আর.জি.কর, “রাত দখল” ও আমাদের সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট: কিছু প্রশ্ন 


  • September 14, 2024
  • (1 Comments)
  • 2232 Views

মনে রাখা প্রয়োজন, আর.জি.কর-এ ডাক্তার তরুণী খুন ও ধর্ষিত হয়েছিলেন নিজের কর্মক্ষেত্রে। কাজেই, কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের অবস্থান নিয়ে চুলচেরা আলোচনা প্রয়োজন আজ। সেই আলোচনা সুবিধাপ্রাপ্ত কর্মী মেয়েদের (অর্থাৎ, হোয়াইট কলার ওয়ার্কার) আর প্রান্তিক কর্মী মেয়েদের (অর্থাৎ, ব্লু কলার ওয়ার্কার) জন্য এক হবে না। সেই আলোচনা হবে না প্রতিটি কর্মক্ষেত্রের ক্রমবর্ধমান নয়া-উদারনৈতিকরণ সম্পর্কিত আলোচনা ব্যতিরেকে। লিখলেন নন্দিনী ধর

 

১.

এই লেখাটির আশু পরিপ্রেক্ষিত ৯ই আগস্ট, ২০২৪ কলকাতার আর.জি.কর হাসপাতালে তরুণী ডাক্তারের ধর্ষণ ও হত্যা। এই লেখাটির আশু প্রেক্ষাপট সেই ঘটনা পরবর্তী আন্দোলন। কিন্তু প্রতিটি আশু প্রেক্ষাপটের পেছনেও তো থাকে অনেক অনেক পরোক্ষ কথা, না বলা গল্প, বিশ্লেষণ। অর্থাৎ, অনেক অনেক বিক্ষিপ্ত প্রেক্ষিত। সেই সমস্ত বিষয়গুলোকেই একবার নেড়েচেড়ে দেখার প্রচেষ্টায় এই লেখা। তাই, এই লেখায় আমরা পেছনে হাঁটবো কখনো কখনো, আবার কখনো কখনো থেমে যাবো বর্তমান মুহূর্তে। আমাদের শহর কলকাতায়।

 

১৯৭৫ সালে সুসান আলেক্সান্ডার স্পিত নামে মার্কিনী এক জীববিদ বাড়ি ফিরছিলেন গভীর রাতে। সম্ভবত মার্কিন যুক্তরাষ্টের পেনসিলভানিয়া ইউনিভার্সিটিতে তাঁর কর্মক্ষেত্রে কাজ সেরে। সুসানকে কারা যেন কুপিয়ে খুন করে। ঘটনাস্থলটি ছিল সুসানের বাড়ির মাত্র কয়েক গজ দূরে। তার অব্যবহিত পরেই, ১৯৭৫ সালের অক্টোবর মাসে, নারী আন্দোলনের কর্মীরা মোমবাতি হাতে প্রতিবাদ মিছিল করেন। মিছিল থেকে আওয়াজ ওঠে “টেক ব্যাক দা নাইট।”

 

যদিও, এই ইতিহাস সর্বজন স্বীকৃত নয়। অনেকে বলেন, টেক ব্যাক দা নাইট আন্দোলনের উৎস ১৯৭৬ সালে, ইতালির রোম শহরে। যা নাকি অনুপ্রাণিত করেছিল জার্মানির নারী আন্দোলনের কর্মীদেরও, যৌন হিংসার বিরূদ্ধে পথে নামতে। আবার অনেকে বলেন, ১৯৭৭ সালে আমেরিকার পিটসবার্গ শহরের মেয়েদের জমায়েতে প্রথম ব্যবহৃত হয় টেক ব্যাক দা নাইট বাক্যবন্ধ। শোনা যায়, আনি প্রাইড নামে এক কবি লিখেছিলেন টেক ব্যাক দা নাইট  নামে একটি কবিতা, যেখান থেকেই টেক ব্যাক দা নাইট স্লোগানটি জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

 

উৎস যাই হোক, এই সবকটি বিবরণ থেকেই বেরোয় কতগুলো বাস্তবতা। টেক ব্যাক দা নাইট আন্দোলনের সূত্রপাত মোটামুটিভাবে বিগত শতাব্দীর সাতের দশকের শেষার্ধে, যখন একভাবে পুঞ্জীভূত হয়েছে পশ্চিমের নারীবাদ সহ বিভিন্ন অধিকার আন্দোলনের ইতিহাস। যদিও, সেসবের জোর স্তিমিত হয়ে আসছে। প্রশ্ন উঠছে অনেক। বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর নামানো হচ্ছে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন। পশ্চিমের নারীবাদী আন্দোলনের ভিতরেও তখন কোথাও একটা ভাঁটার টান। আন্দোলনের ভেতরেই প্রশ্ন উঠেছে অনেক। প্রশ্ন উঠেছে প্রান্তিক মেয়েদের অংশগ্রহণ ও বিশেষ দাবিদাওয়া নিয়ে। প্রশ্ন উঠেছে বিশ্ব-সাম্রাজ্যবাদের প্রেক্ষিতে ঠিক কি অবস্থান নেবে পশ্চিমের নারী আন্দোলনগুলি, নারী সংগঠনগুলি। প্রশ্ন উঠছে শ্রেণী প্রশ্নে, পুঁজির চরিত্র প্রশ্নে।

 

কিন্তু, যে সকল মূল প্রশ্নগুলির ওপরে দাঁড়িয়ে গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন পশ্চিমী দেশের নারী আন্দোলন, অর্থাৎ পিতৃতন্ত্রের প্রশ্ন, অন্যান্য সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সাথে পিতৃতন্ত্রের গাঁটছড়ার প্রশ্ন, তা তখনো সমাধানের পথে কোনোমতেই এগোয়নি। বড়োজোর, ছয়ের দশকের তীব্র নারী আন্দোলনের চাপের মুখে দাঁড়িয়ে পুঁজিবাদ মধ্যবিত্ত মেয়েদের কাছে খুলে দিয়েছে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসে কর্মসংস্থানের জায়গা। এবং, মধ্যবিত্ত মেয়েদের একাংশ, সেইসব “হোয়াইট কলার” কাজে নিজেদের অবস্থানকে সুনিশ্চিত করতে প্রাণপণে লড়ছে।

 

পিতৃতন্ত্রবিরোধী রাজনৈতিক লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে মধ্যবিত্ত কর্মস্থলে নিজেদের মর্যাদা ছিনিয়ে আনাটাই অনেকাংশে হয়ে উঠছে নারীবাদী আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র ও ব্যক্তি মেয়েদের নিজেদেরকে নারীবাদী বলে অভিহিত করার হেতু। সাথে সাথে তৈরী হতে শুরু করেছে এন.জি.ও গুলোও। বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা — ইউনিসেফ, ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানিজশন, ইউনেস্কো — লিঙ্গ সমতা বিষয়টিকে চর্চার মধ্যে নিয়ে এসে একরকমের মান্যতা দিয়েছে। বিগত দশকের লড়াকু নারীবাদীদের অনেকেরই স্থান হচ্ছে নানা আধিকারিক পদে বা কমিটিতে। যে শিক্ষা তাঁরা পেয়েছিলেন লড়াইয়ের ময়দানে, তার দৌলতে জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থাও হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে খুলতে শুরু করছে উইমেন্স স্টাডিস বিভাগগুলি। সেখানেও চাকরি পেতে শুরু করছেন বিগত ও নতুন প্রজন্মের নারীবাদীরা। নারীবাদ কারুর “কেরিয়ার” হতে পারে কি না, এই নিয়ে প্রশ্ন উঠছে আন্দোলনের ভেতরে। অনেক নারীবাদীরা, বিশেষত যাঁরা এন.জি.ও ও বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করতে যাচ্ছেন, বজায় রাখার চেষ্টা করছেন দুই দিকই। চাকরিও করছেন প্রাতিষ্ঠানিক নারীবাদী হিসেবে, আবার প্রতিষ্ঠানের বাইরে ও বিরুদ্ধে যে লড়াইয়ের মঞ্চ, সেখানেও নিজেদের অংশগ্রহণ জারি রাখছেন।

 

কিন্তু, যে প্রশ্নটি সামনে এসে গেছে, তা হলো, পুঁজির রাজনীতি ও বাস্তবতা ঠিক কতটা ও কিভাবে আত্মসাৎ করতে পারে নারীবাদকে।

 

এই পরিবেশে দাঁড়িয়ে, যৌন নির্যাতন ও যৌন হিংসা বিরোধী লড়াই বোধহয় নারী আন্দোলনকে দিয়েছিলো একধরনের মতাদর্শগত ও বাস্তবিক বাঁধুনি।

 

যৌন নির্যাতন — যার চরমতম অভিব্যক্তি ধর্ষণ — ব্যাপারটির ভেতরে আছে একধরনের সর্বজনীনতা। এমন কোনো মেয়ে বোধহয় এই দুনিয়ায় নেই যে বলতে পারে তাকে কোনো ধরনের যৌন নির্যাতনেরই মুখোমুখি হতে হয়নি কখনো। কাজেই, কাজেই, যৌন নির্যাতনবিরোধী লড়াইগুলি একধরনের দ্রুত সর্বজনীন মান্যতা আদায় করে নিতে পারে, যা অন্য ধরনের পিতৃতন্ত্রবিরোধী আন্দোলন পারে না। কোথাও একটা তাই টেক ব্যাক দা নাইট আন্দোলনের কর্মসূচির বিরূদ্ধে দাঁড়ানোর মতো কিছু খুঁজে পাওয়া মুশকিল। অন্যদিকে, যে যে মাত্রায় মেয়েদের জীবনে জ্বলন্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে প্রাত্যহিক যৌন নির্যাতন ও যৌন হিংসার বাস্তবতা ও সম্ভাবনা, সেই সেই মাত্রায়, যৌন হিংসা বিরোধী লড়াইয়ের প্রাসঙ্গিকতা ছিল, আছে এবং অতীব দুর্ভাগ্যজনকভাবে বহুদিন থাকবে।

 

সেই দিক থেকে দেখলে, টেক ব্যাক দা নাইট খুব তাড়াতাড়ি পেরেছিলো বহু বহু সাধারণ মেয়েদের কল্পনাশক্তির কাছে একধরনের প্রগাঢ় আবেদন রাখতে। তাঁরা এই আন্দোলনে বারবার এসেছেন, নিজেদের জীবনে যৌন হিংসার অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন, সমালোচনা করেছেন পুলিশি ও রাষ্ট্রীয় নিষ্ক্রিয়তার, জমায়েতের সামনে রেখেছেন পিতৃতন্ত্র বিষয়ে নিজেদের ভাবনার কথা। কালক্রমে, টেক ব্যাক দা নাইট আন্দোলনটি বহুক্ষেত্রেই নিজেদের দরজা খুলে দিয়েছে প্রান্তিক লিঙ্গ ও যৌনতার মানুষদের নিজেদের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করার জন্য। এমনকি, যে পুরুষরা যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের সম্মুখীন হয়েছেন, তাঁদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে নিজেদের অভিজ্ঞতা ও যন্ত্রণা সর্বসমক্ষে ব্যক্ত করার জন্য।

 

প্রসঙ্গত, টেক ব্যাক দা নাইটের জমায়েতের একটি বিশেষ দিক আছে। প্রায় সব জমায়েতই হয় সেখানে সন্ধ্যার পরে, অন্ধকার নামার পরে। এর ভেতরে আছে একটি প্রতীকী দ্যোতনা, একটা নাটকীয়তা। মেয়েরা তো ছোটবেলা থেকেই শিখে এসেছে, রাত তাদের জন্য বিপজ্জনক। শিখে এসেছে সন্ধ্যা নামতেই তাদের ফিরতে হবে ঘরে। একটু বেশি রাতে ঘরের বাইরে নিগৃহীতা মেয়েদের শুনতে হয়েছে, পুলিশ, পরিবারের লোক ও সমাজপতিদের সাথে একযোগে, অতো রাতে বাড়ির বাইরে কি করছিলেন আপনি? যাকেই পরবর্তী সময়ে নাম দেওয়া হয়েছে “স্লাট-শেমিং।” আমাদের দেশের মেয়েদের হোস্টেলে তাই অনেকাংশে তালা পড়ে সন্ধ্যাবেলাতেই। অবশ্য, সাম্প্রতিক সময়ে, সেই নিয়মের বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলেছেন মেয়েরাও। দিল্লি ও তার আশেপাশের অঞ্চলে গড়ে ওঠা “পিঞ্জরা তোর” আন্দোলন, এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক।

 

কাজেই, জমায়েতের সময়টি এখানে গভীরভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।

 

অন্যদিকে, একটি জমায়েত, বিশেষত পরিকল্পিত আন্দোলন কেন্দ্রিক জমায়েত তো যেকোনো শহরেই হয় পুলিশ প্রহরায়। থাকেন অনেক মানুষ একযোগে। কাজেই, সেই জমায়েত, স্বভাবতই তুলনামূলকভাবে নিরাপদ। যদি না সেখানে আঘাত হানে রাষ্ট্র কিংবা কোনো দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক গোষ্ঠী। টেক ব্যাক দা নাইটের কোনো জমায়েতে তেমন কোনো আক্রমণ কোনোদিন হয়েছে বলে আমার চোখে পড়েনি। কাজেই, একটি মেয়ের পক্ষে সেই আন্দোলনের জমায়েতে থেকে নিরাপদ থাকা খুব কঠিন কাজ নয়।

 

চ্যালেঞ্জ পরেরদিন, পরের রাতে, যখন তিনি আবারো একা, তখন নিরাপদে থাকা। চ্যালেঞ্জ প্রতিদিনকার জীবনে যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই গড়ে তোলা।যে লড়াইয়ে থাকবে না ঠিক রাতের বেলা জমায়েতের প্রতীক, বা টেক ব্যাক দা নাইটের কাব্য। বরং, সেই লড়াই হবে অনেক ক্ষেত্রেই দৃশ্যমানতার বাইরে, অত্যন্ত একঘেয়ে কতগুলো প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে।

 

সাধারণভাবে, টেক ব্যাক দা নাইট আন্দোলনের ধারাটি, সেই পথে অধিকাংশ অংশগ্রহণকারীকেই হাঁটাতে পারেনি। যদিও, একথা অনস্বীকার্য যে গোটা যৌন হিংসা, যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণ বিষয়গুলিকে অনেকাংশেই ট্যাবু মুক্ত করেছে, এক রাতের জন্য হলেও, মেয়েদের একধরনের গণতন্ত্রের বোধ দিতে সক্ষম হয়েছে এই জমায়েতগুলি।

 

২.

পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতায়, প্রথম টেক ব্যাক দা নাইট জমায়েত সংগঠিত হয় ১৯৯৬ কিংবা ১৯৯৭ সালে। ক্ষমতায় তখন বামফ্রন্ট সরকার। মানুষের স্মৃতিতে টাটকা বানতলা ধর্ষণের ঘটনা, বিরাটির ধর্ষণের ঘটনা। টাটকা বিরাটির ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির সাধারণ সম্পাদক শ্যামলী গুপ্তর বিবরণী, যা কিনা প্রকাশিত হয়েছিল তৎকালীন পিপলস ডেমোক্রেসিতে। কি বলেছিলেন কমরেড গুপ্ত? বলেছিলেন, থুড়ি, লিখেছিলেন:

“A group of anti-socials attacked and raped Sabitri Das, Reba Sen and Shanti Sen, the three women who stayed in the unauthorised hutments along the railway tracks… Although so many women of that area, including Shanti Das, the mistress of a notorious anti-social, were involved in foul professions and such honeymoons of these women with the anti-socials were an open secret, that day’s event appeared to be a sequel to the rivalry between these anti-socials with that of Pradip Sarkar, of whom Sabitri Das was a mistress.”

 

অর্থাৎ, কোনো একটি ধর্ষণের ঘটনাকে যথাযথ ধর্ষণের ঘটনা বলে স্বীকৃতি দিতে হলে, ধর্ষিতাদের হতে হবে বিশেষ ধরনের মেয়ে। হতে হবে “ভালো মেয়ে।” এই বিবরণী পড়ে প্রায় হতবাক হয়ে ঐতিহাসিক তনিকা সরকার ইকোনমিক এন্ড পলিটিকাল উইকলি পত্রিকায় লিখেছিলেন:

The only relevance for such description resides in the unstated assumption that there are degrees of culpability in a crime like rape, that women require certain sexual and property qualifications to be classified as fully legitimate victims. More unexpected than the gender politics is the explicitly-accented class angle: the women resided in ‘unauthorised hutments’. It was precisely among refugees clinging to unauthorised hutments that the Left movement had found a major base in Calcutta in the 1950s.

 

তো, তখনকার কলকাতার সেই রাজনৈতিক পরিবেশে ছিল একধরনের বাম-গণতান্ত্রিক নারী আন্দোলনের পরিমণ্ডল। নারী নির্যাতন প্রতিরোধ মঞ্চ, সচেতনা সহ কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের বুকে তখন কাজ করে অনেকগুলি “স্বাধীন” নারী সংগঠন। মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায়, শাশ্বতী ঘোষ সহ অনেকেই আনন্দবাজারের মতো জনপ্রিয় পত্রপত্রিকায় কলাম লেখেন নারী আন্দোলন বিষয়ে। যে সব লেখালেখি পড়েই একটি গোটা প্রজন্ম প্রাথমিকভাবে শিক্ষিত হয়েছিল নারী অধিকার, নারী আন্দোলনের মূল মূল প্রশ্নগুলি নিয়ে। তো, সেই যে মেয়েরা ছিলেন এইধরনের “স্বাধীন” নারী সংগঠনগুলিতে, তাঁরা ছিলেন রাজনৈতিক ভাবধারার দিক থেকে মূলত বাম-মনোভাবাপন্ন। আরও বিশদে বললে, সংসদীয় বাম রাজনীতির বাইরের  বাম রাজনীতির মানুষ। নারী আন্দোলন ছাড়াও তাঁরা অনেকেই সক্রিয় ছিলেন মানবাধিকার আন্দোলন সহ বহু সামাজিক আন্দোলনে। কোথাও একটা গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন, কমিউনিস্ট পার্টি বা কমিউনিস্ট গ্রূপগুলির ছত্রছায়ায় থেকে নারী আন্দোলনের বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজ সমাধা করা যাবে না। কিন্তু, বৃহত্তর বাম সক্রিয়তার সম্পূর্ণ বাইরে গিয়ে তাঁরা প্রায় কেউই নারী আন্দোলন, নারী মুক্তি বা নারীবাদের বিষয়টিকে ভাবেননি।

 

অন্যদিকে, সংসদীয় বাম রাজনীতির ভেতরকার মেয়েদের তখন বড়ো সংগঠন গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি, যাঁদের রাজনীতি সিপিএম-এর পার্টির রাজনীতির পরিধির বাইরে যায় না, লিঙ্গ রাজনীতির দিক থেকে সেই রাজনীতি অতীব সরলীকৃত, এমনকি সমস্যাজনকও। যে সমস্যার কিছুটা সমাজের কাছে ব্যক্ত হয়েছিল শ্যামলী গুপ্তর ওই বিবরণের মধ্য দিয়ে। বানতলা, বিরাটি সহ অন্যান্য ধর্ষণ কাণ্ডে সরকারি প্রশাসনযন্ত্রের নিষ্ক্রিয়তার মধ্য দিয়ে। কাজেই, সিপিএম-এর কাছাকাছি রাজনৈতিকভাবে থাকা অনেক মেয়েরাই তখনো নারী আন্দোলনের প্রশ্নে নিজেদের কাজের গন্ডি বেছে নিয়েছিলেন “স্বাধীন” নারী সংগঠনগুলির ভেতরেই।

 

পশ্চিমবঙ্গের নারী আন্দোলনের এই পর্যায়টি নিয়ে গভীরে কাজ ও রাজনৈতিক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। সেই কাজ এই স্বল্প আয়তনের লেখাটিতে সম্ভব নয়। কিন্তু, যেটা আজ এখন গভীরভাবে ভাবার বিষয়, তা হলো, কেন এতসংখ্যক রাজীনীতি করা, সচেতন মেয়েদের বারবার মনে হয়েছে যে কমিউনিস্ট পার্টি বা গ্রূপের আধারে তাঁদের নারী আন্দোলন কেন্দ্রিক রাজনীতি করার কোনো জায়গা নেই। আজ কমিউনিস্ট পার্টির অন্দরের পিতৃতন্ত্র বিষয়ক বহু কথা উঠে এসেছে।  কিন্তু সেই পিতৃতন্ত্র ব্যাতিরেকেও কি কোনো না কোনোভাবে পার্টি বা গ্রূপগুলির মেয়েদের মনে হয়েছিল যে কমিউনিস্ট পার্টির যে কর্মপদ্ধতি, সেখানে নারী আন্দোলনের প্রশ্নে মেয়েদের কাজ করা সম্ভব নয়? লাল পতাকায় সার্বিক ভাবে রাজনৈতিক বিশ্বাস রেখেও সম্ভব নয়?

 

এই কথা আজ অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে ভাবার সময় এসেছে। নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।

 

কিন্তু, এক্ষেত্রে, যেটা মনে রাখতে হবে যে ১৯৯৫-৯৬ সালের ভেতরেই বাংলার যে “স্বাধীন” নারী আন্দোলনের পরিমণ্ডল ছিল, তা প্রায় ভেঙে চুরমার। স্বাধীন সংগঠনগুলি টিমটিম করে নামকেওয়াস্তে টিকে থাকলেও, প্রায় নিষ্ক্রিয়। তার বদলে জায়গা করে নিচ্ছে এন.জি.ও কেন্দ্রিক নারী আন্দোলন। বাকি ভারতবর্ষের মতনই। বাকি পৃথিবীর মতনই। বহু সময়ে, একসাথে কাজ করতে আসছে একাধিক এন.জি.ও। তার অনেকগুলিরই হোত্রি আগের যুগের “স্বাধীন” নারী আন্দোলনের জঙ্গি কর্মী-নেত্রীরা। আবারো, কেন তাঁরা এন.জি.ও রাজনীতির শরণাপন্ন হয়েছিলেন, সেই আলোচনার আজ প্রয়োজন আছে। প্রয়োজন আছে এই প্রশ্ন তোলার যে এর পেছনে কি প্রকৃতপক্ষে কার্যকরী তাঁদের মূলগত, ভিত্তিগত শ্রেণীচরিত্র? না কি, এখানে আছে আরও বড়ো পুঁজির খেলা? ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত রাজনৈতিক হতাশার বাস্তবতা?

 

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর এই প্রতিবেদনের লেখকের কাছে নেই। এবং, আবারো, এই একটি লেখার স্বল্প জায়গায়, এর সব উত্তর দেওয়াও বোধহয় সম্ভব নয়। কিন্তু, যে কথাটি আমাদের বর্তমান আলোচনার প্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো, এই যে এই নতুনধারার এন.জি.ও ধারার নারীবাদের হাত ধরেই কলকাতায় এলো টেক ব্যাক দা নাইটের উদযাপন।

 

বলতে দ্বিধা নেই এন.জি.ও রাজনীতিতে একটুও বিশ্বাসী না হয়েও, আমিও বেশ কয়েকবার হেঁটেছিলাম সেইসব মিছিলে। তার অন্যতম একটি মূল কারণ ছিল যে যে ধরনের অসংসদীয় বামধারার ছাত্র রাজনীতি আমি করতাম, সেখানে প্রাত্যহিক জীবনে লিঙ্গ রাজনীতির কোনো জায়গা ছিল না। লিঙ্গ রাজনীতির জায়গা ছিল না সংগঠনের কার্যক্রমে, একমাত্র আটই মার্চের আনুষ্ঠানিক বার্ষিক পালন ব্যতীত।

 

অন্যদিকে, সেইসব মিছিলেও যে আমার ভেতরকার রাজনৈতিক ক্ষুধা খুব মিটেছিলো এমনটা নয়। তার পেছনে একটি বড়ো কারণ ছিল এই যে, মিছিলের নেতৃত্বের একটি বড়ো অংশের মহিলাদের  ক্ষেত্রে আমি ভাবতে পারিনি যে তাঁরা কোনো জনমুখী আন্দোলন করতে পারেন, ভাবতে পারিনি তাঁরা আমার যে পরিচিত রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল, সেখানকার মানুষ।তাঁদের সাথে স্বল্প কথাবার্তায় এমন কোনো বোধ তৈরী হয়নি যে তাঁরা রাষ্ট্র, বিচারব্যবস্থা, আইন এইসমস্ত কিছু নিয়ে গভীরভাবে ভাবেন। এমনকি, একটা স্তরের পরে, পিতৃতন্ত্র বিষয়েও তাঁদের আলাপচারিতাকে মনে হয়েছে একশিলাবর্তী।

 

তো, যাক যে সেসব কথা। এই লেখার আলোচ্যও সেসব নয়। তবে, আবারো, কলকতার নারী আন্দোলনের ইতিহাসে এই পর্যায় ও প্রক্রিয়াগুলি অতীব গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই।

 

যদিও, একথা অনস্বীকার্য যে সেসব মিছিলে শ্রমজীবী মহিলা, প্রান্তিক গোষ্ঠীর মহিলারাও ছিলেন। ছিলেন মিছিলের অনাম্নী মুখ হয়ে, সংখ্যা হয়ে। অনেকটা যেভাবে রাজনৈতিক দলের মিছিলেও গরীব মানুষ হাঁটেন সংখ্যা হয়ে, ভীড় হয়ে। গরীব, শ্রমজীবী মেয়েরা সংখ্যা বাদ দিয়ে সেসব মিছিলে অন্যকিছু হয়ে উঠেছেন, নেতৃত্ব দিচ্ছেন, এমন কথা আমার মনে হয়নি। এবং, সত্যই তো এটা বাস্তব নয় যে এন.জি.ও আন্দোলনের ভেতর দিয়ে বর্গ হিসেবে গরিব মেয়েরা (বা পুরুষরা) ক্ষমতায়িত হয়ে ওঠেন। বড়োজোর এইটুকু বলা যেতে পারে যে কিছু কিছু ব্যক্তি মেয়েরা, এন.জি.ও তে চাকরি পান, ব্যক্তিগত জীবনে কিছুটা স্বাচ্ছল্যের মুখ দেখেন।

 

একভাবে দেখতে গেলে, এই দেশে নারী আন্দোলনের এনজিও-আয়ন আসে বিশ্বায়নের হাত ধরে, নয়া-উদারনীতিবাদের উন্মেষের হাত ধরে। না, এন.জি.ও বিষয়টিকেই আমি গোটাগুটিভাবে নাকচ করছি না। একথা অনস্বীকার্য যে বেশ কিছু এনজিও আমাদের এই ভাঙাচোরা সময়ে গুরুত্বপূর্ণ লড়াই লড়েছে। একথাও আমি মনে করি না, বর্তমান সময়ে ফ্যাসিবাদ বিরোধী ও ধর্মীয় মৌলবাদ বিরোধী লড়াইয়ে সমস্ত এন.জি.ও-দেরই বাদ দিতে হবে।

 

এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, গত কয়েক বছরে, যে গুটি কয়েক এন.জি.ও মেয়েদের ও প্রান্তিক মানুষ, জনগোষ্ঠীগুলির প্রয়োজনের ওপর দাঁড়িয়ে কিছু সংঘর্ষমূলক কাজ খুব সীমিত পরিসরে হলেও, গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল বিগত কয়েক দশকে, ২০১৪, বিশেষত ২০১৯-র পর থেকেই,মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই, নানান অজুহাতে তাদের বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, অথবা বন্ধ হতে বসেছে, বিভিন্ন নারী ও লিঙ্গ বিষয়ক পঠনপাঠনের কেন্দ্রগুলি। কাজেই, উদারনৈতিক পুঁজির ছত্রছায়ায় যেটুকু বা পরিকাঠামোগতভাবে নারী প্রশ্নে কিছু ক্ষমতায়নের বাতাবরণ প্রস্তুত করা সম্ভব হয়েছিল, উদারনৈতিক পুঁজি ও দক্ষিণপন্থী ধর্মীয় মৌলবাদ ও ফ্যাসিবাদের আক্রমণে আজ তা প্রায় সম্পূর্ণভাবে নিঃশেষিত। এবং, আজকের সময়ের লিঙ্গ বিষয়ক লড়াইগুলিকে বুঝতে হলে, বিশ্লেষণ করতে গেলে, এই বৃহত্তর প্রেক্ষিতকে বাদ দেওয়ার কোনো উপায় নেই।

 

কিন্তু, একথা অনস্বীকার্য যে গোটা নয়ের দশক জুড়ে এই দেশের নারী আন্দোলনের প্রগাঢ় এন.জি.ও-আয়ন একধরনের বি-সংহতিকরণের (ডিমোবিলাইজেশন) রাজনীতির জন্ম দিলো। সম্মুখ সমরের বদলে এলো পুঁজি নির্ভর (বহুক্ষেত্রেই বিদেশী), “প্রজেক্ট” নির্ভর পেশাদার সামাজিক আন্দোলনের কর্মী। পরিবর্তিত হতে লাগলো রাজনৈতিক ভাষা — শ্রেণী সংগ্রাম বা সংঘর্ষ নয়, অন্য কোনো ধরনের সার্বিক যৌথ সংঘাতও নয়, রাজনীতির আলোচনা হতে শুরু করলো “ক্ষমতায়ন”-কে কেন্দ্রে রেখে। কোনো আমূল সমাজ বদল নয়, এন.জি.ও রাজনীতি মানুষকে শেখালো, এই বর্তমান স্থিতিস্থাপকতার ভেতরেই হবে পরিবর্তন। আস্তে আস্তে। এন.জি.ও প্রণীত পরিবর্তনের ধারণা, তার সম্বন্ধে লেখিকা অরুন্ধতী রায় লিখলেন,

Eventually–on a smaller scale, but more insidiously–the capital available to NGOs plays the same role in alternative politics as the speculative capital that flows in and out of the economies of poor countries. It begins to dictate the agenda. It turns confrontation into negotiation. It depoliticizes resistance. It interferes with local peoples’ movements that have traditionally been self-reliant. NGOs have funds that can employ local people who might otherwise be activists in resistance movements, but now can feel they are doing some immediate, creative good (and earning a living while they’re at it) […] Real political resistance offers no such short cuts. The NGO-ization of politics threatens to turn resistance into a well-mannered, reasonable, salaried, 9-to-5 job. With a few perks thrown in. Real resistance has real consequences. And no salary.

 

অস্বীকার করে লাভ নেই, বাংলা তথা ভারতবর্ষে, যে যে বিষয় ও ক্ষেত্রগুলিকে রাজনৈতিক বামেরা এতদিন ধরে উপেক্ষা করে এসেছে, সেইসব জায়গাগুলিতেই গড়ে উঠলো বেশি বেশি করে এন.জি.ও – নারী আন্দোলন, প্রান্তিক বা বিকল্প যৌনতার আন্দোলন, পরিবেশ আন্দোলন হয়ে উঠলো সেইসব ক্ষেত্রগুলি। অতএব, এন.জি.ও – ধারার সক্রিয়তা প্রতিষ্ঠা পেলো, বৈধতা পেলো বাম রাজনীতির মতাদর্শগত ও পদ্ধতিগত দুর্বলতাকে আঁকড়ে ধরেই। এবং, খুব স্বাভাবিকভাবেই, এক শ্রেণীর মধ্যবিত্ত উদারপন্থী, প্রগতিশীল মানুষের কাছে এন.জি.ও রাজনীতি বৈধতাও পেলো খুব তাড়াতাড়ি। সত্যিই তো, এন.জি.ও করলে, বিদেশী (বা স্বদেশী) ফান্ড জোগাড় করলে, যে কোনো কাজই সমাধা করা যায় অনেক সুষ্ঠূভাবে।  তাতে থাকে না বামপন্থী আন্দোলন গড়ে তোলার প্রাত্যহিক ঘর্ষণ। সাথে সাথে পাওয়া যায় সামাজিক সম্মান ও রোজগার পন্থাও।

 

এই জায়গায় দাঁড়িয়ে, এন.জি.ও গুলি আমাদের দেশে আমদানি করলো আন্দোলনের একটি নতুন ভাষাও। নারী আন্দোলনের ক্ষেত্রে, সেই নতুন ভাষার মধ্যে অন্যতম হলো, টেক ব্যাক দা নাইট। এবং, খুব জনপ্রিয়তাও অর্জন করলো একশ্রেণীর মেয়েদের কাছে। এটা বললে অত্যুক্তি হবে না সেই ১৯৯৬ সাল থেকে শুরু করে, যে টেক ব্যাক দা নাইট অনুষ্ঠানগুলি ঘটতে শুরু করলো, তার ভেতর দিয়েই একভাবে প্রতিষ্ঠা পেলো নয়া-উদারনৈতিক নারীবাদ। যদিও এই গালভারী কথাটি আমাদের ভেতরে নয়ের দশকে ঠিক প্রচলিত হয়নি। দেশের অন্যান্য জায়গাতেও, বিশেষ করে বড়ো শহরগুলিতে নিয়মমাফিকভাবে অনুষ্ঠিত হতে থাকলো টেক ব্যাক দা নাইট। বহুক্ষেত্রেই, কোনো না কোনো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ঘিরে। বা, কোনো না কোনো এন.জি.ও-দের কাজের পরিধিকে ঘিরে। এবং, যত সময় গেলো, দেখা গেলো দিল্লি, মুম্বাই বা ব্যাঙ্গালোরের মতন শহরে টেক ব্যাক দা নাইট পর্যবসিত হয়েছে উচ্চ মধ্যবিত্ত মেয়েদের অনুষ্ঠানে।

 

একভাবে তাই একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে যেটা স্পষ্ট হয়, তা হল, নয়া-উদারনৈতিক নারীবাদ এই দেশে ঠিক পুরোপুরি স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে ওঠেনি। বরং, অতীব সুপরিকল্পিত বিভিন্ন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে তাকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে ধীরে ধীরে। এন.জি.ও-দের আধারে গড়ে ওঠা নারী ও লিঙ্গ আন্দোলন, এক অর্থে, এই উপমহাদেশের আদি নয়া- উদারনৈতিক নারী আন্দোলন।

 

অবশ্য, এর মধ্যে, খোদ আমেরিকাতে টেক ব্যাক দা নাইট পরিবর্তিত হয়েছে একটি এন.জি.ও সংগঠনে — ওদেশের ভাষায় নন-প্রফিট। তাদের চ্যাপ্টার হতে গেলে সংযুক্ত থাকতে হয় কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে — স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মিলিটারি বেস, অথবা সরকারি দপ্তর। তাঁরা বিক্রি করেন টেক ব্যাক দা নাইট টি-শার্ট, ব্যাগ, কফি মগ ইত্যাদি। এই প্রতিবেদকের পনেরো বছর আমেরিকা বসবাসকালে টেক ব্যাক দা নাইট আন্দোলনটি ছিল নেহাতই একটি    নখদন্তহীন প্রাতিষ্ঠানিক আন্দোলন। বছরে একবার বিশ্ববিদ্যালয় স্বীকৃত উইমেন্স সেন্টার পরিচালিত একটি মিছিল বের হতো সন্ধের মুখে কিংবা রাতে। কিছু যৌন হিংসাবিরোধী স্লোগান উঠতো, হতো কিছু সাংস্কৃতিক কর্মসূচী।

 

এমনটা যদিও আমি দাবি করছি না যে টেক ব্যাক দা নাইট শুধুই শ্বেতাঙ্গ মেয়েদের আন্দোলন, কিন্তু মূলগত চরিত্রের দিক দিয়ে আন্দোলনটি শ্বেতাঙ্গ মধ্যবিত্ত মেয়েদেরই মূলত আকর্ষণ করেছে। বাকিরা এসেছেন, নিজেদের সম্প্রদায়, নিজেদের জীবনের কথাও বলেছেন, কিন্তু ঠিক যেন সংযুক্ত হতে পারেননি আন্দোলনটির সাথে। কারণ, আসলে এটাই তো বাস্তব যে যে মেয়েটি শ্রমজীবী মেক্সিকান মেয়েটি সারা রাত জেগে কাজ করেন রাস্তার ধারের একটি পেট্রল পাম্পে বা যে কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েটি সারারাত কাজ করে কোনো ম্যাক-ডোনাল্ডসে, তাঁদের জীবনের সুরক্ষার প্রশ্ন বা সময়ের প্রশ্ন বা দিনরাতের প্রশ্ন, ঠিক মধ্যবিত্ত ঘরের বৌয়ের মতন নয়। নয় মধ্যবিত্ত শ্বেতাঙ্গ পেশাজীবী মহিলাদের মতনও।

 

এই যে প্রাতিষ্ঠানিক পশ্চিমা নারীবাদের নখদন্তহীন চেহারা, তাকে টেক ব্যাক দা নাইট নিয়ে এসেছিল ভারতবর্ষের রাজনৈতিক সক্রিয়তার ভূগোলেও। নারী আন্দোলনের রাজনৈতিক ভূগোলে।

 

আসলে, যৌন হিংসা বা ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের ভেতরে একটা দ্বৈততা আছে। ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন বা যৌন হিংসা বিরোধী আন্দোলন পিতৃতন্ত্রবিরোধী আন্দোলনের যে ক্রমাধিকারতন্ত্র, তাতে কোনো উচ্চতর স্তরকে প্রতিনিধিত্ব করে না। মানে, যৌন হিংসা ব্যতীত জীবন, তাতে যে কোনো মানুষের মূলগত অধিকার। সেই অধিকার চাইতে কাউকে পিতৃতন্ত্রবিরোধী হতে হয় না। যৌন হিংসার বিরুদ্ধে পথে নামতে পারেন প্রচুর পিতৃতান্ত্রিক মানুষও। নামেনও। কারণ, যৌনহিংসাবিরোধী আন্দোলন পিতৃতন্ত্রের খুব গভীর কোনো বহুমুখীন বিশ্লেষণ দাবি করে না।

 

অন্যদিকে, যৌন হিংসা বা যৌন হিংসার সম্ভাবনা একটি মেয়ের জীবনের যে ভিত্তিগত সম্মানবোধ, তা আমূলে নাড়িয়ে দেয়। তার জীবনকে বিভিন্নভাবে কণ্টকিত করে, তাকে তার নিজের শরীর ও যৌনতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে, তার ভেতরে তৈরী করে এক গভীর যৌন বিবিক্ততাবোধ। যে বিবিক্ততাবোধ পিতৃতন্ত্রের অন্যতম বাস্তবতা, যাকে বহুসময়েই ভাষায় ব্যক্ত করা কঠিন। ফলত, যৌনহিংসাবিরোধী আন্দোলন দাঁড়িয়ে থাকে অনেকগুলি খানাখন্দের ভেতরে। অনেক অনেক জটিলতার ওপর দাঁড়িয়ে। সেসবের আলোচনা এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়।

 

কোনো কোনো ক্ষেত্রে, আন্দোলনটি পরিচালিত হতে পারে একেবারেই নখদন্তহীনভাবে। যেমনভাবে বছরের পর বছর ধরে হয়ে চলে একটার পর একটা টেক ব্যাক দা নাইট। উচ্চারিত হয় কিছু সর্বজনগ্রাহ্য কথা। কারণ, ওই যে বললাম, নিতান্ত বিকৃতমনষ্ক না হলে, যৌননির্যাতন বা যৌনহিংসার পক্ষে ঠিক কোনো মানুষই সরাসরি খোলাখুলি দাঁড়ান না। এমনকি, যারা বলে থাকে, ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতন ঘটেছে মেয়েটিরই “দোষে”, তাঁরাও সচরাচর গোটাগুটিভাবে যৌন নির্যাতনের সপক্ষে দাঁড়াবেন না। কাজেই, একটি যৌনহিংসা বিরোধী আন্দোলনকে ওই নখদন্তহীনতার পরিমণ্ডল থেকে টেনে বার করে আনতে হলে, আন্দোলনের ক্ষেত্র থেকে, মঞ্চ থেকে রাখতে হয় কিছু কঠিন প্রশ্ন। যে কঠিন প্রশ্নসমূহ চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে এই সর্বজনগ্রাহ্যতাকে। রাখতে হয় কিছু অস্বস্তিকর প্রশ্ন। সেই কঠিন, অস্বস্তি উদ্রেককারী প্রশ্নগুলি ও বিষয়গুলি বদলেও যেতে পারে পরিপ্রেক্ষিতের ওপর নির্ভর করে।

 

ভারতবর্ষ তথা বাংলার ক্ষেত্রে, ঠিক কি কি পরিগণিত হতে পারে এই অস্বস্তিকর প্রশ্নরূপে? এই আলোচনায় আসবো পরে। তার আগে চলুন চোখ ফেরানো যাক বর্তমান ও খুবই সাম্প্রতিক অতীতের পরিপ্রেক্ষিতে।

 

৩.

এগারোই অগাস্ট, ২০২৪ ফেসবুকে একটি আহ্বান চোখে পড়লো। আহ্বানটি রাখলেন বিভিন্ন নারীবাদী কবি, অধ্যাপিকা ইত্যাদিরা। আহ্বানটির বয়ানটিকে নিচে রাখা হলো:

 

রাতের রাস্তায় মেয়েদের জমায়েত (১)

 

১৪ই অগাস্ট ২০২৪

রাত এগারোটা

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেটের সামনে।

আসুন ছোটো বড়ো সব বয়সের মেয়েরা পালা করে দল বেঁধে বেরিয়ে পড়ি মধ্য রাতের শহরগুলোতে… ঘুরে বেড়াই। কেন আমরা সবাই জানি। সেসব নিয়ে কথা বলার সময় নেই আর।

 

আসুন, আমরা কলকাতাকে কয়েকটা zone এ ভাগ করে এক এক দিন এক একটা জায়গায় কিম্বা একই সঙ্গে অনেক zone (যদি আমরা সংখ্যায় বেশি হই) ছড়িয়ে পড়ি।

 

রাত এগারোটা থেকে একটা – আপাতত শুধু এটুকু বলার জন্য যে এ শহরে আমরা আছি – দিনে রাতে কাজ করছি, ক্লান্ত হচ্ছি, আনন্দ করছি, কষ্ট করছি এইখানেই।

এটা কোনো বৈপ্লবিক পদক্ষেপ নয়, কোনো স্লোগানের প্রয়োজন এই মুহূর্তে নেই।

 

এটা বোঝা যাচ্ছে না যে হাসপাতালে, হোটেলে, রেল স্টেশনে, এয়ারপোর্টে, অলিতে গলিতে মেয়েরা রাতেও থাকে।

তাই…

“গায়ের জল গায়ে শোকায়

চোখের জল চোখে,

একলা মেয়ের লাশ দেখলেও

মন্দ বলে লোকে”

 

আসুন, এই বয়ানটিকে একটু ছিঁড়েখুঁড়ে বিশ্লেষণ করি। এখানে কোনো ঘটনার উল্লেখ নেই। ইঙ্গিতে জানানো হয়েছে ৯ই আগস্ট, ২০২৪, আর.জি.কর মেডিকেল কলেজের তরুণী ডাক্তারের মৃত্যু ও ধর্ষণের কথা। জানানো হয়েছে ইঙ্গিতে কলেজের প্রাক্তন প্রিন্সিপাল সন্দীপ ঘোষের সেই কুখ্যাত উক্তি–অতো রাতে মেয়েটার সেমিনার হলে যাওয়া দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতন কাজ হয়েছে। কিন্তু যেহেতু খুব স্পষ্ট করে বলা হলো না সেসব কথা, এমনকি এক লাইনেও সারা হলো না পরিপ্রেক্ষিতটি, তাই এখানে বিশেষ ঘটনাটির প্রতি কারুর কোনো দায়বদ্ধতা রইলো না।

 

গোটা আহ্বানটিই দাঁড়িয়ে গেলো সাধারণীকৃত একটি বক্তব্যে, সাধারণীকৃত একটি অনুষ্ঠানে, যার মূল কেন্দ্র দাঁড়িয়ে আছে মেয়েদের রাতে একসাথে শহর ঘুরে বেড়ানোর প্রকল্পে। যাঁরা নারী আন্দোলনের ঐতিহাসিক ভাষা ও আন্দোলনের সাথে মোটামুটি পরিচিত, তাঁদের বুঝতে কষ্ট হয় না যে ঠিক নাম না করলেও, এটা অনেকটাই আরেকটি টেক ব্যাক দা নাইট অনুষ্ঠানটি সংগঠিত করার আহ্বান। কিন্তু, তার সাথে সাথে এই যে ঘুরে বেড়ানোর আমন্ত্রণ মেয়েদের কাছে, সেখানে খুব সজোরে ঘোষিত হলো আরেকটি একই ধারার আন্দোলনের অনুরণন — রাইট টু লয়টার। অথবা, ঘুরে বেড়ানোর অধিকার।

 

২০১১ সালে টিসের অধ্যাপিকা শিল্পা ফাডকে, সামিরা খান ও শিল্পা রানাডে মিলে একটি বই লিখলেন, যার শিরোনাম হোয়াই লয়টার: উইমেন আন্ড রিস্ক অন মুম্বাই স্ট্রিটস, যেখানে তাঁরা বললেন, একটি শহরে মেয়েদের স্বাধীন ভাবে ঘুরে বেড়ানো একটি মৌলিক অধিকার এবং আজকের সময়ের নারীবাদকে সেই মৌলিক অধিকারকে জোরেসোরে সামনে রাখতে হবে। লিখলেন তাঁরা — It’s different because women don’t loiter […] there’s an unspoken assumption that a loitering woman is up to no good. She is either mad or bad or dangerous to society (vii). তাঁরা এও বললেন যে সমসময়ের নারীবাদকে দাঁড়াতে হবে “ঝুঁকি” (রিস্ক) ও “সুখানুভব” (প্লেসার”) এই দুইটি ক্ষেত্রের ওপরে। যে ক্ষেত্রদুটিই, তাঁরা বললেন, যে প্রায় গোটাগুটি বাদ পড়ে গেছে সাত ও আটের দশকের ভারতীয় নারী আন্দোলনের ভেতর থেকে। অর্থাৎ, “স্বাধীন” নারী সংগঠনগুলির লড়াইয়ের ক্ষেত্র থেকে। দুখভরি কাহানি শুনিয়ে আর রাষ্ট্রর কাছ থেকে অধিকার বা সুযোগসুবিধা আদায় নয়, সমসময়ের নারীবাদ হবে আনন্দের সন্ধানে, ঝুঁকি বুকে নিয়ে।

 

যেমন, তাঁরা লিখলেন: “Thus, loitering as a right implicitly assumes that everyone has the right to pleasure. The presence of the loiterer ruptures the controlled socio-cultural order of the global city by refusing to conform to desired forms of movement and location and instead, creating alternate maps of movement, and thus, new kinds of everyday interaction.”এই প্রসঙ্গে তাঁরা টেনে আনলেন পারিসিয়ো ফ্লানেয়ারের (flaneur ) কথাও। ফ্লানেয়ার শব্দটি মূলগতভাবে ফরাসি শব্দ – যার সঠিক বাংলা অনুবাদ করা কঠিন। ফ্লানেয়ার অনেকটা যেন সেই আওয়ারা লোফার, যে সুন্দর সেজেগুজে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, দোকানের জানলায় দাঁড়ায়, বইয়ের বা পত্রিকার পাতা উল্টে দেখে। ফ্লানেয়ারের পয়সা আছে, কিন্তু কোথাও নিজেকে সঁপে দেওয়া নেই। সে চির পর্যবেক্ষক, মতাদর্শগত স্থিরতা বা সিদ্ধান্ত তার জন্য নয়।

 

অর্থাৎ, এই যে ফাডকে প্রমুখদের নতুনধারার নারীবাদ, সেখানকার অন্তর্গত “ঝুঁকি” ও “সুখানুভব”-এর যে ধারণা, তা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেলো বাজারের নন্দনতত্ত্বর সাথে, বাজারের স্থাপত্যর সাথে। মানে, বাজার বাদ দিয়ে তো আসলে ফ্লানেয়ার হয় না। শিল্পবিপ্লব পরবর্তী যে সময়ে বদলে গেলো ইউরোপের শহরচিত্র, তৈরী হলো নতুন ধরনের আর্কেড টাইপ বাজার (অনেকটা আমাদের ধর্মতলা-এস্প্লানেডের মতন), সেই পরিপ্রেক্ষিত বাদ দিয়ে তো আসলে ফ্লানেয়ার চরিত্রটি কোনো আকার ধারণ করতে পারে না।

 

আবার, আরেকটু তলিয়ে ভাবলে যেটা দেখা যাবে, তা হলো, এই যে “ঝুঁকি” আর “সুখানুভূতি” এই দুটিই তো বাজারের অন্তরীণ দর্শন, অন্তরীণ দর্শন নয়া-উদারনীতিবাদের যা বাজারকে উন্নীত করে একধরনের একচ্ছত্রাধিপত্যের স্থানে। কাজেই, এই যে নতুন ধারার নারীবাদ, প্রশ্ন জাগে, আসলে কি আন্দোলনকারী মেয়েদের শেখাবে বাজারের সাথে সম্পৃক্ত যথাযথ নয়া-উদারনৈতিক সমাজসদস্য হয়ে উঠতে? না হলে এতো জোরেসোরে ফ্লানেয়ারের কথা এলো কোথা থেকে? এই ফ্লানেয়ারের যে আপাত রোমান্টিক আবেদন, তা সম্পূর্ণভাবে বিভ্রম তৈরী করলো বাজারের অব্যশ্যম্ভাবী শর্ত মানুষের রাজনৈতিক ও সামাজিক চাহিদার যে পণ্যকরণ, সেইটিকে অদৃশ্য করে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে ঝুঁকি যে কেবল ব্যক্তি নারীর নয়, সেটি আসলে সামগ্রিক ব্যবস্থার ক্ষমতা বৈষম্যের ওপর দাঁড়িয়ে এবং বকলমে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায়, সেইটা সম্পূর্ণ ভাবে ভুলিয়ে দেওয়া হল।

 

অবশ্য, একথা অনস্বীকার্য যে এই যে মেয়েদের “ঘুরে বেড়ানো” র আন্দোলনের ভাষা, তা তৈরী করলো একধরনের রাজনৈতিক বৈষয়িকতা। মেয়েদের  রাজনৈতিক বৈষয়িকতা। যে বৈষয়িকতা নিজেকে প্রকাশ করে একধরনের স্থানিক দাবির ভেতর দিয়ে। মেয়েরা এখানে দাবি করে শহরের স্থান। এই রাজনৈতিক বৈষয়িকতা একভাবে সময়েরও দাবিদার। এই রাজনৈতিক বৈষয়িকতা শেখায় একটি মেয়েকে রাতের শহরের দাবি করতে। যে রাত নাকি একটি মেয়ের কাছে অগম্য। যে রাতের শহর নাকি একটি মেয়ের কাছে অগম্য। এবং, এই স্থানকালের দাবিই এই ধরনের আন্দোলনকে করে তোলে অন্যান্য আন্দোলনের থেকে আলাদা।

 

মানে, আমরা তো জেনেছি রাজনৈতিক জমায়েত হয় দিনের আলোতে। আমরা তো জেনেছি রাজনৈতিক জমায়েত শেষ হয় বিকেল বিকেল, সন্ধ্যে পড়তে না পড়তে। তাই, এই যে রাত জুড়ে ঘুরে বেড়ানোর আহ্বান, তা সেই পরিচিত রাজনৈতিক ভাষার প্রতিই যেন একধরনের ভ্যাংচানি, একধরনের আঘাত। বিশেষ করে ভারতবর্ষের মতন দেশে, যেখানে সময় ও সাধারণ সমাজ চিরকালই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ সামাজিক জীবনের থেকে অনেক অনেক বেশি রাজনৈতিক। যেখানে রাজনৈতিক জমায়েত কোথাও একটি শহরের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

 

কিন্তু, এই যে ভ্যাংচানি, তাতো এখানেই শেষ নয়। রাইট টু লয়টার আন্দোলন আমদানি করলো একধরনের উদ্দেশ্যহীন রাজনৈতিক বৈষয়িকতার। শিল্পা ফাডকেরা লিখলেন,

Besides demonstrating that they belong in private spaces, women also have to indicate that their presence in public space is necessitated by a respectable and worthy purpose. Further, this purpose has to be visibly demonstrated to the effect that when any woman accesses public space, she has to overtly indicate her reason for being there.

 

ফাদকেদের এই বক্তব্যের সাথে এই প্রতিবেদকের কোনো দ্বিমত নেই। একথা সত্য যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেয়েরা যখন বাড়ির থেকে বের হয়, সেটা কোনো না কোনো উদ্দেশ্য নিয়েই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, সেই উদ্দেশ্য তার পরিবারের কাজে লাগে। যেমন, বাজারে যাওয়া, ছেলেমেয়েদের স্কুল থেকে আনা, কেনাকাটা করা। মায় চাকরি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাই মেয়েদের রাস্তায় বেরোনোটাকে গৃহশ্রমের পরিবর্ধন বললেও অত্যুক্তি হয় না। একথা মেনে নিতেও বা সোচ্চারে দাবি করতেও এই প্রতিবেদকের কোনো অসুবিধা নেই, চাই মেয়েদের বিশ্রাম ও আনন্দের সামাজিক ক্ষেত্র। চাই মেয়েদের সুরক্ষিত আড্ডার জায়গা। চাইলে মেয়েরা যেন যে কোনো সময়ে — রাত কিংবা দিন — একা অথবা দল বেঁধে ঘুরে বেড়াতে পারে।

 

কিন্তু, তার পরেও তো থেকে যায় অনেক অনেক প্রশ্ন।

 

এবং, একথাও তো অনস্বীকার্য যে মিটিং-মিছিল, দাবি আদায়ের বিভিন্ন ধারার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে যে মেয়েটি রাস্তায় বেরোচ্ছে, সেও তো উদ্দেশ্য নিয়েই রাস্তায় বেরিয়েছে। তাহলে এই যে মেয়েদের উদ্দেশ্যহীনতার এক বয়ানকে এখানে রাজনৈতিক বয়ানে পরিণত করা হলো, সেখানে তো বিলকুল হারিয়ে গেলো এই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে রাস্তায় বেরোনো মেয়েটির কথা।

 

কাজেই, একটি কথা এখানে স্পষ্ট। না, এখানে মেয়েরা বিপ্লব চায় না ছয়ের বা সাতের দশকের একটি বড়ো সংখ্যক মেয়েদের মতন। সেই বিপ্লবে নিজের স্থান করে নিতে পুরুষ কমরেডদের সাথে কনুই গুঁতোগুঁতি করে না। এখানে মেয়েরা সাত বা আটের দশকের নারীবাদীদের মতন ধর্ষণ বা বধূহত্যা ও পণপ্রথার বিরূদ্ধে পথ অবরোধের ডাক দেয় না, সজোরে দাবি করে না ধর্ষণজনিত আইন পরিবর্তন। এখানে বড়োজোর মেয়েরা চায় একটু নিরাপদে ঘুরে বেড়াতে রাস্তায়। সেই ঘুরে বেড়ানোর পেছনে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই, নেই কোনো বিশেষ সামাজিক চেতনার দাবি। সেই উদ্দেশ্যহীনতার অভিব্যক্তি পাওয়া যায় ঋতু সেন চৌধুরীর এই আহ্বানে। বিশেষত, যেখানে তিনি লেখেন: “এটা কোনো বৈপ্লবিক পদক্ষেপ নয়, কোনো স্লোগানের প্রয়োজন এই মুহূর্তে নেই।”

 

অর্থাৎ, অরাজনীতি।

 

স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, যদি মেয়েদের রাস্তাতে ঘুরেও বেড়াতে হয় উদ্দেশ্যহীনভাবেতাদের প্রাত্যহিক জীবনে, তাহলেও তো তাদের লাগবে সুরক্ষা। কিভাবে আসবে সেই সুরক্ষা? কারা দেবে? ঘোষিত অনুষ্ঠানের দিন তো সুরক্ষা দেবে পুলিশ। কিন্তু, তারপর? বাকি রোজকার জীবনে? অর্থাৎ, এখানেও খুব স্বাভাবিকভাবে আসবে, রাষ্ট্র। যে বিষয়টাকে সুচতুরভাবে এড়িয়ে যাওয়া হলো এই আহ্বানে। কিভাবে ঠিক মেয়েরা রাষ্ট্রের কাছে রাখবে নিজেদের দাবিসনদ? কিভাবে সেটা আদায় করবে তারা? সেসবের কোনো উত্তর মিললো না এখানে।

 

উত্তর মিললো না এই বিষয়ে যে, যে মেয়েরা পথেই বাস করেন, অথবা শরীর বেচতে বাধ্য হন, যাদের কাছে রাতের শহরের পথ কর্মক্ষেত্র অথবা বাসস্থান, কিভাবে ঠিক আঁটবেন তাঁরা এই “রাতে ঘুরে বেড়াই চলুন”আন্দোলনে। ঠিক যেমনভাবে “টেক ব্যাক দা নাইট” আন্দোলন সেসবের উত্তর দেয় না। বরং,এই আহ্বানের মধ্য দিয়ে যেটা করা হলো, তা অনেকটা এইরকম — এতদিন ধরে, নারীবাদী আন্দোলনের যে দুটি স্থানিক গতিমুখ ছিল — গার্হস্ত্যতা/পরিবার এবং কর্মক্ষেত্র — তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মনোযোগ দেওয়া হলো একধরনের ভাসাভাসা রাত জুড়ে ঘুরে বেড়ানোর ভাষাপুঞ্জে। কিন্তু, কি ঠিক এই ভাসা ভাসা বর্ণনার ভেতরকার উদ্দেশ্য ?

 

না, একথা বলা অনুচিত হবে যে টেক ব্যাক দা নাইট বা রাইট তো লয়টার আন্দোলনের উদ্দেশ্য প্রতক্ষ্যভাবে কোনো ভোগবাদী, বাজারভিত্তিক বৈষয়িকতা গঠন। কিন্তু, কি করবে মেয়েরা সারা রাত ধরে “উদ্দেশ্যহীন” ভাবে ঘুরে বেরিয়ে? আসলে, এই পৃথিবীতে নিখাদ উদ্দেশ্যহীনতা বলে তো কিছু থাকে না। উদ্দেশ্যহীনতার পেছনেও থাকে উদ্দেশ্য। যেমন অরাজনীতিও আসলে একধরনের রাজনীতি। তো, উদ্দেশ্যহীন মেয়েরা কি ক্রেতা হয়ে উঠবে আরও বেশি বেশি করে? মেয়েরা সারারাত ঘুরে বেড়ানো মানে কি সারারাত খোলা থাকবে মল, শপিং কমপ্লেক্স, কফি শপ, রেস্টুরেন্ট বা আইসক্রিম পার্লারও? যেমন কলকাতার সাম্প্রতিক “রাত দখল” এর দিন সারারাত চলেছে উবের বা ওলা?

 

অর্থাৎ, আরও আরও বেশি করে কর্পোরেট স্পেকটাকেল আর আরও আরও বেশি করে সেই কর্পোরেট স্পেকটাকেলে মেয়েদের অংশগ্রহণ ?

 

না, এমন কথা আমি বলছি না যে সারারাত ঘুরে বেড়ানোর বা মলে মলে ঘিরে জিনিস কেনা বা আইসক্রিম খাওয়ার অধিকার মেয়েদের নেই। আছে। এবং, কোনো মেয়ে এককভাবে বা দলবদ্ধভাবে যদি তা করতে চায়, তাহলে তার সুরক্ষার দায়িত্ব সমাজের, রাষ্ট্রের। কিন্তু, ঠিক কোন ধরনের মেয়েদের কথা বলছি এখানে আমরা? যার ক্রয়ক্ষমতা আছে, তার কথাই তো? যার আছে উদ্বৃত্ত উপার্জন, তার কথাই তো? সেই মেয়েটার সুরক্ষার ঠিক কি হবে যে কাজ করবে এইসব মলে বা আইসক্রিম পার্লার বা কফি শপে? কি হবে সেই মেয়েটার, যে চালাবে ওলা বা উবের? নাকি, সেখানে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর মতন, আমরাও মুখে বলবো এ তো পশ্চাদসরণ (বাঙালি মধ্যবিত্ত প্রগতিশীলের বড়ো দায় পলিটিকালি কারেক্ট থাকা), আর ভেতরে ভেতরে ভাববো, রাতে মেয়েরা কাজ না করলেই তো ভালো। আসলে, যে মেয়েটি ক্রেতা আর যে মেয়েটি ক্রেতাকে সেবা দান করে, তাদের দুজনেরই কি একই সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার আছে? যে মেয়েটি “হোয়াইট কলার” শ্রমিক, আর যে মেয়েটি “ব্লু কলার” শ্রমিক — মানে যেমন ধরুন ডাক্তার আর আয়া, অধ্যাপক আর ক্যাম্পাসের ঝাড়ুদারনী — তাঁদের দুজনেরই তো আছে সুরক্ষায় সমান অধিকার, সেখানে ঠিক কিভাবে এই দুই ধরনের মেয়েদেরই সুরক্ষা সুনিশ্চিত হবে?

 

না, এই ধরনের জটিল প্রশ্ন টেক ব্যাক দা নাইট বা রাইট টু লয়টার নিয়ে চিন্তিত নয়, এই প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজা তাঁরা নিজেদের কাঁধে তুলে নেয়নি। মোটামুটিভাবে, এই আন্দোলনগুলি আটকে থেকেছে একেক দিনের প্রতীকী কর্মসূচিতে। প্রতীকী কর্মসূচি থেকে প্রতিনিয়ত বাস্তবের মাটিতে দীর্ঘমেয়াদি লড়াই এই ধারার আন্দোলনগুলি থেকে ঐতিহাসিকভাবে গড়ে ওঠেনি।

 

প্রসঙ্গত, পাঠককে আরেকটু বড়ো প্রেক্ষাপট দেওয়ার খাতিরে বলি, মল, কফি শপ বা শপিং কমপ্লেক্স — অর্থাৎ, যে যে প্রতিষ্ঠানগুলিকে আমরা চিনি নয়া-উদারনীতিবাদের খাস বাণ্যিজিক স্থান বলে — তারও মোটামুটি ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠা এই নতুনধরনের আন্দোলনগুলির সাথে সাথেই। অর্থাৎ, মোটামুটিভাবে নয়ের দশকের মাঝামাঝি। এবং, একথাও অনস্বীকার্য যে, এই প্রতিষ্ঠানগুলি একশ্রেণীর মধ্যবিত্ত মেয়েদের কাছে এনেছে একধরনের স্থানিক ও সাংস্কৃতিক গণতন্ত্রীকরণের স্বাদ, যা অস্বীকার করা বোকামি, এবং যা আরও গভীর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের দাবি করে। বহুক্ষেত্রে, এও সত্য যে মধ্যবিত্ত মেয়েরা এই প্রতিষ্টানগুলিকে দেখেন, যৌন হিংসা ও যৌন নির্যাতনের প্রতিষেধক বলে। তার ভেতরে থাকে একটি গভীর অবচেতন ভাবনা — “যে কেউ” তো আর এই সব জায়গায় ঢুকতে পারবে না। এবং, সত্যিই তো, যে নিরাপত্তার পরিকাঠামো ঘিরে থাকে এইসব প্রতিষ্ঠানগুলিকে, সেখানে সমাজের যে কোনো মানুষই ঢুকতে পারেন না। বহু নিদর্শন আছে যেখানে শহরের বস্তির বাচ্চাদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি মলে, ঢুকতে দেওয়া হয়নি “লুঙ্গি পরা” কোনো পুরুষকে। কাজেই, এই প্রতিষ্ঠানগুলির যে নিরাপত্তার বাতাবরণ, তার ভেতরেও রয়েছে এক গভীর শ্রেণীবোধ। আমরা মধ্যবিত্ত মেয়েরা হলফ করে কেউ বলতে পারবো না যে আমাদের ভেতরেও এই প্রগাঢ় শ্রেণীবোধজনিত, সাম্প্রদায়িক ও জাতপাতচেতনা জনিত লিঙ্গায়িত ও যৌনায়িত সুরক্ষাবোধ কাজ করে না।

 

কাজেই রাইট টু লয়টার বা “চলুন ঘুরে বেড়াই” জাতীয় আন্দোলন কি একভাবে রাস্তাতেও নিয়ে আসতে চায় এই মল-কফিশপের সুরক্ষাবোধ? যেখানে মধ্যবিত্ত মেয়েদের সুরক্ষার জন্য আগাপাশতলা “সাফসুতরো” করা হবে রাস্তা? বলা বাহুল্য, এই কথা তুললে, সজোরে নেতিবাচকে উত্তর দেবেন উদ্যোক্তারা। কিন্তু, তাহলে তো তাঁদের ওপর দায়িত্ব বর্তে যায় আরেকটু বেশি। প্রতীকী অনুষ্ঠানের বাইরেও কিছু প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায়িত্ব বর্তায়, দায় বর্তায়।

 

কিন্তু, যতোক্ষণ পর্যন্ত তাঁরা সেই দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে না নিচ্ছেন, ততোক্ষণ পর্যন্ত এই আশংকা যে নির্মূল করা যায়না যে, ভারতবর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে, এই আন্দোলনগুলি সঙ্গে করে নিয়ে এলো একধরনের প্রগাঢ় শ্রেণী ও জাতপাতের রাজনীতি, যা ঠিক সাদা চোখে ধরা পরে না।

 

অবশ্য, শিল্পা ফাডকে প্রমুখ, এই শ্রেণী-জাতপাত মিশেলকে সচেতনভাবে ম্যানেজ দেওয়ার চেষ্টা করলেন। লিখলেন, What if there were mass loitering by hip collegians and sex workers, dalit professors and lesbian lawyers, nursing mothers and taporis, Muslim journalists and north Indian taxi drivers, visually challenged management professionals and street hawkers, garbage collectors and heterosexual, Brahmin bureaucrats (178).  এই যে লম্বা তালিকা, সেটার ভেতরে কাব্য আছে। অতীব মনোযোগ দিয়ে বানানো হয়েছে এই তালিকাটি। কিন্তু, বলি, অতোই সহজ নাকি? সোনার পাথরবাটি নাকি? মানে, এই যে বিভিন্ন পরিচিতির মানুষদের কথা বলা হলো, তাঁদের ভিতরে তো আছে সংঘাত। সেই সংঘাতের ইতিহাস ও বাস্তবতা ডিঙিয়ে ঠিক কেমনভাবে তাঁরা হঠাৎ একইসাথে এই আনন্দযাপনের উদ্দেশ্যযাপনের পথপরিব্রজনে অংশগ্রহণ করবেন?

 

মুশকিল হলো, ওই যে আগেই বললাম, কোনো কঠিন প্রশ্নের উত্তরই নেই এই ধারার নারীবাদীদের কাছে। এই ধারার নারীবাদীরা, যাঁদের আমরা স্বচ্ছন্দে বলতে পারি, নয়া-উদারনৈতিক নারীবাদী, কোনোকালেই ঠিক পরিকাঠামোগত পরিবর্তন নিয়ে চিন্তিত নন। নয়া-উদারনৈতিক নারীবাদ নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। সেইসব বিতর্কের পুনরাবৃত্তি এই লেখাতে করছি না। শুধু বলি, না, নয়া-উদারনৈতিক নারীবাদ সমাজের কোনো ব্যাপক পরিবর্তন বা আমূল পরিবর্তন চায় না। চায় না নয়া-উদারনৈতিক অর্থনৈতিক শোষণ কাঠামোর কোনো আমূল পরিবর্তন।

 

বরং, সে চায়, আরও আরও বেশি করে বাজারের সাথে মেয়েদের সংযুক্তি ঘটিয়ে পুঁজিশাসনের সর্বগ্রাহ্যতা বৃদ্ধি। সে মেয়েদের বোঝাতে চায়, পুঁজিতেই মুক্তি। ক্রেতা হওয়াতেই মেয়েদের সার্থকতা। তাই, নারীপুরুষ নির্বিশেষে যে শ্রমিক আন্দোলনকে ভয় পায় নয়া-উদারনৈতিক নারীবাদ। ভয় পায়, শ্রমিক আন্দোলনে মেয়েদের অংশগ্রহণকে। শ্রমিক আন্দোলনের প্রশ্নে সে তাই নীরব। নীরব শ্রেণীর প্রশ্নে। তাই, যেখানে যেখানে যৌন হিংসা বা যৌন নির্যাতন শ্রেণী, পুঁজি বা কর্মস্থলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকাঠামোগত প্রশ্নগুলিকে তুলে আনবে, সেখানে সেখানেই নয়া-উদারনৈতিক নারীবাদ নিয়ে আসে প্রতীকী আন্দোলন। যার ভেতর দিয়ে মেয়েদের যথাযথ ক্ষোভকে কিছুটা হলেও প্রশমিত করা যায় কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তনের কথা উত্থাপন না করেই।

 

অন্যদিকে, একথা সত্য যে যৌন হিংসার বাস্তবতা, একটি মেয়েকে আদর্শ ক্রেতা বা ভোক্তা কোনোটাই হতে দেয় না। বাজারের সাথে মেয়েটির যে সংযুক্তি, তার পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। তাই, আবারো বলি, নয়া-উদারনৈতিক নারীবাদ যৌনহিংসার প্রশ্নে পথে নামে। কখনো কখনো গড়ে তোলে জঙ্গি আন্দোলনও। যদিও, সেই আন্দোলন বা পথে নামাতেও, সে মূল মূল প্রশ্নগুলিকে চায় দূরে সরিয়ে রাখতে কিংবা বেঁকিয়েচুরিয়ে উপস্থাপন করতে।

 

৪.

প্রসঙ্গত, বর্তমান আন্দোলনেও তার ব্যতয় ঘটলো না। আসলে,প্রতীকী কিছু পদ্ধতির ওপর (যাকে, ইংরেজিতে বলা হয়, পার্ফর্মেটিভ) যে পরিমাণে জোর পড়ে এই  টেক ব্যাক দা নাইট সহ নয়া-উদারনৈতিক নারীবাদে, সেই সেই মাত্রায় এই আন্দোলনগুলি দাঁড়িয়ে আছে নাটকীয় কয়েকটি মুহূর্ত তৈরী করার ওপর। কাজেই, এই আন্দোলনের  অন্যতম দুই মূল  সংগঠক যে আহ্বান রাখলেন চোদ্দ তারিখ রাতে মেয়েদের জমায়েতের, সেখানেও এই পার্ফর্মেটিভ দিকটিরই ছড়াছড়ি।

 

মূল মূল আহ্বানগুলিতে প্রায় সব জায়গাতেই বলা হলো, আর.জি.কর-এ প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের মন্তব্যটির কথা।  মন্তব্যটি অতীব কদর্য, এ নিয়ে সন্দেহ নেই। মন্তব্যটি প্রগাঢ়ভাবে পিতৃতান্ত্রিক, এই বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু, জানতে বড়োই ইচ্ছা হয় যে এমনটি যদি হতো যে ঘটনাটি ঘটেছে, বাকি সব কিছুই চলছে ঠিক একইরকমভাবে, কিন্তু সন্দীপ ঘোষ এই মন্তব্যটি করলেন না, তাহলে এই “রাত দখল”-এর আন্দোলন দাঁড়াতো ঠিক কিসের ওপরে। মানে, এই প্রতিবেদক এমন অনেককেই চেনে, যাঁরা প্রভূতভাবে পিতৃতান্ত্রিক ও অতন্ত্য ধূর্ত। সেই ধূর্ততার বশবর্তী হয়েই তাঁরা এমন কাঁচা মন্তব্য তাঁরা কোনোদিনই করবেন না।

 

তাহলে? কি হবে বা হতো ঠিক তাহলে?

 

মোটামুটিভাবে “রাত দখল” আন্দোলনকারীদের দিক থেকে যেটা স্পষ্ট, যে এই মন্তব্য ও আপাদমস্তক পারফর্মাটিভিটি বা কহতব্যতার বাইরের বাস্তবতা নিয়ে তাঁরা বড়ো একটা ভাবেননি। তাই আন্দোলনের মঞ্চ থেকে দাবি উঠেছে যে “স্লাট -শেমিং” বা “আলটপকা” পিতৃতান্ত্রিক মন্তব্যের চাই আইনি শাস্তি। এমন কথা বললেন আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক শতাব্দী দাশও, তাঁর একটি নিবন্ধে। সেই নিবন্ধটির শিরোনাম — “আসুন, রাতের দখল নিই।” প্রকাশিত হয়েছে robibar.in নামক একটি আন্তর্জালিক পত্রিকায়।

 

এ নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে কি পিতৃতন্ত্র কি সমকামবিরোধিতা কি জাতপাত কি শ্রেণী বা অন্য যেকোনো সামাজিক ক্রমাধিকারতন্ত্র বারংবার সামাজিক বৈধতা পায় ভাষার ব্যবহারের মধ্য দিয়ে, উপমার মধ্য দিয়ে। তাই পিতৃতান্ত্রিক বা অন্যান্য ধরনের ক্রমাধিকারতন্ত্রী ভাষার বিরুদ্ধে লাগাতার সাংস্কৃতিক লড়াই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু, এরপর এও তো সত্য যে ভাষা টিকে থাকে বাস্তবিক মুলকে আঁকড়ে ধরে। সেই মূল থেকে পিতৃতন্ত্র উৎপাটিত করতে না পারলে, ভাষার পূর্ণ সংস্কার একদিকে যেমন সম্ভব নয়, তেমনি ভাষার সংস্কার করে পিতৃতন্ত্রবিরোধী পূর্ণ লড়াইটিও সম্ভব নয়।

 

কাজেই, আন্দোলনের মুখ হিসেবে পরিচিতদের লেখায় ও ভাষ্যে যে “সেন্সিটাইজেশনের” ওপর জোর পড়লো, তা এই আন্দোলনের মতাদর্শগত ঝোঁকের দিক থেকে অতীব স্বাভাবিক। নয়া-উদারনৈতিক নারীবাদের এটাই দস্তুর। “সেন্সিটাইজেশনের” নাম করে এই ধারার নারীবাদ, বহু ক্ষেত্রেই কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি বা নন-প্রফিট বা এন.জি.ও দের মাধ্যমে যে ব্যাপক পরিমাণ টাকা খরচা করে, তা অভূতপূর্ব। আর, এই সেনসিটিজেশনের আপাত- নারীবাদী মুখোশের আড়ালে ঢাকা পড়ে যে বাস্তবতাটি, তা হলো, আজকের অধিকাংশ কর্মক্ষেত্রে আই.সি.সি বা জেন্ডার সেলগুলি অচল। আর নামকেয়াস্তে থাকলেও, সেখানে বসানো আছে কতৃপক্ষের পেটোয়া নারী-কর্মচারীবৃন্দ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে, তাও নয়। যেমন ধরুন, আর.জি.কর মেডিক্যাল কলেজের যে সমপর্যায়ের সেল,সেখানে সর্বপ্রথম নামটি   স্বয়ং প্রাক্তন অধ্যক্ষ — সন্দীপ ঘোষের। যদিও, আইন অনুযায়ী, থাকার কথা একজন মহিলার।

 

আই.সি.সি সেল একটি উদাহরণমাত্র। এইরকম আরও আরও উদাহরণ হাজির করা যায়, যা সেন্সিটাইজেশনের সীমিত আওতায় আঁটবে না। যেমন, অর্থনীতি ও তাতে মেয়েদের স্থান। যেমন, কর্মক্ষেত্রে নারী-শ্রমিকদের বেতনগত বৈষম্য। যেমন, অসংগঠিত ক্ষেত্রেযেখানে কোনো সামাজিক সুরক্ষাই নেই, সেখানে মেয়েদের ভীড়। যেমন, শিক্ষার ক্ষেত্রে মেয়েদের স্কুল ড্রপ-আউটের হার। যেমন, পূর্ণবয়স্ক হবার আগেই মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাওয়া। যেমন, লাখো লাখো মেয়েদের পাচার হয়ে যাওয়া। যেমন রাজনৈতিক মতাদর্শ ও সেখানে মেয়েদের বস্তুগত ও বৈষয়িক অংশগ্রহণ। যেমন, পরিবারের ভেতরকার ভিত্তিগত অসাম্য। যেমন একবিবাহের মতন মূলত অসাম্যে পরিপূর্ণ সম্পত্তিব্যবস্থার ভিতর দিয়ে যৌনতা ও প্রেমের অভিব্যক্তি। যেমন, রাষ্ট্রের সাথে বিবাহ ও পরিবারপ্রথার ধারাবাহিকতা। যেমন, রাষ্ট্র দ্বারা ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনকে হাতিয়ারে পর্যবসিত করা। আরও কত কি!

 

কাজেই, সেন্সিটাইজেশন এই পরিপ্রেক্ষিতে অনেকটা যেন আমাদের সেই যৌবনের রাজনৈতিক উপমার মতো — ঘুণধরা টেবিলকে বারবার মুছে তকতকে করার চেষ্টা, বিভিন্ন সুন্দর সুন্দর টেবিলক্লথ বিছিয়ে ঘুণ বিষয়টিকে আড়াল করার চেষ্টা।

 

যদিও বিভিন্ন সময়ে, সেই ঘূণবাস্তবতা ঠিকরে ঠিকরে বেরোয়।

 

প্রকৃতপক্ষে, এই গোটা সামাজিক ও রাজনৈতিক ধারাবাহিকতাকে ধরতে না পারলে, যে ধর্ষণ-সংস্কৃতির কথা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে উঠে এসেছে, তাকে প্রতিহত করা যাবে না। অবশ্যই, তার জন্য লাগবে দীর্ঘমেয়াদি, প্রাত্যহিক লড়াই। যা দৃশ্যের পর দৃশ্য সাজানোর যে সামাজিক গণমাধ্যমজাত রাজনীতি, তা দিয়ে হবে না। বরং, সেই লড়াই ঘটবে দৃশ্যমানতার বাইরে। তার দু-একটি স্ফুরণই হতে পারে দৃশ্যমানতায়।

 

প্রশ্ন উঠতে পারে, এক্ষেত্রে তো রয়েছে একটি বিশেষ ঘটনা — আর.জি.কর-এর তরুণী ডাক্তারের মৃত্যু ও ধর্ষণ। ঠিক কি হবে তার? সেক্ষেত্রে এই কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে কোনো বিশেষ ঘটনা গোটা সমাজকে নাড়িয়ে দেয় অভূতপূর্বভাবে, অসাধারণভাবে। এইরকম ঘটনা অতীতেও বিরল নয়। তার পেছনে থাকে একাধিক কারণ। কেন আর.জি.কর-এর তরুণীর মৃত্যু আমাদের এতো গভীরভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে, সেই কথা আমি আগেই আর একটি লেখায় লিখেছি। এই লেখাতে তার পুনারাবৃত্তি ঘটাবো না। কিন্তু, নাড়িয়ে দেয়, সেটা বাস্তব।

 

কাজেই, সেই পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিটি আন্দোলনে থাকে কিছু আশু দাবি। এই আন্দোলনেরও আছে। দোষীদের শাস্তির কথা, নিরপেক্ষ তদন্তের কথা। কেউ কেউ দাবি করেছেন মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগও। কিন্তু, তার পরেও, একটি সমাজকে বিপুলভাবে নাড়িয়ে দেওয়া আন্দোলন কিছু দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়া দাবি করে। যেমন, “নির্ভয়া” কাণ্ডের পরেও, ভারতবর্ষের ধর্ষণসংক্রান্ত আইনে করা হয়েছে বেশ কিছু পরিবর্তন ও সংস্কার।

 

কাজেই, আজ যে কোনো সচেতন পরিবর্তনকামী ও পিতৃতন্ত্রবিরোধী মানুষের দায়িত্ব এই আন্দোলেনের সেই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা কি কি হবে, তা নিয়ে গভীরভাবে ভাবনাচিন্তা করা। যাঁরা আন্দোলনের প্রধান প্রধান সংগঠক, তাঁদের কাজ ছিল প্রথম বড়ো অনুষ্ঠানটি ডাকার আগেই সেই দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া হিসেবে চিন্তাভাবনা করা, কিছু পরিকল্পনা করা, ও সেইমত কিছু আহ্বান রাখা।

 

কিন্তু, সেইরকম কোনো পরিকল্পনা পাওয়া গেলো না উদ্যোক্তাদের ভাবনাচিন্তায়। যেটা পাওয়া গেলো, তা হলো:

মধ্যরাত শাসন করার কথা উঠলে প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ কবির মগজেও চার যুবক ভিড় করে। মেয়েরা কবে দখল নেবে মধ্যরাতের? অফিস করে আসুন, কাজ সেরে আসুন। আসুন রাত হাঁটি। রাত দেখি। রাত বাঁচি। দুয়েকদিন আপনার পুরুষসঙ্গী পড়াক সন্তানকে। রাঁধুক বাড়ুক। আপনি সংঘবদ্ধ হোন ও রাতের অধিকার নিন। টেক ব্যাক দা নাইট। রাতের কলকাতা, রাতের দিল্লি, রাতের মুম্বাই — রাত সুন্দর। কিংবা রাত ভয়ানক, কিন্তু আসুন, তাকে সুন্দর বানাই।

 

না, এখানে কোনো দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলনের চিহ্নমাত্রও নেই। নেই খুব গভীর কোনো রাজনৈতিক বোধ বা বার্তা। নেই কোনো সম্মুখসমর বা প্রতিরোধের রাজনীতিও। নেই সেই মেয়েদের কথাও রাত যাঁদের কর্ম-সময়।

 

তার বদলে আছে, সাধারণভাবে পরিচিত ও প্রচলিত টেক ব্যাক দা নাইট বা রাইট টূ লয়টার আন্দোলনের বয়ানের মতোই, একটু রাতের কলকাতা “হেঁটে” দেখার আমন্ত্রণ। এবং, নিশ্চিতভাবেই, সেই হেঁটে দেখা হবে পুলিশ প্রহরায়। আছে গৃহশ্রম থেকে “দুয়েকদিন”-এর মুক্তির কথা। আছে “অফিস” করা মধ্যবিত্ত মেয়ের প্রতি আমন্ত্রণ, “কাজ সেরে” আসার উপদেশে আছে স্থিতিস্থাপকতাকে অটুট রেখে এক রাতের একটু পারফরম্যান্সের আহ্বান। আছে কাব্য। আছে রাতের বেলা হাঁটার , থুড়ি, রাতের অধিকার নেওয়ার কাব্যিকতা। এই বার্তা নিতান্তই “ভালো মেয়ে” দের জন্য। যাঁদের কাছে রাত গার্হস্থ্যতার সময় — সমাজের প্রথামাফিক।

 

খুব, গোদাভাবে বললে, এতে আছে বাঙালি মধ্যবিত্তর মনে ও মননে সুরসুরি দেওয়ার সবরকম উপাদান। সাথে সাথে এও বলি, এই যে “রাত দখল”-এর বয়ান, সেখান থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে আরও অনেক অনেক রাজনৈতিক বাস্তবতা।  যেমন, ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে, মুছে দেওয়া হয়েছে এই কথা যে মেয়েরা এর আগেও রাতের বেলা আন্দোলনে শামিল হতে গিয়ে বাড়ির বাইরে থেকেছেন। থেকেছেন ধর্ণা মঞ্চে, থেকেছেন রাস্তায়। রাতের বেলা রাস্তা জুড়ে থেকেছেন ছাত্রীরা, গোটা রাত ধরে রাস্তা অবরোধ করেছেন শ্রমিক মেয়েরা। আমাদের সাম্প্রতিক অতীতে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত মাটি কামড়ে আন্দোলনের মঞ্চে পড়ে থেকেছেন এন.আর.সি-বিরোধী আন্দোলনের মেয়েরা। থেকেছেন শাহীনবাগে, থেকেছেন কলকাতার পার্ক সার্কাসে। থেকেছেন এই দেশের অন্যত্র — ক্ষুদ্র লোকালয় থেকে শুরু করে বড়ো বড়ো শহরে। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে দিল্লি বর্ডারের রাস্তা ধরে রাতে বাইরে থেকেছেন বিভিন্ন বয়সের মেয়েরা।

 

কাজেই, সেই প্রেক্ষাপটে দেখলে, মেয়েদের “রাত দখল”-এর ভেতরে কোনো নতুনত্ব নেই। নতুনত্ব এইখানে যে চোদ্দই আগস্টের আগে মেয়েদের “রাত দখল” ব্যাপারটিকে যেভাবে প্যাকেজিং করা হলো, যেভাবে গোটা ঘটনাটিকে দেওয়া হলো শুধুমাত্রই লিঙ্গ রাজনীতির মোড়ক। এবং, সেই লিঙ্গ রাজনীতিকেও মুড়ে রাখা হলো প্রায় সমস্তরকমের সংঘর্ষহীন, নখদন্তহীন প্রায় অরাজনৈতিক একধরনের সুখানুভূতির রাজনীতিতে, একধরনের পারফর্মাটিভিটি-র রাজনীতিতে। এবং, শুধুইমাত্র পারফর্মাটিভিটি-র রাজনীতিতে।

 

এবং, একথা অস্বীকার করে লাভ নেই যে সেই রাতে, বাংলার সমাজ জুড়ে বেশিরভাগ মেয়েরা — বিশেষত মধ্যবিত্ত মেয়েরা — এটাই চেয়েছিলেন। তাঁরা চেয়েছিলেন এক রাতের ছিপি খোলার অভিজ্ঞতা। এক রাতের ক্রোধ উগড়ে দেওয়ার অভিজ্ঞতা। এক রাতের শহরজুড়ে হাঁটা, আড্ডা, গান, হয়তো বা সাথে সাথে স্লোগানও। অনেকটা যেন “প্রতিদিন যদি কাঁদিবি কেবল /একদিন নয় হাসিবি তোরা” জাতীয় ব্যাপার। যেমন সরিতা আহমেদ তাঁর একটি লেখায় লিখলেন নারীসত্ব পত্রিকায় : “একটা রাত আমাদের মেয়েদের দখলে থাকবে। সেই রাতে আমরা মেয়েরা গাইব, নাচব, যুক্তি তর্কে মাতব, প্রতিবাদে ফেটে পড়ব, কান্নায় ভিজব, হাসিতে গড়াগড়ি যাব, গদ্য-পদ্য বলব নিজের ভাষায়, নিজের স্টাইলে। কিন্তু পুরুষের ভিড়ে মিশে থাকা মদ্য পদের উগ্র দুর্গন্ধ আর ধাক্কাধাক্কি সহ্য হলো না। ৩০ মিনিটের বেশি দাঁড়াতে পারলাম না।” পরের অভিজ্ঞতা নিয়ে বেশ কিছু আলোচনা হয়েছে, তেমন একটি আলোচনা ছাপা হয়েছে গ্রাউন্ডজিরোর পাতাতেও। যদিও গুরুত্বপূর্ণ, সেটা ঠিক এই বর্তমান প্রতিবেদনের মূল কথা নয়।

 

কিন্তু, যেটা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো, তাবড় মেয়েদের ঠিক কি প্রত্যাশা ছিল “রাত দখল”-এর কাছ থেকে। এবং, খুব স্পষ্ট করে বলি, প্রত্যাশা ছিল একটি কার্নিভালের, একটি স্পেকটাকেলের। এবং, এই যে রাজনৈতিক প্রতিবাদ হয়ে উঠবে কার্নিভাল, যার ভেতরে থাকবে না কোনো ঝুঁকি, যা কিনা আবার এই বিশেষ পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের দেবে একধরনের প্রতিবাদী সত্তা কেনার পরিতৃপ্তিও? যে পরিতৃপ্তির আস্বাদন শেষ অবধি নেওয়া যাবে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের পাতা থেকেও?

 

না, একথা আমি বলছি না যে সমাজে মেয়েদের একসাথে  কার্নিভালের কোনো প্রয়োজন নেই। এবং, একথাও সত্য, এই ছোট ছোট আনন্দক্ষেত্র নিজেদের জীবনে তৈরী করার জন্য, মেয়েদের লড়তে হয় প্রভূত পরিমানে সমাজের সাথে, পরিবারের সাথে। কিন্তু, মেয়েদের আনন্দ (তা সে পিকনিকই হোক, কার্ণিভালই হোক আর আড্ডাই হোক) আর পিতৃতন্ত্রবিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলন এক নয়। যতই নয়া-উদারনৈতিক নারীবাদ বলুক ঠিক উল্টো কথা, পিতৃতন্ত্রবিরোধী লাগাতার আন্দোলনে আছে ঘর্ষণ, আছে আক্রমণ, আছে প্রতি -আক্রমণ, আছে কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকারও। যে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনের মতন। তাতে আছে এক অন্তরীণ আনন্দ, কিন্তু মূলস্রোতের সমাজ যে সব কার্যক্রমকে “সুখানুভূতি” বা “আনন্দ” বলে অভিহিত করে, তার সাথে পিতৃতন্ত্রবিরোধী লড়াই যদি গুরুতর প্রভেদ গড়ে তুলতে না পারে, তাহলে সেই লড়াই কোনোদিনও কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন সমাজে আনতে পারে না।

 

তো, সেই রাতে, মেয়েরা পাঁচ দিন ধরে আর.জিকর-এর ঘটনা নিয়ে সমাজজুড়ে আলোচনার পর, জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন ও কর্মবিরতির খবর দেখার ও পড়ার পর, চেয়েছিলেন একটি সেফটি-ভাল্ভ। এবং “রাত দখল”-এর অনুষ্ঠান সেটা দিয়েওছিলো তাঁদের।

 

তাই, খুব স্পষ্ট করেই যেটা বলা যায়, গোটা চোদ্দ তারিখের ইভেন্টটিকে ঘিরে তৈরী হয়েছিল, একধরনের লিঙ্গায়িত জনপ্রিয়তাবাদ। যাঁরা বিভিন্ন সময়ে টেক ব্যাক দা নাইট বা রাইট টু লয়টার থেকে শুরু করে নির্ভয়া-পরবর্তী প্রতিবাদের, আন্দোলনের বিষয়গুলিকে লক্ষ্য করেছেন, তাদের কাছে এই অসাধারণ, লক্ষ লক্ষ মেয়েদের জমায়েত খুব অবাক করবে না। অবাক করবে না তাঁদের, যাঁরা আরব স্প্রিং, অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট সহ ২০০৮-পরবর্তী তথাকথিত “হরাইজোন্টালিস্ট” আন্দোলনগুলিকে লক্ষ্য করেছেন, সেসব নিয়ে ভেবেছেন।

 

কিন্তু, এখানেও কতগুলো বিষয় আছে। যেহেতু প্রতিটি আন্দোলন — যতই তার আঙ্গিক বা ভাষা অন্য পরিপ্রেক্ষিত থেকে ধার করা হোক না কেন — বিকশিত হয় একটি অঞ্চলের বিশেষ ইতিহাস বা রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিপ্রেক্ষিতে, তাই চোদ্দ তারিখের “রাত দখল”-ও কোথাও যেন আহরণ করে নিলো একরকমের বিশেষ বাংলাজাতীয় ও বাঙালি রূপ। হয়ে উঠলো বর্তমান বাংলার শাসকদের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ উদ্গীরণের জায়গা।

 

এই যে এতো এতো মানুষের উপস্থিতি রাত জুড়ে, সেখানে কাজ করেছিল বেশ কয়েকটি বিষয়। গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন ইস্যুতে তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ — বিশেষত শহুরে মধ্যবিত্ত অংশটির পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও ঘৃণা — যার সাথে জুড়ে যায় বর্তমান সরকার আশ্রিত আর.জি.কর মেডিকেল কলেজে অধ্যক্ষের নেতৃত্বে চলা অপরাধচক্র সম্পর্কে মিডিয়া সূত্রে মানুষের অবহিতি। কোথাও একটা সাধারণ মানুষ এই অপরাধ চক্রের সাথে ডাক্তার তরুণীর ধর্ষণ ও মৃত্যুর মধ্যে একটি সম্পর্ক স্থাপন করেন। এর সাথে হয় পুলিশের ভূমিকা, প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে বদলির মতন ঘটনা। ঘটনাটির প্রমাণ লোপাট করে দেওয়ার যে অভিযোগ ওঠে মূলস্রোত ও সামাজিক গণমাধ্যমগুলিতে, সেইসব যোগ হয়ে একটি বিশেষ রাজনৈতিক বাতাবরণ তৈরী হয়। ক্ষোভে ফেটে পড়া রাগান্বিত মানুষ পথে নামেন — স্বতঃস্ফূর্তভাবেই পথে নামেন। এর সঙ্গে, অবশ্যম্ভাবীভাবে ছিল মেয়েদের পূন্জীভূত রাগ, শঙ্কা, ভেতরের ভয়, যাকে ভাষা দিতে সক্ষম হয়েছিল চোদ্দই আগস্টের কর্মসুচী।

 

কাজেই, শুরু হলো যে আন্দোলন আর.জি.করে তরুণী ডাক্তারের মৃত্যু ও ধর্ষণের প্রতিবাদ দিয়ে, কিন্তু ক্রমে ক্রমে সেই আন্দোলনটি আরও ব্যাপ্ত একটি আকার ধারণ করলো। এবং, হয়ে উঠলো একটি পুরোদস্তুর রাজনৈতিক আন্দোলন,  যেখানে একাংশের মুখ থেকে নির্গত হলো এমন দাবিও যে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ চাই। কিন্তু, একদিকে যেমন একথা অনস্বীকার্য যে যৌন হিংসার বিরুদ্ধে বাংলার মেয়েরা পথে নামলেন প্রগাঢ়ভাবে, অন্যদিকে এও সত্য যে এই বৃহত্তর রাজনৈতিক ক্ষোভও মানুষকে পথে নামালো। কাজেই, কোনো এক জায়গায় স্বত্ব: প্রনোদিতভাবেই, সমাজের একটা বড়ো অংশের মানুষ নাকচ করলেন মেয়েদের সারা রাত রাস্তায় “একা” হাঁটার এজেন্ডাটি, তাঁরা চোদ্দ তারিখের রাতকে নিজেদের মতন করে ব্যাখ্যা করেই, নিজের নিজের রাজনৈতিক আশার ওপর ভর করেই পথে নামলেন।

 

একথা অনস্বীকার্য যে সেইদিন রাতে পুরুষদের এই ব্যাপক উপস্থিতির ফলে বহু মহিলারা অস্বস্তি বোধ করেছেন, বেশ কিছু জায়গায় মেয়েরা জন নির্যাতনেরও সম্মুখীন হয়েছেন। ঠিক যে বাস্তবতাটিই উঠে এসেছে ওপরে উদ্ধৃত সরিতা আহমেদের লেখাতে। আরও অনেক জায়গায় মেয়েরা উপস্থিত থাকলেও, আন্দোলনের নেতৃত্ব ছিল পুরুষদের হাতে। তাঁরা বহুক্ষেত্রেই সংগঠিত রাজনৈতিক দলের সদস্য। এছাড়াও, বহু মেয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পুরুষদের মেয়েদের এই রাজনৈতিক প্রকাশভঙ্গিকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া নিয়ে, প্রশ্ন তুলেছেন তার ভেতরকার অন্তরীন পিতৃতন্ত্র নিয়ে। এইসব প্রশ্ন ও পর্যবেক্ষণগুলিকে অত্যন্ত গভীরতার সাথেই দেখতে হবে, বিবেচনা করতে হবে। কিন্তু, তার সাথে সাথে এও সত্যি যে সেইরাতের মানুষের পথে বেরোনোর ভেতরে ছিল গভীর স্বতঃস্ফূর্ততা। যে স্বতঃস্ফূর্ততা একভাবে ছাপিয়ে গেলো উদ্যোক্তাদের প্রত্যাশাকেও।

 

৫.

এই প্রসঙ্গে তাই প্রশ্ন রাখি — কারা ঠিক ছিলেন এই আন্দোলনের উদ্যোক্তা? সামাজিক গণমাধ্যমের ফলে আমরা পেলাম দুটি নাম — রিমঝিম সিনহা ও শতাব্দী দাশ। তাঁদের ভেতরে কে প্রথম আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন, তা নিয়ে বাকবিতন্ডাও দেখলাম ফেসবুকে। আর, সেইসব বাকবিতন্ডা ধরেই দেখলাম, কথা হচ্ছে কি সব হোয়াটস্যাপ গ্রূপ নিয়ে, কথা হচ্ছে কমিটি নিয়ে, কথা হচ্ছে মঞ্চ/ফোরাম নিয়েও। তো, এই যে গ্রূপ বা মঞ্চ বা ফোরাম, যেখানে নাকি সব আলোচনা করেই ঠিক হয়েছে সব কিছু — মায় “রাত দখল”– এর অনুষ্ঠান — সেখানে আছেন কারা? তাঁরা কি কোনো সংগঠন করেন? অন্য সংগঠনের কর্মীরা ঠিক কিভাবে থাকেন সেই হোয়াটস্যাপ গ্রূপে? কিভাবে সিদ্ধান্ত হয় সেখানে? এই যে এতো এতো সাধারণ মানুষ, মেয়েরা পথে নামলেন, তাঁরা ঠিক কিভাবে সংযুক্ত হবেন এই মঞ্চ/ ফোরাম /গ্রূপে? কিভাবে তাঁরা অংশগ্রহণ করবেন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার প্রক্রিয়ায়? নাকি, সেসবের প্রয়োজন মনে করেন না এই গ্রূপ/ফোরাম/মঞ্চের সদস্যরা? তার মানেটা দাঁড়ালো কি? জনগণ তথা সাধারণ মানুষ তথা সাধারণ মেয়েদের খালি দায়িত্ব মিছিলে হাঁটা? মানে সংখ্যা বাড়ানো? ভীড় বাড়ানো?

 

যাহ তারা! এতো ভাই হয়ে গেলো পুরো বকচ্ছপ। মানে, আঙ্গিক হরিজন্টালিজমের, বিষয় ভ্যানগার্ডিসমের, নাকি উল্টোটা? যাই হোক, এই বকচ্ছপ আন্দোলনের পাল্লায় পড়ে যাঁরা একটু আধটু এই কলকাতার অধিকার আন্দোলনের ভূগোলটিকে চেনেন, তাঁরা অবাক হয়ে দেখলেন, যে রিমঝিম সিনহাকে সবাই এতদিন চিনতো একটি অসংসদীয় বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের কর্মী হিসেবে, সেই রিমঝিম সিনহা রীতিমতো নিজের সেই রাজনৈতিক পরিচয় বেমালুম লোপাট করে নিজেকে এক ব্যক্তি হিসেবে উপস্থাপন করে একের পর এক সাক্ষাৎকার দিয়ে যাচ্ছেন টিভি ক্যামেরার সামনে।

 

না, এই প্রতিবেদক বিশ্বাস করে না, এটি রিমঝিমের একক সিদ্ধান্ত। কিন্তু, তাহলে তো প্রশ্নও ওঠে, ঠিক কেন এই ছাত্র সংগঠনটি নিজেদের পরিচয় গোপন করতে এতো ইচ্ছুক? কেন তাঁরা রিমঝিমকে সামনে দাঁড় করাচ্ছেন শুধুই এক ব্যক্তি হিসেবে? এটা ঠিক কোন ধরনের বামপন্থা? এই সিদ্ধান্তের পরে ঠিক কোনধরনের দীর্ঘস্থায়ী ফল তাঁরা আশা করছেন?

 

না, এই কথাগুলি কোনো বামপন্থা বিরোধিতার জায়গা থেকে উচ্চারিত হচ্ছে না। বলা হচ্ছে না কোনো চক্রান্তমূলক তত্ত্বের বশবর্তী হয়ে।

 

বরং, এই কথাগুলি বলা হচ্ছে এই জায়গা থেকে যে আজকের বাংলার অসংসদীয় বাম শিবির যে চূড়ান্ত মতাদর্শগত দিশাহীনতায় ভুগছে, সেই কথাটিকে স্পষ্ট করে উচ্চারণ করার জায়গা থেকে। না, এমনটি বলা যাবে না যে এই মতাদর্শগত দিশাহীনতা একদিনের ফসল। এও বলা যাবে না যে এই একটি মাত্র আন্দোলনেই তা পরিলক্ষিত হয়েছে। কিন্তু, যেটা বলা যায়, তা হলো, এই আন্দোলনের ভেতর দিয়ে সেই দিশাহীনতা একটি চূড়ান্ত আকার ধারণ করেছে। সেই চূড়ান্ত আকারের আছে বেশ কয়েকটি লক্ষণ।

 

প্রথমত, নিজেদের রাজনীতি ও মতাদর্শগত অবস্থান নিয়ে তীব্র আত্মবিশ্বাসহীনতা। যেখান থেকে এসেছে সংগঠনগুলির নিজেদের নাম নিয়ে কাজ না করে “স্বাধীন”, “অরাজনৈতিক,” “গণ-আন্দোলন”, “সাধারণ মানুষের আন্দোলন” ইত্যাদি লেবেলের পেছনে মুখ ঢাকা। যে যে মাত্রায় আজ বাংলার মানুষ রাজনৈতিক দল — এবং, আরও বিশদ করে বলি, যে কোনো ধরনের কমিউনিস্ট পার্টি সংগঠন — থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই নামহীনতা একটি বাস্তবিক রণকৌশলও বটে। এই নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে অসংসদীয় কমিউনিস্ট পার্টি /গ্রূপগুলি যদি একত্রে হয়ে, বা নিজেদের নিজেদের সাংগঠনিক ব্যানারে এই আন্দোলনের ডাক দিতেন, তাহলে এতো সংখ্যক মানুষকে এই আন্দোলনে জড়িয়ে নেওয়া যেত না। মিডিয়া আন্দোলনটিকে এতোটা প্রচার দিত না। কাজেই, স্পষ্টতই এখানে একটি সংগঠনের সংকট আছে, যা গভীরতর রাজনীতিবোধ, বিশ্লেষণ, কল্পনাশক্তি ও পর্যালোচনা দাবি করে। এবং, যা একটি বা দুটি আন্দোলনের ভিতর দিয়ে মিটবে না। কিন্তু, যেহেতু সেই কাজ এই রাজনৈতিক সংগঠনগুলির ভেতর গোটাগুটিভাবে অনুপস্থিত, তার ছাপ পড়লো এই বর্তমান আন্দোলনেও।

 

এবং, খুব স্বাভাবিকভাবেই তাই সেখানে এসেছে, স্বতঃস্ফূর্ততার লেজুড়বৃত্তির প্রবণতা।

 

যদিও, আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে সেই স্বতঃস্ফূর্ততারও একটি রাজনৈতিক ও সমাজতাত্ত্বিক চরিত্র আছে। তার নাম নয়া-উদারনীতিবাদ। এই আন্দোলনের ক্ষেত্রে সেই স্বতঃস্ফূর্ততা ধারণ করেছে নয়া-উদারনৈতিক নারীবাদের স্বরূপ। সেই নয়া-উদারনৈতিক নারীবাদ যৌনহিংসার বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে উস্কে দেয় এন.জি.ও – নারীবাদের স্মৃতি। টেক ব্যাক দা নাইটের স্মৃতি। “টেক ব্যাক দা নাইট” শব্দবন্ধকে ভেঙে যদিও আন্দোলনের বহু জায়গাতেই লেখা হয়, রিক্লেম দা নাইট, তবু এই ভাঙা শব্দবন্ধের ভেতর দিয়ে ফিরে আসে টেক ব্যাক দা নাইটেরই অনুষঙ্গ।

 

এবং, হ্যাঁ, লজ্জায় মাথা নীচু করে বলছি, সেই নয়া-উদারনৈতিক নারীবাদের স্মৃতিকে ও তার চূড়ান্ত সমস্যাজনক কর্মপদ্ধতিকে বাংলার মাটিতে স্থান করে দিলো, প্রগাঢ় বৈধতা দিলো বাংলার অসংসদীয় বামেরা। কাজেই, বাংলার বুকে দাঁড়িয়ে যেখানে যৌন হিংসা ও পিতৃতন্ত্র বিরোধী লড়াই তীব্রভাবে গড়ে উঠছে, সেখানে ইলা মিত্রর স্মৃতিকে আন্দোলনের বুকে প্রতিস্থাপন করা হলো না, আন্দোলনের নেত্রীরা-নেতারা তেভাগার মেয়েদের লড়াইয়ের ইতিহাসকে আবার সমাজের বুকে প্রতিষ্ঠা করলেন না, মায় নকশালবাড়ির আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সমাজের বহু অংশের মেয়েদের যে কঠিন, গভীর লড়াই, তাকে আন্দোলনের বুকে ফিরিয়ে আনলেন না। আনলেন না বাংলার শ্রমিক আন্দোলনের ভেতরে মেয়েদের লড়াইয়ের কথা, আনলেন না মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির লড়াইয়ের কথা।

 

আর যখন তেভাগার স্মৃতিকে আনা হলো, তখন আনা হলো বিকৃতভাবে। সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলতে।

 

প্রকৃতপক্ষে, এই স্মৃতিকে ওগরানো খুব সহজ কাজ হতোনা। সেক্ষেত্রে নামতে হতো গভীর পর্যালোচনায়। যে পর্যালোচনায় চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে হতো, কেন কমিউনিস্ট পার্টি বা গ্রূপের পরিকাঠামোসমূহ ব্যর্থ হয়েছে ঐতিহাসিকভাবে নারী আন্দোলনকে ধরে রাখতে, কোনো বৃহত্তর লিঙ্গভিত্তিক রাজনীতিকে শ্রেণীর আন্দোলন ও পুঁজিবিরোধী আন্দোলনের সাথে সংযুক্ত করতে।

 

এই পর্যালোচনার সাথে সাথেই আসে নতুন কর্মপদ্ধতির কথাও। সেইসব কাজ হাতে নেওয়াও কঠিন। তাতে দায়িত্ব অনেক বেশি। তার থেকে অনেক অনেক বেশি সহজ জনপ্রিয়তাবাদী চলতি মূলস্রোতের নয়া-উদারনৈতিক নারীবাদের কাছে মাথা নত করা। এক শ্রেণীর পুরুষ কমরেডরা, যাঁরা সর্বসময়ে কঠিন কঠিন জটিল রাজনৈতিক তত্ত্ব আওড়ান, তাঁরা তাঁদের সমস্ত রকমের তাত্ত্বিক জটিলতাকে মুলতুবি রেখে, এই লড়াইয়ের সমর্থনে দাঁড়ালেন সম্পূর্ণ অসমালোচনামূলক জায়গা থেকে। অপরাধবোধ স্খলন করলেন বোধহয় তাঁদের নিজেদের ব্যক্তিগত পিতৃতন্ত্র ঘিরেও।

 

কাজেই, একদিকে যেমন এই পরিবর্তনকামী লড়াই-আন্দোলনের স্মৃতিকে বর্তমান আন্দোলনের বুকে উহ্য রাখাকে খুব স্পষ্টি করে বলা যেতে পারে একধরনের রাজনৈতিক আত্মবিশ্বাসহীনতা ও সুবিধাবাদের লক্ষণ, অন্যদিকে, আরও একবার বাংলার বাম আন্দোলনের ভেতরে মেয়েদের অবদানের স্মৃতিকে বিলুপ্ত করা হলো।

 

স্বভাবতই যখন কিছু প্রশ্ন উঠলো এই আন্দোলনের শ্রেণী ভিত্তি নিয়ে, তখন আন্দোলনকারীরা এক অভিনব উপায়ে তার মোকাবিলা করলেন। তাঁরা বোঝাতে শুরু করলেন, কিভাবে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করছেন শ্রমজীবী মহিলারাও, নিম্নবিত্ত মহিলারাও। সেই চিন্তাধারা প্রকাশ পেলো সংগঠকদের লেখায়। সেই চিন্তাধারা প্রকাশ পেলো বিভিন্ন সংগঠনের সামাজিক গণমাধ্যম পাতায়। সেখানে ভিডিও, ছবি ইত্যাদির মাধ্যমে দেখানো হলো কিভাবে পেশাজীবী মেয়েরা থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত গৃহবধূরা থেকে গৃহশ্রমিকরা আর.জি.কর ঘটনার বিচার চেয়ে পথে নেমেছেন। অর্থাৎ, শ্রেণী-সংঘাত নয়, শ্রেণী-সহাবস্থান — মানে পুরোনো দিনের ভাষায় ক্লাস কোলাবোরেশান — হয়ে উঠলো আন্দোলনের মূল সুর। মানে, বলা যায়, যে তাঁদের নিজেদের সংগঠনের শ্রমিক মেয়েদের তাঁরা সংগঠিত করলেন শহুরে মধ্যবিত্ত মেয়েদের যৌন সুরক্ষার এজেন্ডায়। তাঁদের সংগঠিত করলেন নয়া-উদারনৈতিক নারীবাদের আজেণ্ডায়। শ্রমজীবী মেয়েদের উপস্থিতি তাই একধরনের সংযুক্তির রাজনীতিকে নিয়ে এলো আন্দোলনের ভেতরে — নয়া-উদারনৈতিক নারীবাদের সাথে সংযুক্তি — কিন্তু নয়া-উদারনৈতিক নারীবাদের বিরুদ্ধে কোনো সংঘাত গড়ে তোলার রাজনীতি হাজির করার প্রচেষ্টাও করলো না। মোটামুটিভাবে, রিকশাচালকদের মিছিল থেকে শুরু করে গৃহশ্রমিকদের মিছিল, প্রায় সবকটা শ্রমজীবী গোষ্ঠীর মিছিলেই সেই একই চিত্র। স্লোগান দিচ্ছেন সেখানে মূলত মধ্যবিত্ত সংগঠকরা। স্লোগানের পরিধি মূলগতভাবে সেখানে আর.জি.কর ঘটনার বাইরে যাচ্ছে না। কোথাওই প্রায় সামনে এলো না সেই সেই মেয়েদের নিজেদের জীবনের যৌন সুরক্ষাহীনতার গল্প। কোথাওই তাঁদের নিজেদের জীবনের ইস্যুগুলিকে জোড়া গেলো না আন্দোলনের মূল স্রোতের সাথে।

 

উদারমনষ্ক হয়ে এই বিষয়ের সমালোচনা করলে, বলতে হয়, শ্রেণী রাজনীতি কি, তা এঁরা ভুলে গেছেন। না, নয়া-উদারনীতির সাথে শ্রমিক শ্রেণীর সংযুক্তিকে শ্রমিক শ্রেণীর রাজনীতি বলে না। আর একটু কঠোর ভাষায় বলতে গেলে, যেটা বলতে হয়, তা হলো, সমাজের বুকে আরও প্রসারিত রূপে নয়া-উদারনৈতিক এজেন্ডাকে তাঁরা প্রতিষ্ঠা করলেন। প্রতিষ্ঠা করলেন লিঙ্গ-রাজনীতির নামে।  প্রতিষ্ঠা করলেন “সাধারণ মেয়েদের” নামে, লিঙ্গ ও শ্রেণী এই দুই বিষয়েই নিজেদের রাজনৈতিক কল্পনার অভাব ঢাকতে।

 

৬.

যে শ্রমজীবী মহিলারা পথে নেমেছেন, হেঁটেছেন মিছিলে কিংবা থেকেছেন “রাত দখল” কর্মসূচিতে, তাঁদের কারুর কারুর সাথে কথা বলার সুবাদে মোটামুটিভাবে উঠে আসে একটি বয়ান — “এখানে তো একটা ডাক্তার মেয়ের সাথেই অমন হয়। তাহলে আমাদের সাথে কি হবে গো?” অনেকেই বলেছেন, “একজন মহিলা হয়েও “দিদি” (পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) এমন করতে পারেন গো?” কেউ কেউ অতন্ত্য বিরক্ত মহুয়া মৈত্রসহ তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যান্য মহিলা সাংসদদের ওপরে। কাজেই, একদিকে এখানে যেমন আছে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ, তেমনি পশ্চিমবঙ্গের মহিলাদের ভেতর শ্রেণী-ধর্ম -জাত নির্বিশেষে যৌন সুরক্ষা নিয়ে একধরনের অনিশ্চয়তাবোধ। কিন্তু, প্রায় কোথাওই তাঁরা নিজ নিজ কর্মক্ষেত্র ও সার্বিক সমাজ জীবনে নিজেদের জীবনের যৌন নির্যাতনের বাস্তবতাটা ঠিক কি ধরনের, তা নিয়ে কোনো বক্তব্য রাখতে পারেননি। চাহিদা বা দাবি সনদ তো দূরের কথা। একধরনের শ্রেণী -অনুকরণের স্বরে — মানে যাকে বলা যেতে পারে ক্লাস — ভেন্ট্রিলোকুইজম — তাঁরা নিজেদের কথা বলেছেন।

 

এবং, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। নয়া-উদারবাদী অন্তর্ভুক্তি (ইনক্লুশান) বা সংযুক্তির রাজনীতি তো ঠিক এইটাই করে থাকে। কোনো রাজনীতি, যা গুণগত পরিবর্তন আনবে, যা সমাজের বুকে তৈরী করবে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের ভাবনাচিন্তা, সেই ধরনের রাজনীতিকে নির্মাণ করার কোনো প্রয়োজন নেই নয়া-উদারনৈতিক রাজনীতির। বরং, তার অন্তর্ভুক্তির রাজনীতিকে ব্যবহার করে নয়া-উদারনৈতিক রাজনীতি, এই নতুন রাজনীতি যা কিনা ভেঙে দিলে দিতেও পারে বর্তমান রাজনৈতিক স্থিতিস্থাপকতা, তার সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।

 

এই ক্ষেত্রেও তাই হলো। যদিও, এই কথাও সাথে সাথে স্বীকার করতে হবে যে পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষের নিরন্তর পথে থাকার ফলেই, আজ আমাদের চোখের সামনে নগ্ন ভাবে উঠে এসেছে রাজ্যের সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার সম্পূর্ণ বেহাল চেহারা, উঠে এসেছে স্টেথো-মাফিয়াদের কীর্তির কথা, উঠে এসেছে এই রাজ্যের সরকারি চিকিৎসাশিক্ষার ভিতরকার ভাঙাচোরা ছবি। এও অনস্বীকার্য যে পশ্চিমবাংলার সাম্প্রতিক ইতিহাসে কোনো একটি ইস্যুকে ঘিরে মানুষ একমাস ধরে এইভাবে পথে নামেননি, এবং পথেই থাকেননি। কাজেই, এটা বুঝতে সমস্যা হয় না যে সেই কারণেই, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন নেমেছে আন্দোলনের ওপর। আন্দোলনের কর্মীরা গ্রেফতার হয়েছেন বারাসাতে, পুলিশ তাঁদের ওপর আরোপ করেছে বিভিন্ন রকমের কেস। তারপরেও, সার্বিকভাবে টিঁকে আছে মানুষের স্পিরিট। মানুষ পথে নামছেন, নিজেদের মতন করে নিজেদের এলাকায় কর্মসূচি নিচ্ছেন, তা “রাত দখল”-ই হোক, বা হোক অন্য কোনো আঙ্গিকে।

 

কিন্তু, তারপরেও থেকে যায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

 

মূলগতভাবে, কোনো বিশেষ ব্যানারের নিচে আন্দোলনটি হলো না, হচ্ছেও না। তার ফলে তৈরী হয়েছে একজাতীয় প্রগাঢ় বিকেন্দ্রিকতা। ইস্যুটিকে ঘিরে কোনো কেন্দ্রীয় মঞ্চ বা ফোরাম গঠিত হলো না, তৈরী করা হলো না কোনো নির্দিষ্ট কর্মসূচি ও আন্দোলনের নির্দেশনামা, কারুরই কারুর কাছে জবাবদিহি করার কোনো দায় রইলো না। বলা বাহুল্য, এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় সবকটি সংসদীয় রাজনৈতিক দলই নিজেদের পতাকা ব্যতীত আন্দোলনে যোগ দিলো, আবার সময় সুযোগ মতন পতাকা হাতেও সমাবেশ, মিছিল, পথসভা পরিচালনা করলো। সর্বোপরি, কোনো কেন্দ্রীয় ফোরাম না থাকায় অত্যন্ত সুলভ হলো বিজেপি – আর.এস.এস-এর মতন ফ্যাসিবাদী-ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তিগুলির অংশগ্রহণ।

 

এবং, যে যে মাত্রায় উদ্যোক্তারা সমাজের বৃহদংশের স্বতঃস্ফূর্ততার লেজুড়বৃত্তির ওপর আন্দোলনটিকে দাঁড় করালেন, সেই সেই মাত্রায় একধরনের জোলো, অতীব সহজ রাজনৈতিক ভাষার আড়ালে অনেকের পক্ষেই মুখ ঢাকা সম্ভব হলো। একধরনের গোদা গোদা “গণ আন্দোলন”-এর ভাষার ওপর দাঁড়িয়ে একশ্রেণীর শহুরে “প্রগতিশীল” বুদ্ধিজীবী নেমে পড়লেন সুশীল সমাজের কাছে আরএসএস-বিযেপি-র গ্রহণযোগ্যতা তৈরী করতে। দেবী অ্যাওয়ার্ডস-এর অনুষ্ঠানে স্মৃতি ইরানির সাথে অভিনেত্রী দামিনী বেণী বসুর ন্যাক্কারজনক মাখামাখির প্রয়াস ও চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম ওয়েব পোর্টালে স্বাতী ভট্টাচার্যের নিবন্ধটি সেই গ্রহণযোগ্যতা তৈরির পরিচায়ক হিসেবে টিকে রইলো।

 

অন্যদিকে, সিপিএম ও বিজেপি-র মতন রাজনৈতিক দলগুলির নেতৃত্বে যে দাবি সনদ এলো, যে লেখালেখি সামাজিক গণমাধ্যম সহ অন্যান্য ক্ষেত্রে হলো, সেখানে বহু ক্ষেত্রেই আলোচনা শুরু হলো বটে ধর্ষণ ও পিতৃতন্ত্রের কথা বলে, কিন্তু তারপর, পিতৃতন্ত্র, কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের সুরক্ষা, নারী আন্দোলন ইত্যাদি লিঙ্গকেন্দ্রিক প্রশ্নগুলিকে ছাপিয়ে রাখা হলো বৃহত্তর রাজনৈতিক পালাবদলের গল্প। এই প্রসঙ্গে বিশেষ দ্রষ্টব্য পয়লা সেপ্টেম্বরের গণশক্তি-র কনিষ্ক ভট্টাচার্যের লেখাটি। কাজেই, সেইসব জায়গায়, লিঙ্গ রাজনীতি ও মেয়েদের সার্বিক সুরক্ষার প্রশ্ন হয়ে উঠলো গৌণ, যদিও গোটা ঘটনাটির সূচনা যৌন হিংসা, ধর্ষণ ও মৃত্যু ও কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের সুরক্ষার প্রশ্নের ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে।

 

একথা ঠিক যে মাঝেমধ্যে “রাত দখল” আন্দোলনের নাম করে কিছু মেসেজ বা দাবি সনদকে সামাজিক গণমাধ্যম বা হোয়াটস্যাপ গ্রূপগুলোতে শেয়ার হতে দেখা গেলো। শেয়ার হতে দেখা গেলো বেশ কিছু রাজনৈতিক বক্তব্যও। কিন্তু সেই দাবি সনদকে ঘিরে আন্দোলন ঠিক কোন পথে এগোবে, ঠিক কি কি কর্মসূচি নেওয়া হবে, তার কোনো পরিকল্পনা এলো না। কিভাবে এই রাজনৈতিক বক্তব্যসমূহকে রাখা হবে আন্দোলনের মূলস্রোতের ভেতরে, তা নিয়েও কোনো বিশদ রূপরেখা বের হলো না। পরিবর্তে, হলো কিছু গতে বাঁধা মিছিল। এবং, প্রায় গতে বাঁধা মিছিলেরই আকার ধারণ করলো একটার পর একটা “রাত দখল”-এর কর্মসূচি।

 

এর ফলে, ভেতর দিয়ে এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে রাজ্যের মানুষ ক্ষুব্ধ। এবং, সেই ক্ষুব্ধতায় অনুঘটকের কাজ করেছে আর.জি.কর-এর ঘটনাটি। যার ফলে মানুষ পথে নামছেন বিভিন্ন ভাবে। পথে নামছেন বিভিন্ন পেশাজীবীরা, বিভিন্ন ধারার শিল্পীরা, পথে নামছেন মফস্বলের স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা, নিম্নবিত্ত বহু মানুষ। সেই অনুষ্ঠানগুলি বহু ক্ষেত্রেই নিজেদের নাম ব্যবহার না করে সংগঠিত করছেন রাজনৈতিক দলের কর্মীরা, বহু ক্ষেত্রে অনুষ্ঠানগুলি হচ্ছে এলাকা স্তরের সাংস্কৃতিক বা সামাজিক সংগঠনগুলির উদ্যোগে। কিন্তু, তৎসত্ত্বেও, এখনো পর্যন্ত, লিঙ্গ রাজনীতি বা যৌন হিংসা নিয়ে আলোচনাকে সামাজিকভাবে একচুলও এগোনো যায় নি।

 

সমসাময়িক অন্যান্য গণআন্দোলনের সাথে এই আন্দোলনের তুলনা করতে গেলে অবশ্যম্ভাবীভাবে এসে পড়ে কৃষক আন্দোলনের কথা। একদিকে এই তুলনা অনর্থক, কারণ কৃষক আন্দোলনের ক্ষেত্রে ছিল দীর্ঘ প্রস্তুতি, দীর্ঘ চর্চা। অন্যদিকে, কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের এই আন্দোলন গড়ে উঠেছে মূলত একটি বিশেষ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায়। একথা যেমন সত্যি, তেমনি কৃষক আন্দোলনের কাছ থেকে কিছু শিক্ষা নেওয়ারও ছিল এই আন্দোলনের। যেমন, কেমনভাবে একাধিক সংগঠন মিলে গড়ে তুলতে হয় একটি সাংগঠনিক ছাতা, কেমনভাবে নিজেদের ভেতর আলোচনার পর আলোচনা করে গড়ে তুলতে হয় নির্দিষ্ট একটি দাবি সনদ। কেমনভাবে পাখির চোখের মতন সেই দাবি সনদকে মাথায় রেখে গড়ে তুলতে হয় একটির পর একটি পদক্ষেপ, হাতে নিতে হয় একটির পর একটি কর্মসূচি।

 

এবং, এই সব কিছুর জন্যই প্রয়োজন হয় একটি কেন্দ্রীয় আন্দোলন স্থল। যেখান থেকে উচ্চারিত হবে আন্দোলনের নির্দিষ্ট পদক্ষেপ। যেমনভাবে কৃষকরা গড়ে তুলেছিলেন দিল্লি সংলগ্ন বর্ডারকে ঘিরে এক বৎসরাধিক এক বিকল্প বসতি। তো, সেই জাতীয় বিকল্প বসতি না হোক, তেমন একটি পাকাপাকি কেন্দ্রীয় ধর্ণা মঞ্চও এই আন্দোলনে গড়ে তোলা গেলো না।  মানে, গড়ে তোলা হলো না। আসলে, এই সবকিছুর জন্যই যে রাজনৈতিক পরিণতমনস্কতা ও প্রত্যুত্পন্নমতিত্বের প্রয়োজন হয়, তা “রাত দখল”-এর আন্দোলনের উদ্যোক্তাদের নেই। গোটা আন্দোলনটির ভেতরে যে বিভিন্ন শক্তি, তাঁদের ভেতরে নেই তেমন কোনো পারস্পরিক সংহতিবোধ, নেই তেমন কোনো সংহতিবোধ গড়ে তোলার সদিচ্ছাও।

 

মানে, অন্তত গত একমাসের ঘটনা পরম্পরা দেখলে অন্যকিছু মনে হয় না।

 

প্রকৃতপক্ষে, প্রথম থেকেই আন্দোলনটি দাড়িয়েছিলো অত্যন্ত দুর্বল রাজনৈতিক ভিত্তির ওপর। সেখানে নেই কোনো গভীর সাংগঠনিক প্রত্যয়, নেই কোনো পিতৃতন্ত্র বা নারী আন্দোলনের জটিল ইতিহাস সম্পর্কে তেমন কোনো চেতনা ও পর্যালোচনা, নেই বর্তমান সময়ের নারী আন্দোলনের সামনে চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে তেমন জটিল বোঝাবুঝি। বর্তমান সরকারের বিরূদ্ধে একধরনের স্বতঃস্ফূর্ত জনরোষ, যার ভেতর দিয়ে ঘটে যায় চোদ্দই আগস্ট রাত্রির জনবিস্ফোরণ, তা ছাড়া যে আন্দোলনটির দেখানোর মতন খুব কিছু নেই।

 

অন্যদিকে, “রাত দখল”-এর পাশাপাশি যে রাজ্যজুড়ে চলছে জুনিয়র ডাক্তারদের লড়াই ও কর্মবিরতি, সেখানকার দাবি সনদে নেই স্বাস্থ্যক্ষেত্রে মহিলাকর্মীদের যে বিশেষ অবস্থা, তাকে ঘিরে একটি কোনো দাবিও। আলোচনা নেই স্বাস্থ্য ও ডাক্তারি পেশার আভ্যন্তরীন পিতৃতন্ত্র সম্পর্কেও। যদিও মেয়েরা সেই আন্দোলনে হাজির, কিন্তু আন্দোলনের নেতৃত্বে মূলত রয়েছেন পুরুষ ছাত্ররাই। যদিও, সেই আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবেও নেওয়া হয়েছে একের পর এক দৃশ্যমান কর্মসূচি। সেইসব কর্মসূচির তীর কখনো ছিল পুলিশকরতে বিনীত গোয়েলের দিকে, কখনো ছিল আর.জি.কর কর্তৃপক্ষের দিকে, কখনো বা স্বাস্থ্যমন্ত্রী / মুখ্যমন্ত্রীর দিকে। যাঁরা অনেকেই একবিংশ শতাব্দীর গত দশকে সাড়া জাগানো “হোক-কলরব” আন্দোলনের সাক্ষী ছিলেন, তাঁদের স্মৃতিতে থাকবে যে অনেকটাই প্রায় একইরকমভাবে যে আন্দোলন যৌন নির্যাতনের একটি ঘটনা দিয়ে শুরু হয়েছিল, তার গতিমুখ ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছিল ক্যাম্পাসে পুলিশ ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়ণের বিরূদ্ধে। যৌন নির্যাতনের ঘটনাটি ধামাচাপা পড়ে গিয়েছিলো।

 

আশংকা হয়, প্রায় একই জিনিস কি হতে চলেছে আর.জি.কর-এর তরুণী ডাক্তারের ধর্ষণ ও মৃত্যুর ঘটনার ক্ষেত্রেও?

 

৭.

এ নিয়ে কোনো ধন্ধের অবকাশ নেই যে আর.জি.কর-এর ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে যে লড়াই, তা বহুলাংশেই ছাপিয়ে গেছে অন্যান্য পরিপ্রেক্ষিতে যে “রিক্লেইম দা নাইট” জাতীয় আন্দোলন হয়েছে। গোটা বিষয়টির সাথে জুড়ে গেছে জনস্বাস্থ্য বিভাগ ও শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতির প্রশ্ন, সরকারি হাসপাতালের অবস্থা, চিকিৎসাকর্মীদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও কাজের পরিবেশ। জুড়ে গেছে রাষ্ট্র ও পুলিশি নিপীড়ন। জড়িয়ে গেছে আদালত ও সিবিআই। প্রশ্ন উঠে গেছে যে এই সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলির ভেতর দিয়ে আদৌ যৌন হিংসার বিরুদ্ধে সুবিচার পাওয়া যায় কি না।

এবং, এই গোটা প্রক্রিয়াটিই সম্ভব হয়েছে এই রাজ্যের মানুষের প্রতিবাদে, নিরন্তর পথে থাকায়।

 

এবং, একথাও সত্য যে লিঙ্গ বা পিতৃতন্ত্র কোনো সমাজে, কোনো ঘটনাতেই একটি একক ভাবে টিকে থাকে না। কাজেই, গোটা ঘটনাটির প্রেক্ষিতে যে একভাবে জড়িয়ে গেছে যৌন হিংসা, ধর্ষণের রাজনীতি, কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের প্রতিবাদ, জনস্বাস্থ্যে দুর্নীতি বা চিকিৎসাশিক্ষার ভাঙাচোরা অবস্থা, তা ভবিতব্য এবং স্বাভাবিক। কিন্তু এক্ষেত্রে, এই এতগুলো সূত্রকে ধরে রেখেছে একটি কেন্দ্রীয় স্লোগান — উই ওয়ান্ট জাস্টিস। সেই “জাস্টিস” বা “বিচারের” সংজ্ঞা কি, তা নিয়ে কোনো ঐক্যমত নেই আন্দোলনের ভেতর। বহু ক্ষেত্রেই “রাত দখল”-এর বৃহত্তর আঙ্গিকে যে জমায়েতগুলি হচ্ছে সেখানে সহাবস্থান করছে বিভিন্ন দাবি — কেউ কেউ চাইছেন ধর্ষকদের ফাঁসি, কেউ বা রাস্তা জুড়ে আঁকছেন কুনান পোশপোড়া থেকে মণিপুর থেকে উন্নাও থেকে হাত্রাস সংক্রান্ত কোনো একটি স্লোগান, কেউ বা চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী/স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ।

 

আর, সংগঠন তৈরী করার যে প্রক্রিয়াটি হয়েছিল, সেখানকার উপদেষ্টামণ্ডলীতে সেলিব্রিটিদের ভীড়, বা যৌন হয়রানির অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তির উপস্থিতি সেই প্রক্রিয়াটির মূলগত রাজনীতি নিয়েই অনেক অনেক প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। কাজেই, এই আন্দোলনের দীর্ঘমেয়াদি ফল কি হবে? মহিলাদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বা পথে নাম পৃথিবীর ইতিহাসে — বিশেষত বাংলার ইতিহাসে — খুব নতুন কিছু নয়। সাম্প্রতিক সময়েও সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম কেন্দ্রিক লড়াইকে ঘিরে বহু বহু মহিলারা পথে নেমেছিলেন, এসেছিলেন আন্দোলনের আঙিনায়। কি হলো তারপর? কোথায় তাঁরা আজ? সেই অভূতপূর্ব অংশগ্রহণের ইতিহাসের পরেও, বাংলার রাজনৈতিক সক্রিয়তার মানচিত্রে কোনো ব্যাপক নারী আন্দোলন দেখা যায়নি। কাজেই, যে সম্ভাবনা আজ এই আন্দোলনের ভেতর দিয়ে তৈরী হয়েছে, এতো এতো মহিলাদের পথে নামার ভেতর দিয়ে তৈরী হয়েছে, সেই সম্ভাবনাকে পরবর্তী স্তরে নিয়ে যাবে কোন রাজনৈতিক প্রক্রিয়া?

 

সেই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার খোঁজ আমাদের ভেতরে সার্বিকভাবে অনুপস্থিত। যদিও, খুব স্বাভাবিকভাবেই আন্দোলনের গতিময়তার ভেতর দিয়ে বল অনেকদূর গড়িয়ে গেছে। যেমন, ১২ই সেপ্টেম্বর জুনিয়র ডাক্তারদের সরাসরি টেলিসম্প্রচার ব্যতীত মুখ্যমন্ত্রীর সাথে বৈঠকের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার ভেতর দিয়ে গণতন্ত্রের প্রতি সাধারণ নাগরিকদের সাধারণ দাবির মানটি উঠে গেছে বেশ কয়েক ধাপ। কিন্তু, তারপর?

 

প্রসঙ্গত, “উই ওয়ান্ট জাস্টিস” স্লোগানটি নিয়েও, বেশ কিছু প্রশ্নের অবকাশ রয়ে যায়। কার কাছে আমি “বিচার” চাইছি? সেই রাষ্ট্রের কাছে যা ধর্ষণ ও যৌন হিংসাকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় অস্ত্র হিসেবে? সেই বিচারব্যবস্থার কাছে যা আজ অবধি কুনান-পোশপোড়ার ধর্ষকদের সাজা দিতে পারেনি? যে বিচারব্যবস্থার দোর থেকে উচ্চারিত হয়েছে একের পর এক নারীবিরোধী রায়, উচ্চারণ? কাজেই, আরও তীক্ষ্ণ কোনো স্লোগানের উপর কেন দাঁড়ালো না এই আন্দোলন? সেই প্রশ্নটি করা আজ আশু প্রয়োজন।

 

পরিশেষে, মনে রাখা প্রয়োজন, আর.জি.কর-এ ডাক্তার তরুণী খুন ও ধর্ষিত হয়েছিলেন নিজের কর্মক্ষেত্রে। কাজেই, কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের অবস্থান নিয়ে চুলচেরা আলোচনা প্রয়োজন আজ। সেই আলোচনা সুবিধাপ্রাপ্ত কর্মী মেয়েদের (অর্থাৎ, হোয়াইট কলার ওয়ার্কার) আর প্রান্তিক কর্মী মেয়েদের (অর্থাৎ, ব্লু কলার ওয়ার্কার) জন্য এক হবে না। সেই আলোচনা হবে না প্রতিটি কর্মক্ষেত্রের ক্রমবর্ধমান নয়া-উদারনৈতিকরণ সম্পর্কিত আলোচনা ব্যতিরেকে। মনে রাখতে হবে, প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানে আই.সি.সি বা জেন্ডার সেল প্রতিটি মহিলা কর্মীর অধিকার।

 

যে অধিকার আজকে তাঁকে প্রতিষ্ঠা করতে গেলে চাকরি খোয়াতেও হতে পারে। অতএব, প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার লড়াই ভিন্ন এই কর্মক্ষেত্রে এই লিঙ্গ রাজনীতি, মেয়েদের ও প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষদের সুরক্ষার বাতাবরণ প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। আজকের নয়া-উদারনৈতিক কর্মক্ষেত্রে, শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়ন বহুদিনই লুপ্ত একটি প্রতিষ্ঠান প্রায়। এবং, ইউনিয়ন জাতীয় সংগঠনটির বিলুপ্তির সময়টা মোটামুটি নয়া-উদারনৈতিক নারীবাদের উত্থানের সময়ও বটে। কাজেই, আজ প্রশ্ন করতে হবে যে এই যে নয়া-নারীবাদের তথাকথিত জঙ্গিপনা, তার যে পদ্ধতি, তা কি আসলে এই বিলুপ্তির রাজনীতিকেই ঘোলাটে করে দেওয়ার একটি প্রক্রিয়া মাত্র নয়?

 

সেই লুপ্তপ্রায় প্রতিষ্ঠানকে পুনর্প্রতিষ্ঠা করতে গেলে, “রাত-দখল”-এর প্রতীকী কর্মসূচি দিয়ে হবে না। হবে না একাধিক “রাত-দখল”-এর কর্মসূচি দিয়েও।আরও আরও যে জটিল অধিকারের প্রশ্ন এই গোটা মেয়েদের সুরক্ষার প্রশ্নের সাথে যে জড়িয়ে আছে, তার জন্য গড়ে তুলতে হবে প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানে লড়াই। সে লড়াইয়ের পথ কঠিন, বন্ধুর। সেই লড়াই “উই ওয়ান্ট জাস্টিস” এর সহজ ভাষায় হবে না।

 

তবে, আন্দোলন এখনো চলছে। শেষ কথা বলার সময় আসেনি এখনো। কাজেই, আমাদের সবাইকে আরও দেখতে হবে, আরও বুঝতে হবে, পর্যালোচনা করতে হবে। প্রয়োজনে নিজেদের ও আন্দোলনের ক্ষেত্রের ছোটবড়ো বাস্তবতাকে নির্মমভাবে, কঠোরভাবে সমালোচনা করতে হবে। তবে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে একধরনের সাধারণের রাজনৈতিক সক্রিয়তার একটি ছবি বহুদিন বাদে পশ্চিমবঙ্গের বুকে তৈরী হয়েছে। সেই সক্রিয়তার সার্বিক পরিবেশকে সম্মান জানিয়েই এই লেখা।

 

তথ্যসূত্র:

 

Valk, Anne. “Remembering Together: Take Back the Night and the Public Memory of Feminism,” in US Women’s History: Untangling the Threads of Sisterhood. New Jersey: Rutgers University Press, 2017

 

Share this
Recent Comments
1
  • comments
    By: পীযূষ গুহ on September 17, 2024

    আপনি অনেক প্রশ্ন ওঠার সম্ভাবনার কথা বলেছেন বা কিছু outline দিয়েছেন। কিন্তু বিস্তারে যান নি। এ বিষয়ে কথা বলার ইচ্ছে র ইল। কিভাবে সম্ভব?

Leave a Comment