সিএএ বিধি অনুযায়ী, যে সমস্ত নথি জমা দিতে হবে, তা জোগাড় করে জমা দেওয়া এক কঠিন কাজ। এ পথে নাগরিকত্ব পাওয়া মরীচিকা মাত্র। সিএএ নিয়ে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় জানালেন আসামের আইনজীবী ও বিদেশি ট্রাইবুনালের প্রাক্তন সদস্য শিশির দে।
অবশেষে ঝুলির বেড়াল বেরিয়ে গেল। ভারত সরকার সিএএ রুল জারি করেছে। সিএএ ২০১৯-এর পুরো নাম হল সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট মানে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯। চার বছর আগে ১০ জানুয়ারি ২০২০ আইনটি কার্যকরী হয়েছে, যদিও প্রয়োজনীয় রুল বা বিধি তৈরি না হওয়ায় কেউ এখনও পর্যন্ত এই আইনের অধীনে নাগরিকত্ব প্রাপ্তির জন্য আবেদন করতে পারেননি। সকলেই অপেক্ষা করছিলেন রুল জারি হওয়ার। তবে কি এবারে আবেদন করে নাগরিকত্ব লাভে কোনও বাধা থাকল না? আনন্দে আত্মহারা হয়ে কাল থেকেই আবেদন করতে শুরু করে দেবেন! সেই আশ্বাসের ভিত্তিতেই তো এতদিন হিন্দুদের ত্রাণকর্তা হিসেবে বিজেপি তাঁদের ভোট ব্যাঙ্ক হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। সেই উদ্দেশ্যেই চার বছরের নীরবতার পর নির্বাচনের আগ মুহূর্তে সেই রুল যে জারি করা হয়েছে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তা সে যাইহোক, যাঁদের নাগরিকত্ব দেবেন বিনিময়ে তাঁদের এবং তাঁদের প্রতি সহানুভূতি থাকা লোকজনের ভোট শাসক দল চাইতেই পারে। এতে অন্যায় কিছু নেই। প্রশ্ন হল, সত্যিই কি নাগরিকত্ব পাবেন বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে আগত অমুসলিম অনাগরিকরা? যাচাই করে দেখা যাক কীভাবে আবেদন করতে হবে এবং কীভাবে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে বা আদৌ কেউ নাগরিকত্ব পাবেন কি না।
নিন্দুকেরা শুরু থেকেই সন্দেহ প্রকাশ করে আসছেন যে, নাগরিকত্ব কাউকে দেওয়ার জন্য এই আইন তৈরি করা হয়নি। এত সহজে কাউকে নাগরিকত্ব দেবে না এরা, যারা নাগরিকত্ব লাভের সকল পথ বন্ধ করেছিল ২০০৩ সালে। বাস্তবেও তা-ই সত্য হতে দেখা যাচ্ছে রুল জারি হওয়ার পর। সিএএ ২০০৩-এর মাধ্যমে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের নাগরিকত্বের জন্য আবেদনের পথ বন্ধ করা হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ৩১ অগষ্ট ২০১৪ তারিখের আগে ভারতে আসা অমুসলিমরা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নন বলে সিএএ ২০১৯-এ বলা হয়েছিল। তাঁদের নাগরিকত্ব দিতে নাগরিকত্ব আইনে ৬-বি ধারা যোগ করা হয়েছে ২০১৯-এ। রুল জারি হল। কিন্তু যেসব কাগজপত্র দাখিল করে অনলাইনে আবেদন করতে হবে, সেইসব ক’জনের আছে? প্রথমত যাঁরা ইতিমধ্যে নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী নাগরিক, তাঁরা নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন না। যাঁদের জন্ম ভারতে ১ জুলাই ১৯৮৭-র আগে হয়েছে তাঁদের মা-বাবা অনাগরিক হলেও তাঁরা নাগরিক। যাঁদের মা-বাবার এক জন ভারতীয় এবং ৩ ডিসেম্বর ২০০৪-এর আগে ভারতে জন্ম হয়েছে তাঁরাও ভারতের নাগরিক। এ ছাড়াও আসামের ক্ষেত্রে, যাঁরা ২৫ মার্চ ১৯৭১-এর আগে পূর্ব-পাকিস্তান বা বর্তমান বাংলাদেশের এলাকা থেকে আসামে এসেছেন তাঁরা ভারতীয় নাগরিক হয়ে গেছেন। আর যাঁরা ভারতের নাগরিক তাঁরা নাগরিকত্বের জন্য কীভাবে আবেদন করবেন, তাঁরা আবেদনের যোগ্য নন।
যে সকল হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জৈন, পার্সি বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে এসেছেন এবং ইতিমধ্যে ভারতের নাগরিকত্ব পাননি তাঁরা আবেদন করতে হলে সোমবারের প্রকাশিত রুলের তপশিল ১-এ তে উল্লেখিত যে কোনও একটি কাগজ দাখিল করতে হবে। সেইগুলো হল, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের পাসপোর্ট, বার্থ সার্টিফিকেট, স্কুল সার্টিফিকেট, জায়গার দলিল বা ভাড়াটিয়া দলিল, বা যেকোনো ধরনের পরিচয়ের প্রমাণপত্র, বা মা-বাবা, ঠাকুরদা-ঠাকুমা-র ঐ সব দেশের বাসিন্দা থাকার প্রমাণপত্র, বা ভারতে বিদেশি হিসেবে নথিভুক্ত থাকার প্রমাণপত্র। এছাড়াও মা-বাবার জন্মের তারিখের প্রমাণ, যেমন মা-বাবার বার্থ সার্টিফিকেট বা পাসপোর্ট। আর এগুলো না থাকলে আবেদনকারীর বার্থ সার্টিফিকেট যাতে মা-বাবার ঐসব দেশের নাগরিকত্বের স্পষ্ট উল্লেখ থাকতেই হবে। এইসব কাগজপত্র ক’জনের আছে? সম্ভবত কারোরই নেই, তাহলে আবেদন করতেই পারবেন না। আশার গুড়ে বালি!
এ ছাড়াও, আবেদন যদিও করতে হবে অনলাইনে, কিন্তু সেই আবেদন প্রথমেই যাবে জেলা প্রশাসনের কাছে ভেরিফিকেশনের জন্য। আবেদনকারীকে সশরীরে উপস্থিত হয়ে শপথনামায় স্বাক্ষর করতে হবে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে। তার পর জেলা পর্যায়ের কমিটি সেই শপথনামা অনলাইনে আপলোড করে ভেরিফিকেশন রিপোর্ট-সহ পাঠাবেন এম্পাওয়ার্ড কমিটিতে। এম্পাওয়ার্ড কমিটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। প্রক্রিয়াটি মোটেই সহজ নয়। নিজেকে বিদেশি বলে ঘোষণা করতে হবে। ভারতে থাকার প্রমাণ দিতে হবে। ভোটার তালিকায় নাম থাকা ভারতে থাকার প্রমাণ হিসেবে দেওয়া যাবে না, যদিও রেশন কার্ড, সেন্সাস স্লিপ, ইত্যাদি দেওয়া যাবে।
এটা স্পষ্ট যে এই নিয়মে আবেদন করে নাগরিকত্ব পাওয়া দুরাশা মাত্র। ললিপপ দেখিয়ে ভোট আদায় করা এভাবে সম্ভব হবে কি না সময় বলবে। ঝুলির বেড়াল কিন্তু বেরিয়ে গেছে।
রচনাটি প্রথম ১২ মার্চ ২০২৪, আসামের বার্তালিপি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। শিরোনাম পরিবর্তিত।