আজ আমাদের নিজেদের প্রশ্ন করতে হবে, কোথায় ছিল আমাদের এই বিবেকবোধ, রাগ যখন আমাদের দেশের সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে কাশ্মীরে ঘটেছিলো কুনান-পোশপোড়া। কোথায় ছিল আমাদের এই রাগ যখন প্রায় একাকী লড়ছিলেন বিলকিস বানো। কোথায় ছিল আমাদের এই চোখের জল, ক্রোধ যখন মনিপুরের মায়েরা থাঙ্গাম মনোরমার খুন ও ধর্ষণের প্রতিবাদ করেছিলেন সেনাবাহিনীর হেডকোয়ার্টারের সামনে নগ্ন হয়ে। আর.জি.করের দুষ্কৃতীদের শাস্তি চাই। চাই আরও অনেক কিছু। কিন্তু, এই প্রশ্নগুলো যদি নিজেরা নিজেদের করতে না পারি, তাহলে যতই আত্মশ্লাঘা বোধ করি না কেন “রাত দখল”– এর কর্মসূচি নিয়ে, কিংবা জীবনে প্রথম পথে নামা নিয়ে, আমি বা আমরা আসলে সমস্যা, সমাধান নই। লিখেছেন নন্দিনী ধর।
আমার বেঁচে থাকার জগৎ প্রগাঢ়ভাবে মধ্যবিত্ত। গত দেড় সপ্তাহ ধরে, সেই মধ্যবিত্ত জগতের যে বুনোট, সেখানে গভীরভাবে ধাক্কা লেগেছে। কলকাতার আর.জি.কর হাসপাতালের তরুণী চিকিৎসকের খুন ও ধর্ষণকে ঘিরে তৈরী হয়েছে এক জাতীয় অস্থিরতা। যেহেতু ঘটনাটি এখন সবারই জানা, কাজেই তার বিশদ বর্ণনায় আর যাচ্ছি না। বরং, কথা বলি এই ঘটনাটিকে ঘিরে আমার পরিচিত মধ্যবিত্ত জগতের প্রতিক্রিয়াকে ঘিরে।
আমার মধ্যবিত্ত বান্ধবীরা — যাঁরা আমারই মতন প্রগাঢ়ভাবে মধ্যবিত্ত, পেশাজীবী, সুসংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক, “ভালো” বই পড়েন, গান শোনেন, “ভালো” সিনেমা দেখেন — তাঁরা আমায় ফোন করেন, মেসেজ করেন। কেউ বলেন, “ঘটনাটা শোনার পর থেকে ঘুমোতে পারছি না রে।” কেউ কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “আমার মেয়েটাও তো বড়ো হচ্ছে। চাই যে ও ভালো চাকরি করুক, নিজের পায়ে দাঁড়াক। কিন্তু, এই অবস্থা হলে কি করবো রে ?” কেউ বা বলেন, “আমার ভাইঝিটা ঠিক ওই ডাক্তার মেয়েটার বয়সী রে। সে তো প্রায় খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। ঘুমোতে পারে না রাতে।” আরও এক বান্ধবী বলে, “আমি মেয়েটির মা হলে পাগল হয়ে যেতাম।” আমরা একে অন্যেকে সমবেদনা জানাই। একসঙ্গে চোখের জল ফেলি। আর আমার মতন মাতৃত্ব প্রত্যাখ্যান করা মেয়ে, ভয় পাই। ভয় পাই ছাত্রীদের জন্য, ভাইঝি-বোনঝিদের জন্য, বন্ধুকন্যাদের জন্য। নিজের জন্য। বান্ধবীদের জন্য। নিজের জন্য।
আর, নিজের মুখটা আয়নার সামনে ধরি। থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে হয় সেই মুখে। থুথু দিতে ইচ্ছে হয় সেই মুখে। আমার বান্ধবীদেরও বা তাদের মেয়েদের কারুরও কি সেই ইচ্ছা হয়েছিল? হয়? জানি না।
তো, দিন তিনেক ধরে যখন এইসব মেসেজ চালাচালি করছি আমরা, ঠিক তখনই ডাক আসে চোদ্দই আগস্ট “রাত দখল”- এর। এর আগে যে মিছিল-মিটিং হয়নি, তা নয়। বিশেষত, ডাক্তারি পড়া ছাত্রছাত্রীরা লাগাতার প্রতিবাদ কর্মসূচি নিয়েছেন, নিজেদের মতন করে নিজেদের সংগঠিত করেছেন, তদন্ত ও দোষীদের শাস্তির দাবি করেছেন কর্তৃপক্ষ ও রাষ্ট্রের কাছে। কিন্তু, চোদ্দ তারিখের অনুষ্ঠান আমাদের সবাইকে একটি দিশা দেখায়। একটা কর্মসূচি সামনে হাজির করে। “রাত দখল” বাক্যবন্ধটির ভেতরে কাব্য আছে। বাঙালি কবিতাপ্রিয় জাত। “মেয়েদের রাত দখল”– এই বাক্যবন্ধের ভেতরে আছে কবিতা, তার সঙ্গে প্রতিবাদ। নবারুণ ভট্টাচার্যের ভীষণ রাগে শহর উথালপাথাল করে যুদ্ধ হওয়ার কবিতা পড়া বাঙালি মেয়ে, যে হয়তো বা এতদিন ঠিক নিজেকে ওই কবিতার খোলসে দেখতে চেয়েও পায়নি, সে একটি কর্মসূচি পায়। প্রতিবাদের, রাগের অভিব্যক্তির। হোক না সে “রাত দখল” পুলিশ প্রহরায়। হোক না সেই “রাত দখল” ওলা-উবের-রাষ্টের সহায়তায় একটি স্পেকটাকেল। আমরা তখন সমাজ হিসেবে সেসবকে অগ্রাহ্য করে প্রতিবাদ-প্রতিবাদ-প্রতিবাদ নাটকের কুশীলব।
আর, অসুবিধা নেই। এই প্রতিবাদে বাপ-ভাই-দাদা-নেতা-পাড়ার দাদা সবাই পাশে। যে বাবা দিল্লি বর্ডারে কৃষক আন্দোলনে মেয়ে সশরীরে হাজির থাকতে চেয়েছিলো বলে ভীষণ রেগে গিয়েছিলো, সেই বাবা-ই এখন মেয়েকে বলছে, “যা মা, তোদের গলা খোলার সময় এসেছে। প্রতিবাদ কর, রাস্তার দখল নে।” যে দাদা ছোটবোন এন.আর.সি-বিরোধী লড়াইয়ে থাকছে বলে বলেছিলো, “ওই মুসলমানগুলো চিরতরে দেশছাড়া হলে মন্দ হয় না। লজ্জা করে না তোর রোজ ওইখানে গিয়ে নাচানাচি জুড়েছিস? এক থাপ্পড়ে ঘুচিয়ে দেব তোর আজাদী,” সে চোদ্দ তারিখ রাতে বোনকে স্কুটারের পেছনে চাপিয়ে পৌঁছে দেয় প্রতিবাদস্থলে। আমরা উৎসাহিত হই ভয়ঙ্করভাবে। এই তো পিতৃতন্ত্র ধ্বংসের মুখে। আবার কেউ কেউ ভাবি, “এই তো এত্তো এত্তো মানুষ রাস্তায়। বিপ্লব আমার দোরগোড়ায়।”
তবে, সব ইতিবাচকতারই থাকে নিন্দুক। আমি সাধারণভাবে যে কোনো ক্ষেত্রে নিন্দুকের ভূমিকা পালন করে থাকি। তো, এক্ষেত্রেও সেই দায়িত্ব সগর্বে কাঁধে তুলে নিই। খিস্তি খাই। তবে, নিন্দুক হওয়ায় যেহেতু আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, ওই ফেসবুকীয় খিস্তি আমায় বিশেষ কুপোকাত করতে পারে না। হ্যাঁ, স্পষ্ট করে বলি, আমি সেই স্বল্প সংখ্যক মেয়েদের মধ্যে একজন, যারা ওই চোদ্দ তারিখের মধ্যরাত্রের রাজ্যজোড়া প্রতিবাদের ঢেউয়ে গা ভাসাতে পারিনি।
আর.জি.কর-এর ঘটনার গা-হিম করা বীভৎসতার পরেও পারিনি। গোটা ঘটনাটিকে ঘিরে পশ্চিমবঙ্গের সরকারে থাকা রাজনৈতিক দলটির চূড়ান্ত অসততা দেখা ও বোঝার পরেও পারিনি। চোদ্দ তারিখের রাতের এতো এতো মানুষের ক্রোধ, এতো এতো মেয়েদের ক্ষোভ ফেটে পড়ার চিত্রকে সম্মান জানিয়েও, গা ভাসাতে পারিনি এই প্রতিবাদে।
বরং, ভেবেছি এক দশকেরও আগে ঘটে যাওয়া আর একটি ধর্ষণ ও খুনের কথা। হ্যাঁ, আমি দিল্লি ধর্ষণ কাণ্ডের কথা বলছি। যে ঘটনায় ১৬ই ডিসেম্বর ২০১২ সালে একটি প্রাইভেট বাসের ভিতরে নৃশংসভাবে ধর্ষিত হন বাইশ বছর বয়সের এক তরুণী। গুরুতরভাবে আহত হন তাঁর সঙ্গী বন্ধু। যেহেতু ভারতবর্ষে ধর্ষিতার নাম ব্যবহার আইনত নিষিদ্ধ, তাই মিডিয়া তাঁর একটি নামকরণ করে — নির্ভয়া। “নির্ভয়া রেপ কেস” নামেই পরিচিত হয় ঘটনাটি। যদিও, পরবর্তী সময়ে “নির্ভয়া”-র পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁর নাম প্রকাশ করা হয় — জ্যোতি সিং পাণ্ডে। তিনি ছিলেন ফিজিওথেরাপির একটি কোর্সের ছাত্রী। ঠিক কি ঘটেছিলো জ্যোতির সাথে, সে কথা বহুল প্রচারিত। গুগল করলে পাওয়া যাবে অসংখ্য আন্তর্জালিক লিংক। কাজেই, সেইসমস্ত ধারাবিবরণীতে গিয়ে লেখাটিকে ভারাক্রান্ত করবো না।
বরং, যেটা এক্ষেত্রে উল্লেখ করতে চাই, তা হলো, ঠিক আমাদের আজকের সময়ের মতনই দিল্লি ও পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলি ক্ষোভে ফেটে পড়ে। দেশের অন্যত্রও জোরদার প্রতিবাদ হয়। কাতারে কাতারে মানুষ পথে বেরোন। ঠিক ২০২৪ সালের আগস্ট মাসের কলকাতার মতনই। সংঘর্ষ বাঁধে পুলিশের সঙ্গে। পথে নামেন বহু বহু মহিলারা — বিভিন্ন বয়সের। তাঁরা আগে কোনোদিন পথে নামেননি। পরেও নেমেছেন কি? আমরা জানি না। খোঁজ রাখিনি। জনরোষের চাপে পড়ে বাস চালকসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়। জনপ্রিয় মৃত্যুদণ্ডের দাবি মেনে নিয়েই, তাদের বিচার হয় ও অবশেষে ফাঁসি হয়। একভাবে দেখতে গেলে, এই যে জনপ্রিয় আন্দোলন, জ্যোতির ধর্ষণ ও মৃত্যুকে ঘিরে, তার জয় হয়।
আর.জি.কর-এর তরুণীর নাম রাখা হয়েছে “অভয়া”। তাতে কি “নির্ভয়া” নামকরণেরই অনুরণন? ঠিক যেমনভাবে আর.জি কর ঘটনার পরে একটি বড়ো অংশের দিক থেকে দাবি উঠেছে যে এই সময়ের ধর্ষণ-বিরোধী লড়াইকে হতে হবে মূলতঃ অরাজনৈতিক, তেমনি ২০১২ সালের দিল্লির যে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন, তার চরিত্রও ছিল মূলত “অরাজনৈতিক” — অর্থাৎ, কোনো রাজনৈতিক দলীয় পতাকাতলে সেই লড়াই হয়নি। আন্দোলন সক্রিয় থাকাকালীন বিভিন্ন ধরনের সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে বেরিয়েছিল জ্যোতি সিংয়ের ব্যক্তিগত জীবনপঞ্জি। ঠিক কেমন মেয়ে ছিলেন জ্যোতি সিং, কী পরতেন, কী ভালোবাসতেন, পরিবারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কেমন, সঙ্গের বন্ধুটির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কেমন।
সেসব পড়তে পড়তে আমরা জানতে পারি, জ্যোতি সিং নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে। কষ্ট করে পড়াশুনা শিখে চেয়েছিলেন পরিবারটিকে দাঁড় করাতে। জানতে পারি, সেই রাতে, জ্যোতি সিং গিয়েছিলেন একটি মল-এর মাল্টিপ্লেক্স-এ — হলিউডি সিনেমা দেখতে। আমার দিল্লিবাসী ছাত্রীরা যেমন বলেছিলো আমায়, “ম্যাম, ওই মলে-ই আমরাও সিনেমা দেখতে যাই। হয়তো সেইদিনও গিয়েছিলাম। হতেই পারতাম আমরা জ্যোতি সিং। হতেই পারি যে কোনোদিন আমরা জ্যোতি সিং।” অর্থাৎ, আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই, নিজের অজান্তে জ্যোতি সিংয়ের সাথে একাত্ম হতে শুরু করি। জ্যোতি সিং আমাদের ঘরের মেয়ে হয়ে ওঠেন। জ্যোতি সিং-এর ভেতরে আমরা — আবারো নিজেদের অজান্তেই হয়তো — দেখতে পাই একজাতীয় নয়া-উদারনৈতিক চেতনা। যে উদারনৈতিক চেতনা আমাদের স্বস্তি দেয়। স্বস্তি দেয় আমাদের জ্যোতির নিজের পায়ে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা, নিজের পরিবারটিকে নিম্নবিত্ত অবস্থান থেকে মধ্যবিত্ত করে তোলার প্রচেষ্টা। স্বস্তি দেয় আমাদের জ্যোতির মল-এ যাওয়ার, মাল্টিপ্লেক্স-এ যাওয়ার গল্প। এসবের ভেতরে কোনো আতিশয্য নেই, সমাজকে প্রশ্ন করার প্রয়াস নেই। এসবের সঙ্গে এও জ্যোতি সিং যে ব্রাহ্মণকন্যা, তা আমাদের ধাক্কা দেয়। জ্যোতি সিংয়ের মৃত্যুতে, ধর্ষণে, অত্যাচারে আমরা দেখি আক্রান্ত ব্রাহ্মণ্যবাদ। হয়তো, দেখি আক্রান্ত ভারতমাতাও। তাই, ইজরাইলি-ব্রিটিশ চিত্রনির্মাতা জ্যোতি সিংয়ের উপর বানানো তথ্যচিত্রের নাম দেন, “ইন্ডিয়া’স ডটার।”
আবারো বলি, জ্যোতি সিংয়ের ধর্ষণ ও মৃত্যুতে আমরা, অর্থাৎ, ভারতীয় মধ্যবিত্ত উচ্চবর্ণীয় সমাজ নিজেরা আক্রান্ত বোধ করি।
এবার ফিরে আসি আর.জি কর-এর ঘটনায়। আক্রান্ত ও মৃতা ডাক্তার। মিডিয়া আমাদের জানায়, তাঁর প্রাপ্ত নম্বর। জানায়, তিনিও ছিলেন নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। জানান, সম্প্রতি একটি গাড়ি কিনেছিলেন তিনি। জানান, তাঁর আছে এক প্রেমিক-বন্ধু। তিনিও ডাক্তার। তো, এই যে এতসব ছোট ছোট তথ্য, তার ভেতর দিয়ে আমরা আশ্বস্ত হই। আশ্বস্ত হই, ভরসা পাই প্রচলিত অর্থনৈতিক অবস্থায় — পড়াশুনা ভালো করে করলে এখনো গরিব মানুষ সমাজে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে। তাঁর নতুন কেনা গাড়িতে আমরা পাই পণ্যশোভিত বাজারের হাতছানি মেনে চলার স্বস্তি, শ্রেণী-অবস্থানে ওপরে ওঠার হাতছানির স্বস্তি। যাকে সমাজতত্ত্বের পরিভাষায় বলে, ক্লাস মবিলিটি।
কাজেই, আবারো, ঠিক জ্যোতি সিংয়ের ধর্ষণ ও মৃত্যুর মতনই, আর.জি.কর-এর তরুণী ডাক্তারের মৃত্যু, আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণীবোধে ধাক্কা দেয়। আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনবোধ, মূল্যবোধকে আক্রান্ত করে। আমরা নিজেদের অজান্তেই একাত্ম হই তার সঙ্গে।
আমরা মধ্যবিত্ত মেয়েরা, পেশাজীবী মেয়েরা একাত্ম বোধ করি তাঁর সাথে। ক্রোধান্বিত হই, কাঁদি, রাতের ঘুম মাথায় ওঠে আমাদের। এই যে আমাদের তীব্র অশান্তি, তার ভেতরে যতটা না আছে পিতৃতন্ত্রবিরোধী চেতনা, তার থেকে অনেক মাত্রায় বেশি আছে আক্রান্ত শ্রেণীবোধ।
যে আক্রান্ত শ্রেণীবোধ নিজেকে প্রকাশ করে পিতৃতন্ত্রবিরোধী ভাষার ভেতর দিয়ে।
আমাদের দৃষ্টিটা ঘোরানো যাক আর একটু অন্য দিকে। বলি আর একটি নাম। সোনি সোরি। ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে — অর্থাৎ, “নির্ভয়া” ঘটনার প্রায় ঠিক অব্যবহিত আগেই — তিনি গ্রেফতার হন। সোনি বস্তার অঞ্চলের মেয়ে, গ্রেফতার হন মাওবাদী সন্দেহে। পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন নির্যাতিত হন, অত্যাচারিত হন। সেই অত্যাচারের ভাষা যৌনায়িত, তাকে ধর্ষণ বলা-ই যেতে পারে। কলকাতা মেডিকেল কলেজে সোনি ভর্তি থাকাকালীন, তাঁর যৌনাঙ্গে পাওয়া যায় পাথর। সোনি সোরির ঘটনাটিও বহুল প্রচারিত। গুগল করলে পাওয়া যাবে বিশদ তথ্যাদি। কাজেই, সেসবের পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছি না আর এই লেখাটিতে।
সোনি গ্রেফতার হয়েছিলেন দিল্লি থেকে। কিন্তু, তাঁর হেফাজতে অত্যাচার, যৌন নিগ্রহ বা ধর্ষণ, কোনোটাই আমাদের সামাজিক ভাবে রাগিয়ে তোলেনি, কাঁদায়নি, রাতের ঘুম কেড়ে নেয়নি। আমরা পথে নামিনি তাঁর জন্য। “রাত দখল” -এর ডাক দিইনি। এমনকি, ২০১২ সালে, অঙ্কিত গর্গ নামের যে পুলিশ অফিসার, যিনি ছিলেন সোনি সোরি কাণ্ডের অন্যতম অভিযুক্ত, সরকারের কাছ থেকে গ্যালানট্রি পদক পান, আমরা পথে নামিনি। আমরা কাঁদিনি। নিজেদের মেয়ে, ছাত্রী, ভাইঝি, বোনঝি, ভাগ্নিদের কথা ভেবে আতঙ্কিত হইনি।
কারণ, সোনি আদিবাসী মেয়ে। কারণ, সোনি গ্রেফতার হয়েছিলেন মাওবাদী সন্দেহে। কারণ, দিল্লি থেকে ছত্তিসগড়ের দূরত্ব অনেক।
আর, এই যে এতসব পার্থক্য, তা আমাদের সোনির সঙ্গে একাত্ম হতে দেয় না। আমরা একাত্ম হই না তাঁর আদিবাসী পরিচিতির সঙ্গে। আমরা একাত্ম হই না তাঁর জীবনের জটিল রাজনীতির সঙ্গে।
আমরা জানি, আমরা সোনি সোরি নই। হবোও না কোনোদিন। সোনি সোরি হবেন না আমাদের পরিচিত মেয়েরা, আমাদের ভালোবাসার জনেরা।
সোনির সামনে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে যায় তাই আমাদের পিতৃতন্ত্র-বিরোধিতার ভাষা, ধর্ষণ-বিরোধিতার আন্দোলন। জয়ী হয় আমাদের “অপরত্বের” রাজনীতি, সেই রাজনীতিজাত চেতনাবোধ। আমরা নীরব থাকি।
তেমনি ঠিক দু’বছর ও কয়েক মাস আগে বাংলার বুকে ঘটা হাঁসখালির ঘটনা আমাদের চেতনাকে আক্রান্ত করে না। যদিও, সেই ঘটনার বুনোটেও প্রায় একইভাবে জড়িয়ে ছিল রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা দলের হস্তক্ষেপ। সেখানেও পরিবারের সদস্যদের ভাওতা দিয়ে, জবরদস্তি করে পুড়িয়ে দেওয়া হয় নিগৃহীতা কিশোরীর দেহ।
না, আমরা কাঁদিনি। আমরা পথে নামিনি। আমরা দিব্যি ঘুমোতে পেরেছিলাম রাতে। বড়োজোর, নিজেদের ঔচিত্যবোধ অটুট রাখতে সামাজিক গণমাধ্যমে শেয়ার করেছিলাম দু-একটা পোস্ট। আবার যথাসময়ে ভুলে গেছি।
না, ওই মৃতা কিশোরীর মুখে আমরা নিজেদের মেয়েদের, ভাইঝিদের, ভাগ্নিদের, বোনঝিদের, বন্ধুকন্যাদের মুখ দেখিনি। কারণ, মেয়েটি হতদরিদ্র। জেলায় তার বাড়ি। তার গল্পে কোনো সামাজিক সাফল্য নেই, নেই নব্বুই শতাংশ পাওয়া “ব্রিলিয়ান্ট” ছাত্রীর গল্প।
আবারো বলি, ঠিক এই জায়গাগুলোতে এসে ঠেকে গিয়েছিলো আমাদের পিতৃতন্ত্র-বিরোধিতা। জয়ী হয়েছিল আমাদের শ্রেণীবোধ।
না, ধর্ষণ ও যৌনায়িত নিগ্রহের ক্রমাধিকারতন্ত্র গঠন আমার এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। প্রতিটি ধর্ষণই একইভাবে নৃশংস। কিন্তু, আমাদের সমাজে এই ক্রমাধিকারতন্ত্র আছে। কোনো কোনো ধর্ষণ আমাদের কাঁদায় বেশি। কোনো কোনো ধর্ষণ আমাদের রাগায় বেশি। কোনো কোনো ধর্ষণ আমাদের পথে নামায়ও বেশি।
প্রসঙ্গতঃ, ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি)-র তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল অবধি এই দেশে ধর্ষিত মেয়েদের প্রায় ৪৫ শতাংশ অধিকার করে আছেন দলিত মেয়েরা। এরসঙ্গে এও দেখা যায় যে গড়ে এই দেশে ১০ জন দলিত মহিলা ও নাবালিকা ধর্ষিত হন একেক দিনে। বলা বাহুল্য, এই তথ্যগুলি সবই নথিভুক্ত হওয়া তথ্য অনুযায়ী। আমাদের মনে রাখতে হবে যে দলিত মেয়েদের ক্ষেত্রে রিপোর্ট না হওয়া যৌন হিংসা ও ধর্ষণের সংখ্যা আরও আরও বেশি। কিন্তু, আমাদের সুশীল সমাজের মানসিকতায় তো বটেই, আমাদের ধর্ষণবিরোধী লড়াই, পিতৃতন্ত্রবিরোধী পথে নামা, রাত দখল কোনোটিতেই দলিত ও আদিবাসী মেয়েদের ওপর হয়ে চলা যৌন হিংসা ও ধর্ষণ মূল বিষয় হয়ে ওঠে না।
মিডিয়াও, যে যে মাত্রায় আর.জি.কর-এর ডাক্তার-তরুণীর ধর্ষণ ও মৃত্যুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদকে বিভিন্নভাবে প্রদর্শন করে, সমাজ জুড়ে একটি বিপুল আকারের থিয়েটারকে সংগঠিত করছে, বা অতীতেও তারা যেভাবে জ্যোতি সিংয়ের ধর্ষণ ও মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন, তাকে দৃশ্যমান করে তুলেছিল, সেই মাত্রায় দলিত মেয়েদের ওপর ঘটে চলা ধর্ষণ ও যৌন হিংসাকে দৃশ্যমান করে না।
অতএব, কী আমাদের আন্দোলনের ভূগোলে, কী আমাদের মানসিক জগতে, তাঁরা রয়ে যান সংখ্যা হিসেবেই। রয়ে যান আমাদের লড়াইয়ের সীমাবদ্ধতা হিসেবে।
অন্যদিকে, এই “রিক্লেইম দা নাইট” বা “রাত দখল” অনুষ্ঠান চলাকালীনই মুম্বাইতে ঘটলো একটি ঘটনা। জয় ভীম নগরের কিছু দলিত, শ্রমজীবী মহিলা যখন নিজেদের প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে গেলেন পাওয়াই অঞ্চলের গ্যালেরিয়া মল-এর সামনের প্রতিবাদ অঞ্চলে, সেখানে তাঁদের বলা হলো, যে এই আন্দোলন তাঁদের জন্য নয়। বলা হলো, তাঁদের দাবিদাওয়া আলাদা। বললেন সম্পন্ন ঘরের মহিলারা, যাঁরা অনেকেই হীরানন্দানি কমপ্লেক্স-এর বাসিন্দা। যে হাউসিং সোসাইটিতে এই মহিলারা অনেকেই গৃহশ্রমিক হিসেবে কাজ করতে যান। এই যে দলিত মহিলাদের বিতাড়িত হওয়ার ঘটনাটি ঘটলো, এখানে কোনো “সিস্টারহুড”-এর গল্প খাটলো না।
কাজেই, আজ আমাদের নিজেদের প্রশ্ন করতে হবে, কোথায় ছিল আমাদের এই বিবেকবোধ, রাগ যখন আমাদের দেশের সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে কাশ্মীরে ঘটেছিলো কুনান-পোশপোড়া। কোথায় ছিল আমাদের এই রাগ যখন প্রায় একাকী লড়ছিলেন বিলকিস বানো। কোথায় ছিল আমাদের এই চোখের জল, ক্রোধ যখন মনিপুরের মায়েরা থাঙ্গাম মনোরমার খুন ও ধর্ষণের প্রতিবাদ করেছিলেন সেনাবাহিনীর হেডকোয়ার্টারের সামনে নগ্ন হয়ে।
আর.জি.কর-এর দুষ্কৃতীদের শাস্তি চাই। চাই আরও অনেক কিছু।
কিন্তু, এই প্রশ্নগুলো যদি নিজেরা নিজেদের করতে না পারি, তাহলে যতই আত্মশ্লাঘা বোধ করি না কেন “রাত দখল”-এর কর্মসূচি নিয়ে, কিংবা জীবনে প্রথম পথে নামা নিয়ে, আমি বা আমরা আসলে সমস্যা, সমাধান নই।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
Image Courtesy : FB page of Amlan
ভালো লিখেছেন।