“যে গণঅভ্যুত্থানের শুরু হলো তা একমাত্র শেষ হবে এই সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে”– সালমান সিদ্দিকী


  • July 25, 2024
  • (2 Comments)
  • 1089 Views

১৮ জুলাই-এর রাত থেকে বাংলাদেশ সরকার দীর্ঘ সাত দিন ইন্টারনেট পরিষেবা বিচ্ছিন্ন রাখার পর ২৪ জুলাই বিকেলে তা কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পরেই গ্রাউন্ডজিরো-র প্রতিনিধি সুদর্শনা চক্রবর্তী যোগাযোগ করেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সালমান সিদ্দিকীর সঙ্গে। জরুরি মিটিং ও সমস্যাজনক ইন্টারনেট পরিষেবার মাঝেই তিনি দূরভাষে এই সাক্ষাৎকার দিয়েছেন গ্রাউন্ডজিরোকে। কোটা বিরোধী চলমান ছাত্র আন্দোলন, তা গণঅভ্যুত্থানের রূপ নেওয়া, সরকারের নৃশংস দমননীতি, ছাত্রলীগের দীর্ঘ দুর্নীতি, বাম ছাত্র রাজনীতির ভূমিকা – আলোচনায় উঠে এসেছে এই সব দিকই।

 

জিএক্স: গত এক সপ্তাহ, যখন বাংলাদেশ সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল, সেই সময়ের পরিস্থিতি ঠিক কী ছিল একটু বলুন।

 

সালমান সিদ্দিকী: সরকার ১৮ জুলাই রাত ৯ টায় ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। ১৯ জুলাই রাত ১২ টা থেকে কারফিউ জারি এবং সেনাবাহিনী মোতায়েন করে। বাস্তবে সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে আন্দোলনকে স্তব্ধ করার ঘৃণ্য অপচেষ্টার অংশ হিসেবেই। একই সাথে সরকার চেয়েছে, যে অসংখ্য ছাত্র-জনতা সরকারি বাহিনীর গুলিতে নিহত, আহত হচ্ছে তার খবর যেন জনগণ না পায়। তাহলে আন্দোলন আরও বৃহৎ আকার ধারণ করবে।

 

বাংলাদেশের সকল টেলিভিশন চ্যানেলই বড় বড় কর্পোরেট গ্রুপগুলোর মালিকানায় চলে এবং এরা একচেটিয়াভাবে সরকার সমর্থক। ফলে এসময় সবগুলো চ্যানেলে আন্দোলন এবং আন্দোলনকারীদের নামে অনবরত মিথ্যা প্রোপাগাণ্ডা চলতে থাকে। সরকার নির্ধারিত সংবাদই সকল টিভি চ্যানেল দেখাতে থাকে। একটা কথা এই সময়ে প্রচলিত হয়, ‘Single script, different screen’। এসব গণমাধ্যম দেখে বোঝার কোন উপায়ই নেই, সরকার কী নির্মম হত্যাকাণ্ড এখানে সংগঠিত করেছে!

 

গত এক সপ্তাহে বাংলাদেশে আওয়ামী সরকারের মদদপুষ্ট সন্ত্রাসী বাহিনী ছাত্রলীগ-যুবলীগ এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনী পুলিশ-র‍্যাব-বিজিবি’র হাতে পত্রপত্রিকার হিসাবেই দুইশ’য়ের উপর আন্দোলনকারী নিহত হয়। বাস্তবে এই সংখ্যা আরও বেশি। কারণ অনেক শহিদকেই হাসপাতালে বা অন্য কোথাও না নিয়ে অভিভাবকদের নিরবে কবর দিতে বাধ্য করেছে স্থানীয় পুলিশ ও আওয়ামীলীগ নেতারা। এইসকল ঘটনা এখন পত্রিকায় আসছে। অনেক বাবা-মা তাদের নিখোঁজ সন্তানের ছবি নিয়ে ঘুরছেন, খোঁজ করছেন। কোথাও খোঁজ না পেয়ে অনেকে হাসপাতালের মর্গে যাচ্ছেন লাশ পান কি না তা দেখার জন্য। বেওয়ারিশ হিসেবে বহু মৃতদেহকে গোপনে কবর দেয়া হয়েছে। এ এক ভীষণ কষ্টকর ও ভয়াবহ পরিস্থিতি।

 

কয়েক হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। পুলিশ ছররা গুলি ছুড়েছে মুখের উপরে। ফলে পত্রিকার হিসাবে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৫০ জনের উপর স্থায়ীভাবে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। গুলিবিদ্ধ পা ও হাত কেটে ফেলতে হয়েছে এমন আহতের সংখ্যা শুধু ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালেই ২০-এর বেশি। হেলিকপ্টার গানশিপ ব্যবহার করে উপর থেকে গুলি করা হয়েছে। ফলে বাসার ছাদে খেলতে থাকা শিশুও মারা গেছে।

 

আমি যখন এই কথাগুলো লিখছি সে সময়ে – ছাত্রদের মেস, বাসা এবং রাস্তা থেকে যাকে ইচ্ছে তাকে আটক করা হচ্ছে। আওয়ামীলীগের লোকজন বাড়ি-বাড়ি গিয়ে মোবাইল সার্চ করছে, যাকেই সন্দেহ হচ্ছে তাকেই মারধর করছে। গণগ্রেপ্তার চলছে। গত ৮ দিনে সাড়ে চার হাজার লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে। হাজার হাজার মানুষের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করছে। সরকার জনগণের ওপর তার সমস্ত দমননীতি কার্যকর করছে। এ যেন জনগণের বিরুদ্ধে সরকারের অঘোষিত যুদ্ধ!

 

জিএক্স: ছাত্র রাজনীতি দমনে এহেন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে বিরল। এরপর বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির অভিমুখ কী হতে পারে বলে মনে হয়?

 

সালমান সিদ্দিকী: গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলন দমনে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের এমন নমুনা সাম্প্রতিক সময়ে শুধু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নয়, হয়তবা সমগ্র বিশ্বেই বিরল। বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের অভিমুখ আলোচনার আগে সরকারের দলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। ছাত্রলীগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সন্ত্রাস-দখলদারিত্বের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছিলো। ছাত্রহত্যা, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, বিরোধী দল-মত দমন থেকে শুরু করে এমন কোন অপরাধ নেই যে এরা করতো না। সাধারণ শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকরা ছিলো এদের হাতে জিম্মি। এই আন্দোলনের শুরুতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগ শিক্ষার্থীদের ওপর নৃশংস হামলা চালায়। নারী শিক্ষার্থীদের তারা বেধড়ক পেটায়। আহত অবস্থায় যখন শিক্ষার্থীরা ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে যায় সেখানেও ছাত্রলীগ দফায়-দফায় হামলা করে।

 

কিন্তু যত সময় যেতে থাকে আন্দোলনকারীরা পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে এবং ছাত্রলীগের নেতাদের আবাসিক হল থেকে পিটিয়ে বের করে দেয়। এ ঘটনা বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।

 

এই সন্ত্রাস-দখলদারিত্ববিরোধী লড়াই – আগামীদিনের ছাত্রআন্দোলনের একটি প্রধান বিষয় হবে বলেই মনে হয়। ছাত্ররা তাদের ক্যাম্পাসে এই দমন-পীড়ন আর সহ্য করবে না। সরকার বিশ্ববিদ্যালয়সহ সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে রেখেছে। আমাদের দাবি, অবিলম্বে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সন্ত্রাস-দখলদারিত্বমুক্ত পরিবেশ এবং ছাত্র সংসদ নির্বাচন করতে দিতে হবে। ছাত্রলীগ নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দখলে নেওয়ার চেষ্টা করবে। হল-হোস্টেলে ইতোমধ্যে ছাত্রলীগ অবস্থান নিয়েছে বলে আমরা শুনেছি। কিন্তু এতে কাজ হবে না। সমগ্র ছাত্রসমাজকে ঐক্যবদ্ধভাবে ছাত্রলীগের এই দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে তীব্র লড়াই গড়ে তুলতে হবে– এটাই হবে আমাদের সামনের সময়ের অন্যতম প্রধান কর্তব্য।

 

আওয়ামীলীগ-ছাত্রলীগকে জনগণ সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। এই আন্দোলন থেকে দাবি উঠেছে, ছাত্রহত্যার দায় নিয়ে অবিলম্বে হাসিনা সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। আমরা মনে করি, যে গণঅভ্যুত্থানের শুরু হলো তা একমাত্র শেষ হবে এই সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে। শত-শত ছাত্রকে হত্যা করে এ সরকার কিছুতেই ক্ষমতায় থাকতে পারবে না।

 

জিএক্স: প্রথমে এই আন্দোলনে কোনও দলীয় রাজনীতির রং না লাগলেও পরবর্তী সময়ে জামাত, বিএনপি তা দখলের চেষ্টা করছে বলে মনে করা হচ্ছে। বাম ছাত্র সংগঠনের ভূমিকা এক্ষেত্রে কী?

 

সালমান সিদ্দিকী: এই আন্দোলন ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে শুরু হয়। সাধারণ শিক্ষার্থীরা এবং বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা এই ব্যানারের অধীনেই আন্দোলনে যুক্ত হয়। এরকম একটি ছাত্রঘনিষ্ঠ এবং যৌক্তিক আন্দোলনে বাস্তবে রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক সবার অকুণ্ঠ সমর্থন ছিলো।

 

এই আন্দোলন কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে উঠলেও ছাত্রলীগ এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনীর নৃশংস হামলার মধ্য দিয়ে এটি ধীরে ধীরে রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়। আন্দোলনকারীরা ছাত্রহত্যার দায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ চেয়েছে। হত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ও আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের দলীয় পদ এবং মন্ত্রীপরিষদ থেকে পদত্যাগ চেয়েছে। আন্দোলনে যখন নৃশংস হামলা হয় তখন ছাত্র-জনতা পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

 

আওয়ামীলীগ এই আন্দোলনে সর্বস্তরের জনগনের অংশগ্রহণ অস্বীকার এবং লড়াইয়ের অর্জনকে কালিমালিপ্ত করতে বিএনপি-জামায়াতকে দোষারোপের চেষ্টা করছে। এটি আওয়ামী সরকারের পুরনো অপকৌশল। বাস্তবতা হলো, আওয়ামী সরকারের দীর্ঘ শাসনে ভোটাধিকার হরণ, অগণতান্ত্রিক শাসন, দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতি এবং দুর্নীতি-লুটপাটসহ সমস্ত অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে মানুষ ছিলো বিক্ষুব্ধ। এ আন্দোলনে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার প্রবল জোয়ার তৈরি হয় এবং তারা মাঠে নামে। ফলে এ আন্দোলন বিএনপি-জামায়াত দখলে নেয়ার চেষ্টা করে–এ কথার কোন মানে নেই।

 

সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের পক্ষ থেকে আমরা চেয়েছি, এ আন্দোলন ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারেই পরিচালিত হোক। আমরা ঢাকায় এবং সারাদেশে যতটুকু পেরেছি এ আন্দোলনকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছি।

 

বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর জোট ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট’-এর পক্ষ থেকে আমরা বিভিন্নভাবে এ আন্দোলনকে সহযোগিতা করেছি। আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে আন্দোলনের শক্তিগুলোর মাঝে যেন ঐক্য বজায় থাকে সে চেষ্টা করেছি এবং করবো।

 

জিএক্স: ছাত্রদের যে দাবি ছিল তার মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দলীয় রাজনীতি করা যাবে না, এমনটাও বলা হয়েছে। এ বিষয়ে কী বলবেন?

 

সালমান সিদ্দিকী: ছাত্রলীগ দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পাস এবং হলগুলোকে দখলে রেখে এমন কোন অপকর্ম নেই যা করেনি। গণরুম-গেস্টরুমগুলোতে দিনের পর দিন ছাত্রদের ওপর মানসিক-শারীরিক নির্যাতন চালাত। ১৬ জুলাই রাতে শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়-সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করে।

 

আবাসিকহলগুলোর প্রাধ্যক্ষের (Provost) কাছে এ মর্মে আবেদন করে যে, ছাত্রলীগের রাজনীতিসহ দলীয় লেজুড়বৃত্তি এবং সন্ত্রাসনির্ভর সংগঠনের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা মূলত ছাত্রলীগের সন্ত্রাস এবং দখলদারিত্বনির্ভর অপরাজনীতির বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছে। আমরা আন্দোলনকারীদের এ লড়াকু ভুমিকাকে অভিনন্দন জানিয়েছি। একইসাথে এ কথাও স্পষ্ট করে বলেছি, এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনসমূহ কখনও সন্ত্রাস-দখলদারিত্বের রাজনীতি করেনি।

 

আমাদের সংগঠন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টসহ বামপন্থী সংগঠনমূহ আমরা আজও সন্ত্রাস-দখলদারিত্বের রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়ছি। ফলে সকল ছাত্ররাজনীতি এক নয়। ছাত্র রাজনীতিতে দু’টি ধারা আছে। একটি ছাত্র অধিকারের পক্ষের রাজনীতি, অন্যটি সন্ত্রাস-দখলদারিত্বের রাজনীতি। ছাত্র অধিকারের পক্ষের রাজনীতি যত শক্তিশালী হবে সন্ত্রাস-দখলদারিত্ব নির্ভর অপরাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াইও তত তীব্র হবে।

 

আর একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার, আন্দোলনের মাঝপথে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের মত বিষয় আলোচিত হয়েছে একথা ঠিক। কিন্তু আন্দোলন যত বিকশিত হয়েছে এবং ছাত্রলীগ-রাষ্ট্রের হামলা ছাত্ররা মোকাবিলা করেছে তখন তাদের মধ্যে রাজনীতি নিষিদ্ধের মনোভাব আর আগের মত থাকেনি। ছাত্ররাও রাজনৈতিক লড়াইয়ের অংশ হয়ে ওঠে। অর্থাৎ দাবিভিত্তিক আন্দোলন অনেকটা রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ পায়।

 

জিএক্স: কোটা ব্যবস্থার সংস্কার করে যে রায় বেরোলো তাতে মহিলাদের কোটা নেই। ২%-এর মধ্যে প্রান্তিক ও প্রতিবন্ধী মানুষদের রাখা হয়েছে। এই ব্যবস্থাকে সঠিক মনে করছেন আপনারা?

 

সালমান সিদ্দিকী: কোর্ট যে রায় দিয়েছে, তাতে ৯৩ শতাংশ মেধা এবং ৭ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করেছে। এই ৭ শতাংশ কোটার মধ্যে ৫ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা, ১ শতাংশ আদিবাসী এবং ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর জন্য রাখা হয়েছে। আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে আমরা বলেছিলাম, মুক্তিযুদ্ধের ৫৩ বছর পর মুক্তিযোদ্ধা কোটা অযৌক্তিক এবং বৈষম্যমূলক। ফলে এটি সম্পূর্ণ বাতিল করতে হবে। কিন্তু কোর্টের রায় এবং সরকারের সাম্প্রতিক প্রজ্ঞাপনে এটি রাখা হয়েছে। ফলে কোর্টের রায়ে আমাদের দাবির পুরো প্রতিফলন ঘটেনি। আমাদের দাবি হলো– নারী কোটা যুক্ত করা দরকার। একই সাথে আদিবাসী এবং অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা বৃদ্ধি প্রয়োজন।

 

জিএক্স: গত ১৫-১৬ জুলাই তারিখ থেকে আন্দোলন যেভাবে এগিয়েছে, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বেড়েছে, সেক্ষেত্রে আপনাদের সংগঠনের অবস্থান, ভূমিকা কী ছিল?

 

সালমান সিদ্দিকী: ১৪ জুলাই এক প্রেস কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের রাজাকারের ‘নাতি-নাতনি’ বলে কটুক্তি করেন। এতে ঐ দিন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। পরদিন ১৫ জুলাই রাজু ভাস্কর্যে বেলা ১২টায় শিক্ষার্থীরা জড়ো হতে থাকে। এতে বুয়েট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, নার্সিং কলেজ, বদরুন্নেসা কলেজসহ ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সমবেত হয়। ইডেন কলেজ থেকে যখন আমাদের সংগঠনের নেতৃত্বে নারী শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করে তখন এতে ছাত্রলীগ হামলা চালায়। এতে আমাদের সংগঠনের সভাপতি শাহিনুর সুমি, সাংগঠনিক সম্পাদক সুমাইয়া আক্তার সহ ৮-১০ জন শিক্ষার্থী আহত হয়।

 

মেয়েরা যেন বের হতে না পারে সেজন্য দরজায় তালা লাগানো হয়। মেয়েরা তালা ভেঙ্গে রাজু ভাস্কর্যের মুল জমায়েতে অংশ নেয়। ইডেন কলেজ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা কলেজের আন্দোলন সংগঠিত করার ক্ষেত্রে আমরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছি। এ ছাড়াও চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, গাইবান্ধা, রংপুর, সিলেটসহ বিভিন্ন জেলা শহরগুলোতে আমাদের সংগঠনের নেতা-কর্মীরা এ আন্দোলনকে সংগঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এ আন্দোলন পরিচালনা করতে গিয়ে আমাদের নেতা-কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়েছে, হাত ভেঙেছে, মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে। বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে সরকার মামলা দিয়েছে।

 

জিএক্স: এই আন্দোলন এখন গণআন্দোলনের রূপ নিয়েছে। হিংসা এখনও অব্যাহত। সরকার, রাষ্ট্রের ভূমিকা, এই আন্দোলন – সবটা নিয়ে আপনাদের পরবর্তী কর্মসূচি কী?

 

সালমান সিদ্দিকী: এই আন্দোলন শুধু গণআন্দোলনে পরিণত হয়েছে তাই নয়, এটি গণঅভ্যুত্থানের রূপ লাভ করেছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযু্দ্ধ পরবর্তী সময়ে কোন গণআন্দোলনে রাষ্ট্র এত নির্মম আক্রমণ নামিয়ে আনেনি। হিংসাত্মক যা কিছু হয়েছে তার সমস্ত দায় সরকারের। আমরা দেখেছি,সরকারি সশস্ত্র বাহিনীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিরস্ত্র মানুষের প্রতিরোধ; বুকটাকে ঢাল হিসেবে গুলির সামনে পেতে দেওয়া। আমরা দেখেছি, রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাইদের সাহসী আত্মদান। আমরা আরও দেখেছি, হেলিকপ্টার থেকে সরকারি বাহিনীর অবিরাম গুলিবর্ষণ। আমরা দেখেছি, রক্তের নদী আর লাশের সারি। আমরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতা দেখিনি, আমরা হাসিনা সরকারের বর্বরতা দেখেছি। আমরা শহীদদের রক্তের নামে শপথ করছি, অসংখ্য ছাত্রহত্যার দায় নিয়ে এ সরকার কিছুতেই ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। এ লড়াই শুধু লড়াইয়ে সীমাবদ্ধ থাকবে না, শেষ বিজয় নিয়েই আমরা ঘরে ফিরবো। ছাত্রদের আমরা ঐক্যবদ্ধ করবো এবং প্রয়োজনীয় কর্মসূচী দেবো। অচিরেই ছাত্রহত্যার বিচার চাইতে আমরা আবারও মাঠে নামবো

 

জিএক্স: অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে আপনাদের কী যোগাযোগ বজায় রয়েছে? কোনও যৌথ কর্মসূচি আছে কী?

 

সালমান সিদ্দিকী: ৭ টি বামপন্থী সংগঠন নিয়ে ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট’ নামে একটি জোট কার্যকর আছে। এ জোটে আমাদের সংগঠনও আছে। অন্যান্য ছাত্র সংগঠন বিশেষ করে বামপন্থী এবং গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের সাথে আমাদের আলোচনা চলছে। আন্দোলনের বর্তমান পরিস্থিতি এবং করনীয় কর্তব্য নিয়ে কথা বলছি। ছাত্রলীগ যেন পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দখলদারিত্ব কায়েম করতে না পারে – সেজন্য সাধারণ শিক্ষার্থী এবং ছাত্রসংগঠনগুলো যেন সদা সতর্ক থাকে সে আহ্বান জানাই। আমরা বামপন্থী সংগঠন এবং সাধারণ ছাত্রদের নিয়ে সন্ত্রাস-দখলদারিত্ব প্রতিরোধে গণকমিটি করতে চাই। আমরা সর্বোতভাবে চাই, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর প্ল্যাটফর্ম থেকেই সামনের দিনের আন্দোলন পরিচালিত হোক।

 

জিএক্স: সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতিতে বাম রাজনীতির ভূমিকাকে এই আন্দোলনের প্রেক্ষিতে কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন?

 

সালমান সিদ্দিকী: পাকিস্তান পর্বে এবং মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এদেশের সমস্ত গণআন্দোলনে বামপন্থী সংগঠনগুলোর অগ্রণী ভূমিকা ছিলো। বর্তমান পরিস্থিতিতেও আমাদের কাঁধে এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব। আমরা এ দায়িত্ব কিছুতেই অস্বীকার করতে পারি না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বামপন্থী সংগঠনগুলোর যে ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন তার তুলনায় আমরা পিছিয়ে আছি। এর জন্য বিশেষভাবে দায়ী আমাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা।

 

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে শাসকদল আওয়ামীলীগ এবং তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ গণধিক্কৃত। এই আন্দোলনের সমর্থন জনগণের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। এই আন্দোলন ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। জনগণ অকাতরে জীবন উৎসর্গ করেছে। সরকার সাময়িক পিছু হটে কোটা সংক্রান্ত দাবি মেনে নিয়েছে। কিন্তু সরকার এখনো পরাজিত হয়নি, শুধু তাদের মধ্যে পরাজয়ের ভয় ঢুকে গেছে মাত্র। সে দ্রুতই তার সমস্ত শক্তিকে সংহত করতে তৎপর হবে। আমাদের প্রস্তুতিও বহুগুণ বাড়াতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত বিজয় অর্জন করতে না পারছি – তার আগ পর্যন্ত আমাদের অনেকগুলো করনীয় কর্তব্য আছে। আমরা সমস্ত ছাত্র সংগঠন এবং সাধারণ ছাত্রদের সামনের দিনে, ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র লড়াই গড়ে তোলার প্রস্তুতির কথা বলতে চাই। জনগনকে আরও সাহস নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই। এই লড়াই কেবলমাত্র শুরু, শেষ নয়। ছাই চাপা আগুন নিয়ে সামনের দিনের গণঅভ্যুত্থান অপেক্ষা করছে।

 

আমরাও ছাত্রসংগঠন হিসেবে ছাত্রদের মাঝে থাকবো, সবাই যেন ঐক্যবদ্ধভাবে লড়ে সে চেষ্টা করবো। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ কমিটি গড়ে তুলবো। এক্ষেত্রে বামপন্থী দল এবং তাদের সংগঠনগুলোর আরও জোরালো প্রস্তুতি এবং ভূমিকা প্রয়োজন।

 

জিএক্স: মৌলবাদী শক্তি, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও দুর্নীতি এই দুইয়ের মাঝে বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি এই আন্দোলনের পর কীভাবে এগোবে ও আপনাদের ভূমিকা কী হবে?

 

সালমান সিদ্দিকী: রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি ভয়ানক আকার ধারণ করেছে। পুঁজিপতিশ্রেণী এবং সরকারের দলীয় লোকজন দেশের প্রায় সমস্ত সম্পদ কুক্ষিগত করে রেখেছে। নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত মানুষ অসহায় জীবনযাপন করছে। ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ দিয়ে মত প্রকাশের অধিকার হরন করা হয়েছে। বিরোধী পক্ষকে রাতের অন্ধকারে তুলে নিয়ে গিয়ে গুম করা হচ্ছে, হত্যা করা হচ্ছে।

 

বাংলাদেশে মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক শক্তি আছে এ কথা ঠিক এবং এ শক্তিগুলো গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের পক্ষে বিপজ্জনক। গত প্রায় ১৬ বছরে আওয়ামী সরকার তার রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এসব মৌলবাদী শক্তিকে মদত দিয়েছে। আবার মৌলবাদ দমনের নামে জনগণকে ধোঁকা দিয়েছে। আসলে অগণতান্ত্রিক পরিবেশে সাম্প্রদায়িক শক্তি গড়ে ওঠে এবং তা শেষ বিচারে শাসকশ্রেণীর স্বার্থই রক্ষা করে।

 

গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে তীব্র করতে হবে। এই আন্দোলনগুলোকে আমরা যদি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গী ও নৈতিকতার ভিত্তিতে পরিচালিত করতে পারি তবে একই সাথে আমরা আওয়ামী বিরোধী এবং সাম্প্রদায়িক শক্তিবিরোধী লড়াই পরিচালনা করতে পারি। জনগণকে আমরা বোঝাবো, আওয়ামীলীগের বিকল্প শক্তি সাম্প্রদায়িক শক্তি হতে পারে না। এর বিকল্প বাম-গণতান্ত্রিক শক্তি।

 

লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো, এদেশের ছাত্র-গণআন্দোলনে সাম্প্রদায়িক শক্তি কখনোই সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারেনি। তারা যে ব্যাপক ছাত্রদের মধ্যে বিরাট গ্রহণযোগ্য শক্তি, তাও নয়। গত কয়েক বছরে আওয়ামী লীগই এদের বড় করেছে এবং করছে। মৌলবাদী শক্তির দাবি মেনে নিয়ে পাঠ্যপুস্তক থেকে রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের লেখা সরিয়ে নিয়েছে। আবার তারাই ছাত্রদের প্রতিটি আন্দোলনকে সাম্প্রদায়িক শক্তি ও জঙ্গিবাদের ট্যাগ লাগিয়ে দিচ্ছে দেশের অভ্যন্তরের গণতন্ত্রমনা মানুষ ও বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করার জন্য। এই চালাকি দিয়ে আর চলবে না।

 

এই কারণে ছাত্ররা স্লোগান তুলেছে, “সাথে থাকলে সঙ্গী, না থাকলে জঙ্গি।” এদেশের মানুষ শেখ হাসিনার মুক্তিযুদ্ধ, জঙ্গিবাদকে পুঁজি করে ক্ষমতায় থাকা ও জনগণকে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্র পুরোপুরি বুঝে গেছে। আন্দোলনকারীদের মধ্যে এ নিয়ে আর কোন বিভ্রান্তি নেই।

 

ছবি ঋণArka Bhaduri

 

Share this
Recent Comments
2
Leave a Comment