আশঙ্কার বিষয় হল সারা পৃথিবীতে বাড়তে থাকা দক্ষিণপন্থী রাজনীতির অংশ হিসাবে ভ্রূণের অধিকার, জন্ম না নেওয়া সন্তানের অধিকারের সপক্ষে বিরাট সংখ্যক মানুষের সমর্থন তৈরি হচ্ছে গর্ভপাতের অধিকারের বিপরীতে দাঁড়িয়ে। ভারতে পুণে ও কেরলায় এই ধরনের মত সমর্থন করে বড় মিছিলের উদাহরণও রয়েছে। সুতরাং এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে, গর্ভপাতের অধিকারের স্বপক্ষে, নিরাপদ গর্ভপাতের পক্ষে কথা বলার এটাই সঠিক সময়। সুদর্শনা চক্রবর্তীর প্রতিবেদন।
প্রতি বছর ২৮ সেপ্টেম্বর দিনটি ‘নিরাপদ গর্ভপাত দিবস’ হিসাবে পালন করা হয়। যে কথাটি উহ্য রয়ে যায় তা হল – ভারতে গর্ভপাত আইনসিদ্ধ হলেও তা মহিলাদের অধিকার নয়। কথাটি শুনতে কিছুটা জটিল লাগলেও বাস্তব এটিই। অর্থাৎ এ দেশে গর্ভপাত করানো বেআইনি নয়, কিন্তু তা করানোর জন্য আইনে রয়েছে বেশ কয়েকটি শর্ত, যদি তা পূরণ হয়, তবেই একজন গর্ভবতী নারী গর্ভপাতের ‘অনুমতি’ পেতে পারেন। সেই নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ না করলে গর্ভপাত ‘অপরাধ’ বলে গন্য করা হয়। সুতরাং, গর্ভপাত ভারতে আইনি স্বীকৃতি পেলেও গর্ভধারণকারী ব্যক্তির অধিকার, নিজের শরীরের উপরে, নিজের সন্তান ধারনের ইচ্ছার উপরে তা আদৌ কতটা তাঁদের স্বাধীনতা দিচ্ছে, সে প্রশ্ন রয়েই যায়। আইনের মধ্যেও আসলে সামাজিক মানসিকতার প্রতিফলন দেখা যায়। তাছাড়া ভারতে যে গর্ভপাতের আইন রয়েছে সাম্প্রতিক সংশোধনের পরেও তাতে নারীর যে বিস্তৃত সংজ্ঞা তা অন্তর্ভুক্ত নয়। রূপান্তরকামী নারীর অবস্থান স্পষ্ট নয়। প্রতিবন্ধী নারীর গর্ভপাত এবং গর্ভস্থ ভ্রূণের যদি কোনও প্রতিবন্ধকতা থাকে তার গর্ভপাত করানো বিষয়ক যে বক্তব্য আইনে রয়েছে তা প্রতিবন্ধী নারী তথা প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকারের স্বপক্ষে কথা বলে না। ভারতে এখনও গর্ভপাত বিষয়টি এবং তার আইনটি সম্পূর্ণ জটিলতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
এই বিষয়টি নিয়ে জন পরিসরে বিশদে ধারাবাহিক আলোচনা করার প্রয়াসে গত ২৬ সেপ্টেম্বর কলকাতায় “অ্যাকসেস টু সেফ অ্যাবরশন ফর পিপল উইথ ডিসেবিলিটি” (প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য নিরাপদ গর্ভপাতের সুগমতা) শীর্ষক এক আলোচনার আয়োজন করে কমনহেল্থ ও শ্রুতি ডিসএবিলিটি রাইটস সেন্টার। এই অনুষ্ঠানে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন কমনহেল্থ-এর পক্ষে অভহিতি গুপ্তা ও শ্রুতি ডিসএবিলিটি রাইটস সেন্টার-এর পক্ষ থেকে শম্পা সেনগুপ্ত।
আলোচনার শুরুতে শম্পা সেনগুপ্ত এই আইন প্রসঙ্গে জানান এখানে বলা হয়েছে গর্ভস্থ ভ্রূণের প্রতিবন্ধকতা থাকলে সেই ভ্রূণের গর্ভপাত করানো যাবে। অর্থাৎ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্মানো যে অনভিপ্রত তা রাষ্ট্র একটি আইনে স্পষ্ট করে দিচ্ছে। এই আইন যে একটি ‘এবেলিস্ট’ (সক্ষমপন্থী) মানসিকতার ফসল তা বোঝা যায় এই ভাবনা থেকে। যেখানে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিদের অধিকার আইন, ২০১৬ প্রতিবন্ধী নারীদের ‘মা’ হওয়ার অধিকারের কথা বলছে সেখানে ভারতের গর্ভপাত আইনে বলা রয়েছে মানসিক প্রতিবন্ধকতা, বৌদ্ধিক প্রতিবন্ধকতাযুক্ত কোনও নারী যদি সন্তানের দেখাশোনা করতে না পারেন তাহলে তার গর্ভপাত আইন স্বীকৃত। এই ক্ষেত্রেই বিষয়টি জটিল হয়ে পড়ে। একদিকে যেমন প্রতিবন্ধী নারীর স্বাধীনতা রয়েছে, আইনি অধিকার রয়েছে মাতৃত্ব বেছে নেওয়ার, তেমনি তিনি মাতৃত্বের সম্যক ধারণা নিয়ে ‘মা’ হচ্ছেন কী না সেই বিষয়টি দেখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। শ্রবণ প্রতিবন্ধী, বাক প্রতিবন্ধী, মানসিক প্রতিবন্ধী, বৌদ্ধিক প্রতিবন্ধী নারীদের উপরে যৌন সহিংসতার কারণে তাঁদের গর্ভবতী হয়ে পড়ার ঘটনা ভারতে অত্যন্ত বেশী। তা বাড়িতে পরিবারের সদস্যদের দ্বারা, কেয়ার গিভারদের দ্বারা, হোম-এ নিরাপত্তা রক্ষী বা কেয়ার গিভারদের দ্বারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। এই ক্ষেত্রগুলিতে কোন্ আইনি সিদ্ধান্ত নেওয়া সঠিক তা নিয়ে প্রতিবন্ধী আন্দোলনের অভ্যন্তরেও সব সময়ে ঐক্যমত তৈরি হয় না।
অভহিতি-র আলোচনায় উঠে আসে কীভাবে ভারতের যে সার্বিক সামাজিক মানসিকতা তা গর্ভধারণকারী ব্যক্তির সন্তান প্রসব কেন্দ্রীক। এই মানসিকতা বড় সংখ্যক চিকিৎসকদের মধ্যে তথা আইনেও প্রতিফলিত হয়। গর্ভপাতকে আইনি স্বীকৃতি দিলেও শর্ত আরোপ করার মধ্যে দিয়ে আসলে গর্ভধারণকারী ব্যক্তিদের সন্তান প্রসবের দিকেই যেন বা ঠেলে দেওয়া হয়।
এই আলোচনায় উঠে আসে কেন গর্ভপাত সংক্রান্ত আলোচনা জরুরি – (১) সামাজিক ট্যাবু, (২) ভুল তথ্য, (৩) গর্ভব্যক্তি ব্যক্তির সংজ্ঞা ও তাঁর অধিকার, (৪) গর্ভপাতের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া নেতিবাচক ভাবনা, (৫) আইনি স্বীকৃতি (শর্ত সাপেক্ষে), (৬) সুগমতা, (৭) শরীরের উপরে অধিকার, (৮) সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষিত।
গর্ভপাত কী কী কারণে করা হয়, সেখানে পরিকল্পনাহীন, অনাকাঙ্খিত, জোর করে গর্ভধারণ, ধর্ষণের ফলে গর্ভধারণ ইত্যাদি বিষয়গুলি উঠে আসে। পরিকল্পনাহীন ও অনাকাঙ্খিতর মধ্যে যে পার্থক্য তা যে অনেক ক্ষেত্রেই অনালোচিত রয়ে যায় এবং নারীদের উপরে যে সামাজিক ভাবনা থেকেই ‘মাতৃত্ব’র ধারণা চাপিয়ে দেওয়া হয় শুরু থেকেই তাও বোঝা জরুরি। কারণ এই পরিপ্রেক্ষিতেই গর্ভপাত বিষয়টিকে ঘিরে সমাজে ছুঁৎমার্গ বজায় রয়ে গেছে এখনও, তাকে এক ধরনের গর্হিত কাজ বলেই সামাজিকভাবে দেখা হয়, বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা হয় অত্যন্ত কম এবং গর্ভপাত করানো নারীর মধ্যে এক ধরনের অপরাধবোধ তৈরির চেষ্টাও পরোক্ষে করা হয়। অনেক ক্ষেত্রেই চিকিৎসকরাও গর্ভপাত করাতে রাজি হন না, আসে ‘পাপ’ বলে একে দেখার কথাও! তাছাড়া কোনও গর্ভবতী নারীর স্বাধীন ইচ্ছা, তাঁর গোপনীয়তার কথা মাথায় না রেখে অনেক সময়েই পরিবার, পুরুষ সঙ্গী প্রমুখের উপস্থিতি, অনুমতির কথা বলা হয়। পরিবারে, সমাজে গর্ভপাত নিয়ে যে চুপ করে থাকার, লুকিয়ে রাখার প্রবণতা তাই অসুরক্ষিত গর্ভপাতের সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়। এলজিবিটিকিউআইএ+ গোষ্ঠীর মধ্যেও অনেক সময়ে গর্ভধারণকে কেন্দ্র করে উভকামী মানুষরা প্রান্তিকতার মধ্যে পড়ে যান। সামাজিক ট্যাবু-র পাশাপাশি ধর্মীয় মৌলবাদও গর্ভপাতের বিরোধিতা করে। গর্ভপাতের আলোচনায় আসলে যে এই বিস্তৃত পরিসরেই কথা বলার প্রয়োজন রয়েছে তা এদিনের অনুষ্ঠানে বারেবারেই উঠে আসে। শম্পা সেনগুপ্ত যেমন বলেন যৌনতা ও প্রজনন বিষয়ক স্বাস্থ্য ও অধিকার বিষয়ক প্রশিক্ষণের আয়োজন প্রতিবন্ধকতা নিয়ে কাজ করা সংগঠনের সঙ্গে করা হলেও সেখানে কোন কোন বিষয় গুরুত্বপূর্ণ জানতে চাইলে সবার শেষে আসে গর্ভপাতের কথা। প্রতিবন্ধী নারীদের অধিকারের মধ্যেও গর্ভপাতকে রাখা হয় শেষে।
আলোচনা হয় কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নিয়ে – (১) কখন একজন গর্ভধারণ করা ব্যক্তি গর্ভপাত করাতে চান? (২) কখন গর্ভপাত অসুরক্ষিত? (৩) কীভাবে নিরাপদ গর্ভপাত করা যেতে পারে? (৪) কোন ধরনের পরিস্থিতিতে গর্ভপাত একেবারেই মেনে নেওয়া হয় না – ভারতের ও আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে, সামাজিক ধারণায়?
আমাদের দেশে ১৯৭১ সালে পাশ হয় মেডিক্যাল টার্মিনেশন অফ প্রেগন্যান্সি অ্যাক্ট। উদ্দেশ্য ছিল – (১) জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, (২) গর্ভবতী নারীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত করা। কারা গর্ভপাত করতে পারবেন সেক্ষেত্রে এই আইনে মানসিক প্রতিবন্ধকতা বোঝাতে ‘ল্যুনাটিক’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছিল, ২০০৩ সালে আইন সংশোধনের মাধ্যমে তার পরিবর্তে ‘মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তি’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করা শুরু হয়। ২০২১ সালে দ্বিতীয় সংশোধনের মাধ্যমে গর্ভধারণ কালের সময়সীমা বাড়ানো হয়। বলা হয়, একজন চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন-এর ভিত্তিতে গর্ভস্থ ভ্রূণের বয়স ২০ সপ্তাহ পর্যন্ত হলে গর্ভপাত করানো যাবে। দু’জন চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন-এর ভিত্তিতে গর্ভস্থ ভ্রূণের বয়স ২০ থেকে ২৪ সপ্তাহ পর্যন্ত হলে গর্ভপাত করানো যাবে। গর্ভাবস্থার সময়সীমা ব্যতিরেকে বিশেষ পরিস্থিতিতে একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করে গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। এই মেডিক্যাল বোর্ড অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সিদ্ধান্ত নেন কার জীবন বাঁচানো বেশি গুরুত্বপূর্ণ তার ভিত্তিতে।
অভহিতি যেমন উল্লেখ করেন আইনে অনেক কিছু বলা থাকলেও গর্ভপাত এখনও অত্যাবশ্যক স্বাস্থ্য পরিষেবা নয়, তাকে আইনিভাবে মেনে নেওয়া হয় ধর্ষণের ঘটনায় নয়তো ১৮ বছরের নীচে হলে পকসো আইনের অধীনে। আইনে সর্বত্রই গর্ভবতী ‘নারী’ বলে উল্লেখ আছে যা বোঝায় যে লিঙ্গ-যৌনতার যে বিস্তৃত পরিতি এখন সামাজিক ও আইনিভাবে স্বীকৃত তাকে এই আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে না, তাই এই ধরনের আলোচনায় গর্ভধারণকারী ব্যক্তি বলাই এখন বাঞ্ছনীয়। শম্পা সেনগুপ্ত মনে করিয়ে দেন এমটিপি অ্যাক্ট তৈরির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, যেহেতু যেকোনও আইন পাশের ক্ষেত্রেই বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রেক্ষিতটি মনে রাখা দরকার। জরুরি অবস্থার কাছাকাছি সময়েই তা পাশ হয়। বলা হয় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে মুখ্যত আইনটি আসছে। সেখানে নারীর অধিকারের বিষয়টি আসে পরে।
গর্ভপাত কোন কোন শর্তাধীনে হতে পারে?
১) গর্ভধারণ যেখানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আসছে,
২) যেখানে যে শিশু জন্মাবে তাঁর শারীরিক বা মানসিক অস্বাভাবিকতা থাকতে পারে
৩) জন্মনিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা
৪) ধর্ষণ
৫) ১৮ বছরের নীচে ও মানসিকভাবে অসুস্থ – এই দুই গর্ভধারণকারী ব্যক্তির ক্ষেত্রে গর্ভপাত হতে পারে অভিভাবকের অনুমতি সাপেক্ষে। এক্ষেত্রে যেভাবে গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একজন ব্যক্তি ও তাঁর এজেন্সিকে যেন সম্পূর্ণ অদৃশ্য করে দেওয়া হয়।
নারীবাদী দৃষ্টিকোণ ও লিঙ্গ ও যৌন পরিচিতি ভিত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে গর্ভপাতের ক্ষেত্রে সব সময়েই তা সঠিক তথ্য জেনে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারের পর্যায়ে থাকা উচিত। অথচ ১৮ বছরের নীচে ও মানসিকভাবে অসুস্থ গর্ভধারণকারী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তেমনটা হয় না। আরও একটি আশ্চর্যের বিষয় হল নারীবাদীরা পিসিপিএনডিটি অ্যাক্ট-কে যেভাবে স্বাগত জানিয়েছেন, ভারতের অধিকাংশ রাজ্যেই গর্ভপাত আইন নিয়ে ততটা আলোচনা নারীবাদী আন্দোলনেও সামনে আসে না।
শম্পা সেনগুপ্ত বলেন, আইনে যেভাবে উল্লেখ রয়েছে তা প্রতিবন্ধকতাকে অস্বাভাবিকতার সঙ্গে এক করে দিচ্ছে এবং স্পষ্ট করে দিচ্ছে তা সমাজে অনাকাঙ্খিত। ট্রান্স-ক্যুইয়ার, প্রতিবন্ধী মানুষদের এই গর্ভপাত আইনে যেন বাদ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
গর্ভপাত করানোর ক্ষেত্রে যে চ্যালেঞ্জগুলির সামনে পড়তে হয় –
১) স্বাস্থ্য পরিষেবা ও তথ্য সহজলভ্য নয়
২) অসংবেদনশীল স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকারী ও স্বাস্থ্যকর্মী
৩) বিষয়টির গুরুত্ব বোঝানোর ক্ষেত্রে যথেষ্ঠ গবেষণা ও তথ্যের অভাব
৪) গোপনীয়তা রক্ষা না করা
২০১৫ সালে পিজিআইএমইআর চন্ডীগড় ৫০ জন প্রতিবন্ধী নারীকে নিয়ে একটি গবেষণা করে বোঝার জন্য যে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক পরিষেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের শারীরিক, তথ্যগত ও ব্যবহার জনিত কী ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয়। এই নারীদের মধ্যে ৭৮%-এর লোকমোটর প্রতিবন্ধকতা, ৮%-এর দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতা ও ৬%-এর শ্রবণ প্রতিবন্ধকতা ছিল। গবেষণা থেকে উঠে আসে –
১) ৩৬% জানান শারীরিক বাধা রয়েছে গর্ভপাত করানোর জায়গাটিতে (তা সহজগনম্য নয়, র্যাম্প নেই, যাতায়াতের সুগমতা নেই, যে টেবিলে পরীক্ষা হবে তা উপযুক্ত নয়)
২) ২২% বলেন দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার কথা
৩) ২০% বলেন শৌচালয় প্রতিবন্ধী-বান্ধব না হওয়ার কথা
৪) ৮% বলেন স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকারীর ব্যবহার সঠিক ছিল না
৫) ৬% উল্লেখ করেন যে সহায়তা থাকলে তাঁরা আরও ভালোভাবে পরিষেবা নিতে পারতেন।
আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণভাবে আসে ২০০৯ সালের সূচিতা শ্রীবাস্তবের কেসের কথা। বৌদ্ধিক প্রতিবন্ধী সূচিতা একটি সরকারী অনাথ আশ্রমে থাকাকালীন সেখানকার দুই নিরাপত্তাকর্মীর দ্বারা ধর্ষণের ফলে গর্ভধারণ করেন। হাইকোর্ট গর্ভপাতের রায় দিলেও সুপ্রিম কোর্ট সন্তান ধারণের পক্ষে রায় দেন, কারণ এই প্রতিবন্ধী নারী সন্তান রাখতে চেয়েছিলেন (যদিও মাতৃত্ব বিষয়ে তাঁর সঠিক ধারণা তৈরি করা হয়নি)। বিভিন্ন কারণে কেসটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যদিও প্রতিবন্ধী আন্দোলন কর্মীদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয়। এক দল বলেন এই রায়ের ফলে প্রতিবন্ধী নারীদের নিজেদের শরীরের উপরে অধিকার স্বীকৃতি পেল। অন্যরা বলেন – (ক) রায়ে বৌদ্ধিক প্রতিবন্ধকতা থাকা গর্ভধারণকারী ব্যক্তির বদলে বলা হয় ‘সামান্য মানসিক প্রতিবন্ধকতা’, (খ) যে শিশু জন্ম নেবে তার শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধকতার সম্ভাবনা নেই, (গ) রায়ে একবারও ধর্ষণের ঘটনার উল্লেখ ছিল না, (ঘ) পরবর্তী সময়ে বহু কেসে ধর্ষণ হওয়া ব্যক্তির গর্ভপাতের অধিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে এই কেসের উল্লেখ করে বাধা তৈরি করা হয়েছে, (ঙ) অভিভাবকের অনুমতির প্রাসঙ্গিকতা রয়ে যায়, (চ) ন্যাশনাল ট্রাস্ট গর্ভধারণকারী ব্যক্তির স্বার্থে ও সন্তান প্রতিপালনে সহায়তার দায়িত্ব নেওয়া ছাড়া এক্ষেত্রে আর কোনও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি।
আমাদের সমাজে যে ভাষা, যে ছবি ব্যবহার করা হয় তার বেশিরভাগই মাতৃত্ব, শিশুর জন্ম, ভ্রূণের অধিকার ইত্যাদির কথা বলে। পপুলার কালচার, বিশেষত হিন্দি সিনেমা মায়ের জীবন দিয়েও শিশুর জন্ম দেওয়া, একলা নারীর গর্ভপাত না করে শিশুর জন্ম দেওয়া, শিশুর প্রতিবন্ধী না হয়ে জন্মানো ইত্যাদিকে মহিমান্বীত করে দেখায়। গর্ভপাত করাতে চাওয়া নারীকে এমনকি সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও অত্যন্ত অসংবেদনশীলভাবে সন্তানের সংখ্যা জিজ্ঞেস করা হয়। সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে লেখা থাকে ‘বিবাহিত নারীর গর্ভপাত’-এর বিষয়টি। পরিবারে, কর্মক্ষেত্রে গর্ভপাত করিয়েছেন এমন ব্যক্তির সঙ্গে সে বিষয়ে কোনও কথা বলা হয় না, যা তার মধ্যে একাকীত্ব, ডিপ্রেশন, ক্ষেত্রবিশেষে অপরাধবোধ তৈরি করে। প্রতিবন্ধী আন্দোলনের ভেতরে গর্ভপাতের কথা বললে, অনেক সময়েই শুনতে হয় মাতৃত্বের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কথা বলা হচ্ছে।
গর্ভধারণকারী ব্যক্তি যে সন্তানের জন্ম না দেওয়া পর্যন্ত ‘মা’ হন না অথবা ভ্রূণ মানেই যে সন্তান নয় – তা রয়ে যায় আলোচনার বাইরে। এবং আশঙ্কার বিষয় হল সারা পৃথিবীতে বাড়তে থাকা দক্ষিণপন্থী রাজনীতির অংশ হিসাবে ভ্রূণের অধিকার, জন্ম না নেওয়া সন্তানের অধিকারের সপক্ষে বিরাট সংখ্যক মানুষের সমর্থন তৈরি হচ্ছে গর্ভপাতের অধিকারের বিপরীতে দাঁড়িয়ে। ভারতে পুণে ও কেরলায় এই ধরনের মত সমর্থন করে বড় মিছিলের উদাহরণও রয়েছে। সুতরাং এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে, গর্ভপাতের অধিকারের স্বপক্ষে, নিরাপদ গর্ভপাতের পক্ষে কথা বলার এটাই সঠিক সময়।