নারীদের জন্য বরাদ্দ যে একটি দিন কমিউনিস্ট ইতিহাসে, তা ক্রমশ পর্যবসিত হল আনুষ্ঠানিকতায়। অন্যদিকে, পুঁজির রাজনীতি কিন্তু দিনটিকে করে তুলল পারিবারিকতার উদযাপনের দিন, বিবাহ ব্যবস্থার উদযাপনের দিন, এবং একইসাথে, উৎপাদনের জগতে মেয়েদের পা রাখার দিনও। ঠিক যেখানে কমিউনিস্ট শিবির তার নিজের অভ্যন্তরে তৈরি হওয়া তত্ত্বকে পায়ে ঠেলল, তাকে বাস্তবিক, প্রায়োগিক রাজনীতির স্তরে উন্নীত করার কোনো প্রয়াসই নিল না, সেই সেই মাত্রায়, পুঁজি হাজির করল তার নিজের অ্যাজেন্ডাকে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আজকের যে পণ্যায়িত ৮ মার্চের পরিমণ্ডল, যে আধাখেঁচড়া, হৃদয়বিহীন রুটিনমাফিক আন্তর্জাতিক (শ্রমজীবী) নারী দিবস পালন করার ঐতিহ্য, সেটাই স্বাভাবিক। লিখলেন নন্দিনী ধর।
প্রতি বছরই আটই মার্চ বা তার অব্যবহিত আগেপরের সময়টিতে বড়োই ভয়ে ভয়ে থাকি। একে তো দুনিয়ার প্রসাধনদ্রব্য, পোশাকপরিচ্ছদের কোম্পানিগুলির ক্ষণে ক্ষণে “Happy Women’s Day” বার্তা, ছাড়ের বিজ্ঞাপন। অন্যদিকে আবার ফেসবুক বা অন্যান্য সামাজিক গণমাধ্যমগুলো খুললেই সব্বার কেমন যেন বেশ নারী-নারী ভাব। তাবৎ দুনিয়ার এই সময়টিতে নারীজাতির দুঃখে প্রাণ কাঁদে। যে কর্পোরেট বিশ্ববিদ্যালয়ের আমি প্রচুর সুযোগসুবিধাপ্রাপ্ত উচ্চস্তরের শ্রমিক, সেখানে ইউনিয়ন করা মানা। আমারও মানা, অশিক্ষক কর্মীদেরও মানা, রান্নাঘর বা হস্টেল বা বাগানে কর্মরত কর্মী-শ্রমিকদেরও মানা। কিন্তু তৎসত্ত্বেও, ঢল নামে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শুভেচ্ছার। ঢল নামে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠানের। এবং, অবশ্যম্ভাবীভাবে, সেখানে আটই মার্চ আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস নয়, আটই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস।
বলা বাহুল্য, এই যে অবলোপন, “শ্রমজীবী” শব্দটিই গায়েব গোটা শব্দবন্ধটি থেকে, এটি আসলে একধরনের বিস্মৃতির ইতিহাস। কমিউনিস্ট ইতিহাসকে ভুলিয়ে দেওয়ার ইতিহাস। কমিউনিস্ট ইতিহাসকে পুঁজির বাস্তবতা, অর্থনৈতিক সম্পর্ক ও সাংস্কৃতিক রাজনীতিতে আত্মীকরণ করার ইতিহাস। এবং, এই গোটা প্রক্রিয়াটির ভিতরেই আছে পুঁজির সুচতুর রাজনৈতিক পরিকল্পনা, রয়েছে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক শ্রম। অবশ্য শুধুই এইটুকু বললে গল্পটা অর্ধেক বলা হয়। বাকি অর্ধেকটির আলোচনা করতে গেলে তো শুরু করতে হবে কমিউনিস্ট আত্মবিস্মৃতির কথা থেকে। আয়নাটা ঘোরাতে হবে নিজেদের দিকে। জিজ্ঞাসা করতে হবে, কেন এত সহজ হল, আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবসকে কেবলিমাত্র হাসিখুশি সাজুগুজু সাবান-ক্রিম-শাড়ির ডিসকাউন্টের “হ্যাপি উইমেন্স ডে’-তে পরিণত করা। ঠিক কোন প্রক্রিয়ায় পণ্যায়িত হল কমিউনিস্ট ইতিহাসের সাথে আদ্যোপান্ত জড়িয়ে থাকা একটি দিন? এবং, যদি হলই বা, তাহলেই বা ঠিক কোন ধরনের লড়াই দেওয়া হল এই পন্যায়ণের বিপক্ষে কমিউনিস্ট রাজনৈতিক শিবিরের পক্ষ থেকে? অর্থাৎ, যেটা আমি এখানে বলতে চাইছি, তা হল, বিশ্বজুড়ে কমিউনিস্ট রাজনীতি ও আন্দোলনের যে পিছু হটা, যে দিশাহীনতা, তার থেকে আলাদা করে আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবসের পণ্যায়নের বিষয়টিকে দেখা যাবে না।
যেমন ধরা যাক, মার্চ আটের যে আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস হয়ে ওঠার ইতিহাস, তার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে একটি নাম — ক্লারা জেটকিন। সাথে সাথে এও মনে রাখা প্রয়োজন, আটই মার্চকে চিহ্নিত করার আগে থেকেই, ১৯০৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজতান্ত্রিক পার্টির নেতৃত্বে প্রথম পালিত হয় জাতীয় নারী দিবস — ফেব্রুয়ারি মাসের ২৮ তারিখে। ১৯১১ সালে ১৯ মার্চ। মোটামুটি ১৯১৩-১৯১৪ সাল থেকে নারীদিবস পালিত হতে শুরু করে মার্চ মাসের আট তারিখে। এবং এই গোটা পর্যায় জুড়েই, মার্চ ৮ ছিল আন্দোলনের দিন, মেয়েদের নিজস্ব অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দাবিদাওয়ার ওপর ভিত্তি করে জমায়েত হওয়ার দিন। এক্ষেত্রে যেটা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, তা হল, ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে শ্রমজীবী ও সমাজতান্ত্রিক মেয়েদের একটি আন্তর্জাতিক মিটিংয়ে জেটকিন প্রথম একটি বিশেষ দিনকে সারা পৃথিবীতে নারী দিবস হিসেবে পালন করার আহ্বান রাখেন। প্রস্তাবটির বয়ানটি ছিল এইরকম:
In agreement with the class-conscious, political and trade union organizations of the proletariat of their respective countries, the Socialist women of all countries will hold each year a Women’s Day, whose foremost purpose it must be to aid the attainment of women’s suffrage. This demand must be handled in conjunction with the entire women’s question according to Socialist precepts. The Women’s Day must have an international character and is to be prepared carefully
[মেয়েদের ভোটাধিকার প্রাপ্তির আশু ও মূলগত উদ্দেশ্যের ওপর দাঁড়িয়ে, পৃথিবীর প্রতিটি দেশের সমাজতান্ত্রিক মেয়েরা প্রতি বছর, তাদের নিজ নিজ দেশের শ্রেণি-সচেতন, শ্রমিকশ্রেণির রাজনৈতিক ও ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনগুলির সাথে একযোগে নারী দিবস পালন করবে। মেয়েদের ভোটাধিকারের দাবিটিকে দেখতে হবে সমাজতান্ত্রিক ধারায় পরিচালিত গোটা নারীমুক্তির প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতেই। নারী দিবসের থাকবে একটি আন্তর্জাতিক চরিত্র এবং এর জন্যে আমাদের সযত্নে প্রস্তুত হতে হবে।]
পারিবারিকসূত্রে, নারী দিবসের কোনো না কোনো বিপ্লবী-বাম অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছি শৈশব থেকে। কিন্তু এই ইতিহাসটি জানতে পারিনি। জানতে পারিনি সেইসব অনুষ্ঠান থেকে ক্লারা জেটকিনের নাম। নিজের তরুণ ও ছাত্র বয়সে নিজে যখন রাজনীতি করেছি ও আটই মার্চের অনুষ্ঠান সংগঠিত করেছি, তখনো জানতে পারিনি ক্লারা জেটকিনের সাথে এই দিনটির প্রগাঢ় ভাবে জড়িয়ে থাকার ইতিহাস। অথচ, আমরা ক্লারা জেটকিনের নাম শুনেছি, ছাপার অক্ষরে দেখেছি। দেখেছি নারীমুক্তি প্রশ্নে লেনিনের সাক্ষাৎকারী হিসেবে। ওই একটি জিনিসই আমাদের তারুণ্যে নারী-প্রশ্নে সাংগঠনিকভাবে পড়ানো হত। আমরা সেখানে ক্লারাকে দেখতে শিখেছিলাম উপলক্ষ্য হিসেবে। ক্লারা এখানে কোনো স্বাধীন চিন্তক নন। ক্লারা এখানে স্বাধীন সংগঠকও নন। নন স্বাধীন বিপ্লবী। তাই, তাঁর জীবন, তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, তাঁর অন্যান্য লেখাপত্তর এই রাজনৈতিক প্রশিক্ষণপ্রক্রিয়ায় কোনো ধরনেরই জায়গা করে নেয়নি। যে উপলক্ষ্যের হাত ধরে আমরা আরও একটু এগিয়ে যাব লেনিনের ভাবধারার দিকে। আমাদের নেতারা আমাদের চিনতে শিখিয়েছিলেন, ক্লারা কতোটা ভুল, লেনিন কতোটা ঠিক। ক্লারাকে উপলক্ষ করে, আমরা শিখেছিলাম লেনিন মহামতি। তিনি কখনো ভুল করতে পারেন না। ভুল ভাবতে পারেন না।
কাজেই, বাংলা তথা ভারতবর্ষের যে বাম বিপ্লবী রাজনৈতিক অন্দরমহল, সেখানে ক্লারা জেটকিনকে নিয়ে চর্চার কোনো বাতাবরণ ঐতিহাসিকভাবে তৈরি হল না। অবশ্য, শুধু ক্লারা কেন, কোনো কমিউনিস্ট ধারার নারী চিন্তকদের নিয়েই হল না। এর সাথে সাথে এই কথাও সত্য যে ঠিক যে ধারায় বাংলা তথা ভারতবর্ষের ‘এমএল’ রাজনীতি পরিচালিত হয়েছে, সেখানে ক্লারা জেটকিন রাজনৈতিকভাবে বেমানান। বেমানান রোজা লাক্সেমবার্গ বা আলেক্সান্দ্রা কোলানতাইও। কাজেই, এখানে বিস্মৃতির ধারা দ্বিবিধ। একদিকে আছে কমিউনিস্ট রাজনীতি ও পার্টিগুলির লিঙ্গ ও নারী প্রশ্ন নিয়ে ঘোলাটে রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা, সংগঠনের ভেতরকার আভ্যন্তরীণ প্রগাঢ় পরিকাঠামোগত পিতৃতন্ত্র, অন্যদিকে আছে বৃহত্তর কমিউনিস্ট আন্দোলনের দিশার প্রশ্ন।
অতএব, এই পরিপ্রেক্ষিতে, বছরের পর বছর ধরে মার্চ মাসের আট তারিখে অনুষ্ঠান হয়েছে, কোনো না কোনো রকমের সাংগঠনিক নাড়াচাড়া হয়েছে, কিন্তু আটই মার্চ যে একাধিক জটিল রাজনৈতিক প্রশ্ন হাজির করে আমাদের সামনে, সেসব নিয়ে সংগঠনগুলির ভিতরে কোনোধরনের চর্চা ও আলাপআলোচনাও হয়নি। আরও অনেক পালনযোগ্য দিবসের মতো, আন্তর্জাতিক (শ্রমজীবী) নারী দিবস পর্যবসিত হয়েছে আনুষ্ঠানিকতায়। সেই আনুষ্ঠানিকতার ভিতরেই থেকেছে স্মৃতিহীনতা, বিস্মৃতির রাজনীতি। কাজেই, একভাবে দেখতে গেলে, নারী ও লিঙ্গ প্রশ্ন নিয়ে কমিউনিস্ট রাজনীতির যে তীব্র ঐতিহাসিক ভ্রান্তি, তার ফাঁকফোঁকর অলিগলিতেই জন্ম নিয়েছে পুঁজি-কর্পোরেটের কমিউনিস্ট নারীবাদের আত্মসাতের বাস্তবতা, জন্ম নিয়েছে একধরনের বাজারকেন্দ্রিক কর্পোরেট নারীবাদ। তদুপরি, এই যে পুঁজি-কর্পোরেটের ইচ্ছাকৃত রাজনৈতিক বিস্মৃতি, যে বিস্মৃতির হাত ধরে আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারীদিবস হয়ে যায় হ্যাপি উইমেন্স ডে, যে বিস্মৃতির হাত ধরে ক্লারা জেটকিন-সহ অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক-সাম্যবাদী নারীবাদীরা বাদ পড়ে যান নারীদিবসের ইতিহাসের আখ্যান থেকে, সেই বিস্মৃতির নীলছকের পরিপূরক হয়ে ওঠে কমিউনিস্ট পিতৃতন্ত্রের বিস্মৃতির রাজনীতি।
কাজেই, আজকে যখন প্রায় রোজা-ক্লারার সময়কালের মতোই, দিকে দিকে চারা দিয়েছে ফ্যাসিবাদী সরকারগুলি, সারা বিশ্বে আবার যুদ্ধবাজদের আগ্রাসী পদধ্বনি, একের পর এক আক্রমণ নেমে আসছে শ্রমিকশ্রেণির উপর, বাতিল হচ্ছে একে একে গত পঞ্চাশবছরে পৃথিবীর মেয়েদের পুঁজি-রাষ্ট্রের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া খণ্ডিত অধিকার, তখন শুধু কর্পোরেট-পুঁজির এই বিস্মৃতির সমালোচনা যথেষ্ট নয়। যথেষ্ট নয় কেবল কয়েকটি শ্রমজীবী মেয়েদের লড়াই বা জঙ্গি রাজনৈতিক অংশগ্রহণের কথা তুলে ধরা। বরং, এই কমিউনিস্ট আত্মবিস্মৃতির দায় নিজেদের নিতে হবে, কঠিন আত্মসমালোচনা করতে হবে। অর্থাৎ, আবারও বলি, আয়নাটা ফেরাতে হবে নিজেদের দিকে।
২.
অর্থাৎ, এখানে বলতে চাইছি তাত্ত্বিক শ্রমের কথা। কারণ, এই আত্মসমালোচনা, আত্মবিস্মৃতির রাজনীতির পর্যালোচনা করতে গেলে, যা প্রথমত প্রয়োজন। এবং, যা পুঁজিবাদী ও ফ্যাসিবাদী শিবির গত সত্তর-আশি বছরের যে সময়কাল, সেখানে করেছে। করেছে লিঙ্গ ও নারী প্রশ্নকে ঘিরেও। যার ফলশ্রুতি আমরা দেখতে পাই প্রেগা নিউজের বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে দুর্গা বাহিনীর কর্মপ্রকল্পে। অন্যদিকে, বাম শিবির এড়িয়ে গেছে সেই গূঢ় দায়িত্ব, আজও যাচ্ছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে, খিস্তি খাওয়ার সম্ভাবনা মাথায় রেখেই বলি, আজ, অর্থাৎ, আটই মার্চ, ২০২৪, সারাদিন ধরে আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস হিসেবে বিভিন্ন বামপন্থী দল /পার্টি/গ্রূপগুলির নেতৃত্বে যে যে সভা, সমিতি, মিছিল হবে, তার প্রায় প্রত্যেক কটিই, এই এড়িয়ে যাওয়ার রাজনীতির প্রতিফলন।
কীরকম? যেমন, মোটামুটি এই আটই মার্চ উপলক্ষে খুব তাড়াতাড়ি হলে ফেব্রুয়ারি ২৪-২৫, আর খুব দেরি হলে মার্চ ১-২ নাগাদ, বিভিন্ন পার্টিগুলির নারী সংগঠনগুলির ভিতর একটু তৎপরতা দেখা যাবে। যাঁরা ঠিক করেছেন যে বিভিন্ন সংগঠনের সাথে যৌথ অনুষ্ঠান করবেন, তাঁরা একে অন্যেকে একটু ফোনাফুনি করবেন। দু’টি কী তিনটি যৌথ মিটিং হবে। সেই যৌথ মিটিঙে লিফলেট বা স্লোগানের বয়ান নিয়ে একটু বাকবিতণ্ডা হবে। কিছু তাত্ত্বিক বিষয় উঠবে, কিন্তু সময়ের অভাবের দোহাই দিয়ে সেগুলোকে ধামাচাপা দেওয়া হবে। এবং এই যে ধামাচাপা দেওয়া হল, তা নিয়ে সারা বছর আর কোনো চর্চা হবে না। অতঃপর, লেখা হবে একটি গোলগোল বক্তব্যের ধরি মাছ না ছুঁই পানির লিফলেট। এরপর, দ্রুত আলোচনা ঘুরে যাবে অনুষ্ঠানটির প্রায়োগিক দিকে। আলোচনা হবে মাইক, পোস্টার নিয়ে, টাকাপয়সা নিয়ে, পুলিশ অনুমতি নিয়ে। অনুষ্ঠান হবে। একশো থেকে দু’তিনশো মহিলার জমায়েত হবে। পুরুষরা থাকবেন পাঁচটি থেকে দশটি, সাংগঠনিক কাজে সাহায্য করার জন্য, অথবা সংহতি জানানোর জন্য। এই একই প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি ঘটবে আবার পরের বছর। তার পরের বছর। তার পরেরও। প্রসঙ্গত, বলি, এই যে আটই মার্চ পালনের সাধারণ ছক, সেখানে ক্লারা জেটকিনের কর্মকাণ্ডের গভীর অধ্যয়ন একটু বিপজ্জনক বৈকি। ক্লারা মানে তো শুধু লেনিনের সাক্ষাৎকারী নন, ক্লারা মানে তো পার্টির পুরুষ নেতৃত্বের বিধিনিষেধকে কলা দেখিয়ে নারী প্রশ্নে সংগঠনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াও। ভেবে দেখুন, পার্টির “বে-আইনি” ঘোষণা সত্ত্বেও, ১৯১৫ সালে সুইৎজারল্যান্ডে ২৮ জন সমাজতন্ত্রী মহিলা কর্মীকে নিয়ে ক্লারার সম্মেলন করার কথা। ভেবে দেখুন, ১৯১৭ সালে, এর ফলশ্রুতি হিসেবে, এসপিডি বা সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ক্লারাকে পার্টির মুখপত্রের সম্পাদক পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার কথা। অতো সাহস আমাদের সময়কার বঙ্গললনা/ ভারতীয় নারী বামপন্থীদের নেই। কাজেই, বছর বছর আটই মার্চ পালন চলে একই নিয়মে।
আসলে, কোথাও একটা কমিউনিস্ট পার্টির যে সাংগঠনিক-রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপে, সেখানে নারী সংগঠনের বা ফ্রন্টের ঠিক কি ভূমিকা হবে, তা নিয়ে রয়ে গেছে একটা তত্ত্বগত গরমিল। মূলগতভাবে, ঐতিহাসিকভাবে দেখলে, পার্টির ছত্রছায়ায় থাকা যে নারী সংগঠনগুলি, তারা এমন কোনো কাজ করেনি যা ট্রেড ইউনিয়নগুলো করেনি বা করতে পারে না। এই আজকেও, অর্থাৎ ৮ মার্চ, ২০২৪-এ বাম দলগুলির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যে স্লোগানগুলি দেখেছি, সেইগুলি ট্রেড ইউনিয়নদের দেওয়ার কথা। আর বাদবাকি যা চোখে পড়েছে, তা এতটাই মানবিকতার রাজনীতির ওপর দাঁড়িয়ে, যে সেগুলো যে কোনো মঞ্চ, যে কোনো সংগঠন থেকেই দেওয়া যেতে পারে।
কাজেই, এই পরিপ্রেক্ষিতে, যা খুব স্বচ্ছন্দে বলা যেতে পারে যে নারী ফ্রন্টের আসলে কোনো প্রয়োজন নেই। মানছি, বাস্তবত দেখা গেছে যে ট্রেড ইউনিয়নগুলিতে পিতৃতান্ত্রিক পরিবেশের কারণে মহিলা শ্রমিকদের যে দাবিদাওয়া, তা জায়গা পায়নি। সেক্ষেত্রে, পৃথক সংগঠন গড়ে তোলার চাইতে বরং, অনেক বেশি প্রয়োজন ট্রেড ইউনিয়নগুলির ভিতরে পিতৃতন্ত্র বিরোধী লড়াই গড়ে তোলা, আরও বেশি বেশি করে মহিলা শ্রমিকদের ইউনিয়নের সাথে সংযুক্তি। সেই সংযুক্তি ঘটাতে প্রাথমিক স্তরে, একটি পরিবর্তনকামী স্তর হিসেবে নারী সংগঠনগুলি থাকতে পারে। কিন্তু, বাস্তবে যা দেখা গেল, তা হল, যে স্লোগানসমূহ বাম নারী সংগঠনগুলির থেকে দেওয়া হয়, তা মূলত ট্রেড ইউনিয়ন স্তরের স্লোগান। নারী সংগঠনগুলির প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ড হয় বিবিধ। কখনো সেটা হয় পুরুষ নেতৃবর্গের পরিবারের মহিলাদের একটি সামাজিক – সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র, তাঁদের কোনো-না-কোনো ভাবে সংগঠনে জুড়ে রাখার প্রচেষ্টা, কখনো সেটি হয়ে ওঠে পুরুষ শ্রমিকদের পরিবারের মেয়েদের একটু সচল করে রাখার জায়গা। এলাকা ভিত্তিক কাজ হলে নারী সংগঠনটির কাজ হয় মেয়েদের একটু আলাদা করে সংগঠিত করা। কাজেই, আবারও বলি, নারী সংগঠন বা নারী ফ্রন্টের জায়গাটা বৃহত্তর কমিউনিস্ট সাংগঠনিক পরিকাঠামোতে ঠিক কী, তার কোনো তত্ত্বায়ন সাধারণভাবে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ভেতরে নেই। এবং, এই তত্ত্বায়নের অভাব সেই অর্থে একটি উপসর্গ। রোগটি অনেক অনেক গভীরে।
আসলে, বিষয়টি ঠিক এইখানেই যে, পিতৃতন্ত্র ও লিঙ্গ রাজনীতির বিশ্লেষণের যে গভীরতা থাকলে নারী ফ্রন্টের কাজ হবে তা রাজনৈতিকভাবে নির্ধারণ করা যায়, তা আসলে কোনোদিনই কমিউনিস্ট আন্দোলনের ভেতরে সুসংহত ভাবে গড়ে ওঠেনি। পাশাপাশি, মার্ক্সবাদী তত্ত্বে যেভাবে লিঙ্গ ও পিতৃতন্ত্র তত্ত্বায়িত ও আলোচিত হয়েছে, তার যৌক্তিক বাস্তবিক প্রয়োগ ঘটলে কমিউনিস্ট নারী ফ্রন্টের ভিত্তিগত রাজনৈতিক কাজ হত দু’টি — পরিবার ও বিবাহের অবলোপন। না, একথা আমি বলছি না যে এই বিষয়টি ঘটত একদিনে, আকস্মিকভাবে। কিন্তু, ঠিক কী ভাবে ঘটবে এই অবলোপনের কাজ, তার রাজনৈতিক স্তরগুলি ঠিক কী হবে, কীভাবে এই বিষয়গুলির সংযুক্তি ঘটবে উৎপাদন ও অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া, বিষয়গুলির সাথে, তা নিয়ে কোনো ধরনের কোনো আলোচনাই কোনোদিন শুরু করা গেল না কমিউনিস্ট রাজনীতির ভিতরে। বরং, প্রগাঢ়ভাবে মেনে নেওয়া হলো বিবাহ ও পরিবার উভয়কেই, অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোমান্টিসাইজও করা হল উভয়কেই।
অর্থাৎ, ক্লারা জেটকিন বা আলেক্সান্দ্রা কোলানতাই ও অন্যান্য প্রথম যুগের কমিউনিস্ট নারীবাদী চিন্তকদের হাত ধরে যে শুরু হয়েছিল পরিবারের রাজনীতি, বিবাহের রাজনীতি ও উৎপাদনের রাজনীতির আন্তঃসম্পর্ককে দেখার কাজ, রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ও সর্বোপরি পরিবর্তনকামী রাজনীতির ক্ষেত্র গড়ে তোলার কাজ, তার কোনো প্রগতি ঘটল না। আর, যেহেতু পরিবার ও বিবাহ বিষয়টির রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে গেলে, অবশ্যম্ভাবীভাবে আসবে যৌনতার রাজনীতির কথা, বিশেষত নারী যৌনতার সাথে পুঁজির সম্পর্কের কথা, ব্যক্তিগত সম্পত্তির কথা, তাও কোনোদিন পার্টির রাজনীতির ক্ষেত্রে এল না।
তাই, নারীদের জন্য বরাদ্দ যে একটি দিন কমিউনিস্ট ইতিহাসে, তা ক্রমশ পর্যবসিত হল আনুষ্ঠানিকতায়। যার প্রভাব আমরা আমাদের জীবনে দেখেছি গভীরভাবে। অন্যদিকে, পুঁজির রাজনীতি কিন্তু দিনটিকে শুধু আনুষ্ঠানিকতায় রাখল না। বরং, তাকে করে তুলল পারিবারিকতার উদযাপনের দিন, বিবাহ ব্যবস্থার উদযাপনের দিন, এবং একইসাথে, উৎপাদনের জগতে মেয়েদের পা রাখার দিনও। এর সবটাই ঘটল বাজারকেন্দ্রিক সংস্কৃতির সাথে এক শ্রেণির মেয়েদের আরও বেশি বেশি সংযুক্তি ঘটাতে ঘটাতে। এবং, এর জন্য পুঁজি ও বাজারকে করতে হল গভীর তাত্ত্বিক শ্রম। অর্থাৎ, ঠিক যেখানে কমিউনিস্ট শিবির তার নিজের অভ্যন্তরে তৈরি হওয়া তত্ত্বকে পায়ে ঠেলল, তাকে বাস্তবিক, প্রায়োগিক রাজনীতির স্তরে উন্নীত করার কোনো প্রয়াসই নিল না, সেই সেই মাত্রায়, পুঁজি হাজির করল তার নিজের অ্যাজেন্ডাকে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আজকের যে পণ্যায়িত ৮ মার্চের পরিমণ্ডল, যে আধাখেঁচড়া, হৃদয়বিহীন রুটিনমাফিক আন্তর্জাতিক (শ্রমজীবী) নারী দিবস পালন করার ঐতিহ্য, সেটাই স্বাভাবিক।
আবারও বলি, এখানে শুধুই কর্পোরেট সংস্কৃতিকে দায়ী করে লাভ নেই। আয়নাটা ঘোরাতে হবে নিজেদের দিকে, নিজের দিকে।