“এখনও পর্যন্ত জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় ভারত সরকারের যাবতীয় পদক্ষেপ অন্যায্য, চূড়ান্তভাবে অগণতান্ত্রিক এবং বাস্তবত অকার্যকারী। দাবিসনদ জোর দিয়ে জানাচ্ছে, যে সমস্ত অঞ্চলে মানুষের জীবন-জীবিকা প্রকৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে অথবা, জলবায়ু পরিবর্তনে সরাসরি ভাবে যাঁদের জীবন ও জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাঁদের কাছে জলবায়ু সংকট দিন দিন প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে। জলবায়ুর পরিবর্তন যেমন তাঁদের ক্ষতি করছে, তেমনই উন্নয়ন ও জলবায়ু বদল মোকাবিলার নামে তাদের উপর আর্থ-সামাজিক শোষণ নিপীড়ন হয়েই চলছে।” তিথি রায়ের রিপোর্ট।
দেশ জুড়ে উষ্ণতা বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে ২০২৪ সালে পৃথিবীতে তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার এতাবৎকালের সব রেকর্ড ভেঙে দেবে। গাঙ্গেয় উপত্যকা জুড়ে চলছে লাগাতার তাপপ্রবাহ বা ‘হিট ওয়েভ’। এসবের এক ও একমাত্র কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেভাবে গরম বাড়ছে, সেরকমই কোথাও অস্বাভাবিক তুষারপাত, সাইক্লোন, খরা, বন্যা হয়ে চলেছে। উপকূলঅঞ্চল জুড়ে বাড়ছে সমুদ্রের জলস্তর। ধুয়ে যাচ্ছে একের পর এক দ্বীপ এলাকা। সারা পৃথিবী জুড়ে বনাঞ্চলগুলোতে বিধ্বংসী দাবানল ছড়িয়ে পড়ছে।
আবার, ২০২৪-র এপ্রিল মাসেই ভারতের রাজনৈতিক মহলে লোকসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হাওয়া অন্যভাবেও গরম। গ্রীষ্মের তাপ গায়ে লাগিয়েই আমরা দলে দলে বুথমুখী হচ্ছি। গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগে ভবিষ্যৎ-শাসক বেছে নিচ্ছি। কখনও ধর্ম, কখনও দুর্নীতি, কখনও সরকারি ভাতা, পরিকাঠামোর সমস্যার মতো নানা কিছু নির্বাচনের বিষয় হয়ে উঠেছে। তার উপরে ভিত্তি করেই ঠিক হচ্ছে কোন দলের হাতে থাকবে ভারতের শাসনভার। অথচ, অস্বাভাবিক আবহাওয়ায় আমরা যেভাবে বিপর্যস্ত তা আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে কিছুতেই প্রভাবিত করতে পারছে না। অর্থাৎ, আমরা কোন রাজনৈতিক দলকে ভোট দেব বা দেব না, আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনা থেকে জলবায়ু পরিবর্তনের গোটা বিষয়টার তাতে কোনও ভূমিকা নেই। অথচ, একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ, এবং অন্যদিকে তার প্রভাব— সবটাই আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। আমাদের প্রাত্যহিক কাজকর্ম থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের অর্থনীতি, শাসনব্যবস্থা, নীতি প্রণয়ন— এসব থেকে আজ জলবায়ু পরিবর্তন ও তার মোকাবিলাকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা সম্ভব নয়।
তাই, লোকসভা নির্বাচন চলাকালীন, পঞ্চাশটিরও বেশি সংগঠন এবং ব্যক্তি-উদ্যোগ একযোগে “জলবায়ু ন্যায়”-এর দাবিতে তাদের দাবিসনদ প্রকাশ করেছে। সংগঠন ও উদ্যোগগুলির মধ্যে যেমন জলবায়ু সংকট, প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষা, বন জঙ্গল ও বননির্ভর মানুষদের অধিকার নিয়ে কাজ করছেন এমন সংস্থা আছে, তেমনই আছে শ্রমিক সংগঠন এবং বিভিন্ন সমাজকর্মীরা। তাঁদের এহেন ডাকের কারণ— এখনও পর্যন্ত জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় ভারত সরকারের যাবতীয় পদক্ষেপ অন্যায্য, চূড়ান্তভাবে অগণতান্ত্রিক এবং বাস্তবত অকার্যকরী। দাবিসনদ জোর দিয়ে জানাচ্ছে, যে সমস্ত অঞ্চলে মানুষের জীবন-জীবিকা প্রকৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে অথবা, জলবায়ু পরিবর্তনে সরাসরি ভাবে যাঁদের জীবন ও জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাঁদের কাছে জলবায়ু সংকট দিন দিন প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে। জলবায়ুর পরিবর্তন যেমন তাঁদের ক্ষতি করছে, তেমনই উন্নয়ন ও জলবায়ু বদল মোকাবিলার নামে তাদের উপর আর্থ-সামাজিক শোষণ নিপীড়ন হয়েই চলছে।
উপকূলে থাকা মৎস্যজীবী সম্প্রদায়, জঙ্গলে থাকা আদিবাসী মানুষ, কিংবা পাহাড়-মালভূমির পশুচারণ সম্প্রদায়গুলি ক্রমাগত সরতে সরতে একসময় উচ্ছেদ হচ্ছেন। বেঁচে থাকার শেষ উপায় হিসেবে একটা বড় অংশ পরিযায়ী শ্রমিকের জীবন বেছে নিচ্ছেন। চেন্নাই, বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ, মুম্বাইয়ের মতো শহরে ভিড় বাড়ছে পরিযায়ী শ্রমিকদের। শহরেও শ্রমিক বা তথাকথিত পিছিয়ে থাকা শ্রেণির মানুষের জীবনযাত্রা মোটেই সহজ নয়। সেখানেও একইভাবে তাদের উপর অর্থনৈতিক, সামাজিক শোষণ চলছে। এখনও ভারতীয় পরিবারগুলোতে বাড়ির ভেতরের কাজকর্মের বোঝা মেয়েদের ঘাড়েই। সে ক্ষেত্রে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খাবারের সংকট, পানীয় জলের সংকট ও স্বাস্থ্যের অবনতি— এমন নানা চাপে তাঁদের সামাজিক অবস্থান বহুমাত্রায় খারাপ হচ্ছে। শুধুমাত্র তাই নয়। ভারত সরকারের জলবায়ু সংকট মোকাবিলা করার নানান নীতি ও উদ্যোগগুলিও শেষ পর্যন্ত জলবায়ু সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত প্রান্তিক মানুষের বিপক্ষেই দাঁড়াচ্ছে। তাঁদেরই বাসস্থান-জমি-জঙ্গল-বিচরণভূমি চলে যাচ্ছে সরকার এবং সরকার পোষিত কর্পোরেটদের দখলে। তা হচ্ছে স্রেফ জলবায়ু পরিবর্তনের ভয় দেখিয়ে। শেষত, জলবায়ু পরিবর্তনে যাঁদের উচ্ছেদ হতে হচ্ছে, তাঁদের উপরেই উচ্ছেদের আরও বড় বিপদ নেমে আসছে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণে রাখার নানান পদ্ধতি ও নীতি-নিয়মের বেড়াজালে। যেসব সম্প্রদায় এই সংকটের সঙ্গে দিন কাটাচ্ছে, যেসব প্রান্তিক মানুষের জীবন ছিন্নমূল হচ্ছে প্রতিনিয়ত, সমস্যার সমাধানে তাঁদের মতামত ও অংশগ্রহণের সুযোগ থাকছে না রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায়।
কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি ২০১৯-র লোকসভা নির্বাচনে তাদের ইস্তেহারে জানায়, তারা ক্ষমতায় থাকলে ২০৪৭ সালের মধ্যে ভারতের শক্তি (বা বিদ্যুৎ) উৎপাদন ক্ষেত্রে স্বাধীনতা আনবে। নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে সেই শাসকদল-ই গত দশক থেকে জানাচ্ছে, ২০৪৭ সালের মধ্যে ভারতে জলবায়ু ন্যায়ের উদ্দেশ্যে বাতাসে কার্বন নির্গমনের পরিমাণ শূন্য বা নেট জিরোতে নামিয়ে আনবে। আবার,আন্তর্জাতিক স্তরে ভারত উন্নত দেশগুলোর (আমেরিকা ও ইউরোপের নানা দেশ) উপরে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রাথমিক দায় চাপাচ্ছে। এবং ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো যাতে আরও বেশি করে জলবায়ু সংকট মোকাবিলা করতে পারে তাই অর্থের দাবিও করছে তাদেরই কাছে। এছাড়া, ভারতের নিজস্ব সমাধান-নীতি হিসেবে ব্যক্তিগত জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনায় উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ, দৈনন্দিন কাজে এমন জিনিসপত্র ব্যবহারের কথা বলা হচ্ছে যা কিনা তথাকথিতভাবে পরিবেশবান্ধব। সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে, জলবায়ু সচেতনতায় এক সম্মানজনক ভূমিকায় নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার। বাস্তবে সেই সরকারের আমলে, কয়লার উৎপাদন ও ব্যবহার (যা থেকে বাতাসে সবচেয়ে বেশি কার্বন ছড়ায়, ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ে, জলবায়ু সংকট তৈরি হয়) কমানোর সদিচ্ছা চোখে পড়ে না। উল্টে, কার্বন ক্রেডিট, গ্রিন ক্রেডিট, বেসরকারি বাগিচা বা প্ল্যান্টেশন প্রকল্পের মধ্যে দিয়ে জলবায়ু সংকটের সমাধান পুঁজি নিয়ন্ত্রিত বাজারের উপরই ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ, জলবায়ু ন্যায়ের জন্য ব্যক্তিগত স্তর থেকে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ কেমন হওয়া উচিত সবই ঠিক করবে কর্পোরেট, কোম্পানি এবং তাদের অধীনে থাকা পুঁজির বাজার। তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ অর্থাৎ বাতাসে কার্বন নির্গমনের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী ওই কর্পোরেটরাই।
পরিবেশ কর্মী প্রিয়া পিল্লাই জানাচ্ছেন, “বর্তমান শাসক দল ক্ষমতায় আসার পর পরিবেশ, বনভূমি অথবা, বন্যপ্রাণী নিয়ে আইন-কানুন এমন ভাবে পাল্টে ফেলছে যেখানে সাধারণ মানুষের সম্মতি বা মতামতের কোনও জায়গায়ই আর থাকছে না। উপরন্তু, সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা সর্বতোভাবে প্রশাসনের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। জলবায়ু ও পরিবেশ বিষয়ক সমস্ত আইনি ফাঁস ঢিলেঢালা করে দেওয়া হচ্ছে। আজকাল, কয়লার ব্যবহার কমিয়ে অপ্রচলিত-শক্তি (সূর্যের আলো, বাতাস, সমুদ্রের জল থেকে পাওয়া বিদ্যুৎ) ব্যবহার করার চেষ্টা চলছে। কিন্তু, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীশগঢ়ের মতো রাজ্যগুলো যেখানে কয়লা উৎপাদন এবং কয়লা ভিত্তিক অর্থনীতির সঙ্গে বহু শ্রমিক জড়িয়ে রয়েছেন তাঁদের বিকল্প জীবন-জীবিকার কথা কি সরকার ভাবতে পেরেছে? অন্যদিকে, বড় আকারের অপ্রচলিত-শক্তি উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যেও ঠিক একইভাবে মানুষের জমি-জঙ্গল-জীবিকা হারানোর ভয় রয়েছে। সুতরাং, দেশের সরকার আন্তর্জাতিক মঞ্চগুলিতে জলবায়ু বদল নিয়ন্ত্রণে চমৎকার সব লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা সত্ত্বেও জলবায়ুর প্রতি তা ন্যায়বিচার করতে পারছে না।”
উল্লেখ্য, লোকসভা নির্বাচনের আগে যেসব বড় কোম্পানিগুলি সরকারকে ইলেক্টোরাল বন্ডে টাকা দিয়েছে তাদের মধ্যে এই কয়লা ও বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সংস্থাও রয়েছে। দ্য রিপোর্টার’স কালেক্টিভের তথ্য বলছে, ভারতে জ্বালানি/ বিদ্যুৎ/ শক্তি ব্যবসায় জড়িত কোম্পানিগুলি নির্বাচনী বন্ডে এখনও পর্যন্ত মোট ৩,৬০০ কোটি টাকারও বেশি অনুদান দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলিকে৷ নির্বাচনী বন্ডে মোট অনুদানের প্রায় ৩০ শতাংশ অনুদান এসেছে ওই কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে।
গোটা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে কার্বন নির্গমনে ভারতের অবদান, দেশের অভ্যন্তরীণ জলবায়ু নীতি এবং পদক্ষে— এসব ঠিক করতে গিয়ে বারবার দেশের সরকার উপেক্ষা করেছে প্রাকৃতিক সম্পদের উপর দেশের সাধারণ নাগরিকের অধিকার, গণতান্ত্রিক শাসন কাঠামোকে। ক্ষুণ্ণ হয়েছে ভারতীয় সংবিধানের ৫ম এবং ৬ষ্ঠ তফসিলের নির্দেশিত শাসননীতি; পেসা (PESA) ও বনাধিকার আইন (FRA)-র মতো জনমুখী আইন যা সাধারণ মানুষকে প্রকৃতি-পরিবেশ-সমাজব্যবস্থার উপর স্বায়ত্তশাসন কায়েম করতে উৎসাহিত করে।
জলবায়ু সংরক্ষণের নামে কেন্দ্রীয় সরকার বন সংরক্ষণ আইন সংশোধন করে ফেলেছে। কিন্তু, সংশোধনী আইনের ধারাগুলো সুস্পষ্ট ভাবে জানান দেয় ‘উন্নয়ন’ ও জলবায়ু সংরক্ষণে সরকারি দায়বদ্ধতার দোহাই দিয়ে নানাবিধ বড় প্রকল্প (যা পাহাড়-জঙ্গল-নদীর ক্ষতি করতে পারে) অবাধে ছাড় পেয়ে যাচ্ছে। এবং জঙ্গল ব্যবস্থাপনায় সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগকে ব্যাপক ছাড় দেওয়া হচ্ছে। অথচ, সেই জঙ্গলের উপর যাদের জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল সেই আদিবাসী ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষের মতামত, জঙ্গল বাঁচানোয় তাঁদের অংশগ্রহণকে বিবেচনা করা হচ্ছেই না। বরং, জঙ্গল-সহ অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারে তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকারকে নস্যাৎ করা হচ্ছে। পরিবেশকর্মী প্রিয়ার কথায়, “কয়লার বা অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বিকল্প শক্তি ব্যবহারের পরিবর্তন শুধুমাত্র জলবায়ু রক্ষার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলেই সমস্যা মিটবে না। সমাজের ভিতরে বসে থাকা লিঙ্গ-বর্ণ-জাতিভিত্তিক অসাম্য, অন্যায়, অবিচারের প্রেক্ষাপটে জলবায়ু রক্ষার পন্থা ঠিক করতে হবে। জলবায়ু ন্যায় প্রতিষ্ঠা আমাদের কাছে এক বিরাট সুযোগ হয়ে উঠতে পারে। এর মাধ্যমেই আমরা সামাজিক কাঠামোয় থাকা নানা অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার দিকে এগোতে পারি। জলবায়ু বদল মোকাবিলা একেবারেই কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। তা আসলে আমাদের এই গোটা সমাজব্যবস্থা, গোটা তন্ত্রের বদল। এবং সেখানে যাবতীয় নীতি-নিয়ম ঠিক করার অধিকার যেন সেই সমস্ত মানুষের হাতেই থাকে, যাঁদের জীবন জল-জমি-জঙ্গলের ওপর নির্ভরশীল।” এই প্রসঙ্গে সমাজকর্মী সৌমিত্র ঘোষ জানাচ্ছেন, “জলবায়ুর পরিবর্তন একটি বিশ্বব্যাপী ঘটনা। এ নিয়ে সরকার, কোম্পানি বা আমলারা তাদের সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষের ওপর চাপিয়েই চলেছে। অথচ, জলবায়ুর বদল এবং তার সমাধানের নিয়ম-নীতি— উভয় দিক দিয়েই যাঁরা আক্রান্ত, সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের যৌথভাবে অংশ নেওয়ার কোনও সুযোগই নেই। এভাবে জলবায়ুর সমস্যা মিটবে না। সমস্যার সমাধান স্থানীয়ভাবে তৃণমূল স্তর থেকেই করতে হবে। সরকারের মৌলিক প্রচেষ্টা হওয়া উচিত— দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোয় আঞ্চলিক স্তরে স্বায়ত্তশাসনের একক অর্থাৎ গ্রামসভা বা স্বায়ত্তশাসিত জেলা পরিষদের মতো প্রতিষ্ঠানগুলিকে মজবুত করা। এবং সেই প্রতিষ্ঠানগুলি চালু করার জন্য নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া তৈরিই আশু লক্ষ্য হওয়া উচিত।”
জলবায়ু, পরিবেশ এবং মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় কাজ করে চলা সংগঠন ও ব্যক্তি উদ্যোগগুলি যে দাবিসনদ প্রকাশ করেছে সেখানে তাদের মূল দাবিগুলি হল—
# আন্তর্জাতিক এবং জাতীয়, উভয় স্তরেই ভারতের জলবায়ু সংক্রান্ত কাজের কাঠামো পর্যালোচনা এবং পুনর্বিন্যাস করা, যেখানে জলবায়ু রক্ষার জন্য নানা কাজকর্ম ও নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে জলবায়ু সংকটে ভুক্তভোগী সম্প্রদায়ের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন না; এবং জলবায়ু সংকটের মোকাবিলা ন্যায়, সাম্য, গণতান্ত্রিক শাসন এবং সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পথেই করতে হবে;
# বন সংরক্ষণ আইনে সাম্প্রতিক সংশোধনীর পর্যালোচনা করা; ২০২০ এবং ২০০৬ সালের পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন (EIA) সংশোধনী বাতিল করা এবং ১৯৯৪ সালের পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন বিজ্ঞপ্তিকে শক্তিশালী করা;
# ন্যায্য ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের অধিকার আইন ২০১৩, বন অধিকার আইন, ২০০৬ (FRA) ও পেসা (PESA) বাস্তবে কার্যকর করতে হবে;
# সমস্ত উন্নয়নমূলক প্রকল্পের জন্য গ্রামসভাগুলোকে সঠিক অর্থে জানানো ও তাদের সম্মতি (FPIC) এবং সাধারণ নাগরিকের পরামর্শ ও মতামত নেওয়ার প্রক্রিয়া যথাযথভাবে চালু করতে হবে;
# জলবায়ু সংকটের সবচেয়ে সহজ ও কার্যকরী সমাধান হিসেবে বড় এলাকা জুড়ে বাগিচা-বন তৈরি ও বনায়নের প্রচার বন্ধ করতে হবে;
# বায়ু, সৌর এবং অন্যান্য পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি বা বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলির পরিবেশগত ছাড়পত্র থাকা আইনিভাবে বাধ্যতামূলক করতে হবে; এবং এসব ক্ষেত্রেও বনভূমি ব্যবহার করতে হলে তা বনাধিকার আইন (FRA)-র নির্দেশ মেনেই করতে হবে;
# জীবাশ্ম জ্বালানিকে ঘিরে যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় রয়েছি তা থেকে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি ভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তর নিশ্চিত গেলে ভারত সরকারকে অবিলম্বে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে; যেমন— সরকারি খাতের উদ্যোগগুলিকে সমর্থন করার জন্য এবং জীবাশ্ম জ্বালানী শিল্পের উপর নির্ভরশীল শ্রমিকদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান ও আর্থ-সামাজিক সহায়তার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা তৈরি করা;
# বন অধিকার আইন এবং জাতীয় জীববৈচিত্র্য কর্ম পরিকল্পনার নির্দেশ না মেনে দেশে কোনও নতুন সুরক্ষিত বনাঞ্চল বা বাঘ সংরক্ষণ এলাকার বিজ্ঞপ্তি দেওয়া যাবে না;
# চাষবাসের ক্ষেত্রে নানা রকম শস্য ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চাষ করার, স্থানীয় জাতের বীজ স্থানীয়ভাবে সংরক্ষণ করা ও তার বিলি-ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
“জলবায়ু ন্যায়”-এর দাবিসনদ
[pdf-embedder url=”https://www.groundxero.in/wp-content/uploads/2024/04/Demand-Charter_Climate-Justice-Just-Transition-2.pdf” title=”Demand Charter_Climate Justice & Just Transition (2)”]