নোটায় ভোট বেশি পড়লে নতুন করে ভোট নেওয়ার জন্য আইন করার দাবিও তোলা দরকার। যেমন দরকার একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্বাচিত প্রার্থী তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি না রাখলে তাকে ফিরিয়ে আনার অধিকারের (রাইট টু রিকল) জন্য আন্দোলন করা। সেই রাস্তায় না গিয়ে ‘নোটায় কোনও ভোট নয়’ বলে আওয়াজ তুললে লাভ কার? লিখলেন নীলাঞ্জন দত্ত।
এবারের ভোটের সুবাদে আবার ‘নোটা’ (NOTA — None of the Above, বাংলায় ‘কেউ পছন্দ নয়’) নিয়ে কিছু কথাবার্তা নজরে এসেছে। “সাধারণ” ভোটাররা নয়, বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মীরাই বেশি করে এই আলোচনা তুলেছেন। তাঁদের মাথাব্যথার কারণ হল, যেহেতু তাঁরা চান যে মানুষ ভোটের দলগুলোর মধ্যে কাউকে না কাউকে বেছে নিক, নোটা দিয়ে দিলে তো আর সে উদ্দেশ্য সিদ্ধি হবে না। তাই একটা রিনরিনে কোরাস উঠেছে, “নোটা নয়, নোটা নয়, অন্য কোনও বোতামে”।
এ বিষয়ে দুই বিপরীত রাজনৈতিক মেরুর মধ্যে এক অপূর্ব মেলবন্ধন লক্ষ করা যাচ্ছে। অবাক হওয়ার অবশ্য কিছু নেই, কারণ দুই তরফে একটা common cause তো রয়েইছে, যা হল ভোট ব্যবস্থাটার প্রতি জনগণের আস্থা অটুট রাখা। ভোট দিয়ে আমরা কী করি? বাংলায় বলতে গেলে ‘নির্বাচন’, ইংরেজিতে ‘ইলেকশন’। এই শব্দগুলোর অর্থই তো ‘বেছে নেওয়া’। ভোটও দেব, কাউকে বাছবোও না, তা আবার হয় নাকি? পছন্দ তো করতেই হবে, হয় একে, নয় তাকে। ‘কেউ পছন্দ নয়’ বলে দিলে তো ভোটের ছন্দ কেটে যায়। নোটা তাই ভোটের ময়দানে এক rogue player, যে বাঁদুরেপনা করে খেলাটাই ঘেঁটে দেওয়ার চেষ্টা করে। পারে কিনা, সেটা আলাদা কথা।
খবরের কাগজে দেখলাম, নোটা নিয়ে চটেছেন অনেকেই। যেমন, “বকলমে বিজেপির সমর্থনে আরএসএসের ছাত্র সংগঠন আখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি) স্লোগান নিয়ে এসেছে, ‘নো ভোট টু নোটা!’” এই নিয়ে তারা রীতিমত প্রচার অভিযান চালিয়েছে। তাতে দেওয়াল লেখা, পোস্টার, টোটো প্রচার, এসব তো আছেই, গান-নাটক পর্যন্ত আছে। সংগঠনের তরফে বলা হয়েছে, “নোটা’য় ভোট দেওয়া মানে ভোট নষ্ট করা। এক জন সচেতন নাগরিক তাঁর নাগরিক দায়িত্ব পালন করেন ভোটদানের মাধ্যমে। একটি শক্তিশালী, বিকাশশীল সরকার গঠনে প্রত্যেক নাগরিকের ভূমিকা থাকা উচিত। তাই ১০০% মানুষ যাতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তাঁদের ক্ষমতার উপযুক্ত প্রয়োগ করেন, সেই কথা মনে করিয়ে দিতেই এই প্রচার।” দেশ ও রাজ্যজোড়া এই প্রচারাভিযান নাকি পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, উত্তর ২৪ পরগনা, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমান, ঝাড়গ্রাম এবং কলকাতায় বেশ এগিয়ে গেছে।
এই প্রতিবেদনেই আছে, ‘নো ভোট টু বিজেপি’ আন্দোলনের এক কর্মী বলেন, “ওরা ঠিকই বলছে। ওদের স্লোগানের সঙ্গে আমিও সহমত। “নোটা’য় ভোট দেওয়া মানে ভোট নষ্ট করা। তার চেয়ে বিজেপি-বিরোধী যে দলের জেতার সম্ভাবনা বেশি, মানুষ যেন তাদেরই ভোট দেন!’’ প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, একথা তিনি “কিছুটা কটাক্ষের সুরে” বলেছেন, যা পড়ে আমি প্রথমে একটু confused হয়ে গিয়েছিলাম — এটা তাঁর ব্যক্তিগত বক্তব্য না সংগঠনের বক্তব্য তা নিয়ে।
তারপর দেখলাম, ফেসবুকে এই সংগঠনের একজন নেতা নোটার বিরুদ্ধে লিখেছেন। তাঁর বক্তব্য হল:
নির্বাচনে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে নোটা একটি প্রতিবাদী প্রতীক ছাড়া আর কিছুই নয়। ধরা যাক নোটায় ভোট পড়লো ১৫০০, এটা সর্বাধিক। আর পরবর্তী জন পেলো ১২০০। যিনি ১২০০ পেলেন তিনিই নির্বাচিত হবেন। পুনরায় নির্বাচন হবে না। আমি অন্তত যতদূর জানি। এই সংক্রান্ত অন্য কোন বিধি দেখিনি। ইন্দোরে কংগ্রেস প্রার্থী নিজের নাম তুলে নেওয়ার পর মুখোমুখি লড়াই-এ সম্ভবত আছে এসইউসি। সিপিএম ইন্দোরে নোটায় ভোট দেবার আবেদন জানিয়েছে। সম্ভবত কংগ্রেসও। এসইউসি কে ভোট দিতে বললে কিছুটা তো লড়াই হতে পারতো ইন্দোরে। নোটায় ভোট দিতে বলে বিজেপির রাস্তাটা কি মসৃণ করে দেওয়া হলোনা?
সিপিএম নোটায় ভোট দিতে বলেছে জেনে সত্যিই অবাক হলাম। কারণ বিগত বিধানসভা ভোটের সময় এই পার্টির এক বড় নেতার কাছ থেকেই নোটার বিরুদ্ধে লেকচার শুনতে হয়েছিল। কিন্তু সে প্রসঙ্গ এখন থাক। ‘নো ভোট টু বিজেপি’র এই নেতার যুক্তিগুলোকে নিয়েই কথা বলি।
নোটা যদি “একটি প্রতিবাদী প্রতীক ছাড়া” আর কিছুই না হয়ে থাকে, তাতে ক্ষতি কী? গণ-আন্দোলনের কর্মীরা এবং সাধারণ মানুষ কত প্রতীকী প্রতিবাদই তো করে, তাতে প্রতিবাদের প্রয়োজন বা গুরুত্ব খাটো হয়ে যায় কী? প্রতিবাদকে সবসময় সফল হতেই হবে? সফল হবেই যে, তার কোনও নিশ্চয়তা আছে? বেশিরভাগ সময় বরং তা হয় না। তা বলে মানুষ প্রতিবাদ করা থামিয়ে দেবে? থামিয়ে দেয়?
নোটা কোনও সরকার নিজে থেকে চালু করেনি। এর পেছনে একটা দীর্ঘ আন্দোলনের ইতিহাস আছে। সেই ১৯৯৯ সালে পশ্চিমবঙ্গে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি (এপিডিআর) ভোটযন্ত্র বা ব্যালট পেপারে ‘কেউ পছন্দ নয়’ বলে একটা বোতাম অথবা ঘর রাখার দাবি তোলে ও তা নিয়ে প্রচার শুরু করে। সমিতির পূর্ব কলকাতা শাখা ‘অপছন্দের অধিকার’ শিরোনামে একটা পুস্তিকা প্রকাশ করে, যাতে এই দাবিকে ব্যাখ্যা করা হয়। এপিডিআর এবিষয়ে কলকাতা হাইকোর্টে মামলাও করে। সেই মামলা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যায়। সুপ্রিম কোর্টে কেন্দ্রীয় সরকার জানায়, ভারতের সংবিধান অনুসারে কোনও নাগরিকের ভোট দেওয়ার অধিকার যেমন আছে, তেমনই ভোট না দেওয়ার অধিকারও আছে, সুতরাং আলাদা করে আর এই ব্যবস্থা রাখার কোনও দরকার নেই। আদালত তখন সেই যুক্তি মেনে নেয়।
প্রশ্ন থেকে গেল, কেউ যদি ভোট প্রার্থীদের মধ্যে কাউকেই পছন্দ নয় একথা স্পষ্টভাবে জানাতে চায়, তাহলে তো আর তো ভোট না দিয়ে বাড়িতে বসে থাকলে হবে না। আবার ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ‘ভোট দেব না’ বলতে গেলেও বিপত্তি। আমার নিজের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি।
ভোটের দিন নির্দিষ্ট জায়গায় গেলাম। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ভেতরে ঢুকলাম। বিভিন্ন দলের পোলিং এজেন্টরা তালিকা দেখে নম্বর মিলিয়ে নিল, হাতে কালিও নিলাম। তারপর পোলিং অফিসারকে বললাম, আমি ভোট দেব না, এবং সেটা রেকর্ড করাতে চাই। মুহূর্তের মধ্যে পরিবেশটা পালটে গেল। পোলিং অফিসার চিৎকার করতে শুরু করল, “সার, সার, আরেকটা ভোট-দেবে-না এসেছে।” ‘আরেকটা’ মানে পরে বুঝেছিলাম। আমাদের পাড়ায় ভাল মামা বলে একজন ছিলেন, যিনি ১৯৫২ সালে প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ভোট দেওয়ার পর বীতশ্রদ্ধ হয়ে আর কোনওদিন দেননি। কোনও এক ভোটের সময় শীতাংশুশেখর এইরকম দুজনকে — ভাল মামা আর নাট্যকার বাদল সরকার — নিয়ে একটা টিভি চ্যানেলে স্টোরিও করেছিল। তবে বাদলদা ভোট দিতে যেতেনই না, কিন্তু ভাল মামা আজীবন ভোটকেন্দ্রে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে ব্যালটে হিজিবিজি কেটে আসতেন। সেবার ভোটযন্ত্র চালু হয়েছে, এবং তিনি আমার আগেই গিয়ে তাঁর পছন্দের বদলে অপছন্দ রেকর্ড করাতে চেয়েছিলেন, তাই গোল বেধেছিল। আমার বেলাতেও বাধল। পার্টিগুলোর পোলিং এজেন্টরা মহা বিরক্ত হয়ে বকতে লাগল, “ভোট দেবেন না তো এখানে এসেছেন কেন? মিছিমিছি সময় নষ্ট করা!” নির্দল প্রার্থীদের এজেন্টরা বলল, “আরে ওদের দেবেন না তো কী হয়েছে, আমাদের কাউকে দিন।” প্রিসাইডিং আফিসার উপদেশ দিলেন, “এরোপ্লেন টেরোপ্লেন কিছুতে দিলে হয় না?” বললাম, “আপনাদের সময় নষ্ট করতে চাই না, রেকর্ড করিয়ে দিন, চলে যাচ্ছি।” তিনি ব্যাজার মুখ করে একটা ভোটার তালিকায় আমার নামের পাশে লিখতে বললেন, “রিফিউজ টু ভোট”। তারপর একটা ফর্ম ফিল-আপ করা হল। একমুখ বিরক্তি নিয়ে বললেন, “এবার আমাকে একটা সিল্ড খামে এটা আলাদা করে পাঠাতে হবে। দেখুন তো কত কাজ বেড়ে গেল।” আমি সবই করলাম, শুধু বেরিয়ে আসার সময় বললাম, “কাউকে ভোট দিলে সেটা গোপন থাকার কথা, কাউকেই ভোট না দিলে সেটা ওপেন হয়ে গেল — এবার যদি এখান থেকে বেরোলে আমাকে কেউ ‘ভোট বয়কটপন্থী নকশাল’ বলে পেটায়, আপনি দায়িত্ব নেবেন?”
যাইহোক, এরমধ্যে দিল্লির পিপল্স ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিস (পিইউসিএল) এবং আরও কিছু সংগঠন নতুন করে নোটার দাবিতে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করল (Writ Petition (Civil) No. 161 Of 2004 by PUCL and others)। লম্বা শুনানির পর ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৩ সর্বোচ্চ আদালত নোটা চালু করার নির্দেশ দিল। ভোটযন্ত্রে সেই বোতামও বসে গেল।
এই বোতাম যখন ছিল না তখন ‘ভোট দেব না’ বলতে গিয়ে আমার যে দশা হয়েছিল, সুপ্রিম কোর্ট ঠিক সেই কথাটাই তার নোটা মামলার রায়ে বলেছিল, যে কন্ডাক্ট অভ ইলেকশন রুলস, ১৯৬১র Rule 49-O “treats a voter who decides not to cast his vote differently and allows the secrecy to be violated, is arbitrary, unreasonable and violative of Article 19 and is also ultra vires Sections 79(d) and 128 of the RP Act.” (Para 31)
এই রায়ে আরও বলা হয়েছিল, “Not allowing a person to cast vote negatively defeats the very freedom of expression and the right ensured in Article 21 i.e., the right to liberty.” (Para 49) এবং, “a provision of negative voting would be in the interest of promoting democracy as it would send clear signals to political parties and their candidates as to what the electorate think about them. (Para 56)
কিন্তু সব ভোটে নোটার ব্যবস্থা হয়নি। লোকসভা, বিধান্সভায় হয়েছে বটে, পৌর বা পঞ্চায়েত নির্বাচনের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ রাজ্যেই এখনও নোটার কোনও সুযোগ নেই। এপিডিআর এবিষয়ে দুবার রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের সঙ্গে দেখা করে এই দাবি জানিয়েছে। শুনতে হয়েছে, “আইনে নেই তো কী করে করব, আপনারা বিধানসভায় বলুন গিয়ে।” বিধানসভার স্পিকার এবং সমস্ত সদস্যদের কাছে ২০১৫ সালে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে, তার কোনও উত্তর আসেনি।
এসব কাজ অবশ্যই বাকি আছে। কখনও নোটায় ভোট বেশি পড়লে নতুন করে ভোট নেওয়ার জন্য আইন করার দাবিও তোলা দরকার। যেমন দরকার একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্বাচিত প্রার্থী তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি না রাখলে তাকে ফিরিয়ে আনার অধিকারের (রাইট টু রিকল) জন্য আন্দোলন করা। সেই রাস্তায় না গিয়ে ‘নোটায় কোনও ভোট নয়’ বলে আওয়াজ তুললে লাভ কার?
(লেখক গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা আন্দোলনের কর্মী।)