নীলাঞ্জন দত্ত
১৪ জুন, ২০২৪
“Anyway defeat has to be accepted. There should be no attempt to explain it away. However, the whole campaign should be closely analysed so that the pitfalls may be avoided in future”
— Pandit Deendayal Upadhyaya, Organiser Weekly, Political Diary, June 3, 1963
ভোটের ফল আশানুরূপ না হলে দীনদয়াল উপাধ্যায়ের এই উদ্ধৃতিটা হিন্দুত্ববাদী মহলে বারবারই ঘুরে বেরায়, এবারেও ব্যতিক্রম হয়নি। তার সঙ্গে আছে আরএসএস-এর বিশেষ বিলাপ: “দশ বছর কেন্দ্রে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার পর, ভারত আবার জোট সরকারের ফিরে আসা দেখবে।” সঙ্ঘের মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’ বলছে, “বিজেপির ফলাফল মোটের ওপর সন্তোষজনক হলেও আহামরি কিছু নয়, আর তাই আমরা দেখতে পাচ্ছি, জয়োল্লাস এবার অপেক্ষাকৃত ম্রিয়মান।”
কী ভুল হয়েছে? ‘অর্গানাইজার ’ বলছে, একটা বড় ত্রুটি হয়ে থাকতে পারে প্রার্থী বাছাইতে। কী রকম? নিজের দলের নিবেদিতপ্রাণ ‘কার্যকর্তা’দের ওপর ভরসা না রেখে বিরোধী দলগুলো থেকে কালিমালিপ্ত নেতাদের নিয়ে আসা হয়েছে, গোটা নির্বাচনটাই রাজ্য নেতৃত্বের দিকে নজর না দিয়ে নরেন্দ্র মোদীর ‘ক্যারিসমা’ এবং অন্যান্য সর্বভারতীয় নেতাদের কেন্দ্র করে করা হয়েছে। তার ফলে অযোধ্যা অঞ্চলে “মর্মান্তিক” পরাজয় হয়েছে, যেখানে রাম মন্দিরের প্রতি সমর্থনের ঢেউয়ে সওয়ার হয়ে জিতে যাবে বলে দল নিশ্চিত ছিল। রাম মন্দিরের জন্য যারা মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছে সেই মানুষদের সঙ্গে না নিয়ে তারকাদের এনে জাঁকজমক করে তার “প্রাণপ্রতিষ্ঠা” হয়েছে। “আগুনে ঘি ঢেলেছে সরকারী আমলাদের দুর্নীতি, বেড়ে চলা বেকারী এবং পরীক্ষার আয়োজন করতে অনন্তকাল দেরি করে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন দুর্বিসহ করে তোলার ফলে যুবসমাজের বাড়তে থাকা ক্ষোভ।”
তবে যে এতদিন শুনছিলাম, ‘যোগী’ রাজে উত্তর প্রদেশ বৈকুণ্ঠবৎ, তা কি মিথ্যা ছিল? যাইহোক, এখন সে প্রশ্নে যাচ্ছি না। যে বিষয়টার দিকে আমরা নজর দিচ্ছি তা হল, আরএসএস-এর মতে, সারা ভারতেই প্রার্থী বাছাই ঠিকমত হয়নি। এটা বোঝাতে ‘অর্গানাইজার’ বিভিন্ন রাজ্যের ১৫ জন নবাগত বিজেপি প্রার্থী কবে দলে এসেছেন এবং কী ফল করেছেন, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছে। আমরা এখানে তা নিয়ে একটা সারণি তৈরি করলাম। দেখা যাচ্ছে, এদের মধ্যে চারজন মাত্র জয়ের মুখ দেখেছেন।
রাজ্য | আসন | প্রার্থী | দলে কবে এসেছেন | ফল |
আসাম | নওগাঁও | সুরেশ বোরা | ১১ নভেম্বর ২০২৩ | পরাজিত |
ছত্তিসগড় | সরগুজা | চিন্তামণি মহারাজ | ৩১ অক্টোবর ২০২৩ | জয়ী |
কেরালা | কান্নুর | সি রঘুনাথ | ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩ | পরাজিত |
রাজস্থান | নাগৌর | জ্যোতি মির্ধা | ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | পরাজিত |
রাজস্থান | বনসওয়ারা | মহেন্দ্র মালব্য | ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | পরাজিত |
অন্ধ্র প্রদেশ | তিরুপতি | ভারাপ্রসাদ রাও | ২৫ মার্ছ ২০২৪ | পরাজিত |
হরিয়ানা | কুরুক্ষেত্র | নবীন জিন্দাল | ২৪ মার্চ ২০২৪ | জয়ী |
ঝাড়খণ্ড | দুমকা | সীতা মুর্মু | ১৯ মার্চ ২০২৪ | পরাজিত |
ওড়িশা | কালাহান্ডি | মালবিকা কেশরী দেও | এপ্রিল ২০২৩ | জয়ী |
তেলেঙ্গানা | ওয়ারাঙ্গল | আরুরি রমেশ | ১৬ মার্ক্স ২০২৪ | পরাজিত |
পশ্চিমবঙ্গ | কলকাতা উত্তর | তাপস রায় | ৬ মার্চ ২০২৪ | পরাজিত |
পশ্চিমবঙ্গ | ব্যারাকপুর | অর্জুন সিং | ১৫ মার্চ ২০২৪ | পরাজিত |
ওড়িশা | কটক | ভত্রুহরি মহতাব | ২৮ মার্চ ২০২৪ | জয়ী |
পাঞ্জাব | জলন্ধর | সুশীল কুমার রিঙ্কু | ২৮ মার্চ ২০২৪ | পরাজিত |
এই ধরনের ভোটপরবর্তী আত্মসমীক্ষা বামপন্থীদের মধ্যে বিরল। তবে যদি কেউ করে, তা অবশ্যই ভিন্ন খাতে বইবে। পশ্চিমবঙ্গে “একঝাঁক নতুন মুখ” সামনে এনে তাঁরা ঠিক কী প্রমাণ করতে চাইছিলেন জানি না। জনগণ কাকে বেছে নেবে, তার ভিত্তি কি কেবল প্রার্থী প্রবীণ না নবীন, তা হতে পারে? হ্যাঁ, সংবাদমাধ্যমগুলো বেশ কিছুদিন ধরে প্রচার করেছে বটে, “পাকাচুল নেতাদের” দেখেই মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, তাই কমবয়সীদের সামনে আনা দরকার। বামপন্থী পার্টিগুলোর নেতারাও কি সেই প্রচারে ভেসে গেলেন?
যে কোনও দলেরই ভবিষ্যতের কথা ভেবে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে থেকে নেতৃত্ব তুলে আনতেই হবে, কিন্তু শুধু বয়সের নিরীখেই কি লোকে ভোট দেয়? বিশেষ করে বামপন্থী বা সাধারণভাবে প্রতিষ্ঠানবিরোধী ভোটারের ক্ষেত্রে, প্রার্থীর গণ-আন্দোলনের কর্মী হিসেবে পরিচিতি কি একটা বড় বিচার্য বিষয় নয়? সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে রাজ্যে বা স্থানীয়ভাবেও গণ-আন্দোলনে তেমন পোড় না খাওয়া তরুণতরুণীদের পার্টির পছন্দমত জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিলেই হল?
লড়াকু ট্রেড ইউনিয়ান কর্মীরা তো একদিন মধ্যবিত্তেরও ভোট পেয়ে বিপুল জয় এনেছে। এখন যদি শিল্পাঞ্চলেও তাদের মধ্যে থেকে দাঁড় করাবার মত কাউকে খুঁজে না পাওয়া যায়, তবে তার কারণ খোঁজা আবশ্যই জরুরী।
উল্টোদিকে, গণ-আন্দোলন থেকে উঠে আসা কোনও তরুণ যদি আন্দোলনের সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেন, তবে জনগণ যে তাঁকে নাও চাইতে পারে, তার জলজ্যান্ত প্রমাণ দিল্লিতে কানহাইয়া কুমার।
আবার, সিপিআই(এম) দুটি প্রদেশে দুই রাজ্য সম্পাদককে দাঁড় করিয়েছিল: পশ্চিমবঙ্গে মহম্মদ সেলিম (মুর্শিদাবাদ) আর রাজস্থানে অমরা রাম (শিকার)। বরাবর কৃষক আন্দোলনের সামনের সারিতে থাকা অমরা রাম জিতেছেন, সেলিম কেন পারেননি তা খুব একটা গভীর অনুসন্ধানের বিষয় নয়।
এবার একটু অন্য দুয়েকজন প্রার্থীর দিকে তাকাই। এরা প্রশাসন-স্বীকৃত কোনও দলের প্রার্থী ছিলেন না। সরকারীভাবে তাঁদের পরিচয় ‘নির্দল’ — যদিও তাঁদের নিজস্ব সংগঠন আছে। কিন্তু কোনও দলের তকমা ছাড়াই তাঁরা জিতেছেন, জনগণের আন্দোলনে তাদের ভূমিকার জন্য।
এদের একজন হলেন চন্দ্রশেখর আজাদ, যিনি উত্তর প্রদেশের নাগিনা আসনে ৫১.১৯ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন, যা এদেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে খুব বেশি ঘটে না। তাঁর নিকটবর্তী প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপির ওম কুমার পেয়েছেন ৩৬ শতাংশ ভোট। ২০১৫ সালে তিনি ‘ভীম আর্মি’ নামে এক সংগঠন তৈরি করেছিলেন, যা দলিত রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ২০১৭ সালে তিনি ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট’এ গ্রেপ্তার হন, তারপর ১০১৮এ এই আইন বাতিল হলে ছাড়া পান। তারপর গঠন করেন ‘আজাদ সমাজ পার্টি’।
আজাদ যদিও এখন মুক্ত, তাঁর মত আরেকজন কিন্তু ২০১৯ থেকে ইউএপিএ বন্দি হিসেবে জেলেই রয়েছেন। তাঁর নাম শেখ আবদুল রশিদ, যিনি ‘ইঞ্জিনিয়ার রশিদ’ বলেই অধিক পরিচিত। কাশ্মীরের বারামুল্লা কেন্দ্র থেকে কোনও দলের টিকিট ছাড়াই তিনি জম্মু ও কাশ্মীরের ভূতপূর্ব মুখ্যমন্ত্রী ন্যাশনাল কনফারেন্সের ওমর আবদুল্লাকে হারিয়েছেন ২,০৪,৫২৮ ভোটে, আরেক প্রাক্তন মন্ত্রী ও পিপলস কনফারেন্স নেতা সাজ্জাদ গনি লোনকে আরও পেছনে ফেলে দিয়ে।
রশিদ ছিলেন একজন কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ার (যা থেকে তাঁর ডাকনামটা এসেছে)। ২০০৮ সালে তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোদস্তুর রাজনীতিতে আসেন। ওই বছর এবং ২০১৪ সালে ভোটে জিতে বিধায়কও হন, কিন্তু ২০১৯-এর নির্বাচনে হেরে যান। এই সমস্ত নির্বাচনেই তিনি লড়েছিলেন নির্দল প্রার্থী হিসেবে, যদিও তাঁর সংগঠনের নাম আওয়ামি ইত্তেহাদ পার্টি। ২০১৯ সালেই এনআইএ তাঁকে গ্রেপ্তার করে সন্ত্রাসবাদীদের অর্থ যোগানোর অভিযোগে। দিল্লির টিহার জেল থেকেই তিনি এবার নমিনেশন ফাইল করেন। তাঁর নির্বাচনী প্রচারও হয় অবাক করা। কুড়িজন বন্ধুকে নিয়ে তাঁর দুই ছেলে আসরার ও আবরার রাস্তায় নামে, অচিরেই তাদের সঙ্গে হাজার হাজার লোক হাঁটতে শুরু করে দেশের যে কোনও নামী নেতার ‘রোডশো’কে লজ্জায় ফেলে দিয়ে।
স্থানীয় মানুষের কাছে রশিদ হলেন ৩৭০ ধারা বিলোপের পর কাশ্মীরে বিরল গণতান্ত্রিক প্রতিবাদের প্রতীক। এবারের নির্বাচনে তাঁর মত কোনও ব্যক্তির জয়লাভ দেশের বৃহত্তর সংসদীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে হয়ত একটা ফুটনোট মাত্র। কিন্তু আরএসএস ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’রা তো আপাতত ভোটের মাধ্যমে ‘জনাদেশ’কেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন, এমনকি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নন বলে সংবিধানের ‘মূল কাঠামো’ ইত্যাদি সম্পর্কে তাঁদের মতামতের কোনও গুরুত্ব নেই বলে গলা ফাটাচ্ছেন। তাই ভোটে জিতে সংসদের মত একটা ‘পবিত্রতম’ প্রতিষ্টানে এরকম লোকেদের প্রবেশ তাঁদের বুকে মৃদু হলেও কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে।
কোনও কোনও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক বলেছেন, রশিদের মত প্রার্থীদের জয় ভারতীয় গণতন্ত্রের সজীবতাকেই প্রমাণ করছে। কিন্তু অর্গানাইজার প্রশ্ন করেছে, এদেশে গণতন্ত্র কি এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে? আরএসএস-এর মুখপত্র চন্দ্রশেখর আজাদকে নিয়ে আপাতত কোনও মন্তব্য না করলেও তারা বলেছে, দুজন ‘খালিস্তানী’ (পাঞ্জাবের খাদুর সাহিবের অমৃতপাল সিং এবং ফরিদকোটের সরবজিৎ সিং খালসার কথা বলা হচ্ছে) এবং একজন কাশ্মীরী ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’র সংসদে পা রাখাটাই জাতীয় নিরাপত্তার পক্ষে বিপদের ইঙ্গিত। “As parliamentarians, all three winners will have access to sensitive central government documents that are not available to the general public. This information could be manipulated to influence public sentiment over time.”
জনাদেশ নিয়ে যাদের এত মাথাব্যথা, তারা জনগণের কাছ থেকে কিছু লুকিয়ে রাখতেও চায় তবে? গত এক দশকে নোট বাতিল থেকে লকডাউন, এমন সব সরকারি সিদ্ধান্ত জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে যা তাদের জীবনকে তছনছ করে দেওয়ার আগে পর্যন্ত গোপনীয়তার মোড়কে মোড়া ছিল। চন্দ্রশেখর আজাদ বা ইঞ্জিনিয়ার রশিদরা এবার যদি সেই গোপনীয়তার গহ্বর থেকে গণতন্ত্রকে বিন্দুমাত্রও বার করে আনতে পারেন, তবেই তাদের জয় সার্থক হবে। অবশ্য, রশিদকে আদৌ জেল থেকে সংসদ পর্যন্ত যেতে দেওয়া হবে কিনা তা এখনও পরিষ্কার নয়।
(লেখক গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা আন্দোলনের কর্মী।)
তথ্যসমৃদ্ধ দারুণ লেখা