‘একটি শহর আজ কালকূটে নীল/ বিষধর সাপ তোর পদত্যাগ চাই’


  • September 4, 2024
  • (0 Comments)
  • 1139 Views

সুমনা রহমান চৌধুরী 

 

নিবন্ধটির শিরোনামটি যে কবিতা থেকে নেওয়া তার একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত রয়েছে শুরুতে ছোটো করে শিবের গীত হিসেবে সে গল্প বলা যাক যদিও এই নিবন্ধের পরবর্তীতে আমরা সে ইতিহাসকে আজকের সময়ে এসে মিলে যেতে দেখবো 

 

১৯৮৩ সাল বাংলাদেশে তখন জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনকাল তার আগের বছর অর্থাৎ ১৯৮২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর এরশাদ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খান একটি নতুন শিক্ষানীতির প্রস্তাব করেন যেখানে প্রথম শ্রেণী থেকে আরবি এবং দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয় শুধু তাই নয়, উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য মাপকাঠি করা হয় মেধা অথবা পঞ্চাশ শতাংশ ব্যয়ভার বহনের ক্ষমতা বিতর্কিত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং কালক্রমে সেটা গণআন্দোলনের রূপ নেয় এরশাদের সামরিক অপশাসনের আরও বিবিধ অনুষঙ্গও এর সঙ্গে জড়িয়ে ছিল যদিও গণআন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি শিক্ষার্থীরা মিছিল করে সচিবালয়ে স্মারকলিপি জমা দিতে যাওয়ার সময় এরশাদ সরকারের পুলিশ গুলি চালায় এবং জয়নাল ও দীপালি সাহা সহ নিহত হন অন্তত ১০ জন শিক্ষার্থী ১৫ ফেব্রুয়ারি এরশাদ সরকার ঢাকা-চট্টগ্রামের সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে সান্ধ্য আইন জারি করে ভারতের নিরিখে যা পূর্বতন ভারতীয় আইনের পরিভাষায় ১৪৪ ধারার সমান (ভারতীয় ন্যায় সংহিতা অনুযায়ী যা এখন ১৬৩ ধারা)। সমস্ত বাংলাদেশ স্বৈরাচারী এরশাদের দমন-পীড়ন নীতির বিরুদ্ধে ফুঁসছে সেসময়ই, ১৯৮৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচারী এরশাদের রাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগের দাবি জানিয়ে কবি শামসুর রহমান ‘পদত্যাগ’ কবিতাটি লেখেন—

 

একটি হরিণ আজ হয়েছে নিখোঁজ
একটি যুবতী আজ হয়েছে বিধবা
ডোরাকাটা বাঘ তুমি পদত্যাগ করো
একটি মায়ের বুক হয়েছে ব্যাকুল,
কিশোর ফেরেনি ঘরে, জ্বলেনি সন্ধ্যার বাতি আজ;
নেকড়ে তোমার
পদত্যাগ চাই
একটি শহর আজ কালকূটে নীল,
বিষধর সাপ তোর পদত্যাগ চাই

 

প্রথমেই খুব স্পষ্টভাবে বলে রাখা দরকার, আরজি কর মেডিকেল কলেজে যে ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছে সেটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বিষয়টি শুধুমাত্র চিকিৎসক খুন-ধর্ষণ অথবা কর্মক্ষেত্রে নারী সুরক্ষা বা নারী স্বাধীনতার বিষয়ও নয় নারীর শরীরের উপর পুরুষের আধিপত্য বিস্তারের পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গীর কারণেই শুধুমাত্র এই খুন এবং ধর্ষণটি ঘটানো হয়নি তাই শুধুমাত্র নারীবাদের সঙ্গে সংপৃক্ত করে গোটা ঘটনাটি বিচার-বিবেচনা করলে জনতার পবিত্র ক্রোধের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে 

 

দীর্ঘদিন (গত এক দশকের বেশি সময়) ধরে চলে আসা পশ্চিমবঙ্গে বর্তমান শাসক দলের এবং সরকারের অপশাসন, পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতি, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে নিজেদের দলীয় লুম্পেনরাজ কায়েম, লবিবাজী, ধর্ষক-খুনী-অপরাধীদের আড়াল করার প্রবণতা এই ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে এক ‘মেগালোম্যানিয়াক’ শাসকের এবং তার অনুচরদের আকাশছোঁয়া আত্মবিশ্বাস, স্পর্ধা ও দম্ভ এই গোটা ঘটনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পাড়ার ক্লাবগুলিকে অনুদান দিয়ে চুপ করিয়ে রাখা, রাজ্যের অধিকাংশ শিল্পী-সাহিত্যিক-অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বড়ো পদ আর ‘পাইয়ে দেওয়ার’ রাজনীতিতে জুড়ে নেওয়া, এবং সবচেয়ে জরুরি – যে ভাতা, ভর্তুকি পাওয়া একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় দেশের নাগরিকদের অধিকার যতদিন না রাষ্ট্র সকল নাগরিকদের অর্থনৈতিক সুরক্ষা বা রোজগার দিতে পারছে — সেখানে সেটিকে সরকারের ‘দয়ার দান’ হিসাবে দেখিয়ে গরীব-মেহনতী-শ্রমিক-নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত নাগরিককে দলদাস ভাবার প্রবণতা আজকের এই গোটা ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে 

 

আরজি কর মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকের নৃশংস মৃত্যু একটি প্রাতিষ্ঠানিক মৃত্যু যেমন আসিফার ধর্ষণ একটি রাজনৈতিক ক্ষমতা বিস্তারের লক্ষ্যে, একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভেতরে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে করা ধর্ষণ ছিল, যেমন হাথরস, উন্নাও— তেমনই  এই খুন ধর্ষণের চরিত্র এখানেই দিল্লীর নির্ভয়া ধর্ষণের চরিত্র থেকে আলাদা হয়ে ওঠে, বোঝা দরকার, কর্মরত অবস্থায় একজন মানুষকে (মহিলাকে) চরমতম আক্রোশ মেটানোর জন্য মারা হয়েছে শুধুমাত্র তার নারী শরীরের লোভে নয় কিসের স্বার্থে এবং প্রতিষ্ঠানের ভেতরের কোন্‌ দুর্নীতি, কোন্‌ সংগঠিত অপরাধ লুকোতে, কার সিন্ডিকেটরাজ বাঁচাতে এই খুন ও ধর্ষণ— এই প্রশ্নগুলোর উত্তরের ভেতরেই ভিক্টিম-এর জন্য চাওয়া ন্যায় অন্তর্নিহিত হয়ে আছে এবং এখানে এসেই আরজি কর মেডিকেল কলেজের ভিক্টিম-এর সঙ্গে একদিক দিয়ে আনিস খান, মইদুল ইসলাম মিদ্যারা এসেও মিলে যান 

 

এ জায়গায় এসেই ‘মেয়েদের রাত দখল’ আন্দোলনের ‘অরাজনৈতিক’ এবং আবশ্যিক ‘দলহীন’ হওয়ার সতর্কবাণী দেওয়া অংশটি দেখে আন্দোলনের অভিষ্ট নিয়ে সন্দেহের উদ্রেক হয় শাসককে ‘নিরাপদ রাস্তা’ করে দেওয়ার আশঙ্কার মেঘে ভীত হই আমরা কেননা দিনশেষে কোনো ঘটনাই ‘অরাজনৈতিক’ নয় ধর্ষণ যেমন রাজনৈতিক ঘটনা, তার প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধও পৃথিবীর সকল আধিপত্যবাদবিরোধী আন্দোলনই রাজনৈতিক আন্দোলন এমনকি নারী স্বাধীনতা অথবা লিঙ্গসাম্যের অধিকারের লড়াই সেটিও আদ্যান্ত রাজনৈতিক লড়াই ‘অরাজনৈতিক’ দাগিয়ে শুধু ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ বলা সরাসরিভাবেই একটি ভাববাদী ধারণা যেখানে আবেগ আছে, কিন্তু যুক্তি নেই কিসের ‘জাস্টিস’, কেন ‘জাস্টিস’ এবং কার কাছে ‘জাস্টিস’ চাওয়া হচ্ছে? সরকারের কাছে সরকারের মুখ মুখ্যমন্ত্রী সেই মুখ্যমন্ত্রীই একাধারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং পুলিশমন্ত্রী 

 

সেই মুখ্যমন্ত্রীই আরজি কর মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ পদত্যাগ করলে ভিক্টিম নয়, অধ্যক্ষের দুঃখটা অনুভব করে বলেন— “ও খুব দু:খ পেয়েছে, আমরা পদত্যাগপত্র গ্রহন করছি না, বদলি করে দেওয়া হবে” তারপরই অপরাধ সংঘটিত হওয়া প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষকে, তদন্ত চলাকালীন-ই চব্বিশ ঘন্টার ভিতরে ন্যাশনেল মেডিক্যাল কলেজে বদলি করে দিলেন। সেই সরকার এবং প্রশাসন থেকেই আত্মহত্যা বলে চালানো হচ্ছিল শুরুতে একটি অপরাধ সংঘটিত হওয়া স্থানে পুলিশের সামনেই প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা করা হয়েছে তাহলে সেই রাজনীতির বিরোধিতা করতে আন্দোলনকারীদের একটা বড় অংশের বাধ্যতামূলক ‘আমরা অরাজনৈতিক’ দাবী এবং শুধুমাত্র ধর্ষণ ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজ তথা রাষ্ট্র কাঠামোর উপর জোর দেওয়া — শাসক এবং প্রশাসনের অপদার্থতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক লবিবাজী, দুর্নীতি ও সিন্ডিকেটরাজ থেকে সাধারণ জনগনের ক্রোধের অভিমুখ ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হিসাবে দেখা খুব একটা অমূলক হয়তো বা নয় 

 

প্রাথমিকভাবে ধৃত একজন ব্যক্তিকে দেখিয়ে সেন্সেশন তৈরী করতে চাওয়া হল। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ফাঁসি চাইলেন আর শাসক দলের ‘সেকেন্ড ইন কম্যান্ড’ চাইলেন এনকাউন্টার কেন? কাদের বাঁচাতে? কাদের মুখরক্ষা করতে? এই ভীষণ রাজনৈতিক প্রশ্নটি ‘মেয়েদের রাত দখল’-এর রাতে ১৪ আগস্ট আরজি কর মেডিকেল কলেজের বাইরে আন্দোলনরত ‘মেয়েদের রাত দখল’ ডাক দেওয়া এসএফআই, ডিওয়াইএফআই ও গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি বাদে গোটা কলকাতার বিভিন্ন স্থানে এবং পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য জেলায়ও জড়ো হওয়া আর কোনো জমায়েত থেকে শোনা যায়নি 

 

আরজি কর মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষের ‘রাতে মেয়েটি একা কেন সেমিনার রুমে ছিল?’ অশ্লীল মন্তব্যের প্রেক্ষিতে ‘মেয়েদের রাত দখল’-এর ‘অরাজনৈতিক’ ও ‘দলবিহীন’ ডাক প্রথম দিয়েছিলেন নারীরা। সেই অধ্যক্ষ যখন আরেক মেডিক্যাল কলেজের একই পদে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে নিযুক্ত হয়ে যান— সেটা কার নির্দেশে এবং তাকেও শাস্তির আওতায় আনার ভীষণ অবশ্যম্ভাবী দাবীর স্লোগান গোটা ১৪ আগষ্ট রাতে কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তের নারীদের ‘অরাজনৈতিক’ জমায়েতে একবারও বলতে শোনা যায়নি। 

 

একটি নৃশংস ঘটনা পরবর্তী ভীষণ জরুরী প্রাথমিক প্রশ্নগুলিই কেউ তুললেন না আন্দোলন শুরুর সেই প্রথম রাতে। উদ্যোক্তারা বলছেন – তাঁরা ‘অরাজনৈতিক’ তাই শুধু ‘জাস্টিস’ পিতৃতন্ত্রের নিপাত এবং নারী সুরক্ষা-ই তাঁদের স্লোগান বিরুদ্ধতার মিছিলে দাঁড়িয়ে কার বিরুদ্ধে নাগরিকদের সম্মিলিত প্রতিবাদ, তার নামটা জনতা ভয়ডরহীনভাবে সোচ্চারে বলতে পারবেন (দলীয় পতাকা না থাকলেও) সেটাই তো ‘জনতার রাজনীতি’ কার শাস্তি চাই, কাদের গাফিলতির শাস্তি চাই, সেগুলো পরিষ্কার করে না বলা অথবা না বলতে দেওয়া মানেই তো ভাবের ঘরে চুরি করা! 

 

১৪ আগস্ট ‘মেয়েদের রাত দখলের রাতে’-ই বহু নারী বন্ধুরা ফিরে এসে সোশ্যাল মিডিয়ায় খোলাখুলি লিখলেন বিভিন্ন জমায়েতে গোটা রাত দখলে নারীর থেকেও বেশী পুরুষদের উপস্থিতি ছিল এবং কীভাবে তাঁরা কনুইয়ের গুঁতো থেকে বেঁচেছেন আর হ্যান্ডব্যাগ বুকের সামনে ধরে জমায়েতে থেকেছেন 

 

এবং সে রাতেই দুষ্কৃতিরা লাঠি হাতে আরজি কর মেডিকেল কলেজের জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন মঞ্চ ভাঙচুর করলো পুলিশের সামনেই মিডিয়ার ক্যামেরার লাইভের সামনেই দেখা গেল তা ক্রাইম স্পট নষ্ট করাই ছিল উদ্দেশ্য। হাসপাতালের ভেতরের ইন্টার্ন ডাক্তার, জুনিয়র ডাক্তার, নার্স, কর্মীদের ভয়ার্ত ‘প্লীজ সেভ আস’ বার্তা সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে ছড়িয়ে পড়লো পুলিশ গিয়ে লুকোলো হাসপাতালের ভেতরে এক বৈদ্যুতিন সংবাদ মাধ্যমের এক সাংবাদিক যখন সে তান্ডব চলাকালীন করা লাইভে এক পুলিশকর্মীকে জিজ্ঞাসা করলেন— “আপনারা লাঠি চার্জ করছেন না কেন?”  তিনি স্পষ্ট বললেন— “আমাদের উপর লাঠি চার্জের নির্দেশ নেই”  কার নির্দেশ নেই সেই প্রশ্নটা পরবর্তী সময়ে আর কেউ করলো না 

 

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, ঘটনাটি সংঘটিত তো রাস্তায় হয়নি একটি প্রতিষ্ঠানের ভেতরে হয়েছে কর্মরত অবস্থায় হয়েছে তাহলে যে সময়ে আরজি কর মেডিকেল কলেজের সামনে কলকাতা শহরের মধ্যে সকলের জমায়েত হওয়া উচিত ছিল সে সময়ে কলকাতা শহরের বিবিধ স্থানে আলাদা আলাদা জমায়েত কেন? এবং সেই জমায়েতগুলোর  কথাগুলো ‘ধর্ষণ’, ‘পুরুষ আধিপত্য’, ‘স্লাট শেমিং’, ‘পিতৃতন্ত্র’ ইত্যাদিতেই ভরে উঠলো কেন? অথবা এই সমস্ত কথা এবং স্লোগান নিয়েও কলকাতা শহরের ভেতরের সমস্ত মানুষের জমায়েত ঘটনাস্থল আরজি কর মেডিকেল কলেজের সামনে হলে খুব কি ক্ষতি হয়ে যেত? অথবা খুব কি রাজনৈতিক হয়ে উঠতো জমায়েত? 

 

১৪ আগষ্ট দিনের দিকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় আরেকটি ধুয়ো উঠে যাঁরা জমায়েতে আসতে পারবেন না তাঁরা রাতের ওই নির্দিষ্ট সময়ে শঙ্খ বাজাবেন সংহতি জানাতে এই রাত দখলের এক উদ্যোক্তা যিনি সেই সময়ে একটি নিউজ চ্যানেলেও এসেছিলেন তাঁর সোশ্যাল মিডিয়াতেও পোস্টার দিয়ে এই বার্তা দেওয়া হলো বিষয়টি নিয়ে কিছু কিছু প্রশ্ন ওঠায়, অসাম্প্রদায়িকতার রূপ দিতে দোয়ার বিষয়টিও এলো আবারও মূল ঘটনাকে ছাপিয়ে আনুষঙ্গিক বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো 

 

একটি প্রাতিষ্ঠানিক খুন এবং ধর্ষণের প্রতিবাদ জানাতে শঙ্খ বাজাতে হবে কেন? দোয়া-ই বা পড়তে কেন? কেনোই বা ধর্মীয় অনুষঙ্গ টেনে আনতে হবে? রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম নেই রাষ্ট্র, শাসক, প্রশাসনিক ব্যবস্থা এদেশের মহিলা তথা সমস্ত নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ উন্নাও, কাটুয়া, হাথরস, কামদুনি, আরজি কর— সব এক সূত্রে গাঁথা শাসক-রাষ্ট্র-সরকারের ব্যর্থতা অপরাধীদের আড়াল করার স্পষ্ট চেষ্টা রাষ্ট্র-শাসকের সেই ব্যর্থতার বিরুদ্ধে আন্দোলন করা হবে এই প্রবল ধর্মীয় মেরুকরণের ভারতবর্ষে ধর্মীয় অনুষঙ্গ টেনে? 

 

এই প্রশ্নের উত্তরে ধেয়ে এলো তেভাগা আন্দোলনের উদাহরণ সে যুগের বাংলার ডাকাতদের আসার আগে সতর্কতা জানানোর উদাহরণ উগ্র দক্ষিণপন্থীদের হাত থেকে শঙ্খকে ‘রিক্লেম’ করার উদাহরণ অথচ আজকের ভারতের হিন্দুত্ববাদ উত্থানের সময়টা যে কোনোভাবেই তেভাগার সময় আর পরিস্থিতির সঙ্গে মিলে যায় না এবং এই হাওয়াটাও যে উগ্র দক্ষিণপন্থীদের পক্ষে যাবে— সেটা আর ‘অরাজনৈতিকেরা’ ভেবে দেখলেন না প্রতিবাদ ‘অরাজনৈতিক’ হলে লাভ হল শাসক নিজেই নিজের বিচার ধর্ণামঞ্চ আর মিছিলে হেঁটে চাইতে পারে 

 

বিশ্বের গণআন্দোলনের ইতিহাস স্মরণ করা যাক সাম্প্রতিক অতীতে ইরানের মেয়েরা হিজাব বিরোধী আন্দোলনে মাথার চুল কেটে লাঠিতে বেঁধে নিশান উড়িয়েছেন যা নারী অধিকার আন্দোলনে আধিপত্যবাদবিরোধী প্রতীক হয়ে উঠেছিল সারা বিশ্বে সংহতি জানাতে বিশ্বের কোথাও কোনো গণআন্দোলনে ধর্মীয় অনুষঙ্গ টেনে আনা হয়েছে বলে ইতিহাস অন্তত সাক্ষ্য দেয় না সংহতি জানানোর ভাষা পৃথিবীতে বহু আমাদের স্মরণে থাকুক ‘হেইল হিটলার’ অভিবাদন জানানো শৃঙ্খলিত ভিড়ের মাঝে হাত নামিয়ে দাঁড়ানো সেই মানুষটিও, তাঁর নীরব দাঁড়ানোও তীব্র প্রতিস্পর্ধা হয়ে আজও পৃথিবীর স্বৈরাচার বিরোধী লড়াইকে স্পর্ধা যুগিয়ে যায় সাম্প্রতিক অতীতে দিল্লীর নির্ভয়া ধর্ষণেও সারা দেশ সংহতি জানিয়েছিল উন্নাও, কাঠুয়া, হাথরস— প্রতিটি ঘটনায়-ই কিন্তু কোথাও ‘শঙ্খচক্রগদাপদ্ম’-র প্রয়োজন আমাদের পড়েনি 

 

আসলে ‘অরাজনৈতিকতা’-র মজা হল ইতিহাস-বর্তমান সব ভুলিয়ে শাসকের নির্দেশিত পথেই আমাদের অজান্তে হলেও আমাদের চালনা করে ফেলে স্বৈরতন্ত্র এভাবেই আন্দোলনের ভাষা তৈরী করে দেয় একটা বিকৃত বা অতিসরলীকৃত অর্থ এরা নিজেরাই জনগনের মুখে তুলে দেয় যেমন এই সময়ের সবচেয়ে অতিসরলীকৃত ভাষা ‘রাজনীতি করবেন না’, অথবা ‘দলহীন প্রতিবাদ’ এধরণের ভাষ্যের আন্দোলনে শাসকের উৎসাহও থাকে বেশী কেননা তাকে অধিকার করা সহজ বলে অথবা তা স্পষ্ট উচ্চারণে সরাসরি শাসকের বিরুদ্ধে যায় না বলে 

 

এদিকে যাবতীয় ‘অরাজনৈতিক’, ‘অদলীয়’ আন্দোলনের মাঝেই সবচেয়ে বড় ‘রাজনৈতিক’ মিছিলটা ১৭ আগস্ট, ২০২৪-এ হয়ে গিয়েছে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ডাকে যিনি একাধারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী, পুলিশমন্ত্রীও যিনি নিজেই পদত্যাগ করার চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে আরজি কর মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষকে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ পদ দিয়েছিলেন এবং খুবই জরুরিভাবে সে মিছিল এবং সভায় মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর দলের সদস্যরাও ‘জাস্টিস’ চেয়েছেন  

 

এসবের মাঝেই আরেক ছবিও দেখা গেল ‘মেয়েদের রাত দখল’ কর্মসূচির অন্যতম পরিচিত উদ্যোক্তা নিজের সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিও বার্তা দিলেন তিনি চার দফা পরিশীলিত দাবি নিয়ে ‘মাননীয়া’ মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় বসতে চান ‘মাননীয়া’ মুখ্যমন্ত্রী তাঁর সঙ্গে আলোচনায় বসলে তাঁর খুবই ভালো লাগবে সেই চার দফা দাবীর মধ্যে কোথাও এই প্রাতিষ্ঠানিক লুম্পেনরাজ, লবিবাজী বন্ধ করার দাবী ছিল না। কর্তৃপক্ষকে শাস্তির আওতার মধ্যে আনার কোনো দাবী ছিল না। এক্ষেত্রে এই ‘অরাজনৈতিক’ ‘দলহীন’ দাবী করা ‘রাত দখল’-এর উদ্দেশ্য যে শাসক দলকে ‘সেফ পেসেজ’ দেওয়া— আমাদের কারওর কারওর সেই আশংকা এখানে এসেই তীব্র হয়ে ওঠে 

 

শাসকের বিরুদ্ধে কোনো লড়াই তো অরাজনৈতিক নয় ধর্ষণও নয়, তার বিচার চাওয়াও নয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে লুম্পেনরাজ বানিয়ে তোলার বিরুদ্ধের আন্দোলনের চেহারাও কখনো অরাজনৈতিক হতে পারে না এই কথাও স্পষ্ট অবস্থান নিয়ে বলা প্রয়োজন, এই মুহূর্তে যে অরাজনৈতিক, সেও সুযোগসন্ধানী। 

 

এখানে আরেকটি বিষয়ও বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, সাধারণ গণমানুষের ক্রোধ কিন্তু ‘অরাজনৈতিক’ হওয়া বা ‘দলহীন’ হওয়া দাবী করছে না তাঁরা খুব স্পষ্টভাবেই জানেন খুন, ধর্ষণ কারা কেন করেছে তাঁরা স্পষ্টভাবেই মমতা সরকারের কাছে এর জবাব চাইছেন নিজেরাই ভুক্তভোগী তাঁরা এক মহিলা চিকিৎসকের নৃশংস মৃত্যু তাঁদের পথে নামিয়ে এনেছে এতদিনের সহ্যক্ষমতা ভাঙিয়ে ‘অরাজনৈতিক’ এবং ‘দলবিহীন’ শর্তটি ‘রাত দখল-অধিকার দখল’-এর বিবিধ উদ্যোক্তারা বেঁধে দিচ্ছেন তাঁরাই বলছেন ‘রাজনৈতিক প্রশ্ন বা সরাসরি কর্তৃপক্ষ এবং মাথাদের ধরার দাবী তথা মুখ্যমন্ত্রীকে ঘটনার দায় নিতে চাপ দিলে’ ভীষণ রাজনীতি এসে যাবে গোটা বিষয়টায় এবং সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে জমায়েতে যোগ দেবেন না অথচ টেলিভিশনের পর্দা থেকে সোশ্যাল মিডিয়াগুলোর ইতিউতি চোখ বুলালেই গণমানুষের মমতা সরকারের উপর সরাসরি ক্রোধ দেখতে পাওয়া যায় 

 

সেলিব্রেটি থেকে ‘রাত দখল’ আন্দোলনের বৃহদাংশ, বারবার বলছেন ‘রাজনীতি করবেন না’, ‘অরাজনৈতিক আন্দোলন আমরা চালিয়ে যাচ্ছি’ ইত্যাদি প্রভৃতি ১৭ আগস্ট মুখ্যমন্ত্রীর রাজনৈতিক দলও আন্দোলন করেছে ‘জাস্টিস’ চেয়ে বর্তমান শাসক দলের অপশাসনে তিতিবিরক্ত, ক্ষুব্ধ সাধারণ নাগরিকরা, যাঁরা রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে নির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে উদগ্রীব, তাঁরা এই অরাজনৈতিক আন্দোলনের পর আবার না দিগ্‌ভ্রান্ত হয়ে যান, সেই আশংকাও থাকে। 

 

এসব প্রশ্নের মাঝেও অরাজনৈতিক ‘মেয়েদের রাত দখল’-এ যে দাবিগুলি থাকা প্রয়োজনীয় ছিল: 

 

১. পুলিশ কমিশনারের পদত্যাগ

২. মুখ্যমন্ত্রীই যেখানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী, সেখানে এই ঘটনার প্রশাসনিক ব্যর্থতার দায় নিয়ে তাঁর পদত্যাগ

৩. আরজি কর মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ কার ক্ষমতায় এতো ক্ষমতাবান হয়ে উঠলেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে এতো অভিযোগ এতদিন থেকে ওঠা সত্ত্বেও তাকে সুরক্ষা কারা দিচ্ছে তাদের প্রত্যেকের নাম সামনে আনা এবং তাদের শাস্তিও সুনিশ্চিত করা 

৪. আরজি কর মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ কার অঙ্গুলিহেলনে পদত্যাগ করার চার ঘন্টার মধ্যে প্রমোশন পান, তাঁর নাম সামনে আনা এবং শাস্তির ব্যবস্থা করা 

৫. কার নির্দেশে এই নৃশংস খুন-ধর্ষণকে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করা হয়েছিল তার শাস্তিও সুনিশ্চিত করা 

 

‘রাত দখল’ আন্দোলনের উদ্যোক্তাদের সমস্ত দাবিসনদে রয়েছে পিতৃতান্ত্রিক ধর্ষণ, পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামো যা ধর্ষণ-সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখে তার পরিবর্তন, আরজি কর-এর ভিক্টিম সহ ধর্ষণ ও হত্যার শিকার সকল মেয়ে, ট্রান্স ও ক্যুইয়ার মানুষের জন্য ন্যায়বিচার এবং কর্মক্ষেত্রে ও সমাজে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, কর্মরত মেয়েদের সন্তানদের জন্য সুলভ নিরাপদ ক্রেশ-স্কুল চালানো, গৃহনির্যাতিত ও কর্মরত মেয়েদের সরকারি সুলভ হস্টেল বানানো, এলাকায় এলাকায় অভয়া ব্রিগেড তৈরি করা ইত্যাদি। যার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যজোড়া প্রাতিষ্ঠানিক খুন, তৃণমূলের সন্ত্রাসরাজ কায়েম, প্রাতিষ্ঠানিক লবিবাজী, সিন্ডিকেট, অভিযোগ করলেও বিচার না পাওয়া ইত্যাদি যাবতীয় বাস্তব ঘটনার কোনো সমাধান চাওয়া এখনও পর্যন্ত চোখে পড়ছে না।  

 

এবারে আরজি কর কান্ড নিয়েও তাঁরা দাবী জানিয়ে কিছু পয়েন্ট উল্লেখ করেছেন  

 

১) তাঁরা রাতের দখলের আন্দোলনের পক্ষ থেকে আর জি করের ন্যায়বিচারের আন্দোলনকে পূর্ণ সংহতি জানাচ্ছেন (প্রশ্ন জাগে তাহলে তাঁরা অরাজনৈতিকভাবে কিসের ন্যায়বিচারের আন্দোলন-জমায়েত করেছিলেন বা করে চলেছেন?) 

২)  ১৪ আগস্ট রাত দখলের রাতেই আরজি কর ও এন আর এস হাসপাতালে, আন্দোলনকে দমিয়ে দেওয়ার জন্য ও প্রমাণ লোপাটের জন্য সরকারি ও পুলিসি মদতে যে ঘৃণ্য আক্রমণ চলেছে, তাকে তাঁরা ধিক্কার জানাচ্ছেন যাদের নির্দেশে রাষ্ট্রীয় মদতপুষ্টএই ঘটনা ঘটানো হয়েছে তাদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করার এবং আরজি কর-এ সে রাতে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ-প্রশাসনের আধিকারিকদের বিরুদ্ধে তদন্ত করার দাবী জানাচ্ছেন৷ (কে করবেন? পুলিশমন্ত্রী? নিজেই মিছিল-ধর্ণা করছেন!)  

৩)  সিবিআই-কে আরজি কর ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার স্বচ্ছ, দ্রুত তদন্ত করতে এবং দু সপ্তাহের মধ্যে চার্জশিট জমা দেওয়ার দাবী করছন (এখানে প্রশ্ন জাগে, সিবিআইকে স্বচ্ছ তদন্তের কথা সেই রাজ্যের মানুষ বলছেন, যাঁরা সারদা-নারদার সিবিআই-ইডি তদন্তের পর কেন্দ্র সরকার আর রাজ্য সরকারের গট-আপ খেলা দেখেছেন সারদা কেলেঙ্কারির একজন মানুষও আজ পর্যন্ত ন্যায় পাননি দেউলিয়া হওয়া বাদে, আত্মহত্যা বাদে নারদা কান্ডে বান্ডিল বান্ডিল টাকা নিতে অন ক্যামেরা যাদের দেখা গেল তারা হয় এখন কেন্দ্রের শাসক দলে অথবা রাজ্যের শাসক দলের সদস্য। আরজি কর কান্ডে এই দায়সারা দাবীর বদলে এই দাবী হওয়া কি উচিত ছিল না, আরজি কর ভিক্টিম নিয়ে সঠিক সিবিআই তদন্তের পর পূর্ণাঙ্গ তদন্ত রিপোর্ট যেন জনগনের সামনে প্রকাশ করা হয়? তাতে উল্লেখিত সমস্ত দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করা হয় কোনো রাজনৈতিক আশ্রয় না দিয়ে? ) 

৪) রাজ্য সরকারকে সরকারি হাসপাতালগুলিতে চলা দুর্নীতি চক্র সমূলে নিকেশ করতে হবে 

৫) স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে আর জি করের ঘটনার দায় স্বীকার করে অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে এবং পূর্ণ সময়ের স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিয়োগ করতে হবে 

 

কোনও আন্দোলনের পিছনে রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং স্পষ্ট রাজনৈতিক উচ্চারণ না থাকলে সেই আন্দোলন মুখ থুবড়ে পরে তার উদাহরণ আরজি কর কান্ডের প্রথম দিনের ঘটনা প্রবাহ আরজি কর-এর বাইরে সেদিন যদি রাজনৈতিকভাবে ডিওয়াইএফআই, এসএফআই এইসমস্ত বাম সংগঠনের কর্মীরা লুকিয়ে ভিক্টিমের বডি নিয়ে যাওয়া গাড়ি না আটকাতেন, সেদিনই লাশ পাচার হয়ে হাথরসের মতো পুড়িয়ে ফেলা হতো সব ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া হতো আত্মহত্যার নামে রাজনীতি করবেন না বলা আর অরাজনৈতিক বলার মতো পরিস্থিতিটুকু আসতো না ক্রাইম সিন সেমিনার হলের পাশের কন্সট্রাকশনের দেওয়াল ভাঙাও হচ্ছিলো যেদিন সেদিনও স্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান নেওয়া ছাত্র-ছাত্রী-যুবরাই তা আটকেছেন মারধর খেয়েও আরজি কর-এর সামনে লাগাতার ধর্ণায়ও বসে আছেন সমস্ত ঘটনাক্রমের শাসকের কাছে স্পষ্ট রাজনৈতিক উত্তর দাবী করা মানুষেরাই ক্রাইম স্পট আরজি কর মেডিকেল কলেজেই ‘মেয়েদের রাত দখল’-এর ডাক দিয়েছেন সমস্ত নাগরিকদের আহ্বান জানিয়ে 

 

আমরা সিলেটিতে একটা কথা বলি, ‘হ্যাডম’, শব্দটির ভাবার্থ প্রমিত বাংলায় প্রমিত মানুষদের জন্য বলে দেওয়া থাক— ক্ষমতা, সাহস অরাজনৈতিকদের হ্যাডম নাই, স্বাস্থ্যমন্ত্রী যিনিই কিনা মুখ্যমন্ত্রী— তাঁর পদত্যাগ চাওয়ার অরাজনৈতিকদের হ্যাডম নাই পুলিশ থানা ঘেরাও করে এটা বলার যে প্রথমে আত্মহত্যা কার নির্দেশে মিডিয়া এবং বাড়ির লোককে বলা হয়েছিল অরাজনৈতিকদের হ্যাডম নাই মুখ্যমন্ত্রীর অফিস ঘেরাও করার অরাজনৈতিকদের হ্যাডম নাই আরজি কর-এর গেটের সামনে বিচার না পাওয়া না অবধি বসে থাকার  

 

এই শতধা-বিভক্ত দখল, আন্দোলন কি সরকারকে বাস্তবে চাপে ফেলতে পারছে? বিভিন্ন জেলায় মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত পথে নামছেন, তাঁদের প্রয়োজন রাজনৈতিক নেতৃত্ব যতদূর মনে পড়ে এনআরসি আন্দোলনের সময় এক মঞ্চের তলায়ই কলকাতা শহরের ভিতরে মেয়েদের জমায়েত ছিল কিন্তু এনআরসি তো কেন্দ্রের ইস্যু ছিলো আরজি কর তো আর মণিপুর বা উত্তরপ্রদেশে নয় সেখানে জমায়েত, বিপুল জমায়েত যদি লেসার ইভিলকে চাপে ফেলে দেয়, ২০২৬ বিধানসভা নির্বাচনের আগে কি এমনটাই ভাবছেন অনেকে?  

 

আমাদের স্মরণ রাখা প্রয়োজন, রাজনৈতিক ভাবে তৈরি হওয়া দূর্নীতি রাজের মোকাবিলা রাজনৈতিক ভাবেই করতে হয় ‘মেয়েদের রাত দখল’-এ যতদিন অব্দি না এই প্রচন্ড রাজনৈতিক প্রশ্নগুলো সরাসরি শাসকের উদ্দেশ্য উঠছে, ততোদিন  আজ সুজেট, কাল নির্ভয়া, পরশু মহিলা ডাক্তার, তরশু মহিলা নার্স, শিক্ষিকা, উকিল, কারখানা-ইঁট ভাটায় কাজ করা নারী, শ্রমিক নারী—রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের শিকার হতেই থাকবেন আর আমরা রাত দখল আন্দোলনেও নিজেদের বুক হ্যান্ড ব্যাগে ঢেকে থাকবো কনুইয়ের গুঁতো খেতে খেতে কেননা রাজনৈতিকভাবে তৈরী এই ব্যবস্থাকে আমরা অরাজনীতি দিয়ে মোকাবিলা করতে গেছি প্রাতিষ্ঠানিক খুনকে আমরা অরাজনীতি দিয়ে মোকাবিলা করতে গেছি প্রতিটি রাজনৈতিক স্ক্যামকে আমরা অরাজনীতি দিয়ে মোকাবিলা করতে গেছি আমরা চব্বিশ ঘন্টা, দিন-রাত সব মিলিয়ে সমস্ত মানুষ নিয়ে আরজি কর-এর সামনে বসে পড়তে পারিনি বিচারের রায় না হওয়া অব্দি বসে থাকতে পারিনি এক দফা এক দাবীতে সমস্বরে গর্জে উঠতে পারিনি শুরু থেকে, এখন যখন সে দাবি বিক্ষিপ্তভাবে উঠছে অসংখ্য আন্দোলনের মাঝে তা ধার হারাচ্ছে। 

 

আরজি কর কান্ডকে শুধুমাত্র নারীর উপর পুরুষের আধিপত্য হিসাবে দাগিয়ে দিলে একটি প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা, গাফিলতিকে, কর্তৃপক্ষের লুম্পেনরাজ আর সিন্ডিকেটরাজকে লঘু করে তোলা হয় আমাদের মনে রাখা দরকার এই প্রাতিষ্ঠানিক খুন – ধর্ষণের বিচার কোনো সহজ-সরল তিন দফা দাবিতে মিটিয়ে নেওয়া যায় না, তাতে ভিক্টিমের সঙ্গে চরমতম অন্যায়টি করা হয় 

 

সারা পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষী, স্বৈরাচারীরা গদি আঁকড়ে পড়ে থাকতে চায়, মানুষকেই তাকে টেনে নামাতে হয় এই উপমহাদেশের ইতিহাসও যুগে যুগে একই সাক্ষ্য বহন করে চলেছে ২০২৪-এ এসেও তাই পশ্চিমবঙ্গ তথা গোটা ভারতবর্ষের নিরিখে শামসুর রহমানের কবিতাটি আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে—

 

‘একটি শহর আজ কালকূটে নীল,
বিষধর সাপ তোর পদত্যাগ চাই’

 

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

Share this
Leave a Comment