খড়্গপুরে রেশ্মি মেটালিক্স স্পঞ্জ আয়রন কারখানার দূষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন


  • February 20, 2025
  • (0 Comments)
  • 507 Views

দীর্ঘদিন ধরেই খড়্গপুরে  রেশ্মি মেটালিক্সের একটি স্পঞ্জ আয়রন কারখানা ভয়ানক রকমের দূষণ করে আসছে। গতবছর খড়্গপুরের পাঁচবেড়িয়া এবং বিদ্যাসাগরপুর লাগোয়া NH এর কাছে ওয়ালিপুর মৌজায় একটি জমিতে নতুন কারখানা বাসিয়ে চিমনি বসানো শুরু করলে এলাকার সাধারন মানুষরা জনজাগরন কমিটি তৈরি করে এর বিরুদ্ধে আন্দোলোনে নামে। সৌপর্ণ চক্রবর্তীর রিপোর্ট।

 

Groundxero | Feb 21, 2025

 

দীর্ঘদিন ধরেই খড়্গপুরে রেশ্মি মেটালিক্স নামক স্পঞ্জ আয়রন প্রস্তুতকারক একটি কারখানা ভয়ানক রকমের দূষণ করে আসছে। যার ফলে শহরজুড়ে নানারকম স্বাস্থ্যগত সমস্যা তো তৈরি হয়েছেই, কিছু এলাকায় দূষণের মাত্রা এতটাই বেশি যে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছেন মানুষেরা। দীর্ঘদিন অভিযোগ জানানো সত্ত্বেও এই দূষণ তো বন্ধ হয়নেই উলটে রেশ্মি মেটালিক্স খড়্গপুর ও তার আশেপাশে নতুন কারখানা তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গতবছর খড়্গপুরের পাঁচবেড়িয়া এবং বিদ্যাসাগরপুর লাগোয়া NH এর কাছে ওয়ালিপুর মৌজায় একটি জমিতে নতুন কারখানা বাসিয়ে চিমনি বসানো শুরু করলে এলাকার সাধারন মানুষরা জনজাগরন কমিটি তৈরি করে এই চিমনি বসানোর বিরুদ্ধে আন্দোলোনে নামে। জনজাগরন কমিটি আন্দোলনের চাপে কারখানা কতৃপক্ষ কারখানা থেকে চিমনি সহ সমস্ত মালপত্র সরিয়ে নিয়ে যায়। গত ৬ ই ফেব্রুয়ারি জনজাগরন কমিটির পক্ষ থেকে এই নতুন কারখানা তৈরি সম্পূর্নভাবে বন্ধ করার জন্য এবং রেশ্মির দূষণের বিরুদ্ধে এস ডি ও অফিসের সামনে বিক্ষোপ কর্মসূচী এবং নির্দিষ্ট কিছু দাবিকে সামনে রেখে এস ডি ও কে ডেপুটেশানের কর্মসূচি নেওয়া হয়।

 

স্পঞ্জ আয়রন বর্তমানে ভারতের সবচেয়ে দূষিত শিল্পগুলোর একটি। স্পঞ্জ আয়রন তৈরির ক্ষেত্রে কয়লা ছাড়াও জ্বালানি হিসাবে প্রাকৃতিক গ্যাস এর ব্যবহার হলেও ভারতের ক্ষেত্রে মুলত কয়লাই ব্যবহার করা হয়। স্পঞ্জ আয়রন কারখানা থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড ছাড়াও অ্যালুমিনিয়াম, কার্বন, লোহা, সিলিকন, ম্যাঙ্গানিজ এবং ক্যাডমিয়াম সহ কপার, নিকেল, জিঙ্কের মত ভারী ধাতু গুলোও ডাস্ট হিসাবে বাতাসে মেশে। এছাড়াও ফিউগেটিভ ডাস্ট অর্থাৎ যে ডাস্ট এর নির্দিষ্ট কোনো উৎস নেই, কাঁচামাল আনার সময় বা উৎপাদিত সামগ্রী লোডিং-আনলোডিং করা, জমা রাখা বা বাইরে পাঠানোর সময় নানা ধরনের ডাস্ট আশেপাশের এলাকা, রাস্তায় ছড়িয়ে পরিবেশের মারাত্বক ক্ষতি করে। এই বায়ূ দূষণে ক্যান্সার সহ ফুসফুসের নানারকম সক্রামক রোগ যেমন কফ, ব্রঙ্কাইটিস, হাঁপানির ইত্যাদি ব্যাপক ভাবে দেখা যায়। এছাড়াও ত্বকের রোগ, চোখের দৃষ্টি কমে যাওয়ার রোগ প্রচুর দেখা যায়।

 

রেশ্মির এই দূষনের জন্য গোকুলপুর সহ খড়্গপুরের মালঞ্চ, ভবানিপুর, পাচবেড়িয়া, বিদ্যাসাগরপুর, নিউটাউন এই সমস্ত জায়গায় বাসিন্দাদের নানা রকম রোগ হচ্ছে। বহুবার কারখানার নামে দূষণ পরিষদে অভিযোগ গেলেও ESP (Electrostatic Precipitator), ব্যাগ ফিল্টার এইসব লাগানো আছে এই অযুহাত দিয়ে মালিকপক্ষ পার পেয়ে যায়। কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই এই যন্ত্রগুলো বন্ধ রাখা হয়, কিংবা সম্পূর্ণভাবে দূষন রোধ করতে পারে না। ঝাড়খন্ডের স্পঞ্জ আয়রন কারখানাগুলোর উপর এরকম একটি সার্ভেতে ৫০% কারখানায় দেখা গেছে ESP থাকার পরও দূষিত গ্যাস নিয়োগ হচ্ছে। তবে শুধু বায়ু দূষণ নয়,কারখানার আশেপাশের বেশিরভাগ পুকুরে pH (potential of hydrogen), নাইট্রেট, ফসফেট, হাইড্রোজেন সাইফাইড, সালফেট, সায়নাইড এবং পারদ, সিসা, ক্যাডমিয়ামের মত ভারী ধাতুগুলোর মাত্রারিক্ত উপস্থিতির কারনে জলজ বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস হওয়ার সাথে সাথে গ্রামের বাসিন্দাদের ব্যাবহারের অনুপোযুক্ত হয়ে পড়েছে। শুধু তাই নয়, স্পঞ্জ আয়রনের উৎপাদনে প্রচুর জল ব্যবহারের জন্য খড়্গপুরের ভূগর্ভস্ত জলের স্তরও অনেকটা নিচে নেমে গেছে। অন্যদিকে শহরে জমা অতিরিক্ত জল কাসাই নদীর দিকে স্বাভাবিক প্রবাহ অনেকটাই বন্ধ হয়ে গেছে এই কারখানার জন্য। ফলে পাচবেড়িয়া, নিউটাউন, বিদ্যাসাগরপুর এলাকায় বর্ষাকালে জল জমে যাচ্ছে। কারখানার পার্শবর্তী এলাকায় চাষের ফলন ভয়ানক ভাবে কমে গেছে। বিকল্প জীবিকা হিসাবে রেশ্মি এলাকার লোকজনকে কাজের প্রতিশ্রুতি দিলেও, বর্তমানে এলাকার খুব কম লোকই রেশ্মির কারখানায় কাজ পেয়েছে।

 

খড়্গপুর ছাড়া ঝাড়গ্রামের জিতুশোলেও রেশ্মির একটি প্ল্যান্ট আছে। ব্যাপক দূষণের কারনে সেখানকার আশেপাশের গ্রামগুলোর অবস্থাও খুব খারাপ। কয়লা নির্ভর স্পঞ্জ আয়রন পৃথিবীর অনেক দেশে বন্ধ হয়ে গেলেও ভারতের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে রমরমিয়র চলছে। মূলত তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্পঞ্জ আয়রন তৈরি হয় ভারতেই। বিশ্বের মোট স্পঞ্জ আয়রনের ২০% তৈরি হয় ভারতেই। স্পঞ্জ আয়রনের এই ব্যাপক দূষণের প্রভাব উড়িষ্যা, ছত্রিশগড়, ঝাড়খন্ড, পশ্চিমবঙ্গ, কর্নাটক এবং গোয়া সহ দেশের নানা রাজ্যে মানুষের জীবন, জীবিকার ব্যাপক ক্ষতি করেছে। ঊড়িষ্যা, ছত্রিশগড়, পশ্চিমবঙ্গ, অন্ধ্রপ্রদেশ এর জঙ্গল লাগোয়া অঞ্চলগুলি যেখানে আর্থ সামাজিক ভাবে মানুষ ভয়ানক ভাবে পিছিয়ে, স্পঞ্জ আয়রন প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো কারখানা তৈরির জন্য মূলত এইসব অঞ্চলকেই টার্গেট করে। এবং এই কারখানাগুলো যাতে অবাধে হতে পারে স্পঞ্জ আয়রনকে লাল তালিকাভুক্ত ইন্ডাষ্ট্রির মধ্যে জায়গা দিলেও দূষণ ও কারখানা স্থাপন সম্পর্কিত বহু নিময় নিতি শিথিল করা হয়। স্পঞ্জ আয়রনের এই দূষণের বিরুদ্ধে বহু জায়গায় প্রতিরোধেও নেমেছে মানুষ। ২০০৮ সালে উড়িষ্যার সুন্দরগড়ে ৫০০ জন মহিলা একসাথে প্রতিবাদ জানায় স্পঞ্জ আয়রন কারখানার বিরুদ্ধে। এই প্রতিবাদের ফলস্বরুপ ১২ টা স্পঞ্জ আয়রন কারখানা বন্ধ হয়।  ২০০৯ এর জুন মাসে ছত্রিশগড়ের সিলতারা ও উরলাতে স্থানিয় মানুয রাস্তা দখল করে প্রতিবাদ জানায় স্পঞ্জ আয়রন কারখানার বিরুদ্ধে। ২০২১ সালে ছত্রিশগড়ের যশপুর জেলার মূলনিবাসী জনগনরা স্পঞ্জ আয়রন কারখানার বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসনকে চিঠি লিখে জানায় অরন্য ধ্বংস করে আমাদের লোহা কিংবা বিদ্যুৎ চাই না। ২০০৯ সালে কর্নাটকের কুনডিলে বার বার প্রতিবাদ সত্ত্বেও যখন রাজ্য পলিউসান বোর্ড কারখানা চালিয়ে যাওয়ার ছাড়পত্র দেয়, তখন গ্রামবাসীদের লাগাতার আন্দোলনে ভয় পেয়ে প্রশাসন বাধ্য হয় কারখানার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে। সারা দেশজুড়ে স্পঞ্জ আয়রনের এই সর্বগ্রাসী দূষণের বিরুদ্ধে জনগনের প্রতিরোধের প্রচুর ইতিহাস আছে।

 

খড়্গপুরে রেশ্মির এই দূষণের বিরুদ্ধে বহুদিন ধরেই এলাকাবাসীরা প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন। ঘনবসতিপুর্ন এলাকার এত কাছে এইধরনের কারখানা করার নিয়ম না থাকলেও মানি মাসল পাওয়ারের জোরে ক্রমাগত নিজেদের কারখানার সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছে এই কোম্পানি। রেশ্মি কারখানার পার্শবর্তী গোকুলপুর অঞ্চলের মানুষ দীর্ঘদিন ধরেই দূষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আসছেন। নানা রকমে কেসের ভয় কিংবা টাকার লোভ দেখিয়ে এই আন্দোলনকে দমানো যায়নি। এই আন্দোলনের জেরেই কিছু এলাকায় কৃষি জমি দখল করেও কাড়খানার কাজ শেষ করতে পারেনি কতৃপক্ষ। শুধু গোকুলপুর নয়, খড়্গপুরে শহরে মালঞ্চ, খরিদা অঞ্চলে খড়্গপুর দূষণ প্রতিরোধ কমিটির মাধ্যেমে এলাকার মানুষরা দীর্ঘদিন ধরেই এর দূষণের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে। খড়্গপুর নাগরিক সমাজের উদ্যোগে নানা সময় বিভিন্ন এলাকায় স্পঞ্জ আয়রনের দূষণের বিরুদ্ধে প্রচার কর্মসূচী নেওয়া হয়েছে। খড়্গপুর জনজাগরন কমিটির তৈরি হওয়ার পর শেষ কয়েকমাস পাড়ায় পাড়ায় সভা করে কর্মসূচী হয় রেশ্মির দূশণের ক্ষতিকারক প্রভাব বোঝানোর উদ্দ্যেশ্য। পাচবেড়িয়া ও বিদ্যাসাগরপুরের নানা ক্লাব এবং সামাজিক মঞ্চও সামিল হয় এই উদ্যোগে। খড়্গপুর জনজাগরন কমিটি এবং খড়্গপুর নাগরিক সমাজ পক্ষ থেকে খড়্গপুরের ইন্দায় রেশ্মির দুষণের বিরুদ্ধে আয়োজিত  সভায় দাবি ওঠে “রেশ্মি হঠাও, খড়্গপুর বাঁচাও”। ৬ ই ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই ব্যাপক জমায়েত হয় SDO অফিসের সামনে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে জনগনের সম্মিলিত স্বরে বার বার স্লোগান উঠতে থাকে রেশ্মির বিরুদ্ধে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় বিশাল পুলিস বাহিনী। কিন্তু কমিটির পক্ষ থেকে প্রতিনিধি দল ডেপুটেশান দিতে গেলে জানতে পারে যে আগে থেকে সময় দিলেও অদ্ভুত কারনে SDO অফিসেই আসেনি। SDO এর অনুপস্থিতিতে তখন ডি এম ডি সিকে ডেপুটেশান দেওয়া হয়। ডেপুটেশানে দাবিগুলো ছিল নিম্নক্ত।

 

১) NH – 6 সংলগ্ন এবং পাঁচবেড়িয়া, নিউ টাউন এবং বিদ্যাসাগরপুরের মতো জনবসতিপূর্ন এলাকার কাছে ওয়ালিপুর মৌজায় প্রস্তাবিত নতুন কারখানা স্থাপন অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার নিকটবর্তী হওয়ার কারণে, এটি জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশ উপর অপূরণীয় ক্ষতি করবে। আমরা প্রশাসনের কাছে দাবি জানাই সরকারি নির্দেশনামার মাধ্যমে নিশ্চিত করা হোক ওই এলাকাতে কোনো ধরনের দূষণকারী কারখানা তৈরি হবে না।

 

২) দেখা গেছে যে কারখানা থেকে অবৈধভাবে তার বর্জ্য (কালো ছাই) খোলা কৃষি জমি এবং বসতিপূর্ন এলাকায় ফেলে ভয়ানক ভাবে জমি, বায়ু এবং জল দূষণ করছে। এটা দ্রুত বন্ধ করতে হবে।

 

৩) রেশ্মি গ্রুপ অফ কোম্পানিস এবং খড়্গপুরে তাদের বিদ্যমান কারখানাগুলির উপর একটি তদন্ত শুরু করতে হবে। এই কারখানাগুলো থেকে হওয়া অত্যধিক বায়ু, শব্দ, এবং অন্যান্য ধরনের দূষণের অবিলম্বে সুরাহা হওয়া দরকার। এই দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে নতুবা দূষণকারী কারখানাগুলো বন্ধ করতে হবে।

 

৪) রেশ্মির নতুন নির্মিয়মান কারখানার কারণে জলনিকাশী ব্যাবস্থার অবস্থা শোচনীয়। ইমলিতলা পাঁচবেড়িয়া থেকে ওয়ালিপুর মৌজা পর্যন্ত ড্রেন এবং নির্মিয়মান কারখানার কাছে নিউ টাউন এবং বিদ্যাসাগরপুরের জলনিকাশী ড্রেন এর মাধ্যমে খড়্গপুরের সমস্ত বর্জ্য জল খড়্গপুর থেকে বেরিয়ে যায়। কিন্তু নির্মিয়মান কারখানার কারণে এই জলনিকাশী ব্যাবস্থায় ভয়ানক সমস্যা হচ্ছে। এই জন্য এই সমস্ত এলাকায় ভয়ানক ভাবে জল জমে যাচ্ছে। বর্ষার আগে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।

 

SDO অফিস থেকে বেরিয়ে এসে কমিটির পক্ষ থেকে ক্ষোভ জানানো হয় কেন বলা সত্ত্বেও SDO ওইদিন ছিলেন না। গনজমায়েত থেকে শপথ নেওয়া হয় যে দাবিগুলো না মেটা অবদি এই আন্দোলন চলতে থাকবে।

 

Share this
Leave a Comment