অ্যামনেস্টি রিপোর্ট বলছে, ভারতে বুলডোজার মুসলিম নির্যাতনের সঙ্গে সমার্থক হয়ে গিয়েছে। এবং এই ধ্বংস-উচ্ছেদের কারণে ব্রিটিশ বহুজাতিক সংস্থার জেসিবি ব্র্যান্ডের যন্ত্রগুলি এখন এতটাই প্রচলিত হয়ে গিয়েছে যে, ভারতে বুলডোজার এই জেসিবি ব্র্যান্ডের জেনেরিক টার্ম হয়ে উঠেছে। ভারতে জেসিবি মেশিনের মাধ্যমে গণ-ধ্বংসাত্মক কাজ বেড়ে চললেও, ২০২২ সালে ঠিক যখন গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ, দিল্লিতে মুসলিম মহল্লায় মহল্লায় জেসিবি চলছে, তখন যুক্তরাজ্য (ইউকে)-র তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন গুজরাতের ভাদোদরায় জেসিবি’র এক নতুন কারখানার উদ্বোধন করেন। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে সঙ্গ দিয়েছিলেন জেসিবি’র চেয়ারপার্সন লর্ড বামফোর্ড ও গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ভূপেন্দ্র রজনীকান্ত প্যাটেল। এই উদ্বোধনকে ঘিরে বৃটিশ পার্লামেন্টে বিতর্ক বাঁধে। পার্লামেন্টের বহু সদস্য ভারতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নীরবতাকে “নৈতিক ব্যর্থতা” বলে অভিহিত করেন। ভারতে বুলডোজার-রাজ বিষয়ক অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্ট পড়লেন দেবাশিস আইচ।
আমরা আইন ও এজেন্সির সশস্ত্রীকরণ প্রত্যক্ষ করেছি। সেই দৃষ্টিতেই, জেসিবিও সরকারের হাতে আর একটি মারণাস্ত্র। — আশহার ওয়ারসি, মধ্যপ্রদেশে বুলডোজারের বলি নাগরিকদের আইনজীবী
সাধারণের কাছে “বুলডোজার জাস্টিস” বলে পরিচিত, এই শাস্তিমূলক উচ্ছেদ বহু ভারতীয় রাজ্যের কাছেই বস্তুত রাষ্ট্রনীতি হয়ে উঠেছে। এভাবেই শুরু হয়েছে দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত জোড়া জেসিবি-রাজ বিষয়ক অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর রিপোর্ট : “আনআর্থিং অ্যাকাউনটিবিলিটি, জেসিবি’জ রোল অ্যান্ড রেসপনসিবিলিটি ইন বুলডোজার ইনজাস্টিস ইন ইন্ডিয়া।” রিপোর্টের ভূমিকার শুরুতেই আরও বলা হয়েছে, “বেআইনি নির্মাণ ও জবরদখলকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অছিলায় এই প্রযুক্তির ব্যবহারকে রাজনৈতিক নেতা ও বিজেপি’র সমর্থকদের সমাদর ও উদযাপন করতে দেখা যায়।” কেমন সেই উদযাপন? বলা হচ্ছে, বিজেপি নেতৃত্ব মুসলিমদের শাস্তি দেওয়ার জন্য পরোক্ষভাবে জেসিবি মেশিন ব্যবহারের ভয় দেখিয়ে থাকে। যেমন, ২০২২ সালে দিল্লিতে দোকান-পাট ভাঙার সময় বিজেপি মুখপাত্র জিভিএল নরসিংহ একটি ট্যুইটে (পরবর্তীতে মুছে ফেলা হয়) জেসিবি মেশিনকে “জিহাদি কন্ট্রোল বোর্ড” বলে মন্তব্য করেন। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে এক জনসভায় তেলেঙ্গানার এক বিজেপি নেতা ভোটারদের হুমকি দিয়ে বলে, হয় যোগী আদিত্যনাথকে ভোট দাও অথবা জেসিবি বুলডোজার দিয়ে সম্পত্তি ধ্বংস হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকো। ওই নির্বাচনে দ্বিতীয় বারের জন্য যোগী আদিত্যনাথ জিতে এলে গোরক্ষপুরে জেসিবি মেশিন নিয়ে র্যালি করে সেই জয়োৎসব উদযাপিত হয়। আমাদের রাজ্যেও ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ও পরবর্তীকালে বিজেপি নেতারা একাধিক সভায় এ রাজ্যে ক্ষমতায় এলে বুলডোজার ব্যবহারের হুমকি দিয়েছিলেন। হাই কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় দু’টি পৃথক মামলায় কলকাতা ও কালিম্পঙে বেআইনি নির্মাণ ভাঙতে যোগীরাজ্যের “বুলডোজার জাস্টিস”র প্রসঙ্গ তুলেছিলেন।
বেআইনি নির্মাণ বা জমি জবরদখলকারীদের বিরুদ্ধে এই উচ্ছেদ এক রুটিন ব্যবস্থা বলে কর্তৃপক্ষ ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে। সত্যই কি তাই? অ্যামনেস্টির গবেষণা-প্রাপ্ত তথ্য বলছে, এই উচ্ছেদগুলি যথাযথ ও যথেষ্ট পদ্ধতি মেনে করা হয় না। ইতিমধ্যেই আমরা অ্যামনেস্টির আর এক রিপোর্ট — “ইফ ইউ স্পিক আপ ইয়োর হাউজ উইল বি ডিমলিশড”, বুলডোজার ইনজাস্টিস ইন ইন্ডিয়া-তে — দেখেছি, ২০২২ সালে উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি, গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ, আসামে প্রধানত বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে কীভাবে ব্যাপকহারে মুসলিম নাগরিকদের ঘরবাড়ি, দোকান, গুদাম, রেস্তোরাঁ, হোটেল— হয় সাম্প্রদায়িক হিংসা বা সরকারি নীতির বিরদ্ধতা; কিংবা লকআপে সাধারণ মৎস্যজীবীর মৃত্যুর প্রতিবাদ করার জন্য— বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ২০২২ সালের ২০ এপ্রিল, হনুমান জয়ন্তীর মিছিলকে কেন্দ্র করে ১৬ এপ্রিলের হিংসাত্মক ঘটনার পর— সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশের পরও— ওই একই অজুহাতে জাহাঙ্গিরপুরিতে ২৫টি দোকান জেসিবি মেশিন দিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়। এর মধ্যে ২৩টি দোকান ছিল মুসলমানদের। যদি এমন রুটিন তৎপরতা নিয়মিত ঘটতে দেখা যেত তবে দিল্লির পুরসভাগুলির বোধহয় ঘরবাড়ি ভাঙা ছাড়া আর কোনও কাজই থাকত না।
রাজধানী অঞ্চলে (ন্যাশনাল ক্যাপিটাল রিজিয়ন বা এনসিআর) ‘বেআইনি নির্মাণ’ নথিভুক্তির বিষয়ে দিল্লি হাই কোর্ট গঠিত একটি প্যানেল ২০১৭ সালে আদালতকে যে রিপোর্ট জমা দেয়, সেখানে বলা হয়েছে, দিল্লি এনসিআর-এর ৯০ শতাংশ বিদ্যমান বাড়ি নির্মাণ আইনের কোনও না কোনও ধারা লঙ্ঘন করেছে। টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত সাম্প্রতিক তম (২০২৪) একটি রিপোর্ট বলছে, গুজরাতের বিভিন্ন নগরপালিকা ও মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত ৩৫ শতাংশ বাড়ি বেআইনি। তিন মাস ধরে এক স্যাম্পল সার্ভের পর, নগর উন্নয়ন দফতর দেখেছে ‘বিল্ডিং ইউজ’ রুল অনুযায়ী ৮,৩২০টি বাড়ির— বসতবাড়ি, বাণিজ্যিক, হাই-রাইজ ও বিশেষ শ্রেণিভুক্ত (হাসপাতাল ও অন্যান্য)— ব্যবহারের অনুমতি নেই। ‘বিইউ’ অমান্য করার অর্থ বাড়িগুলি ব্যাপক ভাঙার মুখে পড়বে। এখন পরিকল্পনা হচ্ছে কীভাবে অধ্যাদেশ জারি করে এবং হাই কোর্টেকে জানিয়ে বড় কোনও ক্ষতি এড়ানো এবং ন্যূনতম অংশ ভেঙে— একদিকে বিধি, অন্যদিকে মুখ বাঁচানো যায়। জেসিবি নামাবে না পুর কর্তৃপক্ষ। অথচ, গুজরাতে গত এক দশক ধরে ধারাবাহিক ভাবে কোথাও কোথাও “উন্নয়ন”, কোথাও বেআইনি নির্মাণের নামে মুসলিম, আদিবাসী ও দলিতরা উচ্ছেদের শিকার হচ্ছেন। ২০২২ সালে হিম্মতনগর ও খাম্বাতের মুসলিম প্রধান অঞ্চলে ৩৬টি বাড়ি, দোকান, গুদাম ভেঙে তছনছ করে দেওয়া হয়েছে। অ্যামনেস্টির রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২ সালের এপ্রিল ও জুন মাসের মধ্যে বিজেপি শাসিত গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপদেশ, আসাম ও আপ শাসিত দিল্লিতে (২০২২ সালে দিল্লির পুরসভাগুলি বিজেপি শাসিত ছিল এবং দিল্লি পুলিশ কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন) মুসলিমদের ১২৮টি সম্পত্তি— বাসস্থান, ব্যবসাকেন্দ্র, ধর্মীয় স্থান— ভেঙে দেওয়া হয়। এর ফলে ৬১৭ জন মুসলিম নারী, পুরুষ, শিশু হয় গৃহহীন হয়ে পড়েছেন, না হয় তাঁদের রুজিরোজগার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। অ্যামনেস্টির আরও দেখেছে যে, জাতীয় ও রাজ্য সরকারের ঘর-বাড়ি, ব্যবসাকেন্দ্রকে ধ্বংস করার এই প্রক্রিয়া হল গোষ্ঠীগত ও স্বেচ্ছাচারী শাস্তিদান। সাম্প্রদায়িক হিংসা বা কোনও প্রতিবাদ কর্মসূচির পর প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর, বিশেষভাবে মুসলিমদের একইসঙ্গে ভয় দেখিয়ে প্রতিবাদ থেকে নিরস্ত করা এবং প্রতিবাদ করার জন্য, কিংবা জঙ্গি ধর্মীয় মিছিলের বিরোধিতা করার জন্য প্রতিশোধ নেওয়া।
অ্যামনেস্টি রিপোর্ট বলছে, ভারতে বুলডোজার মুসলিম নির্যাতনের সঙ্গে সমার্থক হয়ে গিয়েছে। এবং এই ধ্বংস-উচ্ছেদের কারণে ব্রিটিশ বহুজাতিক সংস্থার জেসিবি ব্র্যান্ডের যন্ত্রগুলি এখন এতটাই প্রচলিত হয়ে গিয়েছে যে, ভারতে বুলডোজার এই জেসিবি ব্র্যান্ডের জেনেরিক টার্ম হয়ে উঠেছে। ভারতে জেসিবি মেশিনের মাধ্যমে গণ-ধ্বংসাত্মক কাজ বেড়ে চললেও, ২০২২ সালে ঠিক যখন গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ, দিল্লিতে মুসলিম মহল্লায় মহল্লায় জেসিবি চলছে, তখন যুক্তরাজ্য (ইউকে)-র তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন গুজরাতের ভাদোদরায় জেসিবি’র এক নতুন কারখানার উদ্বোধন করেন। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে সঙ্গ দিয়েছিলেন জেসিবি’র চেয়ারপার্সন লর্ড বামফোর্ড ও গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ভূপেন্দ্র রজনীকান্ত প্যাটেল। এই উদ্বোধনকে ঘিরে বৃটিশ পার্লামেন্টে বিতর্ক বাঁধে। পার্লামেন্টের বহু সদস্য ভারতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নীরবতাকে “নৈতিক ব্যর্থতা” বলে অভিহিত করেন। এর প্রত্যুত্তরে বৃটেনের বিদেশ, কমনওয়েলথ ও উন্নয়ক বিষয়ক আন্ডার-সেক্রেটারি অব স্টেট ভিকি ফোর্ড বলেন, ইউকে সরকার “বিশ্বাস বা ধর্মের ভিত্তিতে যে কোনও বৈষম্যর ঘটনাকে নিন্দা করে”, এবং জোর দিয়ে বলেন, এটি এখনও দেশের “মানবাধিকারের সর্বোচ্চ অগ্রগণ্য বিষয়গুলির অন্যতম।” তবে, জেসিবি মেশিনের অপব্যবহারের নিন্দা করতে তিনি ব্যর্থ হন।
অ্যামনেস্টি জানাচ্ছে, তাদের “ক্রাইসিস এভিডেন্স ল্যাব” বাড়ি ভাঙার ৭৮টি ফোটো ও ভিডিও যাচাই করে দেখেছে। এগুলির মধ্যে ৬৯টি ফোটো ও ভিডিওয়, এপ্রিল ও জুন মাসের মধ্যে জেসিবি মেশিনের সাহায্যে বাড়ি-ঘর, দোকান-পাট ভাঙার ৩৩টি ঘটনার নজির প্রমাণিত হয়েছে। আরও পাঁচটি ভিডিও পরীক্ষা করে দেখা গেছে সেগুলি উত্তরাখণ্ডে জোর করে উচ্ছেদের ঘটনা। সে রাজ্যে বসতবাড়ি, দোকান, মসজিদ আংশিক কিংবা পুরোপুরি ভেঙে ফেলার দৃশ্য সেই ভিডিও গুলিতে ধরা পড়েছে। অ্যামনেস্টির মতে, জেসিবিই শুধুমাত্র একটা সংস্থা নয় যাদের মেশিন ভাঙার জন্য ব্যবহৃত হয়, তবে, জেসিবি মেশিনের ধারাবাহিক ও ব্যাপক ব্যবহার দেখায় যে, এই কোম্পানিটি এই কাজের ক্ষেত্রে সবচয়ে পছন্দের ব্রান্ড।
২।
মানবাধিকারের প্রতি জেসিবি ও জেসিবি ইন্ডিয়ার দায় ও দায়িত্ব
জে. সি. ব্যামফোর্ড এক্সাভেটর লিমিটেড (জেসিবি) যুক্তরাজ্যে বিধিবদ্ধ একটি বেসরকারি সংস্থা। কোম্পানিটির মূল কাজ নির্মাণ ও কৃষিশিল্পের জন্য মেশিনের “ডিজাইন করা থেকে তৈরি, বিক্রি এবং বিক্রি পরবর্তী পরিষেবা ও যন্ত্রাংশ জোগান দেওয়া। জেসিবি’র উৎপাদিত যন্ত্রগুলির মধ্যে রয়েছে জেনারেটর, হুইল লোডার, ডাম্প ট্রাক, ব্যাকহো লোডার, হাইড্রলিক এক্সাভেটর [অন্যান্য কাজ ছাড়াও ঘরবাড়ি ভাঙা, উচ্ছেদের ক্ষেত্রে ভারতে যেটি ব্যবহৃত হয়], ফর্ক লিফট, লাইটিং টাওয়ার, ইউটিলিটি ভেহিকল এবং সামরিক কাজে ব্যবহৃত যন্ত্র।
জেসিবি ইন্ডিয়া লিমিটেড (জেসিবি ইন্ডিয়া) জেসিবি-ইউকের পুরোপুরি মালিকানাধীন সাবসিডিয়ারি কোম্পানি। কোম্পানির ওয়েবসাইট অনুযায়ী, জেসিবি’র চেয়ারম্যান লর্ড অ্যান্থনি ব্যামফোর্ডের মতে, ভারতে জেসিবি’র প্রতিষ্ঠা তাঁর “সবচেয়ে অনুপ্রাণিত” সিদ্ধান্ত। কোম্পানির মতে, জেসিবি ইন্ডিয়া ভারতে আর্থ মুভিং ও নির্মাণশিল্পের যন্ত্রপাতি প্রস্তুতের সবচয়ে অগ্রণী প্রতিষ্ঠান। এ দেশে জেসিবি’র মোট কারখানা ছ’টি। এবং সারা দেশে ৬০টি ডিলার ও ৭০০ আউটলেট রয়েছে। এমনকি জেসিবি ইন্ডিয়া দক্ষিণ এশিয়ার নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ, মায়ানমার ও শ্রীলঙ্কার বাজারও নিয়ন্ত্রণ করে। ভারতে জেসিবি ইন্ডিয়া ভারতের বাজারের জন্য উৎপাদনের পাশাপাশি ১২৫টি দেশে ভারতে উৎপাদিত যন্ত্র রফতানি করে। ওয়েবসাইট অনুসারে জেসিবি ১১ ধরনের যন্ত্র ও ১৩ ধরনের যন্ত্রাংশ তৈরি করে। এই বিবরণ দিয়ে অ্যামনেস্টির অভিমত, ভারতে “জেসিবি ব্র্যান্ডের যন্ত্রগুলি নানা কাজেই ব্যবহৃত হয়। যার মধ্যে রয়েছে আইনানুগ পদ্ধতিতে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মতো কাজ। যা-ই হোক, এমন যন্ত্রের সাহায্যে বেআইনি ও শাস্তিমূলক উচ্ছেদ মানবিক অধিকারের প্রশ্নে একটি প্রধান উদ্বেগের বিষয়।”
অ্যামনেস্টি তার রিপোর্টে জানাচ্ছে, তথ্য জানার অধিকার আইনে তারা ২০২২ সালে সাম্প্রদায়িক হিংসা ও পরবর্তী বুলডোজার অভিযানের ভিত্তিতে পাঁচ রাজ্যের অভিঘাতপূর্ণ শহরগুলির পুরসভা, পুলিশ ও প্রশাসনের আধিকারিকদের আবেদন করে বুঝতে চেয়েছিল, কর্তৃপক্ষ যে যন্ত্রের সাহায্যে ভাঙার অভিযান চালিয়েছিল সেগুলি ভাড়া করা নাকি তাদের নিজস্ব; যন্ত্রগুলি যে যে সংস্থা্র বা ব্যক্তির তাদের নাম; যন্ত্রগুলির সিরিয়াল নম্বর; যে পদ্ধতিতে যন্ত্রগুলি কেনা হয়েছে বা ভাড়া নেওয়া হয়েছে তার পদ্ধতি; এবং কেনা বা ভাড়া নেওয়ার টেন্ডারের বিজ্ঞপ্তির কপি। এছাড়াও এই যন্ত্রগুলির ব্যবহারের জন্য যদি কোনও গাইডলাইন থাকে তার কপি। কোনও রাজ্যের কোনও আধিকারিকই এই প্রশ্নের জবাব দেননি। অ্যামনেস্টি জানাচ্ছে, কোনও অর্থপূর্ণ উত্তর না মেলায় তারা ওই পাঁচ রাজ্যের সরকারের ওয়েবসাইট থেকে জানতে পারে, বিশেষ ভাবে জেসিবি মেশিনের জন্য রাজ্যগুলি টেন্ডার করেছিল।
অ্যামনেস্টি মনে করিয়ে দিয়েছে, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলির আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও আদর্শ মান্য করার দায় ও দায়িত্ব রয়েছে। এই বিষয়ে সবথেকে প্রামাণ্য দলিল হচ্ছে “দি ইউএন গাইডিং প্রিন্সিপলস অন বিজনেস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস।” ২০১১ সালে এই ঘোষণাপত্র ইউএন হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলে গৃহীত হয় এবং বিভিন্ন দেশ ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান তা অনুমোদন করে। ভারত-সহ বিভিন্ন দেশ সেই ২০১১ সাল থেকেই এ বিষয়ে দেশীয় আইনের আওতায় এই ঘোষণাকে যুক্ত ও কার্যকর করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করে। বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলিও তাদের ব্যবসায়িক নীতিতে এই নীতিগুলি যুক্ত করতে সচেষ্ট হয়। ইউএন গাইডিং প্রিনসিপলস অনুযায়ী, মানবাধিকারকে সম্মান করার দায়বদ্ধতা জেসিবি ও জেসিবি ইন্ডিয়ার উপর বর্তায়। এর অর্থ হচ্ছে, মানবাধিকারের পরিপন্থী যে কার্যকারণ বা যা মানবাধিকারের পরিপন্থী অভিঘাত সৃষ্টি করে সেগুলি অবশ্যই পরিহার করে চলবে, এবং যখন তা ঘটবে তখন সে বিষয়ে তৎপরতা দেখাবে। কর্পোরেটগুলির অবশ্যই মানবাধিকারকে সম্মান জানানোর মতো নীতিগত অঙ্গীকার থাকতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মানবিক অধিকারের প্রতি যথাযথ অভিনিবেশ (ডিউ ডিলিজেন্স) সম্পাদন করা। যা একটি কর্পোরেটের আকার, তাদের কাজের প্রকৃতি ও পূর্বাপর সম্বন্ধ এবং মানবাধিকারের ক্ষতিকর অভিঘাতের তীব্রতার সঙ্গে সুসংগত হবে।
উপসংহার
রিপোর্টে ইতি টানার আগে অ্যামনেস্টি দ্বর্থহীন ভাবে বলছে, সাম্প্রদায়িক হিংসা ও প্রতিবাদ সংগঠিত করার জন্য আসাম, দিল্লি, গুজরাত, মধপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মুসলিমদের শাস্তি দিতে বসতবাড়ি, ব্যবসা কেন্দ্র ও ধর্মস্থান ভেঙে দিয়েছে; সহায়-সম্পত্তি ও ধর্মস্থান এভাবে গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাকে “শাস্তিমূলক বিনাশ” বলে অ্যামনেস্টি অভিহিত করেছে। অ্যামনেস্টির মতে, এই বিনাশমূলক কর্মকাণ্ড, কার্যত গাজোয়ারি করে সামূহিক ও স্বৈরাচারী শাস্তিপ্রদান। এবং তা নারী-পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধা-সহ ৬১৭ জনের উপযুক্ত বাসস্থান, জীবনজীবিকা, জীবন ও স্বাধীনতা এবং নিরপেক্ষ বিচারের অধিকারের উপর আঘাত হেনেছে।
কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারগুলির স্ব স্ব ক্ষেত্রে ব্যর্থতা ও আইন লঙ্ঘন ছাড়াও, অ্যামনেস্টির গবেষণায় পাওয়া গিয়েছে যে, পাঁচটি রাজ্যে জেসিবি’র যন্ত্রের মাধ্যমে ব্যাপকহারে যে শাস্তিমূলক ধ্বংসলীলা চালানো হয়েছে, তার ক্ষতিকর অভিঘাত স্বীকার করতে এবং মানবাধিকারের প্রতি যথাযথ অভিনিবেশ করতে জেসিবি ও জেসিবি ইন্ডিয়া ব্যর্থ হয়েছে। প্রসঙ্গত, অ্যামনেস্টি জেসিবি ও জেসিবি ইন্ডিয়ার কাছে তাদের তৈরি মেশিনের সাহায্যে কীভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে তা জানিয়ে, সে বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিক্রিয়া জানতে চায়— এই রিপোর্টে তার দীর্ঘ বর্ণনা রয়েছে—জেসিবি ও জেসিবি ইন্ডিয়া উত্তরে তাদের সমস্ত দায়দায়িত্ব অস্বীকার করেছে। উপসংহারে অ্যামনেস্টি জানাচ্ছে, জেসিবি আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে বলেছে, এই ঘটনাগুলির উপর তাদের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। সুতরাং ফ্যাক্টরি গেট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর তাদের তৈরি যন্ত্র কী অভিঘাত সৃষ্টি করছে সে বিষয়ে তাদের কোনও দায়দায়িত্বও নেই। অ্যামনেস্টির মতে, এই ব্যাখ্যা পরিষ্কার ভাবে “ইউএন গাইডিং প্রিনসিপলস অন বিজনেস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস” ও “ওইসিডি ডিউ ডিলিজেন্স গাইডেন্স ফর রেসপনসিবল বিজনেস কন্ডাক্ট”-এর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
অ্যামনেস্টির মতে, মুসলিম জনগোষ্ঠীকে শাস্তি দেওয়ার জন্য, ২০২২ সালের এপ্রিল-জুন মাসে যা ঘটেছে এবং এখনও ঘটে চলেছে তা ভারতকে সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের প্রতি সরাসরি ও প্রকট ভাবে দায়বদ্ধ করে তুলেছে। এবং এখনই এসব বন্ধ করতেই হবে। এবং সে ক্ষেত্রে জেসিবিকে এখনই তাদের তৈরি যন্ত্র যাতে মুসলিমদের বিচারবহির্ভূত ভাবে শাস্তি দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত না হয় তা খুঁজে দেখা ও বন্ধ করার জন্য, তাদের প্রকৃত “ভ্যালু চেন” (প্রস্তুতকারী থেকে বাজার ও ব্যবহারকারী) এবং ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দায়বদ্ধ হতে হবে। এবং অবশ্যই তাদের যন্ত্রকে দেশের মুসলিমদের জন্য দুর্বলতার প্রতিধ্বনি-সহ ঘৃণার প্রতীক হিসাবে ব্যবহারের খোলাখুলি নিন্দা করতে হবে।
৩।
বুলডোজার-রাজ অব্যাহত
এখানে আমরা সাম্প্রতিক অতীতে হরিয়ানার নূহ, উত্তরাখণ্ডের হলদোয়ানি, গুজরাতের “কোণায় কোণায়”, (গুজরাতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যেমন জানিয়েছেন), মহারাষ্ট্রের মুম্বাই ও দিল্লির বুলডোজার নিপীড়নের কথা বলব। দিল্লি দিয়েই শুরু করা যাক।
দিল্লি, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
আবার খবরে ওয়াকিল। ওয়াকিল নামটা বোধহয় ভুলে যাননি! ওয়াকিল হাসান… “র্যাট-হোল মাইনার“… সিল্কিয়ারা…! এবার নিশ্চয় মনে পড়েছে। কিন্তু, ভুলে গেছেন দিল্লি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (ডিডিএ)’র কর্তাব্যক্তিরা। এই ২৮ ফেব্রুয়ারি ওয়াকিলের উত্তর-পূর্ব দিল্লির খজুরী খাসের বাড়ি “বেআইনি” তকমা লাগিয়ে বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দিয়েছে ডিডিএ। এর ঠিক তিন মাস আগে, ২৮ নভেম্বর উত্তরাখণ্ডের সিল্কিয়ারার ধসে পড়া টানেল থেকে ৪১ জন সুড়ঙ্গ-বন্দি শ্রমিককে মুক্তির আলো দেখিয়েছিলেন ওয়াকিল-সহ ১২ জন উদ্ধারকারী। সেদিন সে কি উৎসব! আর ২৮ ফেব্রুয়ারি খজুরি খাসে চলল বুলডোজার। ভাঙা পড়ল ওয়াকিলের বাড়ি। কী অদ্ভুত! কী নিষ্ঠুর পরিহাস! একবিংশ শতাব্দীতে ওয়াকিলদের উৎসবের আয়ু, সংবর্ধনা, সম্মানের আয়ু, “রাজা” হওয়ার আয়ু মাত্র তিন মাস। ঠিক তিন মাস।
২৮ ফেব্রুয়ারি, জেসিবি যন্ত্রের সাহায্যেই ওয়াকিল হাসানের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেয় ডিডিএ। এই সময় ওয়াকিল ও তাঁর স্ত্রী বাড়ি ছিলেন না। ছিল তাঁদের ছোট ছোট তিন শিশু। ডিডিএ’র তৎপরতা দেখে তাঁরা দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। তবু, শেষ রক্ষা হয়নি। ডিডিএ’র দাবি, শ্রীরাম কলোনির খজুরি খাসের এই অংশে বেআইনি ভাবে বসবাস করেন ওয়াকিলরা। আরও দাবি ২০১৬ সালেও একবার বাড়ি ভাঙা হয়েছিল। কিন্তু, আবারও বাড়ি বানানো হয়। ওয়াকিলের পাল্টা দাবি, ২০১৩ সালে তিনি খজুরী খাসের এই বাড়িটি কিনেছিলেন। ১৯৮৭ সাল থেকে বাড়িটির রেজিস্ট্রির নথি রয়েছে। কোনও নোটিস না-দিয়ে, কোনও কাগজ না দেখিয়েই বাড়ি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ডিডিএ ওয়াকিলের অভিযোগ অস্বীকার করে বলে, পূর্বপরিকল্পিত উন্নয়নের জন্য বেআইনি দখল উচ্ছেদ করা হয়েছে। পিটিআই।
এই প্রথম বোধহয় দিল্লির বুলডোজার কর্তৃপক্ষ কিছুটা আতান্তরে পড়ল। দিল্লির সংবাদমাধ্যমগুলি ওয়াকিলের সঙ্গে ফের সিল্কিয়ারার “র্যাট মাইনার হিরো” প্রসঙ্গটি জুড়ে দিতেই ডিডিএ জানাল, ভাঙার আগে কিংবা ভাঙার সময়ও তাঁরা জানতেন না ওটি ওয়াকিলের বাড়ি। এর পর তাঁরা ওয়াকিলকে ভিন্ন জায়গায় বাড়ি দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেয়। ওয়াকিল পরিস্কার জানান মৌখিক কোনও প্রতিশ্রুতি তিনি শুনবেন না, লিখিত দিতে হবে। ওয়াকিল যখন ওই ভগ্নস্তূপের উপরই প্রতিবেশীদের সহায়তায় রাতে অবস্থান করছেন, তখন ফের ডিডিএ প্রতিনিধিরা এসে জানান, তাঁর জন্য অস্থায়ী ভাবে বসন্তকুঞ্জে একটি বাংলোয় থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাকাপাকি ব্যবস্থা না-হলে এখান থেকে যাবেন না বলে ফের ওয়াকিল ডিডিএ-র প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন ওয়াকিল। (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১ মার্চ ২০২৪)।
মুম্বাই, ২২ জানুয়ারি ২০২৪
রামমন্দির প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে সারা দেশে অন্তত পাঁচটি—মুম্বাইয়ে দু’টি, মহারাষ্ট্রের নাগপুর, গুজরাতের ভাদোদরা ও মধ্যপ্রদেশের শাহজাদপুরে একটি করে— সাম্প্রদায়িক হানাহানি ও সংর্ঘষের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটে মুম্বাইয়ের ভায়ান্দারের মীরা রোড, নয়ানগর অঞ্চলে।
২২ জানুয়ারি রামমন্দির প্রতিষ্ঠা আর ২১ জানুয়ারি থেকেই শুরু হয়ে যায় উৎসব। ২১ তারিখ রাতে মীরা রোড, নয়ানগরে একের পর এক গাড়ি ও বাইকের মিছিল “জয় শ্রী রাম”-সহ প্ররোচনামূলক স্লোগান তুলে মুসলিম প্রধান অঞ্চলগুলিতে চক্কর মারতে থেকে। লোধা রোডে তাইনি ভিলা মসজিদ ও মহম্মদ মসজিদের সামনে এমনই একটি বাইক মিছিল থেকে গুলি চালানোর আওয়াজ পান স্থানীয় মুসলিম বাসিন্দারা। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের মতে, এগুলি একজাতীয় সাইলেন্সার বিহীন ‘মডিফায়েড’ বাইক। স্থানীয় বাসিন্দারা বেড়িয়ে এলে তাঁরাও বচসায় জড়িয়ে পড়েন। এই সময় বাইক বাহিনী পালাতে গিয়ে স্থানীয় এক যুবককে ধাক্কা দেয় বলে খবর। এখান থেকেই গন্ডগোলের শুরু।
ওইরাতে সাড়ে ১০টা নাগাদ এমনই একটি মিছিল নয়ানগরের বেনেগর গলিতে ঢুকে পড়ে। এই অঞ্চলের প্রায় সকলেই মুসলিম বাসিন্দা। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, বাইক ও গাড়ির ওই মিছিল সাংভী এম্পায়ার হাউজিং সোসাইটির সামনে দাঁড়িয়ে ডিজে থেকে উচ্চস্বরে আপত্তিজনক গান বাজাতে থেকে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ওই হাউজিংটি গলির একদম শেষ প্রান্তে। এর পর আর যাওয়ার রাস্তা নেই। এই পথে মিছিল নিয়ে আসার কোনও যুক্তি ছিল না। এক বাসিন্দার অভিযোগ, প্ররোচনা দিতেই ওরা কানাগলিতে ঢুকেছিল। এছাড়া আর কোনও কারণ নেই।
স্থানীয়রা বেরিয়ে এসে প্রতিবাদ করলে দুই তরফের মধ্যে সংঘর্ষ বেঁধে যায়। এই ঘটনায় মিছিলের গাড়িগুলি আক্রান্ত হয় এবং মহিলা-সহ একাধিক ব্যক্তি ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হন। এই সংঘর্ষের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনার কিছু বাদেই উপমুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডণবীস ঘোষণা করেন, যারাই রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা ভাঙার চেষ্টা করবে তাদের বিরুদ্ধেই “কড়া ব্যবস্থা” নেওয়া হবে। এর পরেই ওই অঞ্চল থেকে দু’টি শিশু-সহ ১৫ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করে। এর মধ্যে অবশ্য প্ররোচনাকারীদের কেউ ছিল না বলে স্থানীয় মুসলিম বাসিন্দারা জানিয়েছেন।
২২ জানুয়ারি রামের প্রতিষ্ঠা দিবসের অনুষ্ঠানের দিন কোনও গন্ডগোল ঘটেনি। ২৩ জানুয়ারি সকালে ২০০-৩০০ জন সেক্টর ফাইভ এলাকায় মীরা রোডের শান্তিনগরে জমায়েত হয়। তাদের নিশানা বা লক্ষ্যবস্তু আগেভাগেই যেন স্থির করা ছিল। এমনই মনে হয়েছে এলাকার ব্যবসয়ীদের। যে যে দোকানে ভাগোয়া ঝান্ডা টাঙানো নেই, আক্রান্ত হয় একের পর এক সেই মুসলিম দোকানগুলি। এলাকায় বেশিরভাগ দোকানপাটই হিন্দুদের। ১৭-১৮ থেকে ২৪-২৫ বয়সি দাঙ্গাবাজেরা বেছে বেছে মুসলিম দোকানগুলিতে ইট-পাথর ছোঁড়ে, লাঠি-রড দিয়ে ভাঙচুর চালায়। প্রচুর পুলিশ মোতায়েন থাকলেও তাঁরা দাঙ্গাকারীদের আটকানোর চেষ্টা করেননি বলে অভিযোগ। দাঙ্গাকারীদের পাহারা দিতেই পুলিশ ছিল বলে ব্যবসায়ীদের মনে হয়েছে। এছাড়াও বেছে বেছে মুসলিমদের অটো রিকশ, টেম্পো ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে। আক্রান্ত ব্যবসায়ীদের শারীরিক আঘাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টাও করেছেন প্রতিবেশী হিন্দু ব্যবসায়ীরা বলে সংবাদ মাধ্যমকে জানান আক্রান্তরা। এই ঘটনায় ১৮টি মামলা দায়ের করা হয় এবং ১৯ জনকে পুলিশ গেফতার করে।
এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই একই দিনে মীরা রোডে সেই জেসিবি বুলডোজার নিয়ে নেমে পড়ে মীরা-ভায়ান্দার মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন। বাছাই করে করে মুসলিমদের ১৫টি দোকান, গ্যারেজ, শো-রুম হয় পুরোপুরি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়, না-হয় একাংশ ভেঙে ফেলা হয়। কর্পোরেশনের হিসাব মতো অবশ্য ৩৩-৩৫টি স্থানে “বেআইনি” দোকানপাটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
মূকনায়ক ওয়েব পোর্টালকে এক গ্যারেজের মালিক আবদুল হাসান শেখ জানান, গ্যারেজ থেকে তাঁকে টেনে বার করে বুলডোজার চালিয়ে দেওয়া হয়। প্রতিবাদ জানালে বলা হয়, গ্যারেজটা বেআইনি। আবদুল হাসানের দাবি ২২ বছর এই গ্যারেজ চালাচ্ছেন। বেআইনি হলে তো কোনও সরকারি ব্যবস্থা নেওয়া হত। কান্নায় ভেঙে পড়ে তিনি জানান, “আমি এখনও জানি না আমার গ্যারেজটা কেন ভেঙে ফেলা হল?”
ওই গ্যারেজের পাশে একটি বহুতলের নীচে ছিল আলিশার ডিজাইনার হিজাব ও চাদরের দোকান। বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে এমএ পাঠরত আলিশা একটি বড় চাকরি ছেড়ে এই দোকানটি করেছিলেন। তিনি বলেন, “কোনও নোটিস ছাড়াই আমার দোকানের একটি অংশ বুলডোজার দিয়ে ভেঙে ফেলা হয়। আমরা যদি রাস্তা কিংবা সরকারি জমি দখল করে থাকি, তবে বিচারবহির্ভূত ভাবে ভাঙার বদলে যথাযথ নিয়ম পালন করা উচিত,”তিনি আরও বলেন, “ওরা (কর্তৃপক্ষ) পাত্তাই দেয় না যে এই কাজকারবার— প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না যে বৈষম্য ও পক্ষপাতে ভরা— একজন নাগরিক হিসাবে আমাদের যন্ত্রণা দেয়।“
এর পরই “আমরা এই দেশের নাগরিক নই? আমাদের অধিকার নেই নিজেদের ভরণপোষণ নিজেরাই চালিয়ে যাওয়ার? আমরা কি দেশের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক? এমন একগুচ্ছ প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন আলিশা।“একইসঙ্গে তাঁর প্রশ্ন, “এলাকায় যদি হিংসা ছড়ায়, সেখানে আমার কী দোষ? আর নয়ানগরে হিংসার পর পরই কেন বুলডোজার নামাতে হল? একদিন আগে নামতে পারত, কিংবা কয়েকদিন পরে।”
বৈষম্য কিংবা পক্ষপাতের অভিযোগ অবশ্য মানতে চায়নি কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে মূকনায়কের প্রতিনিধিকে মীরা-ভায়ান্দার মিউনিসিপ্যাল করপোরেশেনের ডেপুটি কমিশনার মারুতি গায়কোয়ার জানিয়ে দেন, পুরসভার আইন অনুযায়ী “অননুমোদিত নির্মাণ ভাঙার আগে নোটিস দেওয়ার কোনও বাধ্যবাধ্যকতা পুরসভার নেই।“ অন্যদিকে, বৃহণমুম্বাই মিউনিসিপ্যাল করপোরেশেনের এক প্রাক্তন আধিকারিক মূকনায়ককে জানান, আবাসন হোক কিংবা বাণিজ্যিক ভবন এমনকি ফুটপাতে নির্মাণ হলেও নোটিস দিতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের এক আদেশ মতে, রাস্তার উপর নতুন নির্মাণ হলে পুরসভা প্রকাশ্যে ওই নির্মাণের বিষয়ে প্রকাশ্য স্থানে নোটিস দিতে পারে। এমনকি ওই বেআইনি নির্মাণের মালিককেও নোটিস ধরাতে পারে। ভাঙার আগে, প্রয়োজনে শুধু এক বার নয়, দু’বার, তিন বার এমনকি চার বারও নোটিস দিতে পারে।
তিনি জানান, আইন অনুযায়ী, ৩৫১ ধারা অনুসারে প্রথমে সাত দিনের নোটিস দিতে হবে। সে সময় কোনও ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। মিউনিসিপ্যাল কমিশনারের কোনও বিশেষ অধিকার নেই এই আইন ভাঙার বা ধর্ম বা জাতের ভিত্তিতে কোনও পক্ষপাত দেখানোর।
সূত্র:
১। Mumbai: Why buldozer actions often come after violence, crime if it’s really routine affair, ask Mira Road residents, Tariq Anwar, The Muknayak, (en.themuknayak.com, 6 February)
গুজরাত, ২০২৪
২১ ফেব্রুয়ারি, গুজরাত বিধানসভায় স্বরাষ্ট্র দফতরের বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর আরজি জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হর্ষ সাংভি গর্বের সঙ্গে জানালেন, “দাদার (মুখ্যমন্ত্রী ভূপেন্দ্র প্যাটেল) বুলডোজার রাজ্যের কোণায় কোণায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ জানে না কখন কোথায় দাদার বুলডোজার হানা দেবে। তবে, কোনও মন্দির বা দেবস্থানের গায়ে যাতে বিন্দুমাত্র আঁচও না লাগে সেই নির্দেশ দেওয়া রয়েছে।“(১০৮ মাজার গুঁড়িয়ে দিল, ‘দাদা’র বুলডোজার, গণশক্তি, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রশ্ন তোলেন, জুনাগড়ের “উপারকোটে এত মাজার কখন গজিয়ে উঠল? কীভাবে বানানো হল?” তাঁর মতে এটা একটা “ষড়যন্ত্র”। সম্প্রতি জুনাগড় ফোর্ট সংস্কার করেছ বিজেপি সরকার। এছাড়াও সোমনাথ মন্দির এলাকায় সংস্কার করা হয়েছে। এবং সে অঞ্চলে থাকা একটি মাজারও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। ভাষণে তিনি জানান, “সব মিলিয়ে ১০৮টি মাজার ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এবং সরকারের সম্পত্তি মুক্ত করা হয়েছে।… সোমনাথ মন্দিরের আশপাশ জবরদখল মুক্ত করা হয়েছে। দাদার বুলডোজার এখন ২০ ফুট রাস্তা এবং ৮০ মিটার চওড়া রাজপথে চলতে পারবে।“
শুধু মাজার নয়, ধর্মীয় মিছিল ঘিরে হিংসার বাহানায় নয়, গুজরাতে আস্ত আস্ত গ্রাম উচ্ছেদ বিজেপি’র “মুসলিম হঠাও” নীতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। ২০২২ সালের অক্টোবরে “বেআইনি নির্মাণ”-এর বাহানায় ৫০০ বছরের প্রাচীন মুরাদশাহ দরগা-সহ পোরবন্দর জেলার ১১টি নির্মাণ ভেঙে দেয়। ২৪ ঘণ্টার নোটিসে দেবভূমি দ্বারকা জেলায় হরসিদ্ধি মন্দিরের কাছে গান্ধভী মৎস্যবন্দর এলাকায় বাড়ি, মসজিদ, মাজার, ব্যবসাকেন্দ্র ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় প্যাটেল-সিংভি জুটির পুলিশ। গান্ধভী এলাকার অধিকাংশই মুসলিম সম্প্রদায়ের মৎস্যজীবী মানুষ। এবারেও “বেআইনি”, সরকারি জমি “জবরদখল”-এর অভিযোগ আনা হয়েছিল। তার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল এই মৎস্যজীবী গ্রামগুলির ঘরবাড়ি, গুদামগুলিতে বেআইনিভাবে “মাদক মজুত” করা হয়। এবং আরও বড় অজুহাত, এই গ্রামগুলি “জাতীয় নিরাপত্তা”র পক্ষে বিপজ্জনক।
ওই অঞ্চলের কংগ্রেস নেতা নুসরত পাঞ্জার অভিযোগ একই এলাকার শঙ্কর মন্দিরটি কিনতু ভাঙা হয়নি। চারপাশের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে মন্দিরটি একা দাঁড়িয়ে আছে। এছাড়া উপকূল জুড়ে এই মুসলিম গ্রামগুলির পাশাপাশি হিন্দুগ্রামও রয়েছে। শুধুমাত্র, মুসলিম মৎস্যজীবীদের গ্রামগুলিই উচ্ছেদ করে দেওয়া হয়েছে।
এই বুলডোজার অভিযানে, ওখা উপকূলের— বেট দ্বারকার দ্বারকাধীশ মুখ্য মন্দিরের জন্য বিখ্যাত— চারটি গ্রামকে— নাভাদ্রার ১২০টি, হরসাদের ৮০টি, ভোগতের ৬৫টি, বেট দ্বারকার ১২০টি— বাসস্থান, মসজিদ, মাজার, মাদ্রাসা, দোকানপাট-সহ গুঁড়িয়ে উচ্ছেদ করে দেওয়া হয়। ২০২৩ সালে দেবভূমি দ্বারকা জেলার বেট দ্বারকায় এই ধ্বংসলীলা পরিদর্শন করতে যান মুখ্যমন্ত্রী ভূপেন্দ্র প্যাটেল ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হর্ষ সাংভি। দেখেটেখে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, উপকূল অঞ্চলে কোনও বেআইনি নির্মাণ চলবে না। বেআইনি জবরদখলের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান চলবে।
সূত্র:
১। ১০৮ মাজার গুঁড়িয়ে দিল, ‘দাদা’র বুলডোজার, গণশক্তি, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
২। In selective demolition, Muslim structure razed but temple spared in Gujrat’s Dwaraka, thewire.in, Tarushi Aswani, March 2023
উত্তরাখণ্ড, হলদোয়ানি
হাই কোর্টে মামলার শুনানি চলছে তার মধ্যেই একটি মাদ্রাসা ও মসজিদ বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিল হলদোয়ানি প্রশাসন। জেলাশাসকের যুক্তি, আমরা ভাঙার সব আইনি ও অন্যান্য প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিলাম, তাই ভেঙে দিয়েছি। ফলশ্রুতি, পুলিশ-মুসলিম বাসিন্দাদের মধ্যে খণ্ডযুদ্ধ, স্থানীয়দের থানা ঘেরাও, মুখ্যমন্ত্রী পুস্কর সিংহ ধামীর “দেখা মাত্রই গুলির আদেশ”, ইন্টারনেট ও টেলিভিশন সম্প্রচার বন্ধ, পাঁচ জনের পুলিশের গুলিতে মৃত্যু, কয়েক জন পুলিশ-সহ আহত ষাটেরও বেশি, গ্রেফতার ৭৩, অজ্ঞাত পরিচয় পাঁচ হাজারের লোকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের।
৮ ফেব্রুয়ারি বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ এই ঘটনার শুরু। হলদোয়ানির কর্তৃপক্ষের দাবি, হলদোয়ানি শহরের বনভুলপুরা অঞ্চলের ওই মসজিদ ও সংলগ্ন মাদ্রাসাটি অকৃষি নজুল জমি উপর বেআইনি ভাবে নির্মিত। অবশ্য, জেলাশাসক বন্দনা স্বীকার করেন যে, রাজস্ব রেকর্ডে সরকারি ভাবে তার উল্লেখ নেই।
৩০ জানুয়ারি শহরের পথ চওড়া করতে তিন দিনের নোটিস দিয়েছিল জেলা কর্তৃপক্ষ। এবং পুলিশ ও পিএসি ফ্ল্যাগ মার্চ করে। এর পর মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় বাসিন্দারা হাই কোর্টে মামলা দায়ের করেন এবং উচ্ছেদের উপরে ২০০৭ সালে হাই কোর্টের একটি রায়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তখনকার মতো উচ্ছেদ অভিযানের প্রক্রিয়া বন্ধ হয়। এর পর ২০০৭-এর রায়ের ভিত্তিতে বর্তমান উচ্ছেদের নোটিশের উপর স্থগিতাদেশের জন্য আবেদন জানান হয়। দু’দিন শুনানি চললেও হাই কোর্ট স্থগিতাদেশ না-দিয়ে, ১৪ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করে।
স্থানীয় ৩১ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলার শাকিল আহমেদ বলেন, হাই কোর্ট চূড়ান্ত রায় দেয়নি, ১৪ তারিখ পরবর্তী শুনানি আর তার আগেই প্রশাসন মাদ্রাসাটা ভেঙে দিয়ে চলে গেল। মানুষের কোনও কথাই শুনল না। জেলাশাসক বন্দনা বলেন, “আমরা যেহেতু মাদ্রাসাটি ভাঙার সব প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিলাম তাই অভিযানে নেমে পড়ি।“
সূত্র: মামলার মধ্যেই ভাঙা হলো মাদ্রাসা, উত্তরাখণ্ডে পুলিশের গুলিতে হত ৬, গণশক্তি, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
হরিয়ানা: ন্যুহ, গুরুগ্রাম
একটি জেলা, ১১টি শহর ও গ্রাম, পাঁচ দিন, ১২০৮টি বাড়ি ও অন্যান্য নির্মাণ— এই পাহাড়প্রমাণ মুসলিম সম্পত্তি, ৩৭টি অঞ্চল, ৭২.১ একর।
এই হল ৩১ জুলাই ন্যূহ জেলার (পূর্ববর্তী মেরঠ) সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের পর ২ অগস্ট থেকে ৬ অগস্ট পর্যন্ত হরিয়ানার মনোহর লাল খাট্টার সরকারের “বুলডোজার ইলাজ”। মুসলিম সম্পত্তি ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার হিসাবনিকাশ। যে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে এক জন ইমাম, দু’জন হোমগার্ড-সহ মৃত্যু হয়েছে ছ’জনের। ঘটনায় গ্রেফতার ৩১২ জন, নিবারণমূলক আটক ১৪২ জন, এফআইআর দায়ের করা হয়েছে ১০৬টি। এও পুরোপুরি একচোখামি। প্ররোচনা দেওয়া, আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে মিছিল করা, দাঙ্গা, লুটপাট, আগুন লাগানোর অভিযোগে, এক জনও বিশ্ব হিন্দু পরিষদ কিংবা বজরং দলের সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়নি। দুই কুখ্যাত গো-রক্ষক বিট্টু বজরঙ্গি ও মনু মানেসর এই দাঙ্গার মূল উসকানিদাতা এবং একের পর এক খুনের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। কেবলমাত্র অভিযোগ নয়, গো-রক্ষার নামে ২০১৭ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ৭ জনকে খুনের অভিযোগ রয়েছে। শুধু খুন নয়, তার ভিডিও অনেক সময়ই গো-রক্ষকরা সমাজমাধ্যমে ছড়িয়েছে। সেই ভাবেই বিট্টু ও মনুরা ৩১ জুলাইয়ের এই “ব্রিজমণ্ডল জলাভিষেক যাত্রা”র বহু আগে থেকেই ভিডিওর মাধ্যমে ঘৃণা ও হিংসার বাতাবরণ তৈরি করে চললেও কোনও পদক্ষেপই করেনি হরিয়ানা সরকার।
গ্রেফতার করা হয়েছে বাছবিচারহীন ভাবে। জঙ্গি হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর হাতে আক্রান্ত মুসলিম নাগরিকদের এফআইআর গ্রহণ করতে রাজি হয়নি থানা, উলটে ভয় দেখিয়েছে। আরও আক্রমণ, গ্রেফতারের ভয়ে আইনজীবীদের কাছে গিয়েও মামলা দায়ের করা থেকে পিছিয়ে এসেছেন আক্রান্তরা। আবার হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদ এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, আইনজীবীর সাহায্য পাওয়াও তাঁদের কাছে কঠিন হয়ে উঠেছিল। এমনকি এক সময় তিন জন মুসলিম আইনজীবীকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ। অভিযোগ, তাঁরা যাতে আক্রান্তদের আইনি সাহায্য না করেন তাই ভয় দেখাতেই সকালে তুলে নিয়ে গিয়ে বিকেলে ছেড়ে দেয়।
২ অগস্ট থেকে ৬ অগস্ট লাগাতার বুলোডোজার চলেছে ন্যূহ জেলায়। পাঁচ দিনের মাথায় ৭ জুলাই পঞ্জাব ও হরিয়ানা হাই কোর্টের দুই বিচারপতি জি এস সন্ধাওয়ালিয়া ও বিচারপতি হরপ্রীত কাউর জীবন সংবাদপত্রের রিপোর্টে আকৃষ্ট হয়ে স্বতঃপ্রণোদিত মামলায় জেলা জুড়ে ভাঙার কাজে বাধা না-দিলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হয়তো আকাশ ছুঁত।
সংবাদমাদ্যমের শিরোনামে “বুলডোজার জাস্টিস” আমরা দেখেছি। দিল্লির বিজেপি বিধায়কের ট্যুইটে পড়েছি ‘জেসিবি’ হল “জিহাদি কন্ট্রোল বোর্ড”র সংক্ষিপ্তকরণ। হরিয়ানায় স্বরাস্ট্রমন্ত্রী অনিল ভিজের মুখে শুনলাম দাঙ্গার বুলডোজার “ইলাজ”র কথা। এই ইলাজ বা চিকিৎসা কিংবা ট্রিটমেন্টের জন্য মেডিক্যাল বোর্ডের মতোই, ১ অগস্ট এক প্রশাসনিক বোর্ডই বসিয়েছিল হরিয়ানা সরকার। সেই বোর্ড বাছাই করে করে মুসলিম অঞ্চলগুলিতে আক্রমণ নামিয়ে আনার ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করে। ঠিক তখন হিন্দত্ববাদী জঙ্গি সংগঠনগুলি একতরফা আক্রমণ ছড়িয়ে নামিয়ে আনছে ন্যূহ, গুরুগ্রাম, পালওয়াল, ফরিদাবাদেও। গুরুগ্রাম ও অন্যত্র খেটে খাওয়া বাঙালি ও অসমিয়া মুসলিমদের ঝুগগি-ঝুপড়িগুলি থেকে উচ্ছেদ করে সেখানে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ-প্রশাসন এক্ষেত্রে ছিল সক্রিয় সহায়ক। শুধু, উচ্ছেদ করা নয়, পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা এই পরিযায়ী বাঙালি শ্রমিকদের বাঙলাদেশি এবং আসাম থেকে আসা শ্রমিকদের বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা তকমা দিয়ে হরিয়ানা ছাড়া করে ছেড়েছে। ন্যূহ থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে তওরা টাউনে ২৫০ ঝুপড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রশাসনের অভিযোগ, এক একর জুড়ে থাকা এই জমিতে চার বছর ধরে আসাম থেকে আসা বাংলাদেশি। এর আগে বজরঙ্গিদের বাইক বাহিনী গুরুগ্রামের ৭০-এ’র পারলা গ্রামের এক ৮০০-৯০০ পরিবারকে হুমকি দিয়ে ঘরছাড়া করে। এখানে বহু পশ্চিমবঙ্গ থেকে যাওয়া শ্রমিকের বসবাস। তওড়ার মতোই এই পরিবারগুলির কেউ আশেপাশের আবাসনে গৃহপরিচারিকা, দারোয়ান, গাড়ির চালকের কাজ করে। কেউ আবার জঞ্জাল থেকে বাতিল জিনিস এবং পুরনো জিনিসপত্র বেচাকেনা করেন। গুরুগ্রামের সেক্টর ৬৬-এ’র শ’দেড়েক ঘরের ‘বাঙালি বস্তি’তে একইভাবে উচ্ছেদের হুমকি দেওয়া হয়।
১ অগস্টের ওই প্রশাসনিক বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, হরিয়ানা শহরি বিকাশ প্রাধিকার (এইচএসভিপি), পুলিশ প্রশাসন, বন দফতরের আধিকারিক এবং পঞ্চায়েতের প্রতিনিধিরা। ওই বৈঠকেই আধিকারিকরা তাঁদের স্ব স্ব এলাকার নথি যাচাই করে নিশানা স্থির করেন। মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খট্টরের ওএসডি (অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি) জওহর যাদব হিন্দুস্তান টাইমসকে এই তথ্য দিয়ে আরও জানান, যে যে বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, সেগুলি হয় দাঙ্গায় জড়িত, যাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাঁদের অথবা বেআইনি নির্মাণ। যাদব বার বার বোঝাতে চেয়েছেন ৩০ জুন বাড়ি ভাঙার নোটিস দেওয়া হয়েছিল। “ইলাজ”র বোর্ড মিটিং হল ১ অগস্ট, দাঙ্গা হল ৩১ জুলাই আর ৩০ জুন নোটিস দেওয়া হল এমনটাও হয়?
২ অগস্ট থেকে ৬ অগস্ট লাগাতার বুলোডোজার চলেছে ন্যূহ জেলায়। পাঁচ দিনের মাথায় ৭ জুলাই পঞ্জাব ও হরিয়ানা হাই কোর্টের দুই বিচারপতি জি এস সন্ধাওয়ালিয়া ও বিচারপতি হরপ্রীত কাউর জীবন সংবাদপত্রের রিপোর্টে আকৃষ্ট হয়ে স্বতঃপ্রণোদিত মামলায় জেলা জুড়ে ভাঙার কাজে বাধা না-দিলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হয়তো আকাশ ছুঁত।
৭ জুলাই ঘরবাড়ি ভাঙা, উচ্ছেদের উপর হাই কোর্ট স্থগিতাদেশ জারি করে সরকার পক্ষকে প্রশ্ন করেন, “আইনশৃঙ্খলা সমস্যার ধুয়ো তুলে কি একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি ভাঙা হচ্ছে” আর সরকার কি “একটি এথনিক ক্লিনজিংয়ের অনুশীলন” পরিচালনা করছে? এর পর ডিভিশন বেঞ্চের মন্তব্য, ভারতীয় সংবিধান নাগরিকদের রক্ষা করে, আইনি বিধান ছাড়া এভাবে বাড়িঘর ভেঙে ফেলা যায় না। হরিয়ানা সরকারকে কাদের, কত বাড়ি ভাঙা হয়েছে এবং আইনি মেনে তা হয়েছে কি না তার তালিকা ও নথি জমা দিতে নির্দেশ দিয়ে ১১ অগস্ট পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা হয়। আর স্বরাস্ট্রমন্ত্রীর বুলডোজার “ইলাজ’ মন্তব্যের প্রেক্ষিতে আদালত উনবিংশ শতাব্দীর ইতিহাসবিদ লর্ড অ্যাকটনের উক্তি স্মরণ করে বলে “পাওয়ার টেন্ডস টু করাপ্ট; অ্যান্ড অ্যাবসলুট পাওয়ার করাপ্টস অ্যাবসুলিটলি।“ ১০ অগস্ট শুনানির এক দিন আগে বেঞ্চের বদল ঘটানো হয়। বিচারপতি জি এস সান্ধওয়ালিয়া ও বিচারপতি হরপ্রীত কাউরের পরিবর্তে বিচারপতি অরুণ পাল্লি ও বিচারপতি জগমোহন বনসলের আদালতে এই মামলার শুনানি শুরু হয়। শুনানি শেষ হলে বিচারপতি পাল্লি জানান, হাই কোর্টের রুল অনুযায়ী সুয়ো মোটো মামলা তিন দিনের মধ্যে প্রধান বিচারপতির সামনে পেশ করতে হবে।
সেন্টার ফর স্টাডি অব সোসাইটি অ্যান্ড সেকুলারিজম-এর তদন্ত রিপোর্টের উপসংহারে বলা হয়েছে এই দাঙ্গা “মুসলিমদের নিশানা করা লাগাতার ঘৃণাভাষণ এবং সাম্প্রতিক অতীত থেকে তার লালনপালনের মধ্য দিয়ে যে ‘ইকোসিস্টেম’ গড়ে তোলা হয়েছে তারই ফলশ্রুতি।
সূত্র:
১। Nuh violence: 1208 structures razed by Haryana government, mostly of one community, Leena Dhankar, Hidustan Times, August 10, 2023
২। Raze riots and State-led retribution: Reconstructing Haryana’s week of violence, Nikita Jain, Article-14.com, 7 August 2023
৩। Building of particular community brought down as exercise of Ethnic Cleansing? : Punjab and Haryana High Court asks Nuh-Gurugram demolitions. Aiman J. Chisti, livelaw.in, 7 August 2023
৪। In riot-torn Nuh, A Muslim man has found it impossible to get his complaint registered, Kaushik Raj, Article-14.com, 14 August 2023
৫। How provocative posts, videos on social media fueled violence in Nuh, outlookindia.com, August 3, 2023
৬। Haryana violence: How provocative videos and background of hate preceded the Nuh Riots, Alishan Jafri, thewire.com, August 3, 2023
৭। Nuh riots correspond to larger persecution of region’s Muslims: Fact-Finding team, Irfan Engineer, thewire.in, October 05, 2023
৮। ঘুরে বেড়াচ্ছে বিট্টু বজরঙ্গি, মুসলিম বস্তি গুঁড়িয়ে দিচ্ছে খাট্টারের বুলডোজার, অরূপ সেন, গণশক্তি, ৫ অগস্ট ২০২৩
৯। বাছাই দোকানই পুড়ে ছাই, গুরুগ্রাম ভাল নেই, অগ্নি রায়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৭ অগস্ট ২০২৩
পড়ুন:
“মুখ খুললে বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেব, ভারতে বুলডোজার অবিচার” — একটি অ্যামনেস্টি রিপোর্ট