আর.জি.কর আন্দোলনকে ঘিরে বাংলার রাজনীতিতে হিন্দুত্ববাদী আখ্যানসমূহ একধরনের বৈধতা পেল। ভারতবর্ষের নারীবাদীরা, ঐতিহাসিকভাবে, দেবী প্রতিমূর্তির সঙ্গে মেয়েদের বা মেয়েদের বিদ্রোহকে মিলিয়ে দেখার বিরোধিতা করেছেন। এই বিরোধিতা ছিল বাংলা সমাজে, সাহিত্যের ভেতরেও। লিখেছেন নন্দিনী ধর।
আর.জি.কর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বলিউডের জনপ্রিয় গায়িকা শ্রেয়া ঘোষাল একটি গান গয়েছেন। গানটি আমার মতে, অতীব নিম্নমানের। অবশ্য, তাতে কিছু এসে যায় না। বামপন্থী গায়ক-কবিরাও বিভিন্ন সময়ে এমন অনেক গান লিখেছেন, যেগুলির শৈল্পিক গুণমাণ অতীব সমস্যাজনক। হতে পারে সেসব গান বিশেষ কোনো আন্দোলনের প্রেক্ষিতে রচিত, কিংবা এমনিই। কিন্তু শ্রেয়া ঘোষালের গানের গুণমান বিষয়ে এই লেখাটি নয়। বরং, লেখাটি শ্রেয়া ঘোষালের গানের সাধারণ ও সার্বিক গ্রহণের রাজনীতি নিয়ে। তার বৃহত্তর বাস্তবতা নিয়ে।
শ্রেয়ার গানটি একটি অনুষ্ঠানে সম্প্রচারিত হওয়া মাত্রই দেখা গেলো যে, ফেসবুক সহ সামাজিক গণমাধ্যমে অতি গদগদ ভাব সবার। যেমনটি আর.জি.কর কান্ড নিয়ে প্রায় যে কোনো কর্মসূচি, যে কোনো শিল্পকর্ম নিয়েই হচ্ছে। যেমনটি হয়েছিল এর আগে অরিজিতের গানটিকে কেন্দ্র করেও।
কিন্তু, শ্রেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপারটি হলো একটু অন্যরকম। দেখা গেলো, যে বেশ কিছু মানুষ বলছেন, শ্রেয়া রাজনৈতিকভাবে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টদের শিবিরের মানুষ। ম্যাঙ্গালোরে রামমন্দির উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে তাঁর গান গাওয়া সেই নিদর্শনই বহন করে। অনেকেই সাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলেন জানুয়ারী ২২, ২০২৪-এ অযোধ্যায় রামমন্দির উদ্বোধন উপলক্ষে শ্রেয়া ঘোষালের টুইটের দিকে। যেখানে শ্রেয়া লিখেছিলেন – Jai Shree Ram. My eyes are filled with tears of joy to see the divine face of Ram Lalla। কাজেই, প্রশ্ন উঠলো, যে এর পরেও শ্রেয়া ঘোষালের গান এই আন্দোলনের “পোস্টার গান” স্বরূপ হয়ে উঠতে পারে কি না। একটি মতামত উঠে এলো যে শ্রেয়া ঘোষালের গান, এই বর্তমান আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচি থেকে বাদ দেওয়াই শ্রেয়।
আবার কেউ কেউ বললেন, এসব যাঁরা বলছেন, তাঁরা নিশ্চিতভাবেই “চটিচাটা”। শ্রেয়া রামমন্দিরের উদ্বোধনে গেয়েছেন তো হয়েছেটা কি? শ্রেয়া তো আর কমিউনিস্ট নন! রামমন্দিরের উদ্বোধনে কেউ গাইলেই “অচ্ছুৎ” হয়ে যাবেন এ আবার কি কথা? গণ-আন্দোলন ঐরকমই হয়। সেখানে ধারণ করতে শিখতে হয় বহু মতকে। আর, যেখানে মূল উদ্দেশ্য আর.জি.কর-এ মৃত-নির্যাতিতার জন্য বিচার আদায় করা, সেখানে এই বিষয়গুলিতে মনোযোগ “মূল” বিষয়টি থেকে সর্বসাধারণের দৃষ্টি সরিয়ে দেবে। এখন প্রয়োজন অনেক কিছুকেই এই চুলচেরা বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গির আতশ কাঁচ দিয়ে দেখা থেকে বিরত থাকা।
প্রসঙ্গত, এই কথা বিজেপি বা সঙ্ঘপরিবারের সদস্য-সমর্থকরা বললে কোনো সমস্যা ছিল না। বরং, যাঁরা এইধারার মতামত সজোরে সমাজমাধ্যমে রাখলেন, তাঁরা প্রায় সবাই বামপন্থী। সংসদীয় অথবা অ-সংসদীয় বামেদের কর্মী, সমর্থক। এবং, এতটাই কোনো কোনো ক্ষেত্রে আগ্রাসী হয়ে উঠলো দ্বিতীয় দলের শ্রেয়া ঘোষালের পক্ষ নেওয়া মানুষজন, যে যাঁরা রামমন্দির-হিন্দুত্ববাদ-শ্রেয়া-ঘোষাল-বলিউড-ফ্যাসিবাদ এসবের আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে কিছু বলতে চাইছিলেন, তাঁরা অনেকেই বিরূপ মন্তব্য শুনে, একঘরে হওয়ার ভয়ে এই বিষয়ে নিজেদের স্টেটাস লিখেও মুছে দিলেন।
আবারও বলি, শ্রেয়াকে নিয়ে আমার তেমন মাথাব্যথা নেই। কিন্তু, এই গোটা পর্বটিকে ঘিরে যে আরও বৃহত্তর রাজনৈতিক বাস্তবতা প্রকাশ পেলো, আমার মাথাব্যথা মূলত তাই নিয়ে।
সেই রাজনৈতিক বাস্তবতা দাঁড়িয়ে আছে দুটি বোধ ও বোঝাবুঝির ওপর।
প্রথমত, বৃহত্তর বাম শিবিরে একটি ধারণা প্রচলিত আছে। কোনো আন্দোলন চলাকালীন নাকি যে কোনো ধরনের জটিল প্রশ্নের উত্থাপন, সমালোচনা, বিরুদ্ধ বক্তব্য, সমালোচনামূলক সংহতি মানা। কেউ সেইরকম ধৃষ্টতা দেখালে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে একদল অতি-উৎসাহী টিয়া-কাকাতুয়া পাখির দল, কিচিরমিচির করে নাস্তানাবুদ করে ছাড়বে। এই ঝাঁপিয়ে পড়ার বেশ কিছু পদ্ধতি বামপন্থী তথা কমিউনিস্ট তথা লেনিনীয় কমিনিউস্ট পার্টির কাছে চিরকালই আছে। তবে, সামাজিক গণমাধ্যমের প্রচলন ঘটার পর সেই ঝাঁপিয়ে পড়া হয়ে ওঠে সহজতর। এবং, সত্যি কথা বলতে কি, এই আন্দোলনের ক্ষেত্রে যাঁরা এই ঝাঁপিয়ে পড়ার কাজটি করেছে, তাঁদেরকে আর যাই হোক বাম-গণতান্ত্রিক-কমিউনিস্ট আন্দোলনের ঐকান্তিক কর্মী-সমর্থক-চিন্তক কিছুই বলা যায় না। এবং, এই যে আক্রমণের নন্দনতত্ত্ব, তা বৃহত্তর সমাজতাত্ত্বিক-রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ও গবেষণার দাবি করে। সেই গবেষণামূলক কাজের স্থান এই লেখাটির স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। তবু, লেখাটির বাকি বক্তব্যকে পরিস্ফুট করতেই, এই জাতীয় আক্রমণের নন্দনতত্ত্ব নিয়ে দু-একটি কথা বলবো।
আন্তর্জালিক ভাষায় এই আক্রমণ-পদ্ধতির নামই বোধহয় ট্রলিং, কিন্তু বাস্তব জীবনে, থুড়ি, আন্তর্জালিক সমাজমাধ্যম জীবনে, এই ট্রলিং বস্তুটি হাজির হয় বহু জটিল দ্যোতনা নিয়ে। সেই দ্যোতনার কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে থাকে এই বোধ যে বিরুদ্ধমত শুনবো না, অন্য বাস্তবতা দেখবো না। আরও একটু বাড়িয়ে বললে, কোথাও যেন একটা এই ট্রলিংয়ের মাধ্যমে প্রস্তুত হয় প্রাত্যহিক ফ্যাসিবাদের সমাজমাধ্যমজাত ট্যাবলয়েড। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ফ্যাসিবাদের প্রাত্যহিকতার সঙ্গে যার দূরত্ব মাত্রই কয়েক গজ। এবং, যে প্রাত্যহিক ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় গভীরভাবে অংশগ্রহণ করেন বাম কর্মী-সমর্থকরাও। আর.জি.কর-রাত দখল-জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন এই বিষয়গুলিকে নিয়ে যে একটি রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিমবঙ্গে তৈরি হয়েছে, সেখানে এই যে প্রাত্যহিক রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদ, যার একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিব্যক্তির ক্ষেত্র সামাজিক গণমাধ্যম, তা ধারণ করলো একটি বিশেষ রূপ। যে রূপ ঠিক কি ভাবে বাংলার রাজনীতিকে প্রভাবিত করবে, আদৌ করবে কি না, তা একমাত্র ভবিষ্যৎই বলতে পারে।
দ্বিতীয়টি প্রথমটির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু বাংলার রাজনীতিতে তার প্রভাব হয়তো হবে আরও অনেক সুদূরপ্রসারী। সেই বিষয়টি হলো, এই আর.জি.কর আন্দোলনকে ঘিরে বাংলার রাজনীতিতে হিন্দুত্ববাদী আখ্যানসমূহকে একধরনের বৈধতা দান। এবং যেটা আরও দুঃখের কথা, তা হলো, এই বৈধতা দান ঘটেছে বাংলার বাম-উদারনৈতিক মহলের কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে, তাদের হাত ধরে। শ্রেয়া ঘোষালের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রতি সমর্থনের বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়া ও সেই সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে বির্তক উত্থাপন করলে খড়গহস্ত হওয়া, সেই বৈধতাদানের বাতাবরণে নবতম সংযোজন।
আসলে, আন্দোলনটির প্রায় প্রথম থেকেই, যে যে মাত্রায় “অরাজনৈতিক” কথাটি বারংবার ব্যবহার করা হয়েছে, তার ভেতর দিয়ে হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলির অংশগ্রহণের পথ সুগম হয়েছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে এই “অরাজনৈতিক” শব্দটির ব্যবহার নিয়ে যে যে মাত্রায় পাল্টা আক্রমণের সুর উঠলো, সেখানে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ও সমর্থকদের একাংশ “অরাজনৈতিক” শব্দটির বদলে “অ-দলীয়” শব্দটির ব্যবহার শুরু করলেন বটে, কিন্তু ততদিনে যতটা যা ক্ষতি হওয়ার, তা হয়ে গেছে। যেহেতু প্রায় কোনো রাজনৈতিক শক্তিই নিজের নাম বা পতাকা নিয়ে আন্দোলন মঞ্চে বা ক্ষেত্রে উপস্থিত হননি, সেক্ষেত্রে হিন্দুত্ববাদীদের অংশগ্রহণেও কার্যত কোনো বাধা ছিল না।
কাজেই, আন্দোলনকে জনপ্রিয় করতে গিয়ে প্রায় প্রথম থেকেই ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে হিন্দুত্ববাদী সাংস্কৃতিক চিহ্ন ও প্রতীকসমূহ। এবং, বহু ক্ষেত্রেই আন্দোলনের পোস্টার বা ব্যানারে প্রতীকের ব্যবহার দেখে বুঝতে চেষ্টা করতে হয়েছে ওই অংশগ্রহণকারী শক্তিটির রাজনীতি কী, বা তাঁরা হিন্দুত্ববাদী কি না। বা, কোনো একটি বিশেষ কর্মসূচি বা “রাত দখল” অনুষ্ঠানের সংগঠক কারা, তাঁদের রাজনীতি কী। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বিভিন্ন পর্যায়ে ত্রিনয়নীর ছবির ব্যবহার বহু পোস্টারে ও অন্তর্জালিক প্রচারে। ত্রিনয়নী, দুর্গা ও তার সঙ্গে নির্যাতিতাকে এক করে দেখা, হিন্দুত্ববাদ প্রভাবিত তথাকথিত নারীশক্তির বয়ানের ভেতর দিয়ে প্রতিবাদকে দেখা, এই সবই যথেষ্ঠ সামাজিক জনপ্রিয়তা গ্রহণ করে এই সময়ে।
মনে রাখা প্রয়োজন, জনপ্রিয় পত্রপত্রিকা থেকে শুরু করে টিভি চ্যানেলে, বারংবার তুলে আনা হয় কেমনভাবে নির্যাতিতা নিজের বাড়িতে দুর্গা পুজোর অনুষ্ঠান শুরু করেছিলেন। কাজেই, জয়েন্ট পাওয়া মেধাবী ছাত্রী, ডাক্তার, “ভালো মেয়ে” ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত হলো আরও একটি একক – নির্যাতিতা নির্দ্বিধায় “ভালো” হিন্দু। অতএব, তিনি হয়ে উঠলেন আমাদের “ঘরের মেয়ে” আরও একটু বেশি করে। আমরা সামাজিকভাবে, আরও একটু নিশ্চিন্ত হলাম। তাই, যেন স্বাস্থ্যভবনের সামনে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের কোনো একটি মঞ্চ থেকে এমন স্লোগানও শোনা গেলো, “আগে হবে অসুর নিধন / তারপর দেবীর বোধন। “এই অপরত্বের ভাষার ব্যবহারে সমাজ হিসেবে আমরা কোনো সমস্যা দেখলাম না। সমস্যা দেখলাম না যে এই “অসুরনিধন” শব্দবন্ধের ভেতরে কেমনভাবে মিলেমিশে আছে একটি আদিবাসী গোষ্ঠীর জীবন পর্যুদস্ত হওয়ার আখ্যান।
বলা বাহুল্য, ঘটনাটির সময় – অর্থাৎ, দুর্গা পুজো ও সার্বিকভাবে যে উৎসবের মরশুম – এই ব্যবহারগুলিকে একরকমের সার্বিক জনপ্রিয়তা ও সামাজিক বৈধতা দান করে, যা অন্য সময়ে ঘটলে হয়তো ঠিক এইভাবে সম্ভব হতো না। উল্লেখ্য এক্ষেত্রে যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের “উৎসবে ফিরুন” মন্তব্য ও তার বিরোধিতা এই ব্যবহারের একটি উর্বর ক্ষেত্র তৈরী করেছিল। সেই নিরিখে ও পরিপ্রেক্ষিতে দেবীবোধন ও অসুরনিধনের প্রতীক ব্যবহার করে প্রতিবাদের কথা ব্যক্ত করা হয়ে উঠেছিল একধরনের জনপ্রিয় প্রতিরোধী সংস্কৃতি। তার হাত ধরেই বহু ক্ষেত্রে ঘটেছে মিছিলে ধুনুচি নাচ, দুর্গার বিভিন্ন অনুষঙ্গ ব্যবহার ও দুর্গা থিম আশ্রিত জনপ্রিয় স্লোগানের প্রচলন। মিছিলের বাইরে, প্রচলন ঘটেছে একধরনের দুর্গা পুজোর উপাচারকে ব্যবহার করে “অভয়ার বিচার চাই,’ বা “জাস্টিস ফর আর.জি.কর” ধরনের স্লোগানের সমাজজীবনে ও আন্তর্জালিক সমাজমাধ্যমে প্রচারে।
স্বভাবতই, সংঘ-পরিবার, বিজেপি বা হিন্দুত্ববাদী দলগুলি এইধরনের প্রতীক ব্যবহার করবে, এবং করেওছে। কিন্তু, সমস্যাটা এই বিশেষ আন্দোলনটির ক্ষেত্রে ঠিক এইখানে নয়। সমস্যাটা এইখানে যে এই আন্দোলনের ক্ষেত্রে এই ব্যবহারগুলি ঘটেছে বৃহত্তর বামেদের হাত ধরে। অবশ্য, এই সব প্রতীক ব্যবহার বৈধতা পাওয়ার অনেক আগেই, ২৭শে আগস্ট, ২০২৪ যখন বিজেপির নেতৃত্বে প্রতিবাদ-কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়, তখনো এই বিতর্ক তৈরী হয়েছিল। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, যে যাদের হাত রাঙা হাথরস, উন্নাও, আসিফা বা বিলকিস বানোর রক্তে-অশ্রুতে, যারা আশ্রয় দেয় ব্রিজ ভূষণ সিংকে, তাদের আর যাই হোক, আর.জি.কর নিয়ে প্রতিবাদ কর্মসূচি নেওয়ার কোনো নৈতিক অধিকার নেই। এই মতামতের বিপরীতে, একশ্রেণীর “বাম-নারীবাদী” বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকরা আওয়াজ তোলেন, যে এই রাজনৈতিক “এলিটিজম”, “অনমনীয়তা” ও “ছুৎমার্গ”-এর ভেতর দিয়ে, বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতকে দেখা যাবে না, ও আর.জি.করের নির্যাতিতা-মৃতার জন্য বিচারও আনা যাবে না। বলা হয়, অন্য যে কোনো দল/গোষ্ঠীর মতো, বিজেপি সহ হিন্দুত্ববাদীদেরও, গণতান্ত্রিক অধিকার আছে প্রতিবাদ কর্মসূচি ডাকার। বলা হয়, ধর্ষণ-রাজনীতির প্রেক্ষিত দিয়ে দেখলে এই দেশে কোনও রাজনৈতিক দলই ঠিক সম্পূর্ণ নিষ্পাপ নয়।
পাশাপাশি, যখন কিছু বক্তব্য উঠলো প্রতিবাদের প্রচারে হিন্দু ধর্মীয় প্রতীক ব্যবহারের, তখন পাল্টা বক্তব্য আনা হলো এই মর্মে যে এই প্রতীকসমূহ প্রকৃতপক্ষে প্রতিনিধিত্ব করে বাংলার খেটে খাওয়া শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের। ধর্মীয় উপাচারের ব্যবহার এখানে আন্দোলনের ভেতরে প্রান্তিক মানুষের অংশগ্রহণকে একভাবে প্রতিনিধিত্ব করে। নিঃসন্দেহে, এই উপমহাদেশের জনজীবনে ধর্ম ও ধর্মীয় উপাচার যেভাবে জড়িয়ে আছে, তার মূল জায়গাগুলিকে অনুধাবন করতে এখানকার বামপন্থীরা মূলগতভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। তৎসত্ত্বেও বলি, এখানে অনেকগুলি জটিলতা আছে।
প্রথমত, “সাধারণ মানুষ” ব্যাপারটা বড়ই জটিল। কে বা কারা ‘সাধারণ মানুষ”, ঠিক কিভাবে “সাধারণ মানুষ” সেসবের সংজ্ঞায়নের কোনো প্রয়োজন বা দায় এইসব বিতর্ক চলার সময়ে প্রায় কারোরই থাকে না। প্রয়োজন থাকে না কোনো জটিল বিশ্লেষণের। ফলত, “সাধারণ মানুষ” বিষয়টিকে সবাই প্রায় নিজের নিজের সুবিধামতো ব্যবহার করে থাকেন। এক্ষেত্রেও ঠিক তাই হলো।
যদিও, এই সমস্ত প্রতীক ব্যবহার করে প্রচার বয়ানের হোতারা প্রায় সবাই শহরের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, এবং তাঁদের এই প্রতীক, সাংস্কৃতিক উপাচারের ব্যবহারের গোটা প্রক্রিয়ায়, সাধারণ মানুষের স্থান পর্যন্ত নেই – ঠিক যেমনভাবে এই গোটা আন্দোলন থেকে বাদ পড়ে গেছে সাধারণ শ্রমজীবী মেয়েদের সুরক্ষার প্রশ্ন, স্বাস্থ্য পরিষেবা ও পেশাগুলিতে যুক্ত নার্স, আয়া, অ্যাটেন্ডেন্ট সহ অন্যান্য “সাধারণ মেয়ে”দের সুরক্ষার প্রশ্ন – রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে, আমদানি করা হলো বহুল প্রচলিত একধরনের চটুল, সারবত্তাহীন প্রান্তিকতা-মার্জিনালিটি-সাব-অল্টার্নিটির যুক্তি কাঠামো। সেই যুক্তি কাঠামোতে আত্মসাৎ করা হলো সাধারণ মানুষকে, শহুরে মানুষের নিজেদের রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে।
সঙ্গে তোলা হলো অনুশীলন সমিতির রাজনীতির কথা – বাংলার বুকে প্রতিবাদী রাজনীতির সন্দর্ভে ধর্মসংস্কৃতির মিশেলের ইতিবাচক ঐতিহাসিক অনুপ্রেরণা হিসেবে। ভুলে যাওয়া হলো যে অনুশীলন সমিতি বা বাংলার যে বিপ্লববাদী আন্দোলন, তার অনেক কিছুই আজ স্বাভাবিক ভাবেই আতশ কাঁচের তলায়। সেই জটিলতায় যাওয়া সম্ভব নয় এই স্বল্প দৈর্ঘ্যের প্রতিবেদনে। কিন্তু, যেটা এক্ষেত্রে অবশ্যই স্মর্তব্য, তা হলো, বাংলার বিপ্লববাদী রাজনীতির গহ্বর থেকেই একদিকে যেমন উন্মেষ ঘটেছিলো বাংলার সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার ও মার্ক্সিয় বামপন্থার এবং সেই ধারা সন্নিহিত একধরনের বাম ধর্ম-নিরপেক্ষতার, তেমনি এই বিপ্লববাদী ভাবধারারই আর একটি ধারা প্রস্ফুটিত হয়েছিল হিন্দুত্ববাদের রাজনীতিতে। সেই ইতিহাসকে আজকের প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে অতো লঘু করে দেখা যায় না, যাবে না। এই গোটা ইতিহাসটিকেই দেখতে হবে সমালোচনামূলক দৃষ্টি দিয়ে, শুধুই ইতিবাচক অনুপ্রেরণাময় দৃষ্টি দিয়ে দেখলে হবে না। কিন্ত, যে পরিবেশ আর.জি.কর-কে ঘিরে তৈরী হলো, সেখানে এই ধরনের কোনো আলোচনার কোনো স্থান থাকলো না।
ভারতবর্ষের নারীবাদীরা, ঐতিহাসিকভাবে, এই দেবী প্রতিমূর্তির সঙ্গে মেয়েদের বা মেয়েদের বিদ্রোহকে মিলিয়ে দেখার বিরোধিতা করেছেন। এই বিরোধিতা ছিল বাংলা সমাজে, সাহিত্যের ভেতরেও। তার একটি সবচাইতে বড়ো গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ বোধহয় প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের ছোটগল্প অবলম্বনে সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা “দেবী।” এই আন্দোলনে, এতো এতো নারীবাদীদের অংশগ্রহণ থাকা সত্ত্বেও, এই যে দেবীত্বর সঙ্গে নারীত্ব, দেবীত্বর সঙ্গে যৌন নির্যাতন বা দেবীত্বর সঙ্গে মেয়েদের প্রতিবাদের অতীব দৃশ্যমান প্রতীকী রাজনীতি, তার কোনো জোরালো বিরোধিতা হলো না। জুনিয়র ডাক্তাররা অন্তত মঞ্চ থেকে বিজেপি বিরোধিতা করে যেটুকু রাজনৈতিক দায় পালন করলেন, এই রাজ্যের নারীবাদীরা, যাঁরা একের পর এক “রাত-দখল” করে তৈরী করলেন একধরনের বাতাবরণ, তাঁরা সেই দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে নিলেন না। তাঁদের ভেতর কেউ কেউ বিজেপি ও ধর্ষণ সংস্কৃতি নিয়ে বিরোধী স্বর রাখলেন বটে, কিন্ত সেই বিরোধিতা, প্রথাগত ও আনুষ্ঠানিক বিজেপি-বিরোধীতার চৌহদ্দি ডিঙোলো না। অবশ্য, কালীপুজো-দীপাবলি উপলক্ষ্যে জুনিয়ার ডাক্তারদের মঞ্চ পশ্চিমবঙ্গ জুনিয়র ডাক্তার ফ্রন্ট, যা কিনা এই আন্দোলনটিকে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে, যে ভিডিওটি সামাজিক গণমাধ্যমে ছাড়লেন, সেখানে গোটা আন্দোলনের রাজনীতিকেই মোটামুটি ব্যাখ্যা করা হলো একজাতীয় “নরম হিন্দুত্ব”র বয়ানে। যদিও মুষ্ঠিবদ্ধ হাত, খেটে খাওয়া মানুষের আন্দোলনে অংশগ্রহণ, এসব দেখানো হলো বটে, সেখানেও আসলে ঘটলো সেই শ্রমজীবী মানুষের রাজনৈতিক চেতনা ও শ্রম আত্মসাতের রাজনীতিই। মূল সুরটি সেখানে রইলো একধরনের স্নিগ্ধ, সুশীতল হিন্দুত্বের।
না, আমি এমন কথা বলছি না যে তাঁরা সবাই – আন্দোলনের নেতৃত্বদায়ী অংশটির সবাই – তা সে নারীবাদীরাই হোন বা জুনিয়র ডাক্তাররা – হিন্দুত্ববাদী হয়ে গেছেন। তা তাঁরা হননি। কিন্তু, যে পরিণত রাজনৈতিক জায়গা থেকে এই জাতীয় হিন্দুত্ব প্রতীক প্রধান সংস্কৃতির বিরূদ্ধে লড়াই গড়ে তোলা যায়, এবং তা গড়ে তোলা যায় যৌন হিংসাবিরোধী রাজনীতি গড়ে তোলার সঙ্গেই, সেই পরিণত রাজনৈতিক বোধ তাঁদের নেই। নেই সেই রাজনৈতিক আত্মবিশ্বাসও। কাজেই, কোনো এক জায়গায়, আন্দোলনের অন্যতম জনপ্রিয় ভাষা হয়ে উঠলো “নরম” হিন্দুত্বের ভাষা, এবং তার বিপরীতে কোনো জোরালো প্রতিবাদ গড়ে তোলা গেলো না।
এই যে বাংলার গণরাজনীতির ক্ষেত্রে হিন্দুত্বের প্রতীকের প্রত্যক্ষ আমদানি, তার দীর্ঘমেয়াদি পরিণতি কি হবে কেউ জানে না। কিন্তু, যেটা আজ পরিষ্কার, তা হলো, বাংলার একটি বড়ো অংশের “প্রগতিশীল”, বাম-উদারনৈতিক মধ্যবিত্ত শহুরে অংশের কাছে বিজেপি তথা হিন্দুত্ববাদীদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি খুব একটা অচ্ছুত বিষয় আর নয়। বিজেপি-সংঘ পরিবারের মুসলিম ঘৃণার ইতিহাস খুব বড়ো বিষয় নয়, বড়ো বিষয় নয় তাদের একের পর এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংগঠিত করার ইতিহাস। বড়ো নয় তাদের দ্বারা সংগঠিত দলিত ও মুসলিম মহিলাদের ধর্ষণের ইতিহাস। বড়ো নয় বিজেপি-সংঘ পরিবারের ফ্যাসিস্ট রাজনীতি। প্রয়োজন হলেই, তাঁরা সেই রাজনীতির সঙ্গে সমঝোতা করতে পারেন। যতই বেদনাদায়ক হোক না কেন, আমাদের সবার জন্যই বোধহয় বড়োই প্রয়োজন ছিল এই মুখোশ খোলা।