সন্দেশখালিতে অত্যাধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে অস্ত্র খোঁজা হচ্ছে, হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই সন্ত্রাসবাদীও খুঁজে বের করে ফেলবে সংবাদমাধ্যমগুলি। সুন্দরবন অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র রক্ষা বা সেখানকার মানুষের নিরাপত্তা ও স্বাভাবিক জীবনযাপন সুনিশ্চিত করার কোনো অভিপ্রায় বিজেপির নেই; তারা আপাতত ধর্মীয় মেরুকরণের মাধ্যমে অঞ্চলবাসীর মন বিষিয়ে চলেছে। লিখছেন উপমা নির্ঝরাণি।
সন্দেশখালি— গত কয়েকমাস ধরে পশ্চিমবঙ্গের সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে মফস্বলের নির্বাচনী প্রচারে একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম হয়ে উঠেছে। পশ্চিম বাংলার দেয়ালে দেয়ালে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ‘মা-বোনেদের’ উপরে হওয়া অত্যাচারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠছে; মহিলাদের ওপর অত্যাচারের বর্ণনা এবং অত্যাচারীদের মধ্যে কয়েকজনের ধর্মীয় পরিচয় হয়ে উঠেছে অনেক সংসদীয় দলের প্রধান নিশানা। এ কথা সত্যি যে সন্দেশখালির মহিলারা এগিয়ে এসে সন্দেশখালি ২ নম্বর ব্লকের তৃণমূল কংগ্রেস দলের সভাপতি শিবু হাজরার খামারবাড়িতে আগুন না-দিলে, যে নির্মমতার সাক্ষ্য বিদ্যাধরী, কালিন্দী, ডাসা, ইছামতী ও অন্যান্য নদীগুলির উপকূলবর্তী অঞ্চল এখনও বহন করে চলেছে, তার খবর পেতে আরও দেরি হত। সন্দেশখালি অঞ্চলে ১৪৪ ধারা উঠে যাওয়ার পর ৮ মার্চ সেখানকার গ্রামগুলিতে গিয়ে কয়েকজন স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। ধূসর ভেড়িসর্বস্ব সন্দেশখালির চেহারা দক্ষিণবঙ্গের আর পাঁচটা জায়গার মতো নয়। একসময়ে সেখানে ধানচাষ হত— কিন্তু নোনাজলে ধ্বস্ত সেই এলাকায় সবুজের দেখা পাওয়া ভার। দুপুরবেলা কর্ণখালি গ্রামের একটি চালাঘরে এক শীর্ণকায় প্রৌঢ়া কাঁটাফল কাটছিলেন দুপুরে তরকারি করে খাবেন বলে। তাঁর বাড়ির সামনেই তাঁদের জমি; একসময়ে তাঁরা সেখানে ধান ফলাতেন। এখন তাঁদের এবং বহু মানুষের একদা উর্বর জমি হয় ধূসর প্রান্তরে নয় ভেড়িতে পরিণত হয়েছে এবং সেই অঞ্চলে কাঁটা জাতীয় উদ্ভিদ ছাড়া অন্য উদ্ভিদের বেড়ে ওঠার উপায় নেই। উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার অনেক অঞ্চলে অনেকদিন ধরেই জমি দখল করে ভেড়ি বানানো হচ্ছে এবং অনেক জায়গাতেই এমন এক প্রজাতির চিংড়ি চাষ করা হচ্ছে, যা ওই অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্রের জন্যেও যথেষ্ট ক্ষতিকর।১
২০২১ থেকে বিঘার পর বিঘা জমি দখল করতে শুরু করেন উত্তম সর্দার, শিবু হাজরারা। প্রথমে অত্যন্ত কম টাকায় লিজ নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়, কেউ প্রতিবাদ করলে তাঁর ওপর শারীরিক নির্যাতন করা হয় বলে অভিযোগ। কর্ণখালির সেই প্রৌঢ়া, লীলা সর্দারের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর তিনি জানালেন তাঁরা জমি দিতে না-চাওয়ায় তিন বছর আগে নদী থেকে নোনাজল ঢুকিয়ে মাটি নষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল জমি চাষের অনুপযোগী করে তুলে, সেগুলো দখল করে ভেড়িতে পরিণত করা। লীলারা জমি দিতে রাজি হননি। লীলা জানান, জমি নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর তাঁর স্বামী জনমজুর হয়ে উপার্জন করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু, ২০২৩-এর নভেম্বর মাসে উত্তম এবং তাঁর সঙ্গীরা তাঁর ওপর আক্রমণ করে, এবং এখনও তিনি শয্যাশায়ী। সেই সময় থেকেই তাঁদের উপার্জন বন্ধ। লীলা এই ভেবে স্বস্তি বোধ করেন যে তাঁদের মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। তরুণী তথ্যসন্ধানীর কাঁধে হাত রেখে তিনি বলেন, “তোমাদের বয়সি মেয়েদের এই সময়ে ঘরে রাখা যায়?”
আরও অভিযোগ, জমি দখল করে ভেড়ি বানানোর পাশাপাশি চলছিল মেয়েদের ওপর শারীরিক, মানসিক এবং যৌন নির্যাতন। যখন তখন তাঁদের বিভিন্ন সভায়, ‘ব্যক্তিগত কাজে’ ডেকে নিয়ে যাওয়া হত। রাত্রিবেলা সভায় নিয়ে গিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে মহিলাদের সারারাতও আটকে রাখা হত। কর্ণখালির আরেকজন মহিলা বাসিন্দার মনে পড়ে, তিনি ঘাটের দিকে একবার বাজার করছিলেন, তখন উত্তমের গুন্ডারা তাঁকে সভায় যেতে বাধ্য করে; বাজারসমেত থলে বাজারে ফেলেই তাঁকে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য সভায় যেতে হয়। এইসব সভা চলাকালীন কোনো টোটোচালক যাত্রীর খোঁজে বেরোলে ওই গুন্ডাদের হাতে তাঁকে মার খেতে হত। লীলার প্রতিবেশী ভারতী সাহা একা থাকেন; তাঁর দুই ছেলে কলকাতায় কর্মরত। লীলার মতোই তিনিও চান না তাঁর সন্তানরা ফিরে আসুক, তিনি উত্তেজিত হয়ে বলছিলেন, “কোথাও যদি কিছু গন্ডগোল হয়, ওদের ধরে-টরে নিয়ে যায়…যা হয় হবে, আমাদের ওপর হোক। আমরা গরীব মানুষ, এখন হঠাৎ করে যদি একটা কেস দিয়ে দেয় তখন আমরা কী করে ঠেকাব?” তাঁদের জমিও নোনাজল ঢুকিয়ে নষ্ট করা হয়েছে। তিনি এখন নদীর ধারে জাল ফেলে অল্প কিছু মাছ ধরেন, এক জন তাঁর কাছ থেকে এবং স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দার থেকে মাছ কিনে নিয়ে বাজারে বিক্রি করেন। জমি হারিয়ে তাঁরা এখন এই অনিশ্চিত আয়, সরকারি প্রকল্পের অপর্যাপ্ত চাল আর একরাশ আতঙ্ক নিয়ে কোনোরকমে দিন কাটাচ্ছেন। এই মাৎস্যন্যায় পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য, বাঁচার তাগিদে তাঁরা এমন অনেক মানুষ এবং সংগঠনের ওপর ভরসা করা শুরু করেছেন, যাঁরা তাঁদের বিপণ্ণতাকে নিজেদের সুবিধার্থে ব্যবহার করছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, বেশ কিছু বছর ধরে ওই এলাকার মানুষ ভোট দিতে পারেননি। সঙ্ঘ পরিবার অনেকদিন ধরেই সেখানকার আদিবাসী মানুষদের মধ্যে নিজেদের ভাবধারাকে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। তৃণমূলের লুঠতরাজ ও নির্যাতন তাদের প্রসারকে ত্বরান্বিত করেছে। অখিল ভারতীয় আদিবাসী বিকাশ পরিষদের সদস্যরা সেইটার সুযোগ নিচ্ছে, তারা একরকমের মিথ্যা বয়ান প্রচার করছে যে, “মুসলমানদের হাতে হিন্দু মা বোনেরা অত্যাচারিত হচ্ছে।” বেড়মজুরের বেহুলা সর্দারের কাছে যখন মূল বিষয়টি জানতে চাওয়া হয়েছিল, তিনিও প্রথমে একই কথা বলেছিলেন। তারপর অত্যাচারীদের নাম জানতে চাওয়ায় তিনি বলেন শঙ্কর সর্দারের কথা; তিনি জানান তাঁদের কাছে দলিল থাকা সত্ত্বেও প্রায় একশ’ বিয়াল্লিশ বিঘা জমি শঙ্করের তত্ত্বাবধানে বিক্রি হয়ে গেছে। বিঘার পর বিঘা দখল হওয়ার পর পোলপাড়া, বেড়মজুর এলাকার গ্রামবাসীরা তৃণমূলঘনিষ্ঠ পঞ্চায়েত সদস্য শঙ্কর সর্দারের বাড়ির সামনে বিক্ষোভ দেখান। সেই সময়ে তিনি বাড়িতে ছিলেন না, তাঁর স্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। বিক্ষোভ চলাকালীন পুলিশ এসে গ্রামবাসীদের হুমকি দেয়, তাঁদের বলা হয় তাঁরা যাতে আইন হাতে না তুলে নেন। বেহুলা জানান সেখানে আদৌ কোনো ভাঙচুর করা হয়নি, এবং কেউই আইন হাতে তুলে নেননি। প্রতিবাদীদের মধ্যে শঙ্করের এক তুতো বোনও উপস্থিত ছিলেন; দাদার বিরুদ্ধে, আসলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য তাঁকে নিজের পরিজনদের কাছে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এত কিছু ঘটে যাওয়ার পরেও তাঁরা বিচার পাননি। তাঁদের ভয় দেখিয়ে রাখা হয়েছে এই বলে যে পুলিশ ও মিডিয়ার যাতায়াত বন্ধ হলে,”দেখে নেওয়া হবে”। বেহুলাদি গলার স্বর নিচু করে বললেন, “সব জায়গায় শাহজাহানের কান রয়েছে।” ‘কান’ যে রয়েছে সে কথা বারবারই টের পাচ্ছিলাম, তবে কানগুলি শুধু শাহজাহানের কিনা তা জানার উপায় ছিল না।
সঙ্ঘ পরিবার সেখানে প্রায় একযুগ ধরে নিজেদের জমি শক্ত করার চেষ্টা করছে, তারা একটার পর একটা পাকা মন্দির বানিয়ে চলেছে। যেখানে পানীয় জলের জন্য গ্রামের জমিহারা, অত্যাচারিত নারীদের কয়েক মাইল হেঁটে গিয়ে এলাকার একটি মাত্র নলকূপের সামনে লাইন দিতে হয়, সেখানে শুকিয়ে যাওয়া গাছের ডালে ডালে ভর্তি করে গেরুয়া পতাকা লাগিয়ে রাখা হয়েছে। প্রচুর অর্থব্যয় করে সেখানে বিভিন্ন মূলধারার হিন্দু দেবদেবীর পুজো, সংকীর্তনের আয়োজন করা হয়। গ্রামের মহিলারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ করার আগে আরএসএস-এর আদিবাসী শাখা আদিবাসী বিকাশ পরিষদ জমিদখল, শারীরিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতনের বিষয়গুলির বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপই নেয়নি, এবং তাঁদের কোনো সাহায্যও করেনি। যে গ্রামগুলিতে পঞ্চায়েত নির্বাচনে কোনো গ্রামবাসী ভোট দিতে পারেন না, তৃণমূল গুন্ডামি করে জেতে, সেই এলাকাগুলোয় নবনির্মিত মন্দিরের আধিক্য চোখে লাগার মতো। আদিবাসী বিকাশ পরিষদের স্থানীয় কার্যকর্তা দিলীপ সর্দার গ্রামের মানুষদের জমি ফিরিয়ে দেওয়ার মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে চলেছেন, কিন্তু বিজেপির প্রচারে বা মূলধারার সংবাদ মাধ্যমে জমি দখল বা ক্ষতিকর প্রজাতির চিংড়ি চাষের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি গৌণ হয়েই থেকে যাচ্ছে। বর্তমানে সন্দেশখালিতে অত্যাধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে অস্ত্র খোঁজা হচ্ছে, হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই সন্ত্রাসবাদীও খুঁজে বের করে ফেলবে সংবাদমাধ্যমগুলি। সুন্দরবন অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র রক্ষা বা সেখানকার মানুষের নিরাপত্তা ও স্বাভাবিক জীবনযাপন সুনিশ্চিত করার কোনো অভিপ্রায় বিজেপির নেই; তারা আপাতত ধর্মীয় মেরুকরণের মাধ্যমে অঞ্চলবাসীর মন বিষিয়ে চলেছে।
সূত্র
১ তৃণমূলের নেতা শিবু হাজরা প্রধানত ভেনামি প্রজাতির চিংড়ি চাষে ইচ্ছুক ছিলেন। এই বিশেষ প্রজাতির চিংড়িটিকে আন্তর্জাতিক পরিবেশ রক্ষা সংস্থা গ্রিনপিস ক্ষতিকর জলজ প্রাণীদের তালিকায় রেখেছে।
( উপমা সাহিত্যের ছাত্র)