্ট্রোনমি ক্লাব চালু হয়। সেখানে টেলিস্কোপে চোখ রাখে মীরা। শ্রীনিবাস তাকে মহাকাশ দেখায়। সে রাতে যত তারা সব ওদেরই আকাশে…
সেই তারাদেখা রাতে দুজনে দুজনকে দুটো ব্যক্তিগত গোপন খবর জানায়। ছোট থেকে মা নেওটা শ্রীনিবাস একবার তার মাকে পোশাক বদলাতে দেখে ফেলে। সেই তার প্রথম কোন নারী শরীরকে নগ্ন হতে দেখা। ওই দৃশ্য দেখে সে ভয়ে পালায়। শুনে মীরা মৃদু হেসে জানায় একবার তার স্কুলের সোয়েটার হারিয়ে গেছিল। মায়ের ভয়ে সে তার এক সহপাঠির সোয়েটার চুরি করে নেয়। সেই মেয়েটি জানতেও পারে নি কিন্তু সোয়েটার খোয়ানোর দোষে বকুনি খায়। মীরার খারাপ লেগেছিল কিন্তু সত্যিটা স্বীকার করতে পারে নি। এইসব বলা কওয়াতে পরিচালক তালাতি, ছেলেটির সেই আলোছায়া ঘরটি আমাদের সামনে খুলে দিলেন, যার দোরে স্বচ্ছ একটা পর্দা টাঙানো আছে কি নেই কে জানে! আর বোঝা গেল, এই ১৭ বছরের জীবনে মীরা ভাল মেয়ে হয়ে থাকার চাপ সামলাচ্ছে। যে ভাল হয়ে থাকা জানে তার স্কুল বিল্ডিংএর লম্বা করিডোর। জানে সেই করিডোর দিয়ে ওঠা নামার সিঁড়ি, এই ভাল মেয়ের চাপের খবর।
এই অতি ভাল মেয়ের মা কেমন? মেয়ের কীর্তিতে আহ্লাদিত, একটু প্রগলভ বাকিটা সংসারে তেমন পাত্তা না পাওয়া মাঝবয়স। মীরার কাছে তার স্কুলের শিক্ষিকা মিস বনসালি আদর্শ আর নিজের মা অনিলা মাঝে মাঝেই অস্বস্তি আর বিরক্তির কারণ। মীরা তার বাবার মতোন হতে চায়, গৃহবধূ মাকে সে কোন মতে সয়ে নেয়। দেখতেও তাকে তার উত্তর ভারতীয় বাবারই মতোন। মালয়ালি মায়ের গাঢ় ত্বক থেকে লঘু চলন মীরার জিন প্রায় কিছুই গ্রহণ করে নি। রাতে খেতে বসে বাবা যখন ঠাট্টার ছলে অনিলাকে হ্যাটা করে তখন তাতেও সামিল হয় মীরা। ঠাট্টা শুনে অনিলার গম্ভীর হয়ে যাওয়াও বড়ো একটা পাত্তা পায় না বাবা-মেয়ের খুনসুটিতে।
তবে অনিলার দায়িত্বশীল মা হবার আপ্রাণ চেষ্টা। সে মেয়ের পায়ের লোম তুলতে যতটা উদ্যমী, রাতে কর্ডলেসে মেয়ে কোন ছেলে বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছে সেই নজরদারিতেও সমান তৎপর।
কিন্তু পড়বি তো পড় পরীক্ষার আগেই প্রেমে পড়লো মীরা! মহাকাশ দেখতে শেখানো শ্রীনিবাসের পাশে বসেই সে ল্যাবরেটরির মাইক্রোস্কোপে চোখ রাখে। অনেক দূর থেকে খুব নিকটকে দুজনে একসঙ্গে পরখ করতে থাকে। নিজের আর জীবনের প্রথম পুরুষের শরীর আবিষ্কার করতে থাকে। এসব আন্দাজ পেয়ে অনিলা বুঝে নিতে চায় এই ছেলেটির সঙ্গে তার মেয়ে কত গভীরে ডুব দিয়েছে। শ্রীনিবাস মীরার বাড়িতে নেমন্তন্ন পায় আর অনায়াসেই অনিলার স্নেহের উঠোনে জায়গা করে নেয়। যে উঠোন খালি পড়েছিল তার স্বামী-কন্যার ঔদাসীন্যে।
একদিকে মীরার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিচ্ছে শ্রীনিবাস, আরেকদিকে অনিলার অনর্গল আস্কারায় তারও বন্ধু হয়ে উঠেছে। প্রথম আলাপে আন্টি বললেও এখন সাহেবী কায়দায় অনিলাকে সে নাম ধরে ডাকে। তার প্রাক্তন প্রেমের গল্প করে অনিলার সঙ্গে। আবার পাছে মীরার শরীরের বেশি কাছে চলে যায় সেই আশঙ্কায় গ্রুপ স্টাডির দুপুরে অনিলার খাটে ঘুমোতে হয় শ্রীনিবাসকে। এখান থেকেই দর্শকের অস্বস্তি শুরু হবে। মীরা আর দর্শক দুয়েরই চোখের সামনে মীরার বয়ফ্রেন্ড তার মায়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠে, যেখানে মীরা ছোট ভাল মেয়েটি হয়ে বসে থাকে বায়োলজি বই নিয়ে। কোন বাড়াবাড়ি না দেখিয়েও এই অস্বস্তি তৈরি করতে পেরেছেন পরিচালক, সেখানেই চিত্রনাট্যের মুন্সিয়ানা। মা মেয়ে আর শ্রীনিবাসের মধ্যে তৈরি হওয়া এই ত্রিকোণই অবশ্য ছবিটিকে সাধারণ থেকে উত্তীর্ণ করেছে।
২০ তে ৮ পেলে কি হবে, শ্রীনিবাস বেজায় বুদ্ধিমান। নইলে মীরার ওপর তো কত ছেলেই অনুরক্ত। তাদেরকে টপকে এত সহজে এগিয়ে যেতে পারতো না! সে মীরাকে অকপটে জানায় অনিলার সঙ্গে এত মাখামাখি তো মীরার জন্যেই। অনিলা একটু গুরুত্ব চায়, সেটুকু জোগান দিলেই তাদের মেলামেশায় কোন বাধা আসবে না। মীরাও মেনে নেয়। ঠিকই তো!
কিছুটা স্ট্রিট স্মার্ট আর খানিক ভালনারেবল কিশোর শ্রীনিবাসের মধ্যে রয়েছে এক আধুনিক উদার পুরুষের সম্ভাবনা। মীরার মতো মেয়ের একে ভাল না লাগার কোন কারণ নেই। এই ধরণটি আমার বেশ চেনা। এধরনের ছেলেরা নেতৃ স্থানীয় মেয়েদের আলগোছে ভালই কব্জা করে নিতে পারে। শ্রীনিবাস কখনো কেষ্টঠাকুর আবার কখনো অয়দিপাউস হয়ে আনাগোনা করে মা আর মেয়ের জীবনে। মীরা যতই হেড প্রিফেক্ট হোক এসব টের পেতে তার বেশ কয়েকটা বিকেল গড়িয়ে যায়। এমনকি মীরার মায়েরও। তাই তো গার্লস উইল বি গার্লস!
যে কারণে সবদিক দিয়ে সেরা হয়েও মীরা ছেলেদের দলে ঠাট্টার পাত্রী। একটি ছেলের প্রেমের প্রস্তাব ভদ্রভাবে নাকচ করায় ছেলেদের হিংসারও পাত্রী! তার ওপর হংকং থেকে আসা নতুন ছাত্র শ্রীনিবাসের সঙ্গে মাখামাখি সহপাঠী বন্ধুদের তো বটেই, প্রিয় শিক্ষিকা মিস বনসালিরও ভুরু কুঁচকেছে। এভাবে শূচি তার নায়িকার হাত ধরে আমাদেরও চিনিয়ে দেয় মেয়েদের ওপরের ওঠার সিঁড়ি আজবরকমের পেঁচানো।
এই সিঁড়ি ভাঙার অঙ্ক বুঝতে বুঝতে মীরা তার মায়ের অসহায়তাকে খুঁজে পায়। যে মাকে নিয়ে সে বিব্রত সিনেমার শেষে সেই মা তাকে চরম বিপদ থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। এখানে যত না মাতৃত্বের মহিমা তার চেয়ে বেশি মেয়ের বন্ধু হয়ে ওঠার বৃত্ত পূর্ণ হয়। অনিলা মীরার বন্ধু হতে চেয়েছিল বলেই তো নিজের পছন্দ মতোন ছোট স্কার্ট পরতে উৎসাহ জুগিয়ে গেছে, মীরার বাবার আপত্তি স্বত্তেও। দুই মেয়ের এই বন্ধুত্বে একটু ঈর্ষা বা টানাপোড়েন নেহাৎ মানবিক।
শূচি তালাতি ভাল গল্পকার। মীরার চোখ দিয়ে এমন এক কৈশোরকে দেখিয়েছেন যা আমাদের শ্রেণী-সংস্কৃতিতে বেশ পরিচিত। সর্বক্ষণ ইংরিজিতে কথা বলা ছাড়া আর কিছুই বিদেশী লাগেনি আমার। তবে কি না ভারতবর্ষের মধ্যে তো আমার গরীব দেশ আর ওদের ধনী বিদেশ দুই আছে। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে শূচির ছবি ভারতের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সেই বিদেশের গল্প। তাছাড়া দক্ষিণী অনিলা তার উত্তর ভারতীয় স্বামীর সংসারে হয়তো স্বাভাবিকভাবেই ইংরিজিতে কথা বলবেন।
গল্প বলতে নানান ডিটেইল সাজিয়েছেন শূচি কিন্তু তেমন উদ্দেশ্যহীণ ঘোরাঘুরি নেই। অথচ একটা নির্দিষ্ট সময় আর স্থানকে তুলে ধরতে এই সিনেমাটিক র্যাম্বলিং খুব জরুরী। কিন্তু আঁটোসাঁটো চিত্রনাট্য ক্যামেরাকে এদিক ওদিক করতে দেয়নি। তাই ওই বোর্ডিংস্কুলের পাহাড়ি শহরটাকে দু একটি দৃশ্য বাদ দিলে আমাদের তেমন চেনার সুযোগ হয় না। দেখা হয় না উচ্চবিত্ত আর্থ-সমাজের বাইরের কোন চরিত্রকেও। ছবিতে আশ্চর্যজনকভাবে বোর্ডিং স্কুলের কোন ঝাড়ুদার বা পিওন নেই। অনিলার বাড়িতে নেই কোন পরিচারক। মীরার স্কুল আর বাড়ি মিলিয়ে আসা যাওয়ার পথেও তেমন গরীব – গুর্বো চোখে পড়ে না। মীরা-অনিলা-শ্রীনিবাসের ত্রিকোণ শুধু নারী আর পুরুষের বাইনারিতেই বিভক্ত। সে আর কোন অসাম্য দেখে বড়ো হয় না! আর এই দেখে কিছুটা ভয়ও লাগে! না জানি মীরার মতো এরকম আরো কত ভালো মেয়েদের বেড়ে ওঠায় তাদের স্কুলের কেয়ারটেকারের দুষ্টু মেয়েরা বেমালুম উধাও। (না কি লিঙ্গ রাজনীতি তার নিজস্ব বৈষম্য নিয়ে এত মশগুল যে আর কোন অবিচার চোখে পড়ে না)। আর তাই মীরার জন্যে সহানুভূতি তৈরিতে একটা অস্বস্তি কাজ করতে থাকে। মনে হয় সে টেলিস্কোপ আর মাইক্রোস্কোপ দিয়েই শুধু দুনিয়াটাকে দেখতে শিখছে। আপন হতে বাহির হয়ে খালি চোখে নিজের চারপাশ সেভাবে দেখার প্রশিক্ষণ হয় না এই মীরাদের। কি দুর্ভাগা!
হতে পারে পরিচালক অযথা বহির্জগত দেখিয়ে মীরার মনোজগতের নিরিবিলিতে গোল পাকাতে চাননি। এখনকার সিনেমার নিয়মই তাই – প্লটের বাইরে যাওয়া যাবে না। গেলেই দর্শক বাইরে চলে যাবে। সেই নিয়ম মেনে বেশ নির্মেদ আর সাবলীল ছবি। তেমনি সহজ অভিনয় প্রত্যেকের। মীরার চরিত্রে প্রীতি পানিগ্রাহি যেন সকাল বেলার আলো। আর শ্রীনিবাসরূপী কেশব বিনয় কিরণ সেই আমাদের সময়কার হিরোর মতোন। দেখলেই মনে হয় পঁচিশ-তিরিশ বছর আগে এর সঙ্গেই তো স্কুল-কলেজ থেকে হেঁটে বাড়ি ফিরতাম। আর কানি কুশ্রূতি তো এই সময়ের স্মিতা পাতিল। সেই বিরিয়ানি থেকে অল উই ইম্যাজিন… কানি অনায়াসে ছবির চরিত্রে থিতু হয়ে যান।
পরিশেষে বলি এমন মা আর মেয়ের গল্প ভারতে তেমন বলা হয়নি। ‘অপরাজিত’য় আমরা ছেলে আর মায়ের ধ্রুপদী সম্পর্ক দেখেছি। বিদেশে দেখেছি শান্তাল আকেরমানের বিভিন্ন ছবিতে তাঁর মা ঘুরে ফিরে আসেন। তার কাহিনিচিত্র ‘মিটিংস উইথ আনা’, তারপর ডক্যু ছবি ‘নিউজ ফ্রম হোম’ বা ‘নো হোম মুভি’তে আকেরমান-এর শেকড় হয়ে দেখা দেয় তার মা। গ্রেটা গারউইগ-এর প্রথম দিকের ছবি ‘লেডিবার্ড’ অবাধ্য কিশোরী মেয়ে আর তার নাজেহাল মায়ের গল্প। সেখানে ভারতীয় ছবিতে শূচীর ‘গার্লস উইল বি গার্লস’ অন্যরকমের চেষ্টা। শূচীকে নাকি শুনতে হয়েছে তার ছবিটি যথেষ্ট ভারতীয় নয়। আসলে এই ছবি পশ্চিমের আর্কিটাইপ ভারতের মডেলের সঙ্গে খাপ খায় না অনেক জায়গায়, তাই আপত্তি! পরিচালক তালাতি এই এক্সটিক কামসূত্র অথবা দরিদ্র পথের পাঁচালীর বাইরের ভারত হাজির করার পক্ষে দাঁড়াতে চেয়েছেন। আর একথা জানাতে গিয়ে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন ‘ভারতীয় ছবি হতে গেলে সব সময় পভার্টি পর্ন দেখাতে হবে কেন?’ এটা অনেক পরিচালক-প্রযোজকই করে থাকেন। এরকম কথা অভিনেত্রী নার্গিস বলেছিলেন সত্যজিতের ছবি সম্মন্ধে – উনি তো ভারতের দারিদ্র দেখিয়ে বিদেশে কল্কে পেলেন! মূলধারার লোকজন সমান্তরাল ছবির বিষয় এধরনের কথা বলে। শূচীও এই মনোভাব পোষন করেন দেখে ভিরমি খেলাম। বাণিজ্যিক ছবিতে তো হেলিকপ্টারে করে শাহরুখ খান মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসে। শূচীর মতোন শিল্পীরাও কি বিকশিত ভারতের ঢক্কানিনাদে ভুলতে বসেছেন যে দেশটা এখনো আদতে গরীব। এখানে পভার্টি বাস্তব, পর্ণোগ্রাফির মতো উত্তেজক কিছু নয়। বিকল্প সিনেমার সেই বাস্তবকে তুলে ধরারই কথা। তবে আমার আপত্তি শূচীর ওই মন্তব্যে। ছবির নির্মাণের কাজে উনি যথেষ্ট দক্ষতা দেখিয়েছেন। আমার মতে, গার্লস উইল বি গার্লস’ ইংরিজিতে হলেও একান্ত ভারতীয়। মীরা যে সময়ের মেয়ে তখন না ছিল ফেসবুক, না ছিল সেলফি। সেই সময় আমাদের কাকে ঠিক কেমন দেখতে সেই সচেতনতাই তৈরি হয় নি। ব্যক্তি স্বাধীনতা কৌমবোধের চাপে হাঁসফাস করতো। নব্য উদারতা সদ্য এসেছে। তখনকার এলিট ভারতও পশ্চিমের চেয়ে অনেকটাই আলাদা। সেই আধা সামন্ততান্ত্রিক ভারতের আধা সাহেবী স্কুলের মেয়ে মীরা। এমন মেয়ের গল্প আমাদের সিনেমায় বলা হয়নি। শূচী চমৎকারভাবে বলেছেন। তাছাড়া পুরুষতন্ত্রের নিগড়ে এই ভাবে মেয়েদের গল্প মাইক্রোস্কোপের কাচের সামনে ফেলে মেয়েরাই বলতে পারে।
দেবারতি গুপ্ত চলচ্চিত্রকার, প্রাবন্ধিক ও গেস্ট লেকচারার (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়)