সন্তু পানের গ্রেফতার এক স্বৈরাচারী প্রবণতা। এই বেআইনি গ্রেফতারের প্রতিবাদ না করলে, সংসদ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে, পথসভা থেকে সেমিনার-কনভেনশনে, সংবাদমাধ্যম থেকে সমাজমাধ্যমে যেভাবে বিরুদ্ধস্বরকে নিয়ন্ত্রণ করা, দমন করা, ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে স্তব্ধ করার এক লাগামহীন প্রক্রিয়া নরেন্দ্র মোদীর রাজত্বে এক স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে— তার প্রতিবাদ করার নৈতিক জোর আমরা হারিয়ে ফেলব। লিখলেন দেবাশিস আইচ।
Groundxero|20 February, 2024
সোমবার রাতে সন্দেশখালি থেকে রিপাবলিক টিভির সাংবাদিক সন্তু পানকে গ্রেফতার করেছে জেলা পুলিশ। আজ তাঁকে আদালতে তোলা হলে তিন দিনের পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। টেলিভিশনের সংবাদ পরিবেশনের মতোই এই গ্রেফতারও অতি নাটকীয়। সন্দেশখালিতে ইডির হানা, ইডি আধিকারিক এবং ১৪ জন সাংবাদিকের উপর শেখ শাহজাহান বাহিনীর হিংস্র আক্রমণ থেকে এখনও পর্যন্ত যা যা ঘটেছে, তা একদিকে যেমন শাসকের স্বৈরাচারী কর্মকাণ্ডকে নগ্ন করে ছেড়েছে, উল্টোদিকে সাধারণ মহিলাদের প্রতিবাদ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাকেও উজ্জ্বল করেছে।
১৪৪ ধারা জারি করে, বিরোধী দলগুলিকে সন্দেশখালিতে ঢুকতে না দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার ইতিমধ্যেই সংসদীয় রাজনীতির প্রতি তাঁর আস্থাহীনতাকেই ব্যক্ত করেছেন। দেশের অন্যান্য রাজ্যের মতোই এ রাজ্যেও মুক্ত গণতান্ত্রিক পরিসর বহুকালই পচা ডোবায় পরিণত হয়েছে। দেখেশুনে মনে হয়, মুখ্যমন্ত্রী আর ডোবাটুকুও রাখতে রাজি নন। ডোবা বুজিয়ে বোধহয় দলীয় কার্যালয় গড়তে চান। এমন স্বেচ্ছাচারী রাজনৈতিক পরিবেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা পদে পদে লঙ্ঘিত হয়। হয়েছেও। এই অবস্থাতেও যতটুকু খবর দেশের তথা রাজ্যের মানুষের কাছে পৌঁছেছে তা এককথায় ভয়াবহ। এই ভয়াবহতার সংবাদ, সন্দেশখালির অত্যাচারিত নারীদের কথা সংবাদমাধ্যমের জন্যই আমাদের কাছে পৌঁছতে পেরেছে। সমাজ মাধ্যমেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
রিপাবলিক টিভি একটি “হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট প্রোপাগান্ডা চ্যানেল”, একটি “গোয়েবলীয় মেশিনারি”, অন্যান্য অনেক গোদী মিডিয়ার মতোই রিপাবলিক নরেন্দ্র মোদীর “কোলের মিডিয়া” বলে বহু গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক সংগঠন অভিযোগ তোলেন। দিল্লিতে কৃষক আন্দোলন, তারও আগে দিল্লির শাহিনবাগে সিএএ বিরোধী আন্দোলনের সময় বিশেষভাবে এই সংবাদমাধ্যমটিকে আন্দোলনকারীরা বয়কট করেছিল। বর্তমানে এমনও অভিযোগ উঠেছে, রিপাবলিক টিভি এমনই এক প্রোপাগান্ডা মাধ্যম যারা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করে না। মনেই করে না, রাষ্ট্র ধর্মের প্রশ্নে নিরপেক্ষ দূরত্ব বজায় রাখবে। এবং মন্দির নির্মাণ, দেবতার প্রতিষ্ঠা প্রধানমন্ত্রীর কাজ নয়। তারা বিশ্বাস করে রামমন্দির নির্মাণ, মোদীর মতো তাদের কাছেও ৪৫০ বছরের কল্পিত “অন্যায়’র প্রতিশোধ। অতএব, “রামভক্ত”র সাজেই তাদের সাংবাদিকরা হাজির হবেন অযোধ্যায়। এই অভিযোগগুলি অনেকাংশেই বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে। কিন্তু, তার অর্থ এই নয় যে— হিন্দুত্ববাদীদের প্রোপাগান্ডা মেশিনারি হলেও— এখনও যারা খাতায়-কলমে সংবাদমাধ্যম, তাদের প্রতিনিধিকে কর্মরত অবস্থায় গ্রেফতার করতে হবে। যে গ্রেফতার শুধু অনৈতিক নয়, নানা কারণেই বেআইনি। এবং কোনও ব্যক্তিকে গ্রেফতার বিষয়ে উচ্চ আদালত ও শীর্ষ আদালতের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রায়ের পরিপন্থী। এ কথা মনে রেখেই বলা যে, সাংবাদিকদের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অসীম নয়। সাংবাদিকরা আইনের ঊর্ধ্বেও নন। ভারতীয় দণ্ডবিধির যে যে ধারায় সন্তু পানকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তার জন্য কর্তব্যরত অবস্থায় “আপনাকে গ্রেফতার করা হল” বলে টেনেহিঁচড়ে থানায় নিয়ে যাওয়াটাই অপ্রয়োজনীয় গা-জোয়ারি। তাও গ্রেফতারের আইনি পদ্ধতি ছাড়াই, কোনও আত্মীয় বা উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তির সাক্ষ্য ছাড়াই। ঠিক যেভাবে এক জন জঙ্গি কিংবা দাগী অপরাধে যুক্ত ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেফতার করে, ঠিক সেভাবেই। যে মহিলার অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হল, তার তথ্য প্রমাণ খতিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে করেনি পুলিশ। অভিযোগ, ওই মহিলা যখন ঘরে বিস্রস্ত পোশাকে ছিলেন তখন তাঁর ঘরে জোর করে ঢোকা ও ভিডিও করা। তবে তো, তদন্তের স্বার্থে ভিডিও ফুটেজ পরীক্ষা করার কথা। তা না করে, সরাসরি গ্রেফতার করাকে যদি “শাস্তিমূলক”, “প্রতিশোধপরায়ণতা” বলে কেউ অভিযোগ করেন, তা ফেলে দেওয়ার মতো নয়।
ইডি নয়, সিবিআই নয়, কোনও আদালতের নির্দেশে নয়— মহিলাদের আন্দোলনের জোর এতটাই ছিল যে, মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী— মুখে যাই বলুন— কার্যত মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন যে, তাঁর দল, দলের পঞ্চায়েত-রাজ নেতৃত্বের এক ক্ষমতাশালী অংশ দীর্ঘদিন ধরে ধর্ষণ, মহিলাদের নির্যাতন, জোর করে আদিবাসীদের জমি দখল, কৃষিজমিকে ভেড়িতে পরিণত করা, জমি লিজে নিয়ে টাকা না-দেওয়া, তোলাবাজির মতো অপরাধ করে আসছে। রাজ্য মহিলা কমিশনের প্রতিনিধিদের পাঠিয়ে মহিলাদের উপর অত্যাচারের সেই ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার প্রচেষ্টা সফল হয়নি। জেলা পরিষদের সদস্য দুই প্রধান অভিযুক্ত শিবু হাজরা ও উত্তম সর্দারকে গ্রেফতার করার মধ্য দিয়ে, অত্যাচারিত মহিলা ও শিশুকে পুলিশি নিরাপত্তা দিয়ে, দলীয় প্রতিনিধি পাঠিয়ে জোর করে আদায় করা টাকা ফিরিয়ে, ভূমি ও ভূমিসংস্কার দফতরের আধিকারিকদের পাঠিয়ে জমি দখল, জমির চরিত্র বদলানোর মতো অভিযোগের তদন্ত করার মধ্য দিয়ে বাহ্যত (প্রাইমা ফেসি) রাজ্য সরকার স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছে যে, ধর্ষণ হয়েছে, জমি দখল হয়েছে, অর্থ লুঠ হয়েছে।
কিন্তু, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কোনও পূর্ণ লক্ষণ এখনও দেখা যাচ্ছে না। ১৪৪ ধারা জারি করে, বিরোধীদের আটকে, পুলিশ ও গুন্ডারাজ (সেই শাহজাহান বাহিনী) এখনও সন্দেশখালিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। দলীয় কর্মীরা ১৪৪ ধারা সত্ত্বেও “ড্যামেজ কন্ট্রোল” করতে বাড়ি বাড়ি যাচ্ছে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা, ১৪৪ ধারা তবু তৃণমূল কংগ্রেস সভা করার অনুমতি পেয়েছে। সন্দেহ নেই নির্বাচনের মুখে বিরোধীরা বিশেষভাবে বিজেপি এই বেআইনি কার্যকলাপ, বিশৃঙ্খলার সুযোগ নেবেই। এবং যেহেতু, এই তাবড় অন্যায়ের মূল অভিযুক্তের নাম “শেখ শাহজাহান”, হিন্দুত্ববাদীরা সেখানে সাম্প্রদায়িক তাস খেলবেই। আর রাজ্য জুড়েই ছড়ানো হবে ঘৃণা ও বিদ্বেষ। এবং জাতীয় স্তরের নানা প্রতিষ্ঠানকে তদন্তের নামে সন্দেশখালি পাঠিয়ে ঘোলাজলে “ভোট” শিকারের খেলা চলবে। রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানদের ডেকে পাঠাবে লোকসভার স্বাধীকার রক্ষা কমিটি, জাতীয় মহিলা কমিশন এসে বলবে “রাষ্ট্রপতি শাসন”-এর কথা, আবার কাণ্ডজ্ঞানহীন কোনও আইনজীবী মণিপুরের সঙ্গে সন্দেশখালির তুলনা করে বসবে।
সিদ্দিক কাপ্পানের গ্রেফতারের বিরোধিতা, গ্রেফতারি নিয়ে প্রশ্ন গোদী মিডিয়া করবে না। এক জন সাংবাদিককে রাষ্ট্র “জঙ্গি” সাজাবে। আর সেই অভিযোগকে হাতিয়ার করে রিপাবলিকেরা তিলকে তাল করবে। বিবিসি, নিউজ়ক্লিকে আই টি রেইড করলে, সম্পাদক সাংবাদিক প্রবীর পুরকায়স্থকে ইউএপিএ ধারায় গ্রেফতার করা হলেও রিপাবলিকেরা তাদের প্রোফাইল কালো করবে না, লিখবে না “জরুরি অবস্থা”। কিন্তু, স্বাভাবিক ভাবেই সন্তু পানের গ্রেফতারের সুযোগ নিয়ে “গণতন্ত্র’র মসিহা সাজবে। দেশে যে অলিখিত জরুরি অবস্থা জারি হয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আমলে; সাংবাদিকের, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা তলানিতে ঠেকেছে— বিজেপি ও বিশেষভাবে নরেন্দ্র মোদীর প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্যের জন্য— এই সার সত্যটা আমাদের মনে রাখতে হবে।
মনে রাখতে হবে, পশ্চিমবঙ্গ-সহ সারা দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সাংবিধানিক অধিকারগুলিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বার্থে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে রক্ষার স্বার্থে। সন্তু পানের গ্রেফতার এক স্বৈরাচারী প্রবণতা। এই বেআইনি গ্রেফতারের প্রতিবাদ না করলে, সংসদ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে, পথসভা থেকে সেমিনার-কনভেনশনে, সংবাদমাধ্যম থেকে সমাজমাধ্যমে যেভাবে বিরুদ্ধস্বরকে নিয়ন্ত্রণ করা, দমন করা, ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে স্তব্ধ করার এক লাগামহীন প্রক্রিয়া নরেন্দ্র মোদীর রাজত্বে এক স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে— তার প্রতিবাদ করার নৈতিক জোর আমরা হারিয়ে ফেলব। পূর্ণ গণতন্ত্র অধিকারের লক্ষ্যেই, যেটুকু গণতন্ত্র এখনও অবশিষ্ট রয়েছে, তা আমাদের রক্ষা করতে হবে।
ছবি : সীতাংশুশেখর
পড়ুন: কেন অশান্ত হয়ে উঠল সন্দেশখালি?