বাংলাদেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, চিন্তক ও প্রাবন্ধিক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকাকে একটি সাক্ষাৎকার দেন যেটি ৫ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ তারিখে প্রকাশিত হয়। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ এর সম্মতিক্রমে এটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ‘স্বৈরাচার’ সরকার পতনের এক মাস পূর্ণ হলো। রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা। বিজয় হয় ছাত্র-জনতার।
দীর্ঘ ১৫ বছরেরও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা ‘স্বৈরাচার’ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে এক নতুন আশার জন্ম নেয়। গঠিত হয় নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে শুরু হয়ে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান এবং পরবর্তী সামগ্রিক পরিস্থিতি, অন্তর্বর্তী সরকার, তাদের করণীয়, প্রায় এক মাস বয়সী এই সরকারের চ্যালেঞ্জ কিংবা ভ্রান্তি, দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।
দ্য ডেইলি স্টার: জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতনের এক মাস হলো। এ আন্দোলনটি কেন গুরুত্বপূর্ণ?
আনু মুহাম্মদ: এই আন্দোলনের ফলাফলই এর গুরুত্ব দেখিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশে গত ১৫ বছর ধরে একটিমাত্র শাসকগোষ্ঠী ছিল ক্ষমতায় যারা নির্বাচন কিংবা শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল। ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য নির্যাতন কিংবা দমন-পীড়নসহ অনেক কিছু তারা করেছে। তারা মিডিয়াকে ভয়াবহভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে। আদালত অকার্যকর হয়ে গেছে। মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন কোনো কাজ করেনি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মেরুদণ্ডহীন মাস্তানদের সমাবেশ তৈরি হয়েছে। সব মিলিয়ে একটি শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা তৈরি করেছিল। দুর্নীতির কারণে একদিকে যেমন জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে, কর্মসংস্থানের সুযোগ কমেছে, অন্যদিকে হাজারো কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এর মধ্যেই বিভিন্ন ধরনের গোপন চুক্তি, মেগাপ্রকল্পের কারণে মানুষের মধ্যে বিষণ্ণতা বাসা বেঁধেছিল।
সবশেষ ২০২৪ সালের প্রহসনের নির্বাচনের পর মানুষের মধ্যে একটি হতাশা তৈরি হয়, একটা জাতিগত ডিপ্রেশন তৈরি হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতা মানুষের মধ্যে অসহায়ত্ব তৈরি করেছিল। আওয়ামী লীগের বিকল্প বিএনপি-জামায়াত জোটের অতীত মানুষ দেখেছে। জাতীয় পার্টিকেও তারা দেখেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর বিষয়ে মানুষের অভিজ্ঞতা বেশি সুখকর ছিল না। এজন্য জনগণের মনে ক্ষোভ থাকা সত্ত্বেও গত ১৫ বছরের অন্যান্য আন্দোলনগুলো সরকার পতনের দিকে যায়নি। কিন্তু মানুষের মাঝে প্রশ্ন ছিল যে এগুলো কতদিন চলবে? স্বৈরাচারী ব্যবস্থা, মানুষকে অপমান, প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা আর কতদিন চলবে?
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যে সরকার পতন আন্দোলনের দিকে গেল, তা কোনো পরিকল্পিত ঘটনা ছিল না। সমাজের মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হয়েছে আন্দোলনে। শুধু এই সময়ের আন্দোলন দিয়েও এটাকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। এখানে মূল বিষয় হলো এর সূত্রপাত রাজনৈতিক নেতৃত্বে হয়নি। গণঅভ্যুত্থান তো আগেও দেখেছি। ১৯৬৯, ১৯৯০ এ গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। ‘৬৯ এ রাজনৈতিক দলগুলো যেমন—আওয়ামী লীগ, ভাসানী ন্যাপ সামনে ছিল। এই আন্দোলনের ফল মুক্তিযুদ্ধ। আরেকটা গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল ১৯৯০ সালে এরশাদ পতন আন্দোলন। তখন আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও বামদলের নেতৃত্বে তিনটি রাজনৈতিক জোটের সম্মিলিত আন্দোলন হয়। এবারের জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না, এর কোনো নির্দিষ্ট নেতা ছিল না। কিন্তু যার বিরুদ্ধে আন্দোলন, সেই শেখ হাসিনা আন্দোলন দমাতে গিয়ে যা যা করলেন, তার সবই এটাকে সরকার পতন আন্দোলনের দিকে নিয়ে গেছে।
কোটা বাতিলের পরিপত্র আদালত বাতিল করে দেওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হলো। তাদের অনেকে ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছিল। তারা আবার একটা অনিশ্চয়তায় পড়ল। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোটা সংস্কার আন্দোলন আবার শুরু হয়। প্রথম থেকেই শান্তিপূর্ণ হওয়ায় জনগণের সমর্থন পায়। বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর শান্তিপূর্ণ মিছিলে বা সমাবেশে ছাত্রলীগ, যুবলীগ আক্রমণ করল, মেয়েদের ওপর আক্রমণ করা হলো, এরপর আন্দোলনকে অবজ্ঞা করে শেখ হাসিনা বক্তব্য দিলেন, তারপর আবার পুলিশ, র্যাব শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করল, এসব মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলল। তারপর ১৬ জুলাই আবু সাঈদসহ সাতজন যখন নিহত হলো, তখন মানুষের প্রতিক্রিয়া এমন হলো যে আর কত সহ্য করা যায়? আবু সাঈদের ওপর যেভাবে গুলি হয়েছে এর তো কোনোভাবেই যৌক্তিকতা নেই। এর প্রতিক্রিয়ায় সাধারণ মানুষ সমর্থন দিলো আন্দোলনে। একপর্যায়ে পাবলিক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা যখন কুলাতে পারছিল না, তখন প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা এলো, যেটা ছিল সরকারের ধারণার বাইরে। পরে কলেজের শিক্ষার্থীরা, স্কুলের শিক্ষার্থীরা পর্যন্ত আন্দোলনে যোগ দিলো, পুরো দেশে ছড়িয়ে গেল আন্দোলন।
ডেইলি স্টার: ২ আগস্ট আপনারা সরকার পতনের ডাক দিলেন। এরপর গণতান্ত্রিক রূপান্তরের রূপরেখা দিলেন। তারপর শিক্ষার্থীরা একদফা ঘোষণা দিলো। এটাই কি ছাত্র-জনতার মিলিত আকাঙ্ক্ষা ছিল?
আনু মুহাম্মদ: আওয়ামী লীগের এক নেতার একটি প্রিয়বচন ছিল ‘খেলা হবে’। তারা আন্দোলনটাকেও খেলাচ্ছলে নিল। প্রথমে তারা আদালত দেখালো। কিছুদিন পর আন্দোলন তীব্র হলে আদালতের তারিখ এগিয়ে এলো, বোঝা গেল পুরো বিষয়টি আসলে ছিল ভাঁওতাবাজি। ততদিনে প্রায় ২০০ মানুষের জীবন চলে গেছে, যেটি বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কখনো হয়নি। গুলিতে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শ্রমজীবী মানুষ, সাধারণ মানুষ নিহত হলো। এরপর শেখ হাসিনা আলোচনায় বসার কথা বলল, আর অন্যদিকে সমন্বয়কদের আটক করে আন্দোলন প্রত্যাহারের চেষ্টা করল।
আমরা ২ আগস্ট দ্রোহযাত্রা কর্মসূচি দিলাম, সেখানে আইনজীবী, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, ডাক্তার, শ্রমজীবী মানুষ, রিকশাচালক সর্বস্তরের হাজারো মানুষ অংশ নেন। সম্মিলিতভাবেই তখন দাবি এলো পদত্যাগের, সারাদেশের মানুষ পদত্যাগের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ। ৪ আগস্ট আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখা দিলাম, তার মানে আমরা সরকারকে আর গ্রহণই করছি না। তখনো চারিদিকে পুলিশি অভিযান, চারিদিকে গুলি, ছাত্রলীগ-যুবলীগ সন্ত্রাসীদের তাণ্ডব। ততদিনে ৫০০-৬০০ মানুষ মারা যাওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছিল। তাও শেখ হাসিনা হত্যা বন্ধ করেনি। বরং আরও নির্মম হয়ে ওঠে। নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালানো হয় ঢাকায় ও ঢাকার বাইরে। এত মানুষকে গুলি করেও যখন আন্দোলন দমানো যাচ্ছে না, তখন আমরা যেমন বুঝেছি, দেশের মানুষ বুঝেছে সরকার আর টিকতে পারবে না। কিন্তু স্বৈরাচারের ট্রাজেডি হলো তারা বুঝতে পারে না তাদের পতন। সবশেষ সেনাবাহিনী যখন গুলির বিরুদ্ধে অবস্থান নিল, তখন তো শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগকে পালাতে হলো।
ডেইলি স্টার: ছাত্র-জনতার বিজয়ের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হলো। তাদের কাছে মানুষের প্রত্যাশাও বেশি। তারা কেমন করছে বলে মনে করছেন?
আনু মুহাম্মদ: এই আন্দোলনের ফসল নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে প্রায় এক মাস হতে যাচ্ছে। আমি মনে করি তাদের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। প্রথমত, আন্দোলনে নিহত ও আহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, আহতদের চিকিৎসার দায়-দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। এখনো আহত-গুলিবিদ্ধদের অনেকে মারা যাচ্ছে। প্রত্যেকের চিকিৎসার জন্য আর্থিক নিশ্চয়তার ব্যবস্থা করতে হবে। দরকার হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। তৃতীয়ত, আহতদের মধ্যে যারা কর্মক্ষমতা হারিয়েছে তাদের এবং নিহতদের পরিবারের দায়িত্ব নিতে হবে।
অন্যদিকে, চারিদিকে যেসব বিশৃঙ্খলা হচ্ছে—যেমন শিক্ষকদের ওপর অত্যাচার, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। ভাস্কর্য ভাঙা, মূর্তি ভাঙা, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্নের ওপর আক্রমণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য না এবং অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এটা নিয়ে কাজ করতে হবে। আওয়ামী লীগের কেউ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকলে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতে হবে, কিন্তু হামলা করা যাবে না। কোনো মতামত, লেখা, বক্তব্য, পরিচয়ের কারণে নির্যাতন করা যাবে না। আমি মনে করি এ বিষয়গুলো নিয়ে সরকার এখনো ঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না। এসব বিষয়ে সরকারের অবস্থান মানুষের কাছে আরও পরিষ্কার করা দরকার।
ডেইলি স্টার: এই সরকারের মূল চ্যালেঞ্জগুলো কী?
আনু মুহাম্মদ: সরকারের অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে সরকারের। সেটির জন্য প্রস্তুতিও বিবেচনায় রাখতে হবে। সরকারের মূল চ্যালেঞ্জ হবে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গ্রুপ, ইন্টারন্যাশনাল লবি, সিভিল ও মিলিটারি ব্যুরোক্রেসির স্বার্থ রক্ষা করা। এই তিন শক্তিই চাইবে তাদের স্বার্থ রক্ষা হোক। এটা সরকারকে মোকাবিলা করতে হবে নিজেদের সদিচ্ছা, সক্রিয়তা দিয়ে। সবচেয়ে বড় বিষয় হবে তারা মোকাবিলা করতে চায় কিনা বা কীভাবে চায়। সরকারের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো জনগণ। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির জায়গা তৈরি করতে পারলে মানুষ এই সরকারের পাশে থাকবে। আমরা বলছি না রাতারাতি সব করে ফেলতে হবে। কিন্তু সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়গুলো আছে, সেগুলোর সূচনাটা তো এখনই করতে হবে। পরে পর্যায়ক্রমে সেগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন হবে।
ডেইলি স্টার: নতুন বাংলাদেশে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কেমন হওয়া উচিত?
আনু মুহাম্মদ: আমরা বৈষম্যহীন বাংলাদেশের কথা বলছি। কারণ, এখানে শ্রেণি বৈষম্য ভয়ংকর, লিঙ্গ ও জাতিগত বৈষম্য আছে, আঞ্চলিক বৈষম্য আছে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু আছে। সরকার পতনের পর হিন্দুদের ওপর, আহমদিয়া গোষ্ঠীর ওপর আক্রমণ হয়েছে, মাজারে হামলা হয়েছে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা এখনো বৈষম্যহীনতার বিষয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয়নি, পরিষ্কার ধারণা দেয়নি।
আমাদের আরেকটি আকাঙ্ক্ষা হলো, আমরা আর আগের পথে যাব না। কিন্তু, গত ১৫ বছরের কোন কোন বিষয়গুলোতে আমরা আগের মতো হবো না, সে বিষয়ে কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যারা বৈষম্যহীনতার জন্য লড়াই করে, তাদের অবস্থান দুর্বল। কিন্তু যারা সবল, সেই রাজনৈতিক দলগুলোর কেউ ধর্মের নামে, কেউ জাতীয়তাবাদের নামে, কেউ মুক্তিযুদ্ধের নামে বৈষম্যবাদী রাজনীতি করে। রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের স্বার্থকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারছে না। তাদের ওপর ভরসা করা ঠিক হবে না, কারণ তারা অতীতের জন্য অনুতপ্ত হয়নি। এখন পর্যন্ত ভুলও স্বীকার করেনি। যেমন: জামায়াত একাত্তর সালে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত, তারা এখনো অনুতাপ স্বীকার করেনি। বিএনপি তাদের আমলে অনেক স্বার্থবিরোধী কাজ করেছে, সেগুলোর ব্যাপারেও তারা অনুতাপ স্বীকার করেনি। সুতরাং তারা সামনে নতুন কিছু নিয়ে আসবে, সেটি নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়।
রাজনৈতিক দলগুলোর বড় সংস্কার দরকার। তাদের উচিত কর্মীদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি কার্যকর করা, দলীয় পদ বাণিজ্য বন্ধ করা।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবারের আন্দোলনে আমরা দেখেছি যে এসব রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরেও একটি শক্তি আছে বা উঠে আসার সম্ভাবনা রয়েছে যেটি খুবই ইতিবাচক। যারা আসলেই বৈষম্যবিরোধী, তাদের এই শক্তির ওপর দাঁড়িয়ে কাজ করতে হবে। আমাদের প্রশ্ন বা চিন্তাগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। যেমন: আমরা শিক্ষাব্যবস্থা কেমন চাই, স্বাস্থ্যখাত কেমন হবে, রাজনৈতিক পরিবেশ কেমন হবে, রাষ্ট্রব্যবস্থায় কী পরিবর্তন চাই, সংবিধান কেমন চাই—এগুলো নিয়ে ব্যাপক আলোচনার মধ্য দিয়ে জনগণের মত এবং শক্তি তৈরি করতে হবে।
ডেইলি স্টার: ফ্যাসিজম ঠেকাতে সংবিধান সংশোধন বা পুনর্লিখনের কথা আলোচনায় আসছে। এক্ষেত্রে সরকার কী করতে পারে?
আনু মুহাম্মদ: ১৯৭২ সালে যে সংবিধান প্রণীত হয়েছিল, সেখানে কয়েকটি বিপরীত জিনিস ছিল। একটি হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রভাব, কারণ লড়াইটা শুধু মুক্তিযুদ্ধ ছিল না, মুক্তিযুদ্ধের আগের ২৩ বছরের সংগ্রাম ছিল। আরেকটা ছিল কর্তৃত্ববাদী শাসন স্থাপন। যেমন: বাঙালি জাতি অন্য জাতিকে স্বীকার করেনি, এটা একটি সমস্যা ছিল। এ ছাড়া, ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করাও একটি সমস্যা ছিল।
সংবিধানে কিছু বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে। এই সরকার একা তা করতে পারবে না। আমি মনে করি এর জন্য একটি সংবিধান কমিশন করা উচিত, যেখানে যোগ্য ব্যক্তিরা থাকবেন। তাদের বিভিন্ন সুপারিশ নিয়ে জনমত তৈরির জন্য আলোচনায় আসবে। পরে সিদ্ধান্ত আসুক যে এসব পরিবর্তন কি গণপরিষদের মধ্য দিয়ে করতে হবে, নাকি সংবিধান সংশোধনের মধ্য দিয়ে করতে হবে, কিংবা গণভোটের মাধ্যমে। একবার এর ভিত্তি তৈরি হয়ে গেলে পরবর্তী সরকার আর এটিকে এড়িয়ে যেতে পারবে না।
আমরা বেশকিছু মডেল নিয়ে আলোচনা করেছি। সহজভাবে করার জন্য অল্প কয়েকজন সদস্য নিয়ে গণপরিষদ গঠন করা যায়, আবার বেশি সদস্য নিয়েও দীর্ঘ সময় ধরে করা যায়। নেপালে এমন হয়েছে। এমন আরও অনেক দেশে হয়েছে, যেগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যাবে। এসবের জন্য এখন সংবিধান কমিশন গঠন করে তাদের ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে।
ডেইলি স্টার: নতুন সরকার এলেও পুরোনো কিছু ব্যাপার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষ করে আইন-শৃঙ্খলার অবস্থা, গ্রেপ্তার নাটক, ঢালাও মামলা—এই ব্যাপারগুলোর পুনরাবৃত্তি কেন হচ্ছে?
আনু মুহাম্মদ: এটি হচ্ছে কারণ পুলিশ, ডিজিএফআইসহ বিভিন্ন বাহিনীর ছাঁচটা একই আছে। এই ছাঁচটি তৈরি হয়েছিল বিরোধী মত দমন ও হয়রানি করার জন্য৷ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথমেই উচিত ছিল এটা নিয়ে কাজ করা। এসব মামলা তো টিকবে না। যেমন: সাকিব আল হাসান বিদেশে খেলার সময় তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়, এটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। সালমান এফ রহমান অনেক বড় অপরাধী। কিন্তু তাকে নিউমার্কেট এলাকায় হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে। এগুলো পুরোনো অভ্যাস। এর পরিবর্তন না হলে পরিণাম একইরকম হবে। ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করলেও পরে তাদের সঙ্গে সমঝোতা হতে দেখেছি।
যেসব শিক্ষার্থীরা রক্ত দিয়ে বৈষম্যবিরোধী সমাজের জন্য আন্দোলন করেছে, এরকম চললে তাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে না। তাই সরকারকে প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বসে সমাধান বের করতে হবে। একমাস অনেক কম সময় সেটা ঠিক। কিন্তু নির্দেশ দেওয়ার জন্য তো একমাস কম সময় না, সূচনা তো করতে হবে।
ডেইলি স্টার: শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের কথা উঠছে। আপনার মতামত কী?
আনু মুহাম্মদ: আমাদের শিক্ষাঙ্গনের ছাত্ররাজনীতিতে সমস্যা তৈরি করে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনগুলো। তারা সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকে। আমি ছাত্ররাজনীতির কোনো দোষ দেখি না। এবারের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বলেছিল তারা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না। অথচ তারা একটি সরকার পরিবর্তন করে দিলো। এর চেয়ে বড় রাজনীতি আর কী হতে পারে এবং এটি একটি ইতিবাচক রাজনীতি।
ডেইলি স্টার: বলা হচ্ছে ভারত থেকে আমরা এখন মার্কিন বলয়ে ঢুকে যাচ্ছি। আবার চীনের সঙ্গেও আমাদের একটা সম্পর্ক আছে। সরকারের পররাষ্ট্রনীতি কেমন হওয়া উচিত?
আনু মুহাম্মদ: সত্যি কথা বলতে বাংলাদেশে বা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের একটি প্রভাব আছে। ভারত বড় দেশ হিসেবে আশেপাশের দেশের ওপর দাপট দেখানোর চেষ্টা করে। অন্যান্য দেশের ওপর অতটা না পারলেও বাংলাদেশের ওপর বেশি প্রভাব রেখেছে আওয়ামী লীগের কারণে। আওয়ামী লীগ সরকারের ভোট ছাড়া ক্ষমতায় টিকে থাকার পেছনে ভারতের হাত ছিল। গত দেড় দশকে তাই ভারতের আধিপত্য আমাদের দেশে অনেক বেড়ে গিয়েছিল। শেখ হাসিনা তো বলতোই, ‘ভারতকে আমি যা দিয়েছি তারা সেটা সারাজীবন মনে রাখবে।’
কিন্তু এখানে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপানেরও একটা প্রভাব আছে। দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান হলো ১৯৭০ এর দশক থেকে তারা ভারতের সঙ্গে কাজ করে। এশিয়ায় চীন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হুমকি হলেও ভারত কিন্তু নয়। তবে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কিঞ্চিৎ অসুবিধা আছে। যুক্তরাষ্ট্রের এখানে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা সরকারের কোনো আপত্তি ছিল না। যেমন: গত নির্বাচনের আগে এলএনজিসহ বিভিন্ন চুক্তি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অসুবিধাটা ছিল এখানে ভারতের মাধ্যমে তাদের আসতে হতো। নির্বাচন-মানবাধিকার তাদের মূল এজেন্ডা না। যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত কোনো দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে এমন রেকর্ড নেই, কিন্তু স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা করার রেকর্ড আছে।
আবার ভারতের আধিপত্য থাকবে না, এটাও বলা যাবে না। কারণ বিএনপি, জামায়াত সবাই বলছে ভারতের সঙ্গে তারা ভালো সম্পর্ক রাখতে চায়। এ ছাড়া ভারতের সঙ্গে ট্রানজিটসহ যেসব চুক্তিগুলো হয়েছে, সেগুলো বাতিলের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। অসম বাণিজ্য, সীমান্ত হত্যা এগুলো নিয়েও এই সরকার এখনো কোনো কিছু বলেনি। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত ভারতসহ সব দেশের সঙ্গে হওয়া সব চুক্তি প্রকাশ করা। এতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ভারসাম্য নিয়ে একটা বোঝাপড়া তৈরি হবে।
বাংলাদেশে চীনের প্রভাব থাকলেও চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বৈরী। তবে, আমি বলব যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীনের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র সবসময় চীনের বিরোধিতা করলেও মার্কিন ব্যবসায়ীদের একটি বড় বিনিয়োগ চীনে আছে। তাই আমি বলব বাইরের কথা চিন্তা না করে, দেশের ভেতরের শত্রু-মিত্র নিয়ে চিন্তা করা উচিত।
ডেইলি স্টার: আপনাদের গণতান্ত্রিক নাগরিক কমিটির কাজ কী হবে?
আনু মুহাম্মদ: এটি সবেমাত্র গঠিত হয়েছে। এর মূল লক্ষ্য হবে অগণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থা বাতিল এবং ভবিষ্যত বাংলাদেশের ভিত্তি গড়ায় কাজ করা। যেমন: আমরা কেমন বাংলাদেশ দেখতে চাই, শিক্ষা চাই, চিকিৎসা চাই, সামাজিক ব্যবস্থা চাই, পরিবেশ চাই—এগুলো নিয়ে কাজ করবে গণতান্ত্রিক নাগরিক কমিটি।
ডেইলি স্টার: এই সরকার কতদিন থাকতে পারে বা থাকা উচিত?
আনু মুহাম্মদ: এটি নির্ভর করছে এই সরকারের গতি কেমন। ধীরগতির হলে বেশি সময় লাগবে, আর সিরিয়াস হলে বেশি সময় লাগার কথা না। গণঅভ্যুত্থানের যে স্পিরিট বা শক্তি, তার ওপর ভিত্তি করেই অনেক কাজ করা যায়। সরকার যদি শিথিল থাকে বা দীর্ঘসূত্রিতার আশ্রয় নেয়, তাহলে অনেকগুলো কাজ পরে আর করতে পারবে না। সেজন্য যত দ্রুত সম্ভব অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কিছু কাজ করতে হবে। মানে পরিবর্তনের সূচনাটা এখনই করতে হবে।