ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে মেরুকরণের রাজনীতির যে নমুনা দেখা যাচ্ছে তা ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের দিকে ইঙ্গিত করছে। লিখলেন সীতাংশুশেখর।
এই বার লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগেই রাম নবমী। ভোটের ঢাকে আর রাম নবমীর পূজোর ঢাকে কাঠি পড়ার সঙ্গেই মাঠে নেমে পড়েছেন এর থেকে ফায়দা তুলবেন যারা, তারা। নির্বাচনী নির্ঘন্ট বাজার সঙ্গে সঙ্গেই রক্তপাত, মারদাঙ্গা, হিংসা মাত্রাহীনভাবে বেড়ে যায় এখানে। “এমনিতো এখানে যখন-তখন বোমা গুলি চলে, এই সেদিন তো একজনের গলায় কোপ পড়ল ভোজালির, হামারা সামনে, ডর লাগে, লেকিন ক্যায়া করেগা, এইস্যাই হোতা হ্যায় ইঁহা পর,” একটানা বলে চলে সতেরো বছরের কলেজ পড়ুয়া রেজিনা (নাম পরিবর্তিত)।
এই চিত্র এই তল্লাটে খুবই পরিচিত। এখানে শৈশব বেড়ে ওঠে বোমা, পিস্তল আর পাইপগানের মুখে। এখানে দারিদ্র্যের মধ্যেই হাসতে হাসতে বেড়ে ওঠে শৈশব, আবার বোমাকে বল ভেবে খেলতে খেলতে হারিয়েও যায় শৈশব। এ-ই হচ্ছে ব্যারকপুর শিল্পাঞ্চলে ভাটপাড়া-কাঁকিনাড়া তল্লাট।
গত ২০১৯ সালের জুন মাসে ভাটপাড়া বিধানসভা নির্বাচনে ফল বেরোনোর পর থেকেই কাঁকিনাড়া অঞ্চলে যুযুধান দু’দল রাজনৈতিক কারবারির সাঙ্গোপাঙ্গদের এলাকা দখলের উন্মত্ততায় এই শিল্পাঞ্চলের বিপুল শ্রমিক বস্তি-সহ নিম্ন মধ্যবিত্ত জনসাধারণের বাড়িঘর, সামান্য যা কিছু সম্পদ শুধু যে ভস্মীভূতই হয়েছে তা নয় বিপন্ন হয়েছে জীবনও। বহু মানুষ আহত হয়েছিলেন, মৃত্যু হয়েছিল পাঁচ জন নিরীহ দরিদ্র নাগরিকের।
ঘটনার মূলে ছিল তৃণমূল-বিজেপির রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। আরও পরিষ্কারভাবে বলতে গেলে মদন মিত্রের সঙ্গে পবন সিং-এর লড়াই। ঘটনার দিন অর্থাৎ ২০১৯-এর জুন মাসের কুরুক্ষেত্রে আসল লড়াই ছিল কৃষ্ণের (কৃষ্ণের অষ্টনামের আর এক নাম মদন) সাথে অর্জুনের (পবন সিং–এর পিতা)। সেদিনের ঘটনায় এই শিল্পাঞ্চলের শ্রমিক শ্রেণি, তাদের মধ্যে সুদীর্ঘ সময় ধরে বজায় রাখা সম্প্রীতি ও বিশ্বাসের বাতাবরণ ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকে চুরমার করে ‘সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা’ হয়েছিল। অর্থাৎ যাদের শ্রেনী মিত্র হওয়ার কথা ছিল তারা পরস্পরকে দেখেছিল সন্দেহের চোখে, অভিযোগ আর পাল্টা অভিযোগে একে অপরের দিকে আঙুল তুলেছিল। আর এসবই হয়েছিল ক্ষমতালোভীদের ক্ষমতা পাওয়ার লক্ষ্যের চক্রান্তকে কেন্দ্র করে।
আজ সেখানে কী পরিস্থিতি? কি বলছে ভাটপাড়া-কাঁকিনাড়ার মজদুর লাইন?
২০১৯ সালের দাঙ্গার পর এই এলাকার মানুষেরা কেমন আছেন তার তথ্য সন্ধানে এই প্রতিবেদক গিয়েছিলেন এই শ্রমিক অঞ্চলে।
জগদ্দলের ব্যবসায়ী টিংকু আলম জোরের সাথে বলে উঠলেন, সেই দাঙ্গায় তাঁর দোকান অফিস লুট হয়েছিল, তাঁর বাবার উপর আক্রমণ হয়েছিল, তাঁর অফিস বিজেপি দখল করে পার্টি অফিস বানিয়েছিল। একটি ঘর উদ্ধার করলেও অন্যটি আজও উদ্ধার করতে পারেননি টিংকু আলম। সামান্য কিছু টাকা পেলেও সেই অর্থে ক্ষতিপূরণ পাননি।
যেমন কোনও ক্ষতিপূরণ পাননি মিলের মজদুর লালবাবু। সেদিন আক্রমণের মুখে সব কিছু ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে প্রাণে বেঁচেছিলেন লালবাবু। কোনক্রমে বিহারে চলে যান তিনি। পরে ফিরে এসে দেঁখেন তাঁর ঘর ভেঙে সব লুট করা হয়ে গেছে।
মিডিয়া থেকে এসেছি শুনে চিৎকার করে বলে উঠলেন টিনা গোডাউনের রাজিয়া বিবি, ‘‘আউর কিতনা মিডিয়া লোগোকো বোলেগা, কুছ নেহি মিলা। সব লোগ আতা হ্যায়, পুছতা হ্যায় লেকিন কুছ নেহি হোতা।’’ রাজিয়া বিবি জানালেন ,তাঁর বাবার উপর আক্রমণ হয়, বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে যান তিনি, ফিরে এসে দেখেন সব লুট হয়ে গেছে।
এই পাঁচ বছরে ভাটপাড়ার অদূরে গঙ্গার জল অনেক দূর পর্যন্ত গড়িয়ে গিয়েছে। ঘর ছাড়ার এবং ঘর হারানো মানুষেরা আবার ফিরে এসেছেন। টিঁকে থাকার জন্য মাথার ছাদটা আবার বানিয়েও নিয়েছেন। ক্ষিদের টানে ছুটছেন মিলে, কবরে শায়িত প্রিয়জনের মুখ বা শশ্মানে প্রিয়জনের নশ্বর স্মৃতি ধূসর হয়ে যাচ্ছে মিলের কলের আওয়াজে।
পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতই খুশির ঈদে ৪নং কুলিলাইনে রিজাওনু রেজিনা বেগম কিংবা টিনা গোদামে আলমাস, রফিকুল, জাহানারারা (নাম পরিবর্তিত) পথে থমকে যান আমার বেয়াড়া প্রশ্নে – “ইলেকশন আ রাহা হ্যায়, সাথমে রাম নবমী পূজা, ক্যায়া সোচতা হ্যায় আপ লোক, কুছ হোগা?” বললেন, “মালুম নেহি। আভি তক ঠিক হ্যায়, হোগা কি নেহি হোগা, ওলোক জানতা হ্যায়।”
তাঁদের কথা বাংলায় তর্জমা করলে যা দাঁড়ায় – “এখনও পর্যন্ত সব ঠিক আছে, শান্তিতেই আছি, ঝুট ঝামেলা নেই। সেবারোতো তাই ছিল। আক্রমণের আগে তো জানতেই পারিনি এ রকম হতে পারে। আগে তো হয়নি, সেবারেই হয়েছিল। এই দেখুন হোলি গেল, এই ঈদ গেলো, সবাই শান্তিতেই আছি। আপনি প্রশ্ন করছেন কিছু কি হতে পারে। না হলে তো তা বলতে পারবো না, তবে সেদিনের কথা আমরা ভুলে যেতে চাই। যা হয়েছে, আর যাতে না হয় সেটা চাইছি। কিন্তু এসব তো আমাদের হাতে নেই। হতেও পারে। আমরা আতঙ্কে আছি।”
অবিশ্বাস, সংশয়, আর আতঙ্ক একসঙ্গে চোরাস্রোতে যে বইছে, তা কান পাতলেই বোঝা যায়। আতঙ্কের সব উপকরণ আজও মজুত আছে। সেই একই পটভূমিকা আছে, নির্বাচনও আছে, রামও আছে, রাম নবমীও আছে। কুশিলবের কিছু পরিবর্তন ঘটলও, এবারের আসরে হাজির হয়েছেন শ্রীকৃষ্ণের সখা একই নামে দুই যুযুধান পার্থ(ভৌমিক) এবং অর্জুন(সিং)।
গতবারে এই এলাকার মানুষ দেখেছেন যুদ্ধং দেহি রাম রূপে অর্জুনকে। সেবারে রামের হাত ধরেই বৈতরণী পার হয়েছিলেন অর্জুন। এবারে সেই যুদ্ধং দেহি রাম হাইজ্যাক হয়ে গেছে অর্জুনের কাছ থেকে। এলাকায় সর্বত্রই দেখা যাচ্ছে রামরূপে পার্থকে, রামের সঙ্গে পার্থকে একই ব্র্যকেটে। এলাকায় পোস্টার ছেয়ে গেছে — রামের সঙ্গে পার্থ। বড়ো বড়ো হোর্ডিং-এ যুদ্ধং দেহি রামের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ও পার্থ ভৌমিক।
এতদিন বাংলার মানুষ যে চিত্রটা দেখতে অভ্যস্ত ছিল, তা হলো বিজেপি রামের নামে মিছিল করবে, সংখ্যালঘু মানুষদের আক্রমণ করবে, হিন্দুদের বার্তা দিয়ে মেরুকরণের রাজনীতি করবে, নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ঘটিয়ে হিন্দু ভোট তাদের (বিজেপি) দিকে নিয়ে আসতে চাইবে। এই প্রেক্ষাপটে প্রশাসনে থেকেও মুখ্যমন্ত্রী বিজেপিকে এই পরিকল্পনাকে সফল করতে দেবেন, আর তারপর শান্তি মিছিল করে বা বিজেপিকে ঘটনার জন্য দোষারোপ করে সংখ্যালঘুদের পরিত্রাতা হিসাবে নিজেকে তুলে ধরে সংখ্যালঘুদের ভোট নিজেদের (তৃণমূল কংগ্রেস) বাক্সে নিয়ে আসার চেষ্টা চালাবেন। এটাই ছিল বাংলায় নির্বাচনী স্ট্যাটেজি। শাসক এবং প্রধান বিরোধী দলের, তৃণমূল এবং বিজেপির।
কিন্তু আজকের পশ্চিমবাংলার যে কোনো সচেতন মানুষের কাছে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে, হিন্দুত্বের রাজনীতির একচেটিয়া সুযোগ তৃণমূল আর বিজেপিকে নিতে দিতে চাইছে না, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপির এ্যাজেন্ডা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছন। তাই, ইতিমধ্যে রাম নবমীর দিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করে রাজ্য সরকার বিজেপির তুরুপের তাস কেড়ে নিতে চলেছে। ময়দানে রেড রোডে ঈদের সমাবেশে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে সরাসরি তৃণমূলকে ভোটদানের আহ্বান জানিয়ে মেরুকরণের রাজনীতি, বিভাজনের রাজনীতির ষোলকণা পূর্ণ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ তাঁরই অনুপ্রেরণায় তাঁরই অনুগামীরা ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে মেরুকরণের যে রাজনীতির নমুনা দেখাচ্ছে তা ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের দিকে ইঙ্গিত করছে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য অর্জুন সিং মেরুকরণের রাজনীতির কোন শব্দভেদী বান প্রয়োগ করবেন এবং তার পরিণতি কী হতে পারে তা ভেবে এই সর্বস্বান্ত, সর্বহারা মানুষদের আতঙ্কে দিন কাটছে।
তবে ফিরে আসার সময় আশার বাণী শোনালেন লালবাবু ‘‘অব আউর কুছ নহি হোনে দেঙ্গে, হমলোগ সাবধান হো গিয়া হ্যায়, ওলোগ কুছ করনে নেহি সকতা অগর হম সমঝ যায় কে মারদাঙ্গা হোনে সে লুকসান সির্ফ হমারা হোতা হ্যায়। এ মহল্লা মে হিন্দু-মুসলিম সব এককাট্টা হো কর ওলোগ কো রোক দেঙ্গে।“
একটা স্পষ্ট ছবি ফুটে উঠল।