আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে তরুণী জুনিয়র ডাক্তারের ধর্ষণ ও হত্যা আরও একবার স্পষ্ট করে দিল মহিলারা তাঁদের কর্মক্ষেত্রে কোথাওই সুরক্ষিত নন। পশ্চিমবঙ্গে কর্মক্ষেত্রে যৌন নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে গণশুনানির উদ্যোগ নেওয়া হল। এই গণশুনানির মূল লক্ষ্য রাজ্য জুড়ে যৌন নির্যাতনের ঘটনার সাক্ষ্য গ্রহণ করার পর তা প্রতিরোধে পদ্ধতিগত ব্যর্থতাগুলি চিহ্নিত করা এবং প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য পরবর্তী সময়ে ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যাওয়া। সুদর্শনা চক্রবর্তীর প্রতিবেদন।
কাজ করতে গিয়ে গণধর্ষিতা হয়েছিলেন ভাঁওরি দেবী। ছেড়ে দেননি তিনি। চোয়াল শক্ত করে লড়াই করেছিলেন। ভারতে তৈরি হয়েছিল বিশাখা গাইডলাইনস। কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা রুখতে আইন তৈরি হয় ২০১৩ সালে, সেই আইনেরও ভারতে ১০ বছর অতিক্রান্ত।
তবু এদেশে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত কাজের জায়গায় বৈষম্য থেকে শুরু করে যৌন হেনস্থা, মানসিক ট্রমা-র মধ্যে দিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে শারীরিক অত্যাচার –এই সবকিছুর মধ্যে দিয়েই যেতে হয় বিভিন্ন বয়সের কর্মরতা মহিলাদের। যত বিস্তৃত হয়েছে কাজের জায়গার সংজ্ঞা, ততই বেড়েছে এই হেনস্থার সংখ্যা। যতই মহিলারা স্বাধীন, স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য খুঁজে নিয়েছেন বিবিধ কাজের পরিসর ততই তাঁদের উপর যৌন নির্যাতন থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের হেনস্থার ঘটনা বাড়তে দেখা গেছে এই পিতৃতান্ত্র্রিক সমাজব্যবস্থায় এবং সেই ছক অনুসরণ করা কাজের পরিকাঠামোয়।
কলকাতায় আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে তরুণী জুনিয়র ডাক্তারের ধর্ষণ ও হত্যা আরও একবার স্পষ্ট করে দিল মহিলারা তাঁদের কর্মক্ষেত্রে কোথাওই সুরক্ষিত নন। সাধারণত সমাজে জীবিকার নিরিখে উঁচু অবস্থানে থাকা চিকিৎসা পরিষেবায় যুক্ত এক নারীর সঙ্গে ঘটা এই নৃশংস অপরাধ আলোড়ন তুলেছে। এবং দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে সেই সূত্র ধরে কথা হচ্ছে অন্যান্য পেশায় থাকা এবং স্বল্প আলোচিত পেশাতে থাকা মহিলাদের এই নির্যাতন ও হেনস্থার অভিজ্ঞতা নিয়ে। দীর্ঘদিন তাঁরা বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে এই অত্যাচারের কথা বললেও, নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা অনেক সংগঠন, ব্যক্তিমানুষ বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাইলেও তা তেমনভাবে সামনে আসেনি। মহিলাদের সঙ্গে ঘটা লিঙ্গ পরিচিতি ও যৌন পরিচিতি ভিত্তিক হিংসার বিভিন্ন উদাহরণ নিয়ে কথা হলেও কর্মক্ষেত্রে হিংসা ও হেনস্থার কথা যেন কিছুটা কম আলোচনায় এসেছে।
আরও একটি বিষয় যা সামনে আসতে শুরু করেছে তা হল এই প্রেক্ষিতেই ‘নারী’-র সংজ্ঞা। কর্মক্ষেত্রে নারী বলতেই যে নির্দিষ্ট বয়স বা পরিচিতির নারীদের ছবি ভেসে ওঠে তা অতিক্রম করে এখন সেই পরিধিও বিস্তৃত হয়েছে। প্রান্তিক যৌন ও লিঙ্গ পরিচিতির নারীরা, প্রতিবন্ধী নারীরা নিজেদের পরিচিতি নিয়ে যত বেশি কাজের জগতে প্রবেশ করছেন ততই তাঁদের সঙ্গে বৈষম্য, হেনস্থা, নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে।
এই প্রেক্ষপটে পশ্চিমবঙ্গে কর্মক্ষেত্রে যৌন নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে গণশুনানির উদ্যোগ নেওয়া হল। এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করা বিভিন্ন ব্যক্তি, স্বাধীন সংগঠন ও নির্দিষ্ট কিছু সংস্থার সম্মিলিত প্রচেষ্টা বলে উদ্যোক্তাদের তরফে ২৫ সেপ্টেম্বর কলকাতা প্রেস ক্লাবে এক সংবাদিক সম্মেলনে জানানো হয়।
এই গণশুনানির মূল লক্ষ্য সারা রাজ্য জুড়ে যৌন নির্যাতনের এক বড় সংখ্যক ঘটনার সাক্ষ্য গ্রহণ করার পর সেই উদাহরণগুলিকে সামনে রেখে তা প্রতিরোধে পদ্ধতিগত ব্যর্থতাগুলি চিহ্নিত করা এবং কর্মক্ষেত্রে হেনস্থার মোকাবিলা সহ প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য পরবর্তী সময়ে ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যাওয়া।
গণশুনানির প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করবেন প্রতিবন্ধী নারী, প্রান্তিক যৌন ও লিঙ্গ পরিচিতির নারী, অসংগঠিত ক্ষেত্রের মহিলা কর্মী (চা-বাগানের কর্মী, নির্মাণ কর্মী, গৃহ পরিচারিকা), স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত তৃণমূল স্তরের কর্মীরা। আগামী ৯ থেকে ২০ নভেম্বর এই গণশুনানিতে অংশ নেবেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, আমলা, আইনজীবী, নারী-ট্রান্স-ক্যুইয়ার অধিকার কর্মী, মানসিক স্বাস্থ্য অধিকার কর্মী, প্রতিবন্ধী অধিকার আন্দোলন কর্মী, শ্রমিক অধিকার কর্মী প্রমুখেরা। সারা রাজ্যের সব জেলা যাতে এই গণশুনানির আওতায় আসে তার জন্য পাঁচটি ভাগে ভাগ করে নেওয়া হয়েছে – (১) উত্তরবঙ্গ, (২) মধ্য বঙ্গ, (৩) রাঢ় বাংলা, (৪) কলকাতা, (৫) দুই ২৪ পরগণা।
উদ্যোক্তারা তৈরি করেছেন ই-মেইল আইডি, সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেলস। তাছাড়া থাকছেন ভলান্টিয়ার-রা। যাঁরা সাক্ষ্য দিতে চান তাঁরা এই প্রক্রিয়াগুলিতে নিজেদের নাম ও কর্মক্ষেত্র উল্লেখ করে অথবা তা সম্পূর্ণ গোপন রেখে নিজেদের অভিজ্ঞতা পাঠাতে পারবেন। তাছাড়া নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট জায়গায় জুরি-র সামনে উপস্থিত থেকে সাক্ষ্য দেওয়ার ব্যবস্থা থাকছেই। এই গণশুনানিতে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হবে সাক্ষ্য দেওয়া মহিলাদের নিরাপত্তা ও কেস-এর গোপনীয়তার উপর। যদি কোনওভাবে তা বিঘ্নিত হচ্ছে বলে সাক্ষী জানান তবে তাঁকে যাবতীয় প্রয়োজনীয় সহায়তা উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে দেওয়া হবে বলে জানানো হয়। এই শুনানি স্থলে উপস্থিত থাকবেন শুধু সাক্ষ্য দিতে আসা মহিলা (যদি তাঁদের কোনও সহায়ক প্রয়োজন হয় তিনি) এবং জুরি-রা। তা সকলের জন্য খোলা থাকবে না।
গণশুনানি শেষ হলে একটি রিপোর্ট তৈরি করা হবে, যাতে থাকবে এই শুনানি থেকে উঠে আসা তথ্য এবং রেকমেন্ডেশন। যাতে সরকার, প্রশাসন, সংশ্লিষ্ট কর্মক্ষেত্রের কর্তৃপক্ষ, নিয়োগকারী পক্ষ তাঁরা কর্মক্ষেত্রে যৌন নির্যাতন ও অন্যান্য বৈষম্যের বিরুদ্ধে সক্রিয় হন তার জন্য তাঁদের কাছেও এই রিপোর্ট পাঠানো হবে। উদ্যোক্তাদের তরফ থেকে সাংবাদিক সম্মলনে বলা হয় শুধু কর্মরতা মহিলারাই নন, নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞরা, স্টেক হোল্ডার-রা, নিয়োগকরী পক্ষও, ইন্টারনাল কমপ্লেইন কমিটি ও লোকাল কমিটির সদস্যরা যদি নিজেদের সীমাবদ্ধতা, সমস্যা নিয়ে সাক্ষ্য দিতে আগ্রহী হন, তাহলে তাও গ্রহণ করা হবে।
সাংবাদিক সম্মেলনে আইনজীবী ঝুমা সেন বলেন, তাঁরা মূলত যে বিষয়গুলির উপর জোর দিচ্ছেন –
(ক) হেনস্থার প্রকৃতি – লিঙ্গভিত্তিক হেনস্থার বিভিন্ন রূপ যার মধ্যে শারীরিক ও মৌখিক নির্যাতনও থাকবে
(খ) হেনস্থার পর মহিলার উপর কী ধরনের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব পড়ে, তাঁর শারীরিক কোনও সমস্যা হয় কী না, তাঁর উপরে অর্থনৈতিক প্রভাব কী হয়
(গ) কোনও ঘটনা ঘটলে তা রিপোর্ট করার প্রক্রিয়া, যে ব্যবস্থা রয়েছে তা কী যথেষ্ঠ, অন্তর্ভুক্তিমূলক আর কার্যকরী? ইন্টারনাল কমপ্লেইন কমিটি, লোকাল কমিটি (বিশেষত অসংগঠিত ক্ষেত্রে) কাজ করছে কী না
(ঘ) আইনি পরিকাঠামোয় এই সমস্যাগুলিকে কীভাবে দেখা হচ্ছে। পশ অ্যাক্ট-এর পুনর্মূল্যায়ন ও তার বাস্তবায়ন
(ঙ) আইনি পরিকাঠামোয় কোনও শূন্যস্থান রয়ে যাচ্ছে কী না
(চ) খতিয়ে দেখা হবে ন্যায় পাওয়ার ক্ষেত্রে কী কী বাধা তৈরি হচ্ছে (তার মধ্যে থাকতে পারে সামাজিক মানসিকতা, আইনিক্ষেত্রে বিবিধ চ্যালেঞ্জ ও সা্ংগঠনিক অসুবিধা) এবং সেখানে রাজ্য প্রশাসনের ভূমিকা
(ছ) সাংগঠনিক কর্মপদ্ধতি। কাজের জায়গায় পলিসিগুলির পুনর্মূল্যায়ন, সেখানে কর্তৃপক্ষ বা নেতৃত্ব কীভাবে যৌন হেনস্থার ঘটনাগুলির মোকাবিলায় পদক্ষেপ নিচ্ছে, ইন্টারনাল কমপ্লেইন কমিটির ভূমিকা
প্রান্তিক লিঙ্গ ও যৌন পরিচিতির মানুষদের অধিকার কমী কলিকা মিত্র বলেন, “সমকামী নারীদের তাঁদের যৌন পরিচিতির জন্য যখন কর্মক্ষেত্রে হেনস্থা করা বা সেখান থেকে বের করে দেওয়া হয়, সেখানে পশ অ্যাক্ট কীভাবে কাজ করে, আদৌ করে কী না তা দেখা প্রয়োজন। কোনও রূপান্তরকামী মানুষ যখন হিজড়ে পেশায়, যৌন কর্মে যান তখন সেখানে তাঁর সুরক্ষার বিষয়ে কী করা হয় তাও দেখা প্রয়োজন।”
পশ্চিমবঙ্গ খেত মজদুর সমিতির পক্ষ থেকে অনুরাধা তলওয়ার জানিয়েছেন, “প্রতিবন্ধী নারীদের বিষয়টি যাতে উঠে আসে তাঁর জন্য এক্ষেত্রে কাজ করছেন এমন অধিকার কর্মীরা আমাদের সঙ্গে আছেন। বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতার কথা মাথায় রেখে তাঁদের অন্তর্ভুক্তির সহায়ক পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছি আমরা।”
বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করা ইউনিয়নদের সাক্ষ্য নেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে কী না জানতে চাওয়ায় তিনি জানান, “অবশ্যই। এই কাজটা এগিয়ে নিয়ে যেতে ইউনিয়নকে প্রয়োজন হবে। আমরা ইতিমধ্যেই বিভিন্ন ইউনিয়ন-এর সঙ্গে আলোচনা করতে শুরু করছি। যে জায়গাগুলিতে গণশুনানি হবে তার কিছু জায়গায় আমরা প্রারম্ভিক কয়েকটি মিটিংও করব, যাতে যৌন হেনস্থার বিষয়টি কর্মী মহিলারা স্পষ্ট বুঝতে পারেন। কারণ কোনও কোনও কাজের পরিসরে তা যেন সূক্ষ্মভাবে কাজেরই অংশ হয়ে উঠেছে।” তিনি আরও জানিয়েছেন কোনও ফান্ড বা গ্রান্ট নয়, এই গণশুনানির পুরো প্রক্রিয়াটিই হতে চলেছে ক্রাউড ফান্ডিং-এর ভিত্তিতে।
২০২৩ সালে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো-র তথ্য অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে যৌন হেনস্থার ঘটনার একটি মাত্র রিপোর্ট পাওয়া গেছে। এরথেকেই স্পষ্ট বাস্তব ও সরকারি পরিসংখ্যানের মধ্যে কতটা আকাশ-পাতাল তফাৎ রয়েছে। এই গণশুনানির পর উদ্যোক্তারা আশা করছেন সারা রাজ্যে কর্মক্ষেত্রের বিস্তৃত পরিসরে লিঙ্গভিত্তিক হেনস্থা ও সহিংসতার ঘটনার একটি তদন্তমূলক প্রতিবেদন প্রস্তুত হলে তা বর্তমানের আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো যার মধ্যে পশ অ্যাক্ট ২০১৩-ও রয়েছে তার বিশ্লেষণে সাহায্য করবে, কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক হেনস্থা ও সহিংসতা কোন ধরনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক, সাংগঠনিক ও অর্থনৈতিক জায়গা থেকে ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকে তা বুঝতে সাহায্য করবে এবং এর থেকে যে পলিসি রেকমেন্ডেশন তৈরি হবে তা কর্মক্ষেত্রে হেনস্থা ও সহিংসতা প্রতিরোধ ও মোকাবিলায় শক্তিশালী ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ও সার্ভাইভার নারীদের প্রতি দায়বন্ধ হতে, তাঁদের জন্য ন্যায় সুনিশ্চিত করতে সাহায্য করবে।