ত্রিপুরার সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি, ব্যর্থ ডবল ইঞ্জিনের সরকার


  • September 1, 2024
  • (0 Comments)
  • 762 Views

বিজেপি-র ডবল ইঞ্জিনের সরকার ত্রিপুরায় বন্যা পরিস্থিতি সামলাতে ব্যর্থ। প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতি ও তার ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে এখনো রাজ্যের সিদ্ধান্ত জানা যায়নি। আর্থিকভাবে বহু মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। বহু মানুষ সহায় সম্বলহীন পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়িয়েছেন। সৌরব চক্রবর্ত্তীর প্রতিবেদন।

 

ত্রিপুরার সাম্প্রতিক বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে, অর্থাৎ জল বিপদসীমা থেকে নেমেছে, কিছু অঞ্চলে জল শুকিয়ে গিয়েছে, কিছু অঞ্চলে এখনো বাকি। আপাতদৃষ্টিতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মনে হলেও আদতে তা নয়। আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি, খাদ্যাভাব, ফসলের মারাত্মক ক্ষতি, পানীয় জলের সমস্যা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি সমস্ত ব্যবসা প্রায় ধসে যাওয়া, ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের সম্পূর্ণ চাষ জমি নষ্ট হয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে পরিকাঠামোগত নানান সমস্যায় জর্জরিত সমগ্র রাজ্য। যেহেতু ত্রিপুরা একটি প্রান্তিক রাজ্য, পাশাপাশি দেশের একটি প্রান্তিক কোণ উত্তর-পূর্বে অবস্থিত, সেহেতু জাতীয় সংবাদমাধ্যমের কাছে ত্রিপুরার বন্যার খবর তত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেনি। একথাও বলে রাখা প্রয়োজন, স্বাধীন সংবাদমাধ্যম ও স্বাধীন সাংবাদিকেরা বন্যার খবর ও পরিস্থিতি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে কার্পণ্য করেননি।

 

গত ১৭ আগস্ট থেকে বৃষ্টি শুরু হয় সারা রাজ্যে। ১৮ থেকে ২৪ আগস্ট প্রায় বিরামহীনভাবে ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয়। ফলে সারা রাজ্যের বিভিন্ন নদীতে জলস্তর বাড়তে থাকে। খোয়াই, শান্তিরবাজার, কুমারঘাট, বিশালগড়, কুমারঘাট, তেলিয়ামুড়া, কৈলাসহর, ধর্মনগর, সাব্রুম, উদয়পুর, সোনামুড়া, গণ্ডাছড়াসহ বহু জায়গা জলের নীচে ডুবতে শুরু করে। জাতীয় সড়ক বন্ধ হয়ে যায় জলের কারণে। ১৯ আগস্ট থেকে ক্রমান্বয়ে প্রায় আড়াই হাজারেরও বেশি জায়গায় ভূমিধ্বসের ঘটনা ঘটেছে। ২৫ আগস্ট রাজ্যে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার জানায় প্রাথমিক হিসেবে ক্ষতি ১৫ হাজার কোটি টাকা। ৫৭০টি ত্রাণ শিবিরে আশ্রিত ১ লক্ষ ৩০ হাজার ৪৮৬ মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন প্রায় ১৭ লক্ষ মানুষ। ৩০ আগস্ট গত শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত ৩২৯ টি ত্রাণ শিবির চালু রয়েছে, তাতে প্রায় ১৭,৯৩৯ জন মানুষ রয়েছেন। মৃত্যুর সংখ্যা এখন অবধি ৩২ জন। ২৫ আগস্ট জল কমতে শুরু করার পর ক্ষয়ক্ষতির ভয়ংকর রূপ সামনে আসে।

 

সরকারি হিসেব অনুসারে, প্রাণী সম্পদে ক্ষতি হয়েছে সাড়ে তেইশ কোটি টাকা। কৃষিতে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ১৮ কোটি টাকা। ফসল নষ্ট হয়েছে প্রায় ৯০ হাজার হেক্টর জমির। মৎস্য চাষে ক্ষতি হয়েছে ১৪৪২ কোটি টাকা। অমরপুর ও দক্ষিণ জেলা বাদে ২০৯টি স্কুলের ক্ষতি হয়েছে। বই নষ্ট হয়েছে ১২ হাজার শিক্ষার্থীর। শিক্ষা দপ্তরে ক্ষতির পরিমাণ ১১ কোটি টাকা। তথ্য অনুযায়ী ২০,২৮৯টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে ১,৬১০টি সম্পূর্ণ, ১,৬৩৩টি মারাত্মকভাবে এবং ১৭,০৪৬টি বাড়ি আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ছবি: অভিষেক দেববর্মা

৩০ আগস্ট, গত শুক্রবারই ত্রিপুরার রাজস্ব দপ্তরের সচিব ব্রিজেশ পাণ্ডে সাংবাদিক সম্মেলন করে বন্যার সর্বশেষ পরিস্থিতির কথা তুলে ধরেন। তিনি জানান, সাম্প্রতিক বন্যার পর প্রথমবারের মতো ৩০ আগসট সোনামুড়ায় গোমতী নদীর জলস্তর বন্যাস্তর থেকে নিচে নেমে এসেছে। গত শুক্রবার থেকে রাজ্যের ৯ হাজার ২৭৮টি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র পুনরায় চালু করা হয়েছে। বাকি ৯৩৬টি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র হোম রেশনের সুবিধা নিয়ে কাজ করছে। এখনও পর্যন্ত রাজ্যের ৪ হাজার ৭৩৪টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ৪,৫৯০টি বিদ্যালয় খোলা হয়েছে। ধলাই জেলা, সিপাহীজলা জেলা, গোমতী জেলা এবং দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলার ১৪৪টি বিদ্যালয় এখনও খোলা যায়নি। এছাড়া গত ২৭ আগস্ট থেকে কলেজগুলিতে পড়াশোনা ও প্রশাসনিক কাজকর্ম পুনরায় শুরু হয়েছে।

 

ব্রিজেশ পাণ্ডে আরও জানান, ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক কোর্সের চলতি সেমেস্টার পরীক্ষার দিনক্ষণ পুননির্ধারণ করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। সেই অনুসারে ২০২৪ সালের সমস্ত চলতি সেমেস্টার পরীক্ষা যা গত ১৩ আগস্ট, ২০২৪-এ শুরু হয়েছিল সেগুলি ২০ আগস্ট থেকে ২০২৪-এর সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে।

ছবি: অভিষেক দেববর্মা

ত্রিপুরায় এই বন্যা নিয়ন্ত্রণে রাজ্য সরকারের দুর্বলতা প্রত্যক্ষভাবে সামনে এসেছে। ১৭ আগস্ট থেকে অতিবৃষ্টির পূর্বাভাস পাওয়ার পরেও ত্রিপুরা রাজ্য প্রশাসন পর্যাপ্ত পরিমাণে ব্যবস্থা নেয়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ত্রিপুরা রাজ্য সরকারের এক উচ্চপদস্থ কর্তা গ্রাউন্ডজিরো-কে জানিয়েছেন, “সরকার এই বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত ছিল না। এখনো ড্যামেজ অ্যাসেসমেন্ট সঠিক ভাবে শুরু হয়নি। সরকারি তরফে ত্রাণ ছিল অপ্রতুল। বাধ্য হয়ে দুটো মহকুমার মহকুমা শাসককে এই বন্যা পরিস্থিতির মধ্যেই সরাতে হয়। সামগ্রিকভাবে সঠিকভাবে এগিয়ে না আসতে পারার ব্যর্থতা রাজ্যের সব ক’য়টি জেলার জেলা শাসকদের, কারণ ত্রাণ সহ বিপর্যয় মোকাবিলার সমস্ত কিছুই জেলাস্তরে তাদের মাধ্যমে হয়ে থাকে। এই বন্যা প্রমাণ করে দিয়েছে যে বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ ইত্যাদি যথেষ্ট পরিমাণে রাজ্যে মজুত নেই। সঠিক প্রশিক্ষণ না হওয়ার বিষয়টিও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিপর্যয় মোকাবিলা আইন খুবই নির্মম। অথচ যে সমস্ত সরকারি আধিকারিক এবং কর্মচারীদের সঠিক সময়ে কাজ শুরু না করার কারণে সাধারণ মানুষ যথেষ্ট দুর্ভোগের সম্মুখীন হয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। এক অর্থে সাধারণ প্রশাসনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনভিপ্রেত আচরণকে সরকার সাবস্ক্রাইব করে গেছে।”

 

ত্রিপুরা থেকে ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে রেকর্ড ভোটে বিজয়ী দুই সাংসদ বিপ্লব কুমার দেব ও কৃতি সিং-কে এই ভয়ংকর বন্যা পরিস্থিতিতে রাজ্যের কোথাও দেখা যায়নি। যদিও সাংসদ বিপ্লব কুমার দেব-কে তখন হরিয়ানায় দলীয় প্রচারে দেখা গিয়েছিল। বন্যার তীব্র প্রকোপের সময় দেখা মেলেনি তিপ্রা মথার সুপ্রিমো প্রদ্যোত কিশোর দেববর্মনের, যিনি ২০২৩ সালের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে বিরোধী ভোট বহুলাংশে ভেঙে দিয়ে বিজেপিকে ক্ষমতায় আসতে সাহায্য করেন এবং পরবর্তীতে বিজেপি সরকারে যোগ দেন।

 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই উচ্চপদস্থ সরকারী কর্তা আরও জানান, “অমরপুর সহ পুরো গোমতী জেলা সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মানুষজন বেশ কয়েকদিন পর্যন্ত ত্রাণ শিবিরে থেকেও খাবার, পানীয় জল পাননি। রাজ্যের গ্রামীণ অর্থনীতি সামনের দিনগুলোতে এক বড় বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে যাচ্ছে। কৃষকদের জন্য বিশেষ প্যাকেজ ঘোষণা করা সময়ের দাবি, এখনো কিছুই হয়নি। অনেকেই নিজের বসত ভিটা হারিয়েছেন। এখনো এদের জন্য সরকারের কোন পরিকল্পনা আছে বলে জানা যায়নি। রাজ্যের বিরোধী দলগুলোর অনেকাংশেই নীরব ভূমিকা এবং সরকারের ওপর যথেষ্ট চাপ তৈরি না করার কারণে সাধারণ মানুষ খুবই হতাশ।”

 

দশ দিনেরও বেশি সময় ধরে চলা এই বন্যার প্রকোপে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, গ্রামীণ এলাকার মানুষজন। যাদের রুজি-রুটির অধিকাংশই ঘিরে রেখেছে চাষবাস। দক্ষিণ ত্রিপুরায় ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ অনেকটা বেশি। কারণ বন্যার প্রকোপ অন্য জায়গার তুলনায় এই অঞ্চলেই বেশি ছিল। সরকারি সুবিধে এখনো প্রচুর জায়গায় পৌঁছায়নি। গ্রাউন্ডজিরো কথা বলেছিল স্বাধীন সাংবাদিক চন্দ্রিমা সরকারের সঙ্গে। চন্দ্রিমা জানান, “বহু ক্ষেত্রে সরকারি সুবিধে না পৌঁছানোর কারণে সাধারণ মানুষ নিজেরাই উদ্যোগ নিয়েছেন বিভিন্নভাবে। বহু ক্লাব, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, এনজিও একাজে সহায়তার জন্য এগিয়ে আসে। কিছু ক্ষেত্রে রান্না করা খাবার পরিবেশন করা হয়, কিছু ক্ষেত্রে রান্নার প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করা হয়। বিপদে মানুষের পাশে সবচেয়ে বেশি দাঁড়িয়েছেন তার পাশের মানুষটিই। আমরা নিজেরা ব্যক্তিগতভাবে আগরতলা শহরের বিভিন্ন জায়গায় গাড়ি নিয়ে গিয়ে তাঁদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পৌঁছে দিতে চেষ্টা করেছি। সবক্ষেত্রে পারিনি, তখন হয়তো অন্য একটি গ্রুপ সেই কাজটি করে দিয়েছে।”

ছবি: অভিষেক দেববর্মা

প্রয়োজনের সময়ে ত্রাণ পৌঁছায়নি, এই অভিযোগ বহু জায়গা থেকে এসেছে। বিরোধী দলনেতা জিতেন চৌধুরী বারবার এই অভিযোগ তুলেছেন। তাঁর মতে, “হার্বাতলি স্কুলপাড়ায় সরকারি কোন ত্রাণ এখনো সেই এলাকার মানুষের কাছে পৌঁছায়নি। সরকারিভাবে যে সমস্ত ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে তা সব হার্বাতলি কুশলচন্দ্র পাড়া পর্যন্ত দিয়ে ফিরে চলে যায়। হার্বাতলি এডিসি ভিলেজের প্রায় ৩০০ পরিবারের চারদিকে শুধু রাস্তার উপর ধস আর ধসে মানুষের বাড়িঘর ভেঙে পড়ে আছে। হার্বাতলি এডিসি ভিলেজের স্কুলপাড়া, বাজার পাড়া, চিতাবাড়ী, নলছড়ি, রতনমণি, এডিসি ভিলেজের ধূপছড়ি পুরানভিটা বড়টিলা, বেতাগা, পূর্ব টাকা,পশ্চিম টাকা এডিসি ভিলেজে দ্রুত ত্রাণ পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা জরুরী। বন্যাবিধ্বস্ত এলাকাগুলোতে পানীয় জলের ব্যবস্থা করা, স্বাস্থ্যবিধির জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্য আবশ্যক।”

 

প্রাকৃতিকভাবে ত্রিপুরা বন্যাপ্রবন অঞ্চল নয়। অত্যধিক বৃষ্টি বন্যার একটি বড় কারণ। সাধারণ বাসিন্দা, যারা দীর্ঘদিন ধরে ত্রিপুরায় থাকছেন, তাঁদের অনেকেরই অভিমত, এরকম ভয়ংকর পরিস্থিতি ত্রিপুরায় তৈরি হয়েছিল নব্বইয়ের দশকে। তারপর এরকম হয়নি। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ ছিল যে ১৯৯৩ সালের পর ২০২৪ সালে প্রথম ডম্বুরের বাঁধ খুলে দিতে হয়েছিল।

 

মূলত ত্রিপুরা রাজ্যকে বন্যা থেকে সুরক্ষা প্রদান এবং ডুম্বুর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের অধীনে বিদ্যুত সরবরাহ নিশ্চিত করতে ১৯৭০-এর দশকে গোমতী নদীর উপর ডম্বুর বাঁধ নির্মাণ হয়। ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা থেকে সড়ক পথে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরের ডম্বুর হ্রদআমবাসা থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গণ্ডাছড়া সাব ডিভিশনে অবস্থিত। হ্রদ টি দেখতে তীরের আকারের ছোট ড্রামের মতো, যা শিবের ‘ডমরু’ থেকে এসেছে, যেখান থেকে এই ‘ডম্বুর’ নামের উৎপত্তি।

 

এই অঞ্চলের পরিবেশ সংরক্ষণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছেন রাজ বসু, বিবিসি বাংলা-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, “রাইমা আর সরমা – এই দুটি ছোট নদী, ত্রিপুরার স্থানীয় ভাষায় যেগুলিকে বলা হয় ‘ছড়া’, এই তীর্থমুখ হ্রদে এসে মিশেছে। আবার সেখান থেকেই গোমতী নদীর উৎপত্তি। ত্রিপুরার বেশিরভাগ নদী বা ছড়ার মতোই এই গোমতীও স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের দিকে বয়ে গেছে। ওই হ্রদে প্রায় ৪৮টি ছোট ছোট দ্বীপ রয়েছে। শীতকালে এগুলিতে অনেক পরিযায়ী পাখিও আসে। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন স্থলও। বর্ষাকালে ত্রিপুরা বা উত্তর পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য এলাকায় অথবা বাংলাদেশের অভ্যন্তরের লাগোয়া এলাকাগুলোতে যেরকম ফ্লাড-প্লেইনস দেখা যায়, এটিও সেরকমই একটি অঞ্চল। বহু কাল ধরেই এই অঞ্চলটি তার জীববৈচিত্রের জন্য বিখ্যাত।” শুধুমাত্র গোমতী জেলায়, যেখানে গোমতী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের অধীন ডম্বুর জলাধার, সেই জেলায় অগাস্ট মাসে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা ১৯৬.৫ মিলিমিটার। এ বছর সেখানে বৃষ্টি হয়েছে ৬৫৬.৬ মিলিমিটার, যা স্বাভাবিকের চেয়ে ২৩৪% বেশি।

 

ত্রাণ শিবিরে বহু মানুষ রাতের পর রাত কাটিয়েছেন। তাঁদের অভিজ্ঞতাও ভয়াবহ। কল্যাণপুর ব্লকের বাগান বাজার এলাকার প্রৌঢ় দম্পতি বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ও গীতা চক্রবর্তী মাঝরাতে বাড়ি ছেড়ে অন্য জায়গায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। ঘরের ভেতরে তখন প্রায় হাঁটু জল। সঙ্গে নিতে পেরেছিলেন শুধু অতি প্রয়োজনীয় কিছু কাগজপত্র। বিলোনীয়ার বাসিন্দা কমল দেবনাথ গ্রাউন্ডজিরো-কে জানান, “এরকম বন্যা কোনোদিন দেখিনি, রাতের খাবার অবধি খেয়ে যেতে পারিনি, শিবিরে যেতে হয়। সেখানে খাবারের জল, খাবারের সমস্যা ছিল প্রবল।” গ্রাউন্ডজিরো কথা বলেছিল উদয়পুরের মাছ ব্যবসায়ী রঞ্জিত দেবের সাথে। তাঁর মতে, “চিকিৎসায় সরকার থেকে সাহায্য পাইনি। অনেকেই শিবিরের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পর্যাপ্ত পরিমাণে ওষুধ, পানীয় জলের প্রবল সমস্যা হয়েছে।”

 

এরকম অবস্থায় একজন সাধারণ মানুষ প্রথমে তার পাশের বাড়ির মানুষটির কাছেই সাহায্য চান। বন্যার কবলে পড়ে ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নেওয়া বহু মানুষ এমনটাই জানিয়েছেন। সরকারি ত্রাণ আসতে সময় লেগেছিল, কিন্তু মানুষ অপেক্ষা করে থাকেনি, পাশের এলাকার মানুষটিকে বিনা প্রশ্নে সাহায্য করতে পৌঁছে গিয়েছেন। যে কারণে প্রাণ হারাবার সংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা গিয়েছে। গ্রাউন্ডজিরো-কে দূরভাষে শিক্ষক নীলয় সরকার জানিয়েছেন, “আমার বাড়ি রামনগরে, অন্যান্য বাড়িঘরের মতো আমাদের বাড়িতেও জল উঠেছিল। কিন্তু প্রতিবেশী কাটাখাল পাড়ের বাড়িগুলি চার, পাঁচদিন জলের নিচে ছিল। ঐ এলাকাবাসী প্রায় সবাই-ই আশেপাশের স্কুলগুলিতে আশ্রয় নিয়েছিল। বর্ডার গোলচক্কর, রামপুর, কালিকাপুরও চার, পাঁচদিন কোমর সমান জলে দিন কাটিয়েছে। আমরা প্রধানত উমাকান্ত একাডেমী অ্যালামনি-র তরফে বর্ডার গোলচক্করে আড়াইশো প্যাকেটের মত শুকনো খাবার দাবার দিয়েছি। কর্মচারি সংগঠন টিইসিসি (এইচ বি রোড) এরসঙ্গে যোগেন্দ্রনগর শ্রীলঙ্কা বস্তি, মুসলিম পাড়া ইত্যাদি এলাকায় পাঁচশ প্যাকেট খাদ্যসামগ্রী বিলি করি।”

 

বিজেপি-র ডবল ইঞ্জিনের সরকার ত্রিপুরায় এই বন্যা পরিস্থিতি সামলাতে ব্যর্থ। প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতি ও তার ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে এখনো রাজ্যের সিদ্ধান্ত জানা যায়নি। আর্থিকভাবে বহু মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। বহু মানুষ সহায় সম্বলহীন পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়িয়েছেন। এই অবস্থায় সরকার কী সিদ্ধান্ত নেয় তার দিকেই সকলে তাকিয়ে আছে, সরকার পাশে না দাঁড়ালে অচিরেই তাদের ভয়ানক বিপদে পড়তে হবে।

 

ছবি: অভিষেক দেববর্মা

 

Share this
Leave a Comment