কোনও স্পেকটাকল তৈরি নয়, সিস্টেমকে বদলানোর জন্য গণ প্রতিরোধ ও রাজনীতির অভিমুখ প্রয়োজন হয়। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের ঘটনায় প্রতিনিয়ত নতুন তথ্য সামনে আসছে। এই আন্দোলন যাতে ন্যায় পায় এবং নারীর প্রতি সহিংসতায় সকল শ্রেণীর নারীর অন্তর্ভুক্তি নিয়ে যাতে নারীবাদী আন্দোলন রাজননৈতিক হয়ে ওঠে সেটুকুই হয়তো এই প্রতিটি মৃত্যু দাবি রেখে যায়। লিখলেন সুদর্শনা চক্রবর্তী।
মিছিলের ব্যানারে, প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল হাথরস, উন্নাও, কামদুনির মেয়েদের কথা। লেখা ছিল কোনওভাবেই যাতে সেই অন্যায়ের, সেই বীভৎসতার পুনরাবৃত্তি না হয়। দাবি উঠেছে অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গতভাবেই প্রকৃত দোষীকে শাস্তি দেওয়ার, সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার। শুধু মেঘলা দুপুরে, ক্রুদ্ধ প্রতিবাদী স্বরের মাঝে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল, এর শেষ কোথায়? আদৌ সমস্ত দাবি, সব প্রতিবাদ কোনও লক্ষ্যে পৌঁছচ্ছে কি না। প্রতিবাদের স্বরে সংযুক্তি থাকছে কি না। মহিলাদের প্রতি ঘটতে থাকা সহিংসতা আদৌ রাজনৈতিকভাবে দেখা হচ্ছে কি?
মিছিলে হাঁটতে থাকা ক্রুদ্ধ, বিধ্বস্ত ছাত্রছাত্রী, তরুণ চিকিৎসকদের যখন সাংবাদিক হিসাবে প্রশ্ন করেছি, “হাথরাস ও আর জি কর-কে কীভাবে একসূত্রে দেখছেন?”– মেডিক্যাল কলেজে পাঠরত ছাত্র বলেছেন, “সরি, আমি ঠিক জানি না হাথরস সম্পর্কে।” ছাত্রীরা নিজেদের আতঙ্ক, ভয়, ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছেন। কিন্তু বিস্মিত হয়েছি দেখে তাঁদের এই অনুভূতিগুলি যতটা সত্যি, অকৃত্রিম, বাস্তব, ততটাই তাঁদের না জানা যে হাধরাস, উন্নাও, কাঠুয়াতে কী হয়েছিল এবং কিভাবে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে মহিলা চিকিৎসক হত্যার ঘটনাটি শুধু বীভৎসতা নয়, সরকার-প্রশাসনের ভূমিকাতেও এক হয়ে যায়। সেখানে ছিল জাতের প্রশ্ন। এখানে তা না এসে, এসেছে সরকারি হাসপাতালে রাজ্য সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তির শীর্ষ কর্তা হিসাবে নিয়োগ, সেখানে ঘটতে থাকা টানা অপরাধমূলক কাজকর্ম এবং সেই বিষয়গুলি সম্পর্কে আপাত উদাসীনতা, রাজনৈতিকভাবে বিষয়গুলিকে না দেখা এবং সুরক্ষিত দূরত্ব বজায় রাখা ধীরে ধীরে সামগ্রিক পরিস্থিতিকে এই ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় ঠেলে দিয়েছে।
এখানে ছাত্রছাত্রীদের একাংশের ক্ষোভের মুখে তাঁদের দাবি আনুযায়ী পোস্টমর্টেম করাতে বাধ্য হলেও বৃদ্ধ শোকসন্তপ্ত বাবা-মাকে প্রভাবিত করে পুলিশ পাহারায় মৃতদেহ পুড়িয়ে দেওয়া হয় জনরোষ এড়াতে। অথচ এই পশ্চিমবঙ্গের মূলস্রোতের গণ মাধ্যমের এমন অবস্থা সে খবর তাদের কাছে থাকে কি না জানি না, থাকলেও খোদ যোগীরাজ্যে নিজের প্রাণ ও কেরিয়ার বাজি রেখে যেভাবে দলিত কিশোরীর চিতার দিকে আঙুল দেখিয়ে পুলিশের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে যেতেই পারেন তরুণ মহিলা সাংবাদিক “উও কেয়া জ্বল রহা হ্যায়?” – অন্তত পেশাগতভাবেও সেই কাজ তাঁরা করতে পারেন না। গণ মাধ্যম ন্যায়ের প্রশ্ন, সরকার-প্রশাসনের দূর্নীতি নয়, বরং টিআরপি বাড়াতে এই ধরনের খবরকে ঠিক যেভাবে ‘সেনসেশনাল’ করতে হয়, তাই করেছে। পুলিশি তদন্ত যে পথে এগোয়, অভিযুক্তের গ্রেফতার, আর জি কর মেডিকেল কলেজের প্রশাসন ঘনিষ্ঠ অধ্যক্ষের পদে বহাল থাকা, সরকারে ক্ষমতায় থাকা দলের এই বিষয়ে আইনি প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করা – সবটুকু নিয়ে গণমাধ্যম হোক বা সমাজমাধ্যম সেখানে যেভাবে তোলপাড় হয়, বিষয়টিকে লিঙ্গ রাজনীতির লেন্স দিয়ে দেখা ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার কাজটি সেভাবে হয় না।
একটি রাত বা একজন কর্মরতা মহিলার ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা এটি নয়। কোনও ঘটনা আসলে বিচ্ছিন্ন হয় না। এবং কোনও ঘটনাক্রমই অরাজনৈতিক হয় না। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে মহিলা চিকিৎসকের কর্তব্যরত অবস্থায় ধর্ষণ ও মৃত্যুর ঘটনার প্রতিবাদে এবং ন্যায়ের দাবিতে কলকাতার বুকে যে মহামিছিল হয় শনিবার ১০ অগাস্ট, সেখানে বারেবারেই মনে হতে থাকে এই মৃত্যু, নারীদের নিরাপত্তাহীনতা, নারীদের উপর বীভৎস আক্রমণ এবং তারজন্য ন্যায়ের দাবিতে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠা কোথাও পৌঁছে কেমন যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। রাজনীতি ব্যতিরেকে যেমন ব্যক্তিগত থেকে সামাজিক জীবন কোনও কিছুই সম্ভব নয়, তেমনি কোন ইস্যুতে সেই রাজনীতির ব্যবহার কেমন হচ্ছে তা বিশ্লেষণরও প্রয়োজন হয়ে পড়ে এমন পরিস্হিতিতেই।
কর্তব্যরত অবস্থায় কলকাতার আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে জুনিয়র মহিলা চিকিৎসকের ধর্ষণ, মৃত্যু, তাকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন রাজ্য সরকার ও প্রশাসনের ভূমিকা ঘিরে রাজ্য জুড়ে চিকিৎসক ও মহিলাদের প্রতিবাদের যে ছবি দেখা যাচ্ছে, তা স্বাভাবিক, কিন্তু অপ্রিয় হলেও যে প্রশ্নটি কিছুটা ঝুঁকি নিয়েও করা দরকার তা হল, এই প্রতিটি মৃত্যু, নারীর প্রতি যৌনতা ও লিঙ্গভিত্তিক হিংসার প্রতিবাদে যে মিছিল, প্রতিবাদ এই রাজ্যে গত কয়েক বছরে হয়েছে, তা শেষ পর্যন্ত কোথাও গিয়ে পৌঁছায়নি – কেন? স্পষ্টভাবেই রাজনৈতিক অভিমুখ না থাকা এবং সেখানে মহিলাদের অবস্থান, তাঁদের সঙ্গে ঘটতে থাকা নিরন্তর বৈষম্য ও হিংসার ঘটনাকে দলীয়, নির্বাচনী রাজনীতিতে গুরুত্ব দিয়ে না দেখা এবং সামাজিকভাবে এক ধরনের উদাসীনতা, দুর্বৃত্তায়নকে মেনে নেওয়ার মানসিকতা এবং অতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভর যুক্তিহীন বাগাড়ম্বরে নারীবাদী আন্দোলন ও দাবিগুলি দিশা হারাচ্ছে বলেই মনে হয়।
তরুণ, জুনিয়র চিকিৎসক, চিকিৎসক পড়ুয়া ও ছাত্রছাত্রীদের মিছিলে কথা বলতে গিয়ে বারেবারে উঠে আসে, ‘অথরিটি’ বা কর্তৃপক্ষের প্রশ্ন। তারা আসল দোষীকে আড়াল করতে চাইছে। প্রকৃত দোষীর কঠোরতম শাস্তির দাবি প্রথম উঠে আসে। তারপরে আসে প্রতিটি হাসপাতালে, মেডিক্যাল কলেজে নিরাপত্তা ব্যবস্থার খোলনলচে বদলানো ও তা যথাযথ করার দাবি। উঠে আসে মহিলা চিকিৎসকদের জন্য পৃথক ও নিরাপদ বিশ্রামের ঘর, চেঞ্জ রুম বাথরুম-এর দাবি। এর প্রত্যেকটি দাবি ন্যায্য ও সরকারি তরফে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পূর্ণ হওয়ার দাবি রাখে। কিন্তু এই প্রতিটি প্রশ্নের সঙ্গে যে সরকারের দায়িত্বে থাকা প্রশাসন ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী (যিনি রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রীও) ভূমিকা থাকে এবং প্রশ্নগুলি যে সাধারণ নাগরিক থেকে বিরোধী দল প্রত্যেকেরই আবেগ নয় রাজনীতি দিয়ে প্রশ্ন তোলার জায়গা তা এখন না বুঝলে সমস্যা রয়ে যায় বৈ কি।
উল্লেখ করা যেতে পারে, আন্দোলনে যেমন “নো ট্রিটমেন্ট আনটিল সেফটি” প্ল্যাকার্ড থাকে (জরুরি বিভাগে পরিষেবা জারি আছে), তেমনি মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টিতিভ পেশায় থাকা এক মহিলা ও পুরুষ নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বলেন, “চিকিৎসা করবে না ঠিক করবে, একজন মায়ের কোল খালি হয়েছে, আরও মায়ের কোল খালি হলে, চিকিৎসা বন্ধ থাকলে তখন বুঝবে।” যে মানসিকতায় সোশ্যাল মিডিয়ায় মৃতার ছবি ও পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্যাতনের বিবরণ ভাইরাল হতে থাকে, অমানবিক ও দিশাহীন সেই ‘মব’ মানসিকতা থেকেই হয়তো বিনা চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু বা যন্ত্রণা বৃদ্ধিকে প্রতিবাদের ভাষা হিসাবে স্বিকৃতি দেওয়ার ধারণা তৈরি হয়।
শুধু একটি মিছিল নয়, শহরের আরও মিছিলে এই ভয়াবহ ধর্ষণ ও হত্যার জন্য ন্যায় ও চিকিৎসক সম্প্রদায়ের সুরক্ষার দাবিতে শ্লোগান ওঠে। ওঠার কথা, ওঠা উচিত। সেখানে কেন কীভাবে মিশে যায় ‘আজাদি’র শ্লোগান? কার থেকে আজাদি? কিসের আজাদি? কমলা ভাসিন যে ‘আজাদি’ কবিতাটি তৈরি করেছিলেন পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, তার সঙ্গে আজাদ কাশ্মীরের জন্য তৈরি হওয়া ‘আজাদি’ শ্লোগানটিকে মিশিয়ে দিয়ে যে অযৌক্তিক, অর্থহীন, অহেতুক উত্তেজনা তৈরি করার এবং কিছুটা প্রতিবাদকে দিগভ্রষ্ট করার বা সেই আবারও রাজনীতিকে সঠিকভাবে না বুঝে ‘প্রতিবাদ’ হাইজ্যাক করার প্রবণতা, আগ্রহ দেখা যায়, এবার অন্তত তা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন।
এই সবের সুযোগ নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা দিয়ে আওয়াজ তোলাতে পারে, “গো ব্যাক অল পলিটিক্যাল পার্টিস” – “মৃত্যুতে রাজনীতির রং লাগতে দেব না”। এই রাজ্যে, এই শহরে ছাত্রমৃত্যু,কর্তব্যরত অবস্থায় মহিলা চিকিৎসকের মৃত্যু কীভাবে ‘রাজনীতিহীন’ করা হয়ে পড়ে? মেডিক্যাল কলেজগুলি সহ সমস্ত কলেজে ছাত্র ইউনিয়ন কীভাবে শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের দখলে থাকে সে প্রশ্ন কেন বছরের পর বছর ধরে ওঠে না? বামপন্থী বিরোধী দল, বামপন্থী ছাত্র সংগঠন আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে প্রতিবাদ কর্মসূচী, সংহতি মিছিল নিয়ে গেলে বাধাপ্রাপ্ত হয়। ছাত্রদের আস্থা অর্জনে এ যেমন তাঁদের ব্যর্থতা, তেমনি বাম সংহতিকে, প্রতিবাদে তাঁদের অংশগ্রহণ ও আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে তাঁদের সংযোগ স্থাপনে বাধা তৈরি কোন্ রাজনৈতিক অনাস্থা তৈরির পরিকল্পনার অংশ তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। কারণ বাম রাজনীতি যুক্ত হলে সেখানে কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা, দীর্ঘ সময় বিরতিহীন কাজের শোষন, নারীকর্মীর অধিকার ও সুরক্ষার বিষয়গুলি অবধারিতভাবে যুক্ত হয়ে যায়। সেই অস্বস্তিজনক প্রশ্নগুলি তুলে সরকারের উপর চাপ তৈরি করা যায়। তখন শুধু একটি ঘটনা নয়, সেখানে প্রকৃত অপরাধীকে আড়াল করার সরকারের প্রবণতা নয়, নারীর সঙ্গে ঘটতে থাকা বৈষম্য আর হিংসার তথ্য অস্বীকার নয় – সামগ্রিকভাবে সরকার ও প্রশাসনিক ব্যর্থতাকে প্রশ্ন করা যেতে পারে। অবশ্যই তার জন্য এ রাজ্যের বাম ছাত্র রাজনীতি বা সার্বিকভাবে বাম রাজনীতিকে ঘটনা নির্ভর নয়, প্রধান বিরোধী দলের রাজনীতির মুখ হতে হবে। তা না হলে এই ঘটনাগুলিকে ভিত্তি করে বিজেপি তাদের জমি শক্ত করে নিতে পিছ-পা হবে না।
মিছিলে হাঁটছিলেন যে মেডিক্যালের ছাত্রীরা বা তরুণ মহিলা চিকিৎসকেরা তাঁদের চোখে-মুখে একইসঙ্গে ভয় ও ক্রোধের মিলিত ছবি প্রতিফলিত হতে দেখি। তাঁদের যত জনের সঙ্গে কথা বলি, মনে হয় তাঁদের এই উদ্বেগ কতটা যুক্তিযুক্ত। যে স্বপ্ন নিয়ে, পরিশ্রম ও মেধার চর্চা করে আসলেই রোগীর চিকিৎসা করার জন্য টানা ডিউটি করে যান, শুধুমাত্র মহিলা হওয়ার কারণে এই নৃশংসতা তাঁর প্রাপ্য হতে পারে না। কর্মরতা মহিলা, জীবনদায়ী পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত কর্মী – পরিচয়কে যেভাবেই দেখা হোক না কেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায়, ততোধিক পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা প্রদর্শনকারী সরকারি পরিকাঠামোয় মহিলা শরীর-উত্তীর্ণ হতে পারেন না। সেই কারণেই ন্যায়ের দাবিতে পথে নামা মহিলারা বারেবারে জোর দেন নিজেদের চিকিৎসক পরিচিতির উপরে। প্রকৃত দোষীকে খুঁজে বের করা ও তাঁর শাস্তির দাবি যেমন ন্যায্য, তেমনি প্রশ্ন জাগে, চিকিৎসকের মতো তথাকথিত ‘এলিট’ পেশা বলেই কি এতটা সঙ্ঘবদ্ধভাবে পথে নামতে পেরেছেন তাঁরা? শুধু এই পরিচিতিটিই কেন সামনে উঠে আসছে এই প্রতিবাদ মিছিলের?
প্রশ্ন আসে কারণ সেদিনের মিছিলে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা, নারীবাদী আদর্শের তরুণীরা অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু এ রাজ্যে যখন আরও যৌন হেনস্থা, ভয়াবহ ধর্ষণ, নারীর প্রতি সহিংসতা, এমনকি হত্যার ঘটনায় প্রতিবাদী মিছিল হয়, তখন সাংবাদিকতার সূত্রেই জানি এই গোষ্ঠীর বড় রকমের অনুপস্থিতির কথা। তার পেছনে অবশ্যই পেশাগত দায়বদ্ধতা বড় কারণ, পাশাপাশি সামাজিকভাবে বিষয়টি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকাও রয়েছে। সামাজিকভাবেই শিক্ষাব্যবস্থায় প্রথম থেকেই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ক্ষেত্রের পড়ুয়াদের যেভাবে প্রথম শ্রেণীর বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়, পরবর্তী সময়ে পেশাগত জীবনে নিজের পেশাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে দেখার মানসিকতাও সেখান থেকেই তৈরি হয়। তৈরি হয়ে পড়ে সমাজ বিচ্ছিন্নতা। মিছিলে যে মহিলা চিকিৎসকেরা বা ছাত্রীরা ছিলেন, “এই ঘটনা বিচ্ছিন্ন না কি সার্বিকভাবে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়া, মহিলাদের প্রতি বাড়তে থাকা হিংসার সঙ্গে যুক্ত?” – এই প্রশ্ন করায় প্রায় প্রত্যেকেই বিষয়টিকে ‘মহিলা চিকিৎসকদের উপর আক্রমণ’ হিসাবে উত্তর দিলেন। হাসপাতাল যা তাঁদের সেফ স্পেস, ফার্স্ট হোম হয়ে যায় সেখানে তাঁরা এতটা অসুরক্ষিত তা মেনে নিতে পারছেন না তাঁরা।
সেক্ষেত্রে কি তাহলে ধরে নিতে হয় অন্যান্য পেশায়, বিশেষত অসংগঠিত ক্ষেত্রের মহিলা কর্মীদের উপর যে হিংসা সংঘঠিত হয়, প্রতিবন্ধী মহিলাদের উপর যে হিংসা হয়, তার প্রতিবাদের স্বর এতটা জোরালো হয় না এবং সেক্ষেত্রে এমন ‘সিলেক্টিভ’ প্রতিবাদ হয় না তার মধ্যে আর্থ-সামাজিক শ্রেণীগত ও ‘প্রিভিলেজ’-এর বৈষম্যের চিত্রটি স্পষ্ট থাকে বলে? ভুলে গেলে চলবে না রোগিনীদের ধর্ষণের ঘটনা, রোগিনী বা রোগির বাড়ির মহিলাদের যৌন হেনস্থা হাসপাতাল চত্ত্বরে ঘটার মতো উদাহরণও আছে। পাশাপাশি পার্ক স্ট্রিট, কামদুনি, কুশমান্ডি, নদিয়া – যে ধর্ষণ ও মৃত্যু বা নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাগুলি ঘটেছে সেখানে মুখ্যমন্ত্রী ছোট ঘটনা বলা থেকে দোষীর ছাড়া পেয়ে যাওয়া, ধর্ষিতার নিখোঁজ হয়ে যাওয়া, নির্যাতিতাকেই কাঠগড়ায় তোলা (ভিক্টিম ব্লেমিং) – রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান হিসাবে এগুলি উদাহরণ তৈরি করেছে, যার প্রতিচ্ছবি আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের বক্তব্য।
১০ অগাস্ট জুনিয়র চিকিৎসক ও চিকিৎসক পড়ুয়াদের মিছিলে একজন তরুণ চিকিৎসক যিনি ৬০ ঘন্টা টানা ডিউটি করার পর মিছিলে যোগ দিতে এসেছিলেন বলেন, “হ্যাঁ, এই পরিস্থিতি সার্বিক পরিস্থিতির অবনতি ও অবক্ষয়ের সঙ্গেই যুক্ত। কেন একজন চিকিৎসককে টানা ডিউটি করে যেতে হবে? কেন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম থাকবে? এই কারণেই ইচ্ছা থাকলেও গ্রামে চিকিৎসা করাতে যেতে পারেন না। অন্যান্য স্টাফদের নিয়োগেও স্বচ্ছতা থাকে না। এই সামগ্রিক পরিস্থিতির অবনতির জন্য প্রশ্ন তো করতে হবে।” অনেক ক্ষেত্রেই চিকিৎসকরাও যৌন হেনস্থায় অভিযুক্ত হয়েছেন সেই প্রশ্ন তোলায় এই তরুণ চিকিৎসক বলেন, “অস্বীকার করছি না। এমনকি সিনিয়র ডাক্তারের কাছে জুনিয়র ডাক্তারের যৌন হেনস্থা হয়েছে এবং আমরা তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে পদক্ষেপ নিতে কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করেছি। এবং শুধু মহিলা নন প্রান্তিক যৌন ও লিঙ্গ পরিচিতি, অর্থাৎ সমকামী চিকিৎসকেরাও সুরক্ষিত, নিরাপদ নন।”
আসলে সকলে স্পেকটাকল ভালবাসে। মিডিয়া থেকে প্রতিবাদ সবটাই স্পেকটাকল সর্বস্ব। কামদুনির ঘটনাটি বীভৎসতায় স্তব্ধ করে দিয়েছিল, তাছাড়া সেই সময়ে রাজ্যের সরকারও প্রায় নবীন, দিল্লির নির্ভয়া-কান্ডের সঙ্গেও মিল দেখা গিয়েছিল এবং খেয়াল করলে দেখা যাবে সেখানে মহিলাদের সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিবাদ, বামেদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য ছিল। পরবর্তীতে তা হয়তো দিশা হারায়। কিন্তু এই একটি ঘটনাতেই সরকার বাধ্য হয়েছিল সঠিক তদন্ত করতে। যদিও দোষীরা এখন মুক্ত এবং আইনি প্রক্রিয়া প্রভাবিত হয়েছে এমন সন্দেহ করা হয়। এটাও লক্ষণীয় যে, এই আন্দোলন কলকাতাকেন্দ্রীক ছিল না। একইভাবে কুশমান্ডির প্রতিবন্ধী মেয়েটির ধর্ষণ ও নিখোঁজ হয়ে যাওয়া নিয়ে কোনও গণ প্রতিবাদ তৈরি হয়নি, মহিলা কমিশনের সামনে প্রতিবাদে গিয়ে আন্দোলনকর্মীদের আটক হওয়া নিয়ে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েনি, নদিয়ায় মৃত নাবালিকাকে ভিক্টিম ব্লেমিং-এর পর ছি ছিক্কার দু-এক দিনেই আটকে ছিল। অ্যাসিড আ্যাটাকে সারা দেশে প্রথম স্থানে এই রাজ্য থাকলেও, তাঁদের দাবি নিয়ে কোনও গণ প্রতিবাদ হয় না।
বিষয় হল, কলকাতা শহরের একদম মূল কয়েকটি জায়গায় এখন এই প্রতিবাদের সময়ে রাত্রিবেলা সমবেতভাবে মহিলাদের রাতের রাস্তার দখল নিয়ে আদপেই কোনও বদল আসবে না। এটা টোকেন হিসাবেই থাকবে, ফলপ্রসূ হবে না। এবং এটা কোনওভাবেই কোনও রাজনৈতিক পদক্ষেপ নয়। একদিনের বা কয়েক দিনের এই জমায়েত কোনওভাবেই সরকার, প্রশাসনের দায়বদ্ধতা, অ্যাকাউন্টেবিলিটি বাড়াবে না। কারণ এটা কোনও দীর্ঘস্থায়ী পন্থা নয়, দীর্ঘমেয়াদী প্রতিবাদের উপায় না। এ কেবলই পরের দিনের সংবাদমাধ্যমে ফটো-অপ। নারীবাদী আন্দোলনের হাতিয়ার হিসাবেও এ নেহাতই বালখিল্য আচরণ। কারণ কার জন্য, কীসের জন্য এই প্রতীকী প্রতিবাদ তার উত্তর সম্ভবত সোশ্যাল মিডিয়ায় তুফান তোলা এই আহ্বানের নেই। কর্মসূচী আছে, কিন্তু তা প্রথম থেকেই স্পষ্ট নয় কেন, কারা তৈরি করছেন সেই কর্মসূচী, লক্ষ্যই বা কী, রাজনীতিটা কী, সেসব কথা স্পষ্টভাবে না আসলে, এগুলি নারীবাদী আন্দোলনকে দুর্বল করে দেয়। আসল প্রশ্নগুলি গুলিয়ে দেয়।
আমরা নিশ্চয়ই বারাসাতে কাজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে কর্মরতা দিদিকে যৌন হেনস্থার হাত থেকে বাঁচাতে ভাইয়ের মৃত্যুর ঘটনাটি ভুলিনি। পরিস্থিতির বদল হয়নি। কারণ সামগ্রিকভাবে সমাজের মানসিকতা বদলায়নি, কর্তৃপক্ষকে প্রশ্ন করার মানসিকতা তৈরি হয়নি। যে শ্রমজীবী মহিলারা প্রথম ট্রেন ধরে গৃহ পরিচারিকার কাজে যোগ দিতে আসেন, সব্জি নিয়ে ট্রেন, ভ্যান, ম্যাটাডোরে করে আসেন বাজারে বসবেন বলে, শপিং মল-এ কাজ সেরে যে তরুণী অনেক রাতে বাড়ি ফেরেন – তাঁদের জন্য এই রাতের রাস্তার দখল আদৌ কোনও অর্থ বহন করে? বাড়ি থেকে ভ্যান, ট্রেন ধরার জন্য যে দূরত্বটা তাঁদের হেঁটে আসতে হয়, সেখানকার নিরাপত্তার প্রশ্ন মহানগরীর বা আশেপাশের শহরের রাতের রাস্তার নিরাপদ সময়ে দখল নেওয়ার উৎসবে মনের কোণে উঁকি দেবে কি?
রাজ্যের মহিলা কমিশন, সরকার, প্রশাসন – যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তাঁরা নাগরিকদের সুরক্ষা, নিরাপত্তার জন্য দায়বদ্ধ। কলেজগুলির জেন্ডার সেল, কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি রোধের আইন এগুলি কেন কার্যকরী হয় না সেই প্রশ্ন তোলা জরুরি এখনই, এই মুহূর্তে। নির্ভয়া কান্ডের পর গণ প্রতিবাদ যে পর্যায়ে পৌঁছেছিল এবং তাতে বিভিন্ন ক্ষেত্রের নারী আন্দোলনকর্মীদের যে অংশগ্রহণ ছিল তাতে আইন বদল হতে বাধ্য হয়। কোনও স্পেকটাকল তৈরি নয়, সিস্টেমকে বদলানোর জন্য গণ প্রতিরোধ ও রাজনীতির অভিমুখ প্রয়োজন হয়। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের ঘটনায় প্রতিনিয়ত নতুন তথ্য সামনে আসছে। এই আন্দোলন যাতে ন্যায় পায় এবং নারীর প্রতি সহিংসতায় সকল শ্রেণীর নারীর অন্তর্ভুক্তি নিয়ে যাতে নারীবাদী আন্দোলন রাজননৈতিক হয়ে ওঠে সেটুকুই হয়তো এই প্রতিটি মৃত্যু দাবি রেখে যায়।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)