কেন অশান্ত হয়ে উঠল সন্দেশখালি? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে আপনাকে যেতে হবে সন্দেশখালি ব্লকের দাড়ির জঙ্গল মৌজায়, যেতে হবে দাড়ির জঙ্গল মৌজার ৭ নম্বর পেত্নি ঘোলায়। যেতে হবে দীর্ঘদিনের অত্যাচারের শিকার সন্দেশখালির আমজনতার কাছে। বিঘার পর বিঘা জমি কার্যত দখল করে মাছ চাষের অভিযোগ রয়েছে ‘পলাতক’ তৃণমূল নেতা শেখ শাহজাহান এবং তার দুই ছায়াসঙ্গী, সন্দেশখালি ২ ব্লকের জেলা পরিষদ সদস্য শিবু হাজরা ও উত্তম সর্দারের বিরুদ্ধে। রেশনের চাল-আটাই নয়, শাহজাহান বাহিনীর লুঠের তালিকায় পাট্টাজমি থেকে পানীয় জল। সন্দেশখালি ঘুরে এসে লিখলেন সীতাংশুশেখর।
এই মুহূর্তে সন্দেশখালি জ্বলছে। যেমন জ্বলেছিল ৫০ দশকে তেভাগা আন্দালনের সময়। মানুষ জানে সেই ইতিহাস। আজও সেই ইতিহাসের কথা মানুষ মনে করিয়ে দিচ্ছে। হাত ধরে নিয়ে গিয়ে দেখাচ্ছে তেভাগা আন্দোলনের স্মৃতিস্তম্ভ। সেই স্মৃতিস্তম্ভে আজ কাস্তে হাতুড়িটি নেই কিন্তু রয়ে গেছে প্রতিবাদী হাতটি। তাই আবারও গর্জে উঠেছে সন্দেশখালি।
শুক্রবার সকালে জেলিয়াখালিতে শিবু হাজরার বাগান বাড়িতেও চড়াও হয়েছিলেন গ্রামের প্রতিবাদী মানুষ। এই প্রতিবাদের আগুনে ছাড়খার হয়ে যায় শিবু হাজরার পোলট্রি। সূত্রের খবর, এলাকার তৃণমূলের নেতা শেখ শাহজাহানের নেতৃত্বে তার দুই শাগরেদ শিবু হাজরা আর উত্তম সর্দার দীর্ঘদিন ধরে অত্যাচার চালিয়ে আসছিল গ্রামের মানুষের উপরে। তার ভয়ে সন্ত্রস্ত মানুষ মুখ খুলতে পারছিলেন না। রেশনের চাল-আটা অবৈধভাবে বিক্রি করার অভিযোগে অভিযুক্ত এবং বর্তমানে জেলবন্দি খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। একই অভিযোগের ভিত্তিতে খাদ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বলে কথিত শেখ শাহজাহানের বাড়িতে জিজ্ঞাসাবাদ ও তল্লাসি চালাতে গিয়ে আক্রান্ত হন ইডির অফিসাররা। সেই সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে শাহজাহান-বাহিনীর মারের মুখে পড়েন সাংবাদিকরা। সেই থেকে শেখ শাহজাহান পলাতক।
ইডির ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যেতেই গ্রামের লোকজন প্রতিবাদে নেমে পড়েছেন রাস্তায়। দীর্ঘদিনের ক্ষোভ উগড়ে দিচ্ছেন তাঁরা। গ্রামবাসীরা যখন শিবুর বাগান বাড়িতে ঢুকতে যান, তখন তাঁদের পুলিশ আটকাবার চেষ্টা করে। গ্রামবাসীদের অভিযোগ, পুলিশের সামনেই তৃণমূল কর্মীরা হাতে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে তাদের ওপর হামলা চালায়। আরও অভিযোগ, তৃণমূল নেতা শিবপ্রসাদ হাজরার অনুগামীদের বিরুদ্ধে। এই ঘটনায় বহু গ্রামবাসী আহত হয়েছেন। আহতদের চিকিৎসার জন্য স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশের বিরুদ্ধে গ্রামবাসীদের অভিযোগ, গ্রামবাসীরা আক্রান্ত হলেন তৃণমূল দুষ্কৃতী বাহিনীর হাতে, কিন্তু আক্রমণকারীরা কেউ গ্রেফতার হল না। উল্টে আক্রান্ত কয়েকজন গ্রামবাসীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
কিন্তু প্রশ্ন, কেন অশান্ত হয়ে উঠল এই সন্দেশখালি?
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে আপনাকে যেতে হবে সন্দেশখালি ব্লকের দাড়ির জঙ্গল মৌজায়, যেতে হবে দাড়ির জঙ্গল মৌজার ৭ নম্বর পেত্নি ঘোলায়। যেতে হবে দীর্ঘদিনের অত্যাচারের শিকার সন্দেশখালির আমজনতার কাছে। বিঘার পর বিঘা জমি কার্যত দখল করে মাছ চাষের অভিযোগ রয়েছে ‘পলাতক’ তৃণমূল নেতা শেখ শাহজাহান এবং তার দুই ছায়াসঙ্গী, সন্দেশখালি ২ ব্লকের জেলা পরিষদ সদস্য শিবু হাজরা ও উত্তম সর্দারের বিরুদ্ধে। কী ভাবে নিজেদের স্বার্থে এই সব জমি কাজে লাগিয়েছে শেখ শাহজাহান ও তার শাগরেদরা?
বছরে দু’বার যে সমস্ত জমিতে খালের মিষ্টি জল ব্যবহার করে আমন ও বোরো ধানের চাষ হত, সেই জমিতে মাছ চাষ চলছে তিন বছর ধরে। নদীর বাঁধ কেটে, সরকারি স্লুইস গেট ব্যবহার করে নোনা জল ঢুকিয়ে। আগে খালগুলিতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন মৎসজীবীরাও। এও বাহ্য, শাহজাহান বাহিনী বাড়ি বাড়ি পানীয় জল সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে দাড়ির জঙ্গল এলাকায় থাকা জনস্বাস্থ্য কারিগরি দপ্তর বা ‘পিএইচই’-র পাম্প হাউস থেকে সরাসরি পানীয় জল পাইপ দিয়ে টেনে নিচ্ছে মিষ্টি জলের মাছচাষ করতে। সন্দেশখালি থানার নাকের ডগায়, এ সবই চলছিল শেখ শাহজাহানের নেতৃত্বে।
না, এলাকার বাসিন্দাদের জমি কেড়ে নেওয়া হয়েছে শুধু তাই নয়, মাছ ব্যবসায়ীদের টাকা ‘মেরে দেওয়ার’ অভিযোগ উঠছে শেখ শাহজাহান এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গদের বিরুদ্ধে। অভিযোগ করছেন এলাকার মাছ ব্যবসায়ীরা। গত বুধবারই সন্দেশখালির তৃণমূল নেতা এবং জেলা পরিষদের সদস্য শেখ শাহজাহানের বিরুদ্ধে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তোলেন মাছ ব্যবসায়ীরা। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের বাগদা মাছের এজেন্টদের কাছ থেকে শেখ শাহজাহান কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে বলে অভিযোগ এসেছে। এখন শুধু গ্রামবাসীরা বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন তাই নয়, সেই এজেন্টরাও টাকা ফেরতের দাবি নিয়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন মাছ কোম্পানির অফিসের সামনে।
পশ্চিম মেদিনীপুর, পূর্ব মেদিনীপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, উত্তর ২৪ পরগনা-সহ বিভিন্ন জেলার বাগদা মাছের এজেন্টরা কলকাতা বাসন্তী হাইওয়ের ঘোষপুকুরের কাছে একটি বাগদা মাছের কোম্পানিতে মাছ সরবরাহ করতেন। এই কোম্পানিতেও মাছ সরবরাহ করতেন শেখ শাহজাহান। অভিযোগ এসেছে, এজেন্টদের কাছ থেকে যে, ২০১৮ সালে অগস্ট মাস নাগাদ ওই কোম্পানি মাছের এজেন্টদের প্রায় দশ কোটি টাকা আটকে রাখে এবং সেই টাকা দিতে না পারার জন্য ওই মাছের কোম্পানিতে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন সন্দেশখালির শেখ শাহজাহান। বাধ্য হয়ে কোম্পানি কর্মকর্তারা সমস্ত এজেন্টদের জানায় কোম্পানিতে মজুত করে রাখা সমস্ত বাগদা ও গলদা চিংড়ি বিক্রি করে এজেন্টদের টাকা দেওয়া হবে। কিন্তু বিধি বাম! শেষ পর্যন্ত কোম্পানির মাছের দখল নিয়ে নেয় শেখ শাহাজাহান এবং প্রতিশ্রুতি দেন যে মাছ বিক্রি করে এজেন্টদের টাকা দিয়ে দেবেন। কোনো এজেন্টই টাকা পাননি, কিন্তু মাছ বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা পকেটে ঢুকিয়েছে শেখ শাহজাহান, এমনটাই অভিযোগ এজেন্টদের।
অভিযোগ ঝুড়িঝুড়ি। পরিবর্তন হয়েছে, শাসক বদলেছে, ‘মেহনতি মানুষের’ সরকার থেকে ‘মা-মাটি-মানুষের’ সরকার। কিন্তু মানুষ যে তিমিরে ছিলেন সেই তিমিরেই আছেন। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ আজকের সন্দেশখালি। আপনি যদি সন্দেশখালির বিডিও অফিস যেতে চান, যাওয়ার পথে দেখতে পাবেন ত্রিমোহনী মোড়ে নয়ানজুলি ভরাট করে সরকারি জমিতে বিরাট তৃণমুলের দফতর। বনসৃজনের গাছ কেটে ফাঁকা করে দিয়ে বনদফতরের জমি কোটি কোটি টাকায় বিক্রি হয়ে গেছে দাউদপুর, সুখদোয়ানিতে। সব দেখেও চুপ বনদফতর, বিডিও। আর এসবই হয়ে চলেছে তৃণমূল কংগ্রেসের সন্দেশখালির ব্লক-২ এর সভাপতি ও জেলা পরিষদ সদস্য শিবপ্রসাদ হাজরা এবং জেলা পরিষদের আরেক সদস্য তৃণমূলের উত্তম সর্দারের হাত ধরে। আর তাদের মাথায় শেখ শাহজাহান।
দাড়ির জঙ্গল-সহ সন্দেশখালি বিধানসভায় পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকার আদিবাসী ও অন্যান্য অংশকে পাট্টা, বর্গার অধিকার দিয়েছিল। সেখানেই চলছে নির্মম জমিদখল। দাড়ির জঙ্গল এলাকায় উত্তম সর্দার হুঁশিয়ারি দিয়ে বলে দিয়েছে খালে মাছ ধরা যাবে না। বহুবার থানায় জানিয়েও কোনও লাভ হয়নি। অভিযোগ, পুলিশ, প্রশাসন ও এক শ্রেণির সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের মাসোহারার বিনিময়ে সমস্ত অন্যায় অত্যাচারের খবর চাপা পড়ে যেত যা, এখন আন্দোলনের ফলে যা সামনে আসছে।
শাহজাহান পালিয়ে যাওয়ার পর কার্যত শিবু হাজরা, উত্তম সর্দাররাও বেপাত্তা। মানুষ মুখ খুলতে শুরু করেছেন। রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেছেন। শয়ে শয়ে বঞ্চিত শোষিত মানুষ সন্দেশখালিতে শাহজাহান-সহ দুই তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগ তুলে দাড়ির জঙ্গল মৌজার থানা এবং বিডিও অফিসে বিক্ষোভ দেখিয়ে দাবি জানাচ্ছেন, “আমাদের জমি আমাদের ফিরিয়ে দাও।”
গত ৩১ জানুয়ারি থেকে পেত্নীঘোলা কর্ণখালির মানুষ তাঁদের জমি ফেরত চেয়ে, সরকারি খাল ব্যবহারের অধিকার চেয়ে আন্দোলন শুরু করেন। তাঁদের অভিযোগ সন্দেশখালির তৃণমূলের বাহুবলী নেতা শেখ শাহজাহান, জেলা পরিষদ সদস্য শিবুপ্রসাদ হাজরা, উত্তম সর্দার, লাল্টু ঘোষরা তাদের জমি দখল করে মাছের ভেড়ি বানিয়ে বছরের পর বছর লিজের টাকা দেয় না। তাঁরা তাঁদের জমির অধিকার ফিরে পেতে আন্দোলন শুরু করেন শান্তিপূর্ণভাবে। সেই আন্দোলনকে দমিয়ে দিতে সন্দেশখালি থানার মদতে গ্রামবাসীদের উপর আক্রমণের ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করে শেখ শাহজাহান, শিবু হাজরা, উত্তম সর্দার ও লাল্টু ঘোষরা।
গত মঙ্গলবার থেকে সন্দেশখালি থানার অদূরে ত্রিমোহনীতে সভা করে তৃণমূল। সভা শেষে রাতের অন্ধকারে সন্দেশখালির ২-নং বিডিও অফিস সংলগ্ন তৃণমূলের পার্টি অফিসে বসে নীল নকশা তৈরি করা হয়। স্থির হয়, বুধবার মিছিল করে পেত্নীঘোলা কর্ণখালির আন্দোলনকারীদের উপর হামলা চালানো হবে। এই খবর গ্রামে গ্রামে রটে যেতেই ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ে প্রতিরোধের বার্তা। লাঠি ঝাঁটা হাতা খুন্তি নিয়ে বিশেষত মহিলারা নেমে পড়েন রাস্তায়। ওদিকে তখন তুষখালি, জেলিয়াখালি, দাউদপুর, খুলনা, হাটগাছা থেকে সশস্ত্র দুষ্কৃতীরা মিছিলে যোগ দিতে সন্দেশখালি ফেরিঘাটে এলে গ্রামবাসীদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে। পুলিশের উপস্থিতিতে গ্রামবাসীদের লক্ষ্য করে ছোঁড়া হয় কাচের বোতল। রক্তাক্ত হন শম্ভু সিংহ-সহ কয়েকজন সাধারণ মানুষ। ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন সাধারণ গ্রামবাসী। প্রতিরোধের উত্তাপ মূহুর্তে বেড়ে যায়। শুরু হয় ধুন্ধুমার কাণ্ড। বিপদ বুঝে পুলিশের সাহায্যে পুলিশের লঞ্চ, যন্ত্রচালিত নৌকায় চেপে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় বহিরাগত দুষ্কৃতীরা, এমনই অভিযোগ গ্রামবাসীদের। জলে পড়েও যায় কয়েকজন। এরপর সন্দেশখালি থানা ঘেরাও করে শুরু হয় গ্রামবাসীদের বিক্ষোভ। আন্দোলনকারীদের দাবি শেখ শাহজাহান, শিবু হাজরা, উত্তম সর্দার, লাল্টু ঘোষকে গ্রেপ্তার করতে হবে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ঘটনাস্থলে আসে র্যাপিড অ্যাকশন ফোর্স-সহ বিশাল পুলিশ বাহিনী। বন্ধ হয়ে যায় ধামাখালি-সন্দেশখালি ফেরি চলাচল, দোকানপাট। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ লাঠিচার্জ করলে কৃষ্ণপ্রসাদ লাইয়া আহত হন। তাঁর মাথা ফেটে যায়। আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন সাধারণ মানুষ। শুরু হয়ে সন্দেখালি থানা ঘিরে বিক্ষোভ। তাঁরা দাবি করতে থাকেন এখনই শেখ শাহজাহান, উত্তম সর্দার ও শিবু হাজরা ও লাল্টু ঘোষকে গ্রেপ্তার করতে হবে। শেষমেশ আন্দোলনকারীদের চাপে উত্তম সর্দার-সহ দুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং বাকিদের গ্রেফতার করা হবে বলে আন্দোলনকারীদের শান্ত করে পুলিশ।
রাতে উত্তম সর্দারের বাড়ি শিবু হাজরার পোল্ট্রিতে ভাঙচুর চলে, মেছো ভেড়ির আলাঘর আগুনে দাউদাউ করে পুড়তে থাকে। বৃহস্পতিবার সকাল হতেই প্রচার শুরু হয় আন্দোলনকারীরা এই হামলা, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটিয়েছে। অভিযোগ নসাৎ করে আন্দোলনকারীরা। তাদের বক্তব্য আমরা হকের দাবিতে আন্দোলন করছি।
অন্যদিকে, গত বৃহস্পতিবার সকালে যখন সাধারণ মানুষ জানতে পারে পুলিশের বয়ান অনুযায়ী উত্তম সর্দারকে গ্রেফতার না করে গ্রেফতার করা হয়েছে ভরত দাস ও পালান সরদারকে। এবং তাদের আদালতে পাঠানো হয়েছে। উত্তম সর্দারকে পুলিশ গ্রেফতার করেনি। এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই ফের ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে আন্দোলনকারীরা। লাঠি, ঝাঁটা গাছের ডাল যে যা হাতের সামনে পেয়েছে তাই নিয়ে মহিলা, পুরুষ এসে জমা হয় সন্দেশখালি থানা ত্রিমোহনী-সহ সর্বত্র। তাঁরা প্রতিবাদ মিছিল শুরু করেন। বিডিও অফিস সংলগ্ন তৃণমূলের পার্টি অফিসে ভাঙচুর চালানো হয়।
বিক্ষোভকারীদের বক্তব্য, “এতদিন ওরা আমাদের পালিশ করেছে। আজ আমরা ওদের পালিশ করব।” থানায় অভিযোগ জানাতে গেলে পুলিশ শেখ শাহজাহান, শিবু হাজরা, উত্তম সর্দারের কাছে পাঠিয়ে দিত। অন্ধকার নামলে শুরু হত শেখ শাহজাহানের অত্যাচার। বৃহস্পতিবার এমনই অভিযোগ করলেন সন্দেশখালিতে বিক্ষোভকারী মানুষজন। ভয় ভেঙেছে সন্দেশখালির। প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে পিছু হটছে তৃণমূল। পুলিশ প্রশাসনের উপর কোনও ভরসা নেই সন্দেশখালির মানুষের। তাই অত্যাচার, অবিচার, বঞ্চনার প্রতিবাদে প্রতিরোধের বার্তা ছড়িয়ে যাচ্ছে জমির আলপথ থেকে প্রতিটি জনপদে। বুধবারের রাতের পর বৃহস্পতিবারের ছবিটা প্রতিরোধের শুরুর ইঙ্গিত দিলেও তা আগামী দিনে গোটা সন্দেশখালি জুড়ে ছড়িয়ে পড়ার ইঙ্গিত মিলছে।
পঞ্চাশের দশকে তেভাগা আন্দোলন শুরু হয়েছিল কৃষকদের শ্রমে উৎপাদন হওয়া ফসলের তিনভাগের দাবি নিয়ে। সেই আন্দোলনের উপর দমনপীড়ন নামিয়ে এনেছিল তৎকালীন কংগ্রেস সরকার। পুলিশ আর জোতদারের পোষা গুন্ডাদের দিয়ে। কাকদ্বীপের অহল্যা, বাতাসির মতোই শহিদ হয়েছিলেন এই সন্দেশখালির রবিরাম, রতিরাম, চামুবিশরা। পরে বামেরা ক্ষমতায় এসে কৃষকদের জমি কেড়ে শিল্প করতে চাইলে তাদের পাশ থেকেও সরে গিয়েছিল রাজ্যের মানুষ। কৃষকদের কথা বলেই ক্ষমতায় এসেছিল বর্তমান মা-মাটির-মানুষের সরকার। আজ সেই দলও কৃষকদের জমি কেড়ে নিতে চাইছে, জমি লুট করছে।
শুধু জমিই না, ঘর থেকে ‘অহল্যা বাতাসি’-দের লুট করতে চাইছে শেখ শাহজাহানরা। রাত বারোটার পর ডেকে পাঠানো হত পার্টি অফিসে, না এলে মার, হুমকি। নারী নির্যাতনের অভিযোগ জানাচ্ছে সন্দেশখালির মাটিতে দাঁড়িয়ে ‘অহল্যা, বাতাসি’রা। আপনারা কি বিজেপি? প্রশ্ন করতেই হাতের লাঠিটা তুলে চিৎকার করে জানান দেন “না আমরা তৃণমূল। তবে তৃণমূল করি বলে কি ঘরের মেয়েদের তুলে দিতে হবে শেখ শাহজাহান, উত্তম সর্দার, আর শিবু হাজরাদের হাতে। তৃণমূল পার্টির হাতে?”
ইতিমধ্যে উত্তম সর্দার দল থেকে সাসপেন্ড হয়েছে আর সেই সঙ্গে তাঁকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কিন্তু এখনও অধরা থেকে গেছে শেখ শাহজাহান, শিবু হাজরা। কিন্তু শেষ রক্ষা হবে তো?
রাজা আসে যায় রাজা বদলায়
নীল জামা গায় লাল জামা গায়
এই রাজা আসে ওই রাজা যায়
জামা কাপড়ের রং বদলায়…
দিন বদলায় না।
–বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
সবুজ বদলের পর লাল এসেছিল, লালের বদলে নীল তবে কি এবার গেরুয়া? এ প্রশ্নও ঘুরপাক খাচ্ছে সন্দেশখালির আকাশে বাতাসে। কে যেন বলে উঠল, ‘‘আবার লাল নয় কেন?” তখনই চোখে ভেসে ওঠে তেভাগা আন্দোলনের শহিদ স্তম্ভের বলিষ্ঠ মুঠো হাতটা। আন্দোলন আছে, প্রতিবাদ আছে, লড়াইয়ের বলিষ্ঠ হাত আছে, কিন্তু কাস্তে-হাতুড়ি নেই। মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়রা নিশ্চয়ই ভাববেন, আর বাকি বামপন্থীরাও।
(লেখক মানব অধিকার কর্মী ও স্বাধীন সংবাদিক।)
পড়লাম। ভাল লাগল। কিন্ত এই তথ্যগুলির ও বিবরণের সমর্থনে সাক্ষ্যপ্রমান থাকলে, ওখানকার লোকজনের মুখের কথা থাকলে আরও ভাল লাগত।