বাচ্চাদের লাইব্রেরি “কিতাব ঘর”থেকে ‘ষ্টুডিও সফদার’দ্বারা আয়োজিত ‘শাদিপুর নাটক উৎসব -২০২৪’ নিয়ে তার অভিজ্ঞতা লিখলেন ঊর্মিমালা।
‘ষ্টুডিও সফদার’, কিংবদন্তি থিয়েটার শিল্পী সফদার হাশমির নামে নামাঙ্কিত নিউ দিল্লির শাদিপুরে অবস্থিত একটি স্বাধীন, নন-ফান্ডেড ব্ল্যাক বক্স স্পেস। ২০১২ সালে পুরোনো একটি বিল্ডিংয়ের মধ্যে রেট্রোফিটিং করে, থিয়েটার গ্রূপ ‘জন নাট্য মঞ্চ’(জনম) এটি প্রতিষ্ঠা করে। মলয়শ্রী হাশমির থেকে জানা যায় যে, “সফদার বরাবর শ্রমিক শ্রেনীর বসতি অঞ্চলে একটা সাংস্কৃতিক পরিসরের খুলবার কথা ভাবতেন, যাতে সেই সৃজনশীল স্থানটি শ্রমিক শ্রেনীর পক্ষে easily accessible হয়।“ তাঁর ধারণাকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যেই ‘ষ্টুডিও সফদার’ স্থাপন। শাদিপুর মহল্লাবাসীদের সাথে সেই গোড়া থেকেই নাটক ছাড়াও নানান কার্যকলাপের মধ্যে দিয়ে জড়িয়ে রয়েছে ‘ষ্টুডিও সফদার’। যার মধ্যে বিশেষতম বোধহয় বাচ্চাদের লাইব্রেরি “কিতাব ঘর”।
আশেপাশের বাচ্চাদের বই নিয়ে বইয়ের প্রতি আগ্রহ বাড়ানোর লক্ষ্যে ২০১৫ সালের মে মাসে, প্রতি রবিবার সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বাচ্চাদের জন্য একটি লাইব্রেরি খোলার কথা ঘোষণা করা হয়। চার থেকে চোদ্দোর আশপাশের অনেক শিশু কিশোর আগ্রহ দেখায়। প্রতিটি সেশনে ৩০ থেকে ৩৫ টি করে বাচ্চা আসতে শুরু করে। লাইব্রেরির জন্য ছয় থেকে আটজন স্বেচ্ছাসেবক আসেন। ১০টা থেকে ১২টা এই দুই ঘন্টার প্রথম ঘন্টাটি ব্যয় করা হয় বই পড়তে। স্বেচ্ছাসেবকরা ছোট ছোট বাচ্চাদের বই থেকে গল্প পড়ে শোনান, এমনভাবে পড়া যাতে গল্পটা শুনতে বাচ্চারা মজা পায়, আগ্রহ সৃষ্টি হয়, ছোটরা যাতে বইয়ের ছবির সাথে লেখা শব্দগুলোর মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে পায়। দরকার পড়লে বড়দেরকেও পড়তে সাহায্য করেন স্বেচ্ছাসেবকরা। দ্বিতীয় ঘন্টায় কিছু মজার সৃজনশীল কাজকর্ম যেমন ঐদিনের পড়া কোনো গল্পের ভাবনা নিয়ে ছবি আঁকতে বলা হয়। দেখে নকল করে আঁকা না, জোর দেওয়া হয় তার নিজের ভিতর থেকে সৃষ্টি করার দিকে, তা যেমনই হোক না কেন। যেমন একদিন হয়ত ‘ছোট হওয়ার সুবিধে’ নিয়ে কোনো গল্প পড়া হল। সেদিন বাচ্চাদের বলা হয় যে খুব ছোট হলে সে কি কি করতে পারতো, যেটা সে এখন পারে না, তেমন কিছু আঁকো। কেউ আঁকলো ছোট্ট বলে সে কেমন ফুলের মধ্যে ঘুমাতে পারছে, কেউ পিঁপড়ের পিঠে চেপে বেড়াতে যাচ্ছে, এই সব। এছাড়া তাদের মনোযোগ বাড়ানো, মনে রাখা, ভালো করে লক্ষ্য করতে শেখা বা চিন্তা করতে শেখা, যুক্তি দেওয়ার ক্ষমতা ইত্যাদির প্রতি লক্ষ্য রেখেই কখনো কখনো বাচ্চাদের সাথে নানা রকম খেলাধুলো করা হয়। কখনো অন-দ্য-স্পট গল্প বানানো, একসাথে গান করা, কখনো অভিনয় করানো হয়।
লাইব্রেরির ইনচার্জ নিখিল শর্মা জানান, “ক্রিয়াকলাপগুলি বাচ্চাদের মধ্যেকার নানান সুপ্ত সুকুমার প্রবৃত্তিগুলোকে খুঁজে নিতে এবং একে অপরকে আরও ভালভাবে বুঝতে সাহায্য করে ৷ আমরা বাচ্চাদের চিন্তা করতে উৎসাহিত করি, এমনকি নতুন নতুন খেলা বা কাহিনী উদ্ভাবন করতে উৎসাহ দিই।“ কিতাব ঘরের বাচ্চা ও স্বেচ্ছাসেবকদের শেখানোর প্রক্রিয়াটা আসলে একটা আদান-প্রদানের, পাওলো ফ্রেয়ারের ভাষায় “Those who teach teach by teaching and those who learn teach by learning.” কেউ কেউ কয়েক বছর ধরে নিয়মিত আসছে। আবার কিছু বাচ্চা কিছুদিন পর আর ফিরে আসে না। মলয়শ্রী জানান যে এই “drop out” এর প্রধান কারণ দারিদ্র। তারসাথে অতি মারীটি ছিল যাকে বলে গোদের ওপর বিষফোঁড়া। কোভিদের পর পুনরায় যখন কিতাব ঘর খোলা হলো তখন বহু পরিবার স্থানান্তরিত হয়ে গেছে। অনেকের অভ্যেস চলে গেছে। অনেকেই দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। সেই অভিভাবকদের সঙ্গে অনেক আলোচনার পর আবার বাচ্চাদের ধীরে ধীরে কিতাব ঘরে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু বাচ্চাদের মধ্যে আসবার আগ্রহ অপরিসীম। কখনো কখনো তারা চলে আসে বাড়িতে না বলেকয়ে। কারণ অধিকাংশ পরিবারই এত গরিব যে বাড়ির বাচ্চাটিকেও কোনো না কোনো কাজ করতে হয়। নিখিল জানান যে একটি ছোট্ট মেয়ে কিতাব ঘরে আসে তার ছয় মাসের ভাইকে কোলে করে, এক হাতে ভাইটিকে নিয়ে, অন্য হাতে বই পড়ে। অপরএক স্বেচ্ছাসেবক ইকরা জানান, “এরমধ্যে কিছু কিছু শিশু এমনও আসে যারা স্কুলে যায় না; যখন অনুভব করি যে আমিই তাদের প্রথম শিক্ষক তখন ভীষণ অভিভূত লাগে।”
সফদার হাশমি বলতেন, “We just kept going because the people gave us so much energy”। আর জনমানুষের এই ভালোবাসা আর প্রাণশক্তির জোরেই সফদারের স্বপ্নকে আরো এগিয়ে নিয়ে চলেছেন তাঁর কমরেড সাথীরা। দিল্লির ২০১৯-এ শুরু হয়েছে শাদিপুর নাটক উৎসব। মাঝে অতিমারীর কারণে বন্ধ ছিল দু’বছর। আয়োজক ‘ষ্টুডিও সফদার’। প্রতিবছরই উৎসবে অংশ নেন ভারতের নানান নাট্যদল। ২০২৪-এ চার বছরে পা দিলো। এবছরের মনোনীত দলগুলি ছিল মহারাষ্ট্রের পুনে থেকে আগত দল ‘স্নেহ’ এবং পালগড়, ওয়াড়া থেকে আসা ‘Laugh Again’, কর্ণাটকের শহর বেঙ্গালুরুর দল ‘আওয়ার থিয়েটার কালেকটিভ’ এবং ম্যাঙ্গালুরু থেকে ‘কলাভি থিয়েটার’, পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার দল ‘সন্তোষপুর অনুচিন্তন’, মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়ন থেকে আসা ‘অঙ্কুর রঙ্গমঞ্চ সমিতি’।
অন্য পাঁচটা নাটক উৎসবের থেকে শাদিপুর নাটক উৎসব বেশ কয়েকটি কারণে বিশেষ। প্রথম বিশেষত্ব উৎসবের নাটক মনোনয়ন কমিটি। সম্ভবত এটাই ভারতের প্রথম (এবং একমাত্র) কমিউনিটি কিউরেটেড থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল। নির্বাচক কমিটির প্রত্যেকেই শাদিপুর ও তার নিকটস্থ অঞ্চলের স্থানীয় বাসিন্দা। যেমন এবারের কিউরেটররা ছিলেন MTNL-এর থেকে অবসরপ্রাপ্ত কর্মী কমলেশজি, প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা সোনিয়া ও রজনী, নাট্য শিক্ষক কৃতার্থ, ধীরাজ, যিনি পেশায় দর্জি, এবং একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী টিনা। টিনার আরেকটি পরিচয় হল ছোটবেলায় সে ছিল ষ্টুডিও সফদরের কিতাব ঘরের নিয়মিত একজন পড়ুয়া।
এই নাটক উৎসবের দ্বিতীয় বিশেষত্ব হল টিকিটের দামে। যে সমস্ত দর্শক শাদিপুরের বাসিন্দা নন এবং আর্থিক সামর্থ্য আছে তাঁদের জন্য টিকিটের মূল্য দু’শ টাকা। তবে পড়ুয়াদের জন্য বিশেষ ছাড়। স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য টিকিট মূল্য কুড়িটাকা। বাচ্চারা এক-দু টাকা যে যা পারে নিয়ে আসে। আনতে ভুলে গেলেও টিকিট দেওয়া হয়, শুধু মনে করিয়ে দেওয়া হয় পরের দিন যেন নিয়ে আসে। অবশ্য পরের দিন আনতে না পারলে তারপরের দিন। তারপরের দিনও অনেকেই পারে না। কোনো ক্ষুদে বলে, “এই নাও একটাকা, আমাদের পাঁচজনের”, তাও চলে! আর বিনামূল্যে টিকিট দেওয়া হয় রিকশাওয়ালা, জঞ্জালসাফাই কর্মী কিংবা গৃহপরিচারিকাদের মত অর্থনৈতিক অবস্থার মানুষজনদের।
অবশ্য এই বছরের উৎসবের তৃতীয় বিশেষ দিক রয়েছে। কিতাব ঘরের বাচ্চাদের একটি নাটক পরিবেশনা। নাটকের নাম ‘শিখো শিখাও’। নাটকটির কাহিনী এবং কমপোজিশনও মূলত তাদেরই। সেইসঙ্গে সেই বাচ্চাদের একটি চিত্রপ্রদর্শনী।
তাছাড়া শাদিপুরের ছোটদের নাটকের প্রতি বিপুল উৎসাহ দেখেই ২০২৩ সাল থেকে এই উৎসব বিশেষভাবেই শিশুনাট্য উৎসব। কি রকম উৎসাহ ? বাচ্চারা জড়ো হতে শুরু করে নাটক শুরু হবার ঘন্টা তিনেক আগে থেকে! ক্রমশ বাড়তে থাকে বন্যার জলের মতো। এমনকি Show শুরু হয়ে যাবার পরও। অথচ স্থান তো হতে পারে বড়ো জোর জনাপঞ্চাশ-ষাট, কি মেরে কেটে সত্তর! স্থান অকুলান হলেও নিরস্ত্র করতে ভলান্টিয়াররা নাকাল! কখনো বাচ্চাদের নিজেদের মধ্যে লেগে যায় ঝগড়া! ভলান্টিয়াররাই তখন রেফারি। এদেরকে সামলে সারিবদ্ধভাবে স্টুডিওর ভিতরে ঢুকিয়ে বসাতে বসাতেই শুরু হয়ে যায় নাটক। নাটকের সাথে সাথেই ওই একপাল ধুলোমাখা ক্ষুদে এক এক করে ভেসে চলে অজানায়, ‘জবলেস জব’ বগলদাবা করে, জাপানি বুনরাকু পাপেট্রির পুরসন পুতুল আর তার বেলুন বন্ধুর সঙ্গে স্বপ্নের উড়ানে ভেসে তারা পৌঁছে যায় বিরসা মুন্ডার জঙ্গল কি তাঁতিয়া ভীলের দেশে। নাটক কি কোনো ‘সব পেয়েছির দেশের’ সন্ধান দেয় ? আর্নস্ট ফিশারের “infinite capacity of man for metamorphosis”- এর স্বাদ পায়? যেখানে সে যে কোনো রূপ ধারণ করতে পারে, এক জীবনেই অনায়াসে হাজার হাজার জীবন যাপন করতে পারে! হয়তো দেয়, নাহলে কিসের টানে এই বাচ্চাদের উপচে পড়া ভিড় ?! প্রতিবছর, প্রতিটা নাটকের প্রতিটি শোতেই!
সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো শিশু নয় এরা। চারপাশের নোংরা, দূষণ, দারিদ্র্য, শিশুশ্রম, বেকারত্ব, নেশা আর অশিক্ষার মতো হাজার হাজার অনিশ্চয়তার মধ্যে জন্ম নেওয়া শিশু। ওরা গাদাগাদি করে থাকে অন্ধকূপের মতো ছোটছোট পায়রার খোপে, বাতাসও যেখানে ঢুকতে ইতস্তত করে। ওদের হামাগুড়ি থেকে হাঁটতে শেখা ওই অপ্রশস্ত গলি বেয়ে, মাথায় ঝুলন্ত তারের কুন্ডলির ফাঁক দিয়ে সরু ফিতের মতো একফালি আকাশ দেখতে দেখতে। দেখবার কেউ নেই, মা বাপকে ছুটতে হয়েছে পেটের ধান্দায়। ওরা খেলে বেড়ায় স্থানে অস্থানে স্তুপ করা জঞ্জালের মধ্যে, ফুসফুসে দুর্গন্ধের কড়া ঝাঁজ থাকবে না তাই হয় নাকি!
মনস্তাত্ত্বিক ভিগটস্কি (Vygotsky) বিশ্বাস করতেন যে কথা বলার ক্ষমতা এবং বুদ্ধির বিকাশ শুধু, জৈবিকভাবে নির্ধারিত হয় না, বরং সাংস্কৃতিক-ঐতিহাসিক ও সামাজিক পরিবেশের মিথস্ক্রিয়া ওপর নির্ভর করে। তাঁর মতে “Verbal thought is not an innate, natural form of behavior but is determined by a historical-cultural process. The problem of thought and language thus extends beyond the limits of natural science and becomes the focal problem of historical human psychology, i.e., of social psychology.” এখানে কবর খুঁড়লেই অন্ধকার অতীত, রক্তাক্ত নদী, গুলিবিদ্ধ লাশ, নিরন্ন মানুষের মিছিল, এখানে ঘরে ঘরে “সবারই এক একটা কাহিনী আছে ভেসে যাওয়ার”(মিঞা কবি কাজী নীল)। দেশভাগ, ভূমিকম্প, দাঙ্গা, ইমার্জেন্সি, উচ্ছেদ, বুলডোজার, স্টেরিলাইজেশনের, বস্তি উচ্ছেদ, গুলিবর্ষণে, অস্থায়ী জীবিকা, অবিরাম ছাঁটাই, অতিমারী। সবমিলিয়ে অধিকাংশ এখানে বংশ পরম্পরায় ঘর-হারা, উৎপাটিত, সদা বহমান অভিবাসী। নির্মম ভাবে বাস্তবের কড়া রোদ প্রতিনিয়ত শুষে নেয় এদের কোমলতা। রূঢ়, রুক্ষ, দুর্বিনীত, দুর্দমনীয়। স্বাভাবিকভাবেই ওরা তাই অসহিষ্ণু হয়ে উঠলে দরজা পেটায়, ঢিল-পাথর ছোঁড়ে, বলিউডি ফিল্মি কায়দায় হুমকি দিয়ে অপ্রস্তুত অনভিজ্ঞ ভলেন্টিয়ারদের ঘাবড়ে দিয়ে মজা পায়।
দারিদ্র সত্ত্বেও পুরোনো গ্রামের কৌম বা কৃষিভিত্তিক সমাজে, শ্রমজীবী সমাজের যা নিজস্ব সম্পদ ছিল যে লোকসংস্কৃতি, বর্তমান কর্পোরেট পুঁজির আক্রমণে ছিন্নমূল শিশুরা তা থেকেও বঞ্চিত। ডিজিটাল এডুকেশন, নয়া উদারবাদ, Corporatization অফ এডুকেশনের পরাক্রমী ঢেউয়ের সামনে খড়কুটোর মত ভাসমান এদের ভবিষ্যৎ। “Poverty is not just the lack of money.” অমর্ত্য সেন বারবার যে কথাটা বলেন তা হলো, “It is not having the capability to realize one’s full potential. Not to be able to read or write or count or communicate is a tremendous deprivation.” অথচ “পৃথিবী উদাস”, সারা পৃথিবী জুড়েই উদ্বাস্তু শিশুদের সংখ্যা ও অবস্থা ক্রমাগত ভয়ঙ্কর থেকে ভয়ংকরতর চেহারা নিচ্ছে। বিশ্বব্যাপী ৭০70টিরও বেশি দেশের তথ্যের দেশের তথ্যের ভিত্তিতে নির্মিত, ইউএন রিফিউজি এজেন্সির (UNHCR’s) ২০২৩ শিক্ষা প্রতিবেদন বলছে : বিশ্বের ১৪.৮ মিলিয়ন স্কুল-বয়সী উদ্বাস্তু শিশুর অর্ধেকেরও বেশি আনুষ্ঠানিক শিক্ষার আওতার বাইরে রয়ে গেছে। এর সাথে ২০২৪ এর প্যালেস্টাইন জেনোসাইডের যুক্ত করলে সংখ্যাটা কত গুণ বাড়তে পারে সেটা অনুমেয়। নয়া ফ্যাসিবাদ-নয়া উদারবাদের জোড়া বলদ শোষিত বঞ্চিত প্রান্তিক মানুষগুলোকে ঠেলে দিচ্ছে “নৈঃশব্দের সংস্কৃতির” অন্ধকারে। এতদসত্ত্বেও Malgré Tout, “ইটে-কাঠে-পিচে-পাথরে দেয়ালে-দেয়ালে”বেজে ওঠে সেই দুর্বার উচ্চারণ,“প্রাণ আছে, এখনো প্রাণ আছে … … – শুধু এক প্রাণই আশ্চর্য সম্পদ / এক ক্ষয়হীন আশা / এক মৃত্যুহীন মর্যাদা।“(অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত) আর যতক্ষণ প্রাণ থাকবে ‘গল্পপোষ্য’ মানুষ ততদিন তার কাহিনী বলে যাবে, এটাই Narrative paradigm। পৃথিবীতে আর-সকলে টাকা খুঁজুক, নাম খুঁজুক, আরাম খুঁজুক, এমন মানুষ থাকবেই যারা দৈত্যপুরী থেকে রাজকন্যাকে উদ্ধার করতে বেরোবেই বেরোবে। তুফান উঠবে, নৌকো মিলবে না, তবু সে তবু খুঁজে যাবে।“এইটেই হচ্ছে মানুষের সব-গোড়াকার রূপকথা আর সব-শেষের।“ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।
নিয়মিত নাটক দেখে দেখে বাচ্চারা শিখে গেছে যে আলো নিভে গেলে চিৎকার করতে নেই তারা এও জানে যে নাটকের শেষে অভিনেতাদের প্রশ্ন করা যায়। অভিনেতাদের সাথে আলাপ পরিচয়ের মধ্য দিয়ে শাদিপুরের বাচ্চারা অনায়াসে মিশে যায় সন্তোষপুর অনুচিন্তনের দক্ষিণ ২৪ পরগণার ঘাসিয়ারার শিশু অভিনেতাদের সাথে। ‘কোথা থেকে এসেছো’-র মতো সরল প্রশ্নই শুধু নয়, একটি বাচ্চা জিজ্ঞাসা করে, ‘নাটকটি তুলতে কতদিন লেগেছে?’ কিংবা কস্টিউম বা মুখোশ ইত্যাদি প্রপ্স কিভাবে বানানো হয়েছে ? কেউবা জেনে নেয় ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্রগুলোর নাম। ব্যাঙ্গালুরুর নাট্যদলের থেকে মুখেমুখে বাচ্চারা তুলে নেয় ‘Just Hiss’ নাটকের গান। “Education does not change the world, Education changes people. People change the world” – কথাগুলো বলেছিলেন পাওলো ফ্রেইরি । এখানেও তো বাচ্চারা শিখছে, বদলাচ্ছে, তবে কি একদিন আসবে যেদিন ফলে যাবে তাঁর পরের কথাটাও? কিন্তু কেমন ভাবে ফলবে? কোনদিকে? এই post-truth আর উত্তর আধুনিকতার যুগে? Global financial capital এখন বাজারে ছেড়েছে প্রতিবাদের নতুন একধরণের স্টাইল, যাকে বলা হচ্ছে, অরাজনৈতিক আন্দোলনের স্টাইল, নেতৃত্বে দেবে ওই পুঁজিনিয়ন্ত্রিত গদি মিডিয়ারা, খুব সতর্কভাবে যাতে আসল ব্যবস্থাটার গায়ে আঁচটি না লাগে, অথচ উত্তেজনার আফিম ছড়িয়ে মানুষকে চমৎকার ঘুম পাড়িয়ে রাখা যায় আর কি। কিন্তু “মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ”, আর তাই মানুষের অগ্রগতির পথ রৈখিক নয়; দীর্ঘ ও অনিশ্চিত, কিন্তু অনিবার্য।
১৯৬৩ তে আর্নস্ট ফিশার তাঁর বই “নেসেসিটি অফ আর্ট”-এ লিখছেন, … the function of art is to re-create as every individual’s experience the fullness of all that he is not, the fullness of humanity at large. And it is the magic of art that, by this process of re-creation, it shows that reality can be transformed, mastered, turned into play। একই ধারণা দিচ্ছেন ভিগটস্কি (Vygotsky)। তাঁর মতে কল্পনাশক্তি পুষ্টি যোগায় সৃজনশীলতাকে, আর সেটাই মানুষকে উদ্ভাবন করতে এবং তাদের বর্তমান পরিস্থিতি পরিবর্তন করতে চালনা করে। শিশুরা যখন শান্ত মগ্ন হয়ে গল্প শুনছে, নাটক দেখছে তখন তাদের মস্তিষ্ক আসলে উন্মত্তভাবে কাজ করে চলেছে এবং চিন্তা করতে শিখছে। সাংস্কৃতিক হাতিয়ার ব্যবহারের দিকে শিশুকে পরিচালিত করার জন্য যে মধ্যস্থতাকে মানব উন্নয়নের চাবিকাঠি হিসেবে সফদার দেখেছেন, সেই মধ্যস্থতার কাজটাই তো করে চলেছে ‘ষ্টুডিও সফদার’, কিতাব ঘর থেকে নাটক উৎসবে। কারণ “সফদার হাসমি মানে জাগা, জেগে থাকা, জাগানো। “সেই মধ্যস্থতার ফলেই ২০১৫ থেকে পায়ে পায়ে ২০২৪ এ এসে কিতাব ঘরের বাচ্চারা লিখে ফেলেছে নিজেদের নাটক। আর বাচ্চারাই তো ভবিষ্যৎ। হয়তো, এভাবেই একদিন, কোনোএকদিন তাদের হাতেই লেখা হবে আগামী পৃথিবীর ভবিষ্যৎ।“এই এপিটাফ ও অবেলিস্কের শহরে” তাই “জাগো ঘাস, জাগো নিশানেরা, জাগো মানুষের চিন্তা ও ইচ্ছার স্রোত, নাভি থেকে শব্দকে তুলে আনতে জাগো। …‘বৃশ্চিক রাশির নিচে যে মানুষ শুয়ে আছে ভাষাহীন, কপর্দকহীন, তাকে দাও রূপকথা, তাকে দাও যথার্থ মনীষা। জাগো ভবিষ্যৎ। জাগো, নতুন কবিরা।’ (কবি জয়দেব বসু )
(ঊর্মিমালা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কর্মী)
Unique endeavour! Congratulations!