ভাগ্যিস, মাইকেল একালে জন্মাননি


  • February 8, 2024
  • (0 Comments)
  • 461 Views

পুণেতে রামকেন্দ্রিক একটি নাটক অভিনয় চলাকালীন “ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত” লাগার অজুহাতে নাটকের অভিনয় বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং অধ্যাপক-সহ কুশীলবদের মারধরের পর গ্রেফতার করা হয়। রামের বিতর্কিত দিকটি বাদ রাখলেও, একটু ভেবে দেখবার বিষয় আছে, এটিই কি প্রকৃত রামরাজ্য? লিখলেন রাজর্ষি

 

গত ২২ জানুয়ারি ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি অন্যতম বিশেষ দিন। দিনটি কী ছিল সেটি আর বিশদে বলছি না, আপনারা সবাই জানেন। সেই দিনটিতে যে কবিতাটি সব থেকে বেশি শেয়ার হয় ফেসবুক এবং অন্যান্য সমাজমাধ্যমে, সেটি অবশ্যই রবীন্দ্রনাথের ‘দীনদান’। সকলের স্টেটাস ও স্টোরি ভরে গিয়েছিল “সে মন্দিরে দেব নাই’ পঙক্তিটিতে। কিন্তু শুধু কি এইটুকু?

 

মন্দিরে রাম আছে কি না জানা নেই, ‘দীনদান’-এ সরাসরিভাবে রাম নেই, তবে রাম আছে বাংলায়, বাংলা সংস্কৃতিতে, বাংলা সাহিত্যে। সম্ভবত কৃত্তিবাস ওঝার হাত ধরেই রামের সে অর্থে বাংলায় আগমন এবং প্রবল প্রসার। অধ্যাপক অমর্ত্য সেন এক সময় মন্তব্য করেন “রামায়ণ ও মহাভারতের সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদের কাজ শুরু হয় বাংলার মুসলমান শাসকদের নির্দেশে, মোটামুটি চতুর্দশ শতাব্দীর গোড়ায়। মহাকাব্য দু’টির সেই অনুবাদগুলোই এখনও বাংলায় সর্বাধিক পঠিত।”

 

কৃত্তিবাসের পৃষ্ঠপোষক কে ছিলেন এই নিয়ে দ্বন্দ্ব আছে। এই পৃষ্ঠপোষক রাজা যদি রুকন্‌ উদ্‌‌-দিন বরবাক শাহ না-হয়ে রাজা গণেশ অথবা কংসনারায়ণ হন তাহলে ইসলামি শাসকদের নির্দেশের তত্ত্ব খাটে না। সে যা-ই হোক, কৃত্তিবাস থেকে সন্ধ্যাকর নন্দী হয়ে রামের পথচলা বাংলায় বহুদিন। শুধু কি মহাকাব্যের রাম? তা ছাড়াও আরও বহু রাম ছড়িয়ে আছে বাংলার আনাচে কানাচে। রামমোহন, রামপ্রসাদ, রামদুলাল, রামকুমার হয়ে রামকৃষ্ণ পর্যন্ত, বহু রামকে নিয়ে আমাদের এই বঙ্গজীবন। তাহলে এই ধারা আটকে যাচ্ছে কোথায়? আটকাছে এই নতুন ‘রাম’-এর অনুশীলনে। নতুন বলা ভুল হবে, এটি প্রায় ৩২-৩৩ বছর ধরেই চলে আসছে, তবে এখন সেটি আরও উগ্র, আরও হিংস্র, আরও আক্রমণাত্মক।

 

এই উগ্রতা অনুশীলনের বিপ্রতীপে, আরও এক জন রাম অবস্থান করেন, আরও একটি রামকথা অবস্থান করে বাংলায়। যদিও একে রামকথা বলা যায় না ওভাবে, তাও বললাম। কেন? সেই প্রসঙ্গে আসছি, তার আগে একটু প্রাচীন গ্রিসে নজর রাখা যাক। পোয়েটিক্সে ইতিহাস ও শিল্পের দ্বন্দ্বের কথা মনে আছে? সেখানে ইতিহাসের থেকে শিল্পকে অ্যারিস্টটল এগিয়ে রেখেছিলেন, কারণ অ্যারিস্টটলের মতে ইতিহাস কেবল যা ঘটে গেছে তা নিয়েই কথা বলে, তবে শিল্প সবসময় সম্ভাব্যতার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। যা না হওয়ার, সেটাও হইয়ে দিতে পারে শিল্প। সেইজন্য অ্যারিস্টটল শিল্পকে “পূরণকারক সত্য” হিসাবে চিহ্নিত করেছেন।

 

পাঠকদের মনে হতে পারে রামায়ণ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আমি হঠাৎ গ্রিসে চলে গেলাম কেন? কারণ ওই একটাই, পূরণকারক সত্য। আমরা রামায়ণের লিখিত রূপের থেকে যদি মৌখিক ঐতিহ্যর দিকে নজর দিই, তাহলে দেখা যাবে হাজার হাজার বছর ধরে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষদের মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছে রামায়ণের কাহিনি। শুধু প্রবাহিতই হচ্ছে না, সেখান থেকে একের পর এক নতুন কাব্য তৈরি হচ্ছে। মহাভারতে বারবার রামায়ণের প্রসঙ্গ এসেছে, রামের ভ্রান্তিকে তুলনা করা হয়েছে যুধিষ্ঠিরের বোকামির সঙ্গে। ভাসের নাটকে সীতা পরিত্যাগের প্রসঙ্গ পাওয়া যাচ্ছে। ভবভূতির মহাবীরচরিত এবং উত্তর-রাম-চরিতে রামায়ণের এক অন্য আখ্যান পাওয়া যাচ্ছে। আমরা যে কাহিনি জেনে এসেছি, ভবভূতি তাঁর দৃশ্যকাব্য রচনার ক্ষেত্রে ‘পোয়েটিক লিবার্টি’ নিয়ে সেই কাহিনি থেকে বেশ কিছুটা সরে গিয়েছেন। এইখানেই ধরা দিচ্ছে “পূরণকারক সত্য”। যা না হওয়ার সেটাও হবে। তবে রামায়ণের অন্য ন্যারেটিভ কেবল ভাস-ভবভূতির আমলে হয়েছে, ব্যাপারটা এরকম ধরে নিলে হবে না। বাঙালি যেন ভুলে না যায় রাম নিয়ে তাদের একটি নিজস্ব অন্য ন্যারেটিভের মহাকাব্য আছে।

 

এবার আবার ফিরে যাই ২২ জানুয়ারির কথায়। ২২ জানুয়ারি প্রবল মাতামাতি ও উন্মাদনার তিন দিন পর, উত্তর কলকাতার এক প্রান্তে অনুষ্ঠিত হল একটি অনুষ্ঠান। আয়োজক হিন্দু স্কুল, স্থান গিরিশ মঞ্চ, উপলক্ষ মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মদ্বিশতবর্ষ উদ্‌যাপন, তারিখ ২৫ জানুয়ারি ২০২৪। গিরিশ মঞ্চে অনুষ্ঠিত হল গৌতম হালদার অভিনীত ও নির্দেশিত নাটক ‘মেঘনাদবধ কাব্য’।

 

মেঘনাদবধ নিয়ে আমার নতুন করে কিছু বলার নেই। “প্যারাডাইস লস্ট” যেমন সেকেন্ডারি এপিক বা গৌণ মহাকাব্য, এটিও সেরকম। প্রাচীন সাহিত্যে আধুনিক কবি নিজের সত্যজ্ঞান মিশিয়ে একটু নতুন সৃষ্টি করেছেন। কিছুক্ষণ আগে যে পূরণকারক সত্যের কথা বলছিলাম, এটিও ঠিক তেমনই। মাইকেল বারবার এই পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে। বীরাঙ্গনার চিঠিগুলির কথা ভাবুন। উদাহরণ স্বরূপ “সোমের প্রতি তারা” পত্রটির কথা যদি ধরা যায়, সেখানে মাইকেল সম্পূর্ণ প্রেক্ষিতটাই ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। গুরুমা’র শিষ্যের প্রতি প্রণয় আহ্বান বাংলা সাহিত্যের একটি বিরলতাম অধ্যায়। তবে সবকিছুকে ছাড়িয়ে যায় মেঘনাদবদ কাব্য।

 

গৌতম হালদার সেদিন তাঁর অভিনয় শুরুর আগেই যে কথাগুলি বলেছেন, সেগুলিই হয়তো চরম সত্য। রামায়ণে রাম কর্তৃক বালির হত্যা যেমন গুপ্তহত্যা, লক্ষণের মেঘনাদ হত্যাও ঠিক সেই রকমই গুপ্তহত্যা বা আস্যাসিনেশন। আমরা, পাঠকেরা যুগের পর যুগ সেই গুপ্তহত্যাগুলিকে গৌরবান্বিত করে যাই, করে যাচ্ছি। মাইকেল যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন, এটা গুপ্তহত্যাই। এখানে রামের থেকে বড়ো নায়ক রাবণ, আবার রাবণের থেকেও কোথাও গিয়ে অনেকটা বড়ো হয়ে যান মেঘনাদ, হয়তো নিজের থেকেও বড়ো। মেঘনাদের মৃত্যুর পর যখন রামের কাছে রাবণ এক সপ্তাহের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেন, তখন রামের কথা—“ধর্মকর্মে রত জনে কভু না প্রহারে. ধার্মিক!” শুনে পাঠক তথা দর্শক হাসেন, কেউ বা মুখে, কেউ বা মনে মনে।

 

যখন এই লেখা লিখছি, তখন ভারতের অন্য প্রান্তে পুণেতে রামকেন্দ্রিক একটি নাটক অভিনয় চলাকালীন “ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত” লাগার অজুহাতে নাটকের অভিনয় বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং অধ্যাপক-সহ কুশীলবদের মারধরের পর গ্রেফতার করা হয়। রামের বিতর্কিত দিকটি বাদ রাখলেও, একটু ভেবে দেখবার বিষয় আছে, এটিই কি প্রকৃত রামরাজ্য? যে রামরাজ্য মর্যাদাপুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্র থেকে শুরু করে গান্ধীজি পর্যন্ত সবাই চেয়েছিলেন? মাঝেমাঝে মনে হয় ভালো হয়েছে মাইকেল আজকের ভারতবর্ষে জন্মাননি। জন্মাইলে বা কী, তিনি তো আজ আজকের দিনে সেই সমাজব্যবস্থা, হিন্দু কলেজ, বিদ্যাসাগর, কিছুই পেতেন না। আমার মনে হয় না তিনি আজ বেঁচে থাকলে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ লিখতেন। বা হয়তো লিখতেন, কিন্তু লিখলে তাঁর অবস্থা অবধারিতভাবে গৌরী লঙ্কেশের মতোই হত, তাতে সন্দেহ নেই।

 

লেখক প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।

 

Share this
Leave a Comment