পড়শি হয়ে যুগ-যুগান্ত কাটিয়ে দিলেও হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কের মাঝে কতশত ফাঁকের ফাঁকি। রবীন্দ্রনাথ যেমন দেখেছিলেন জমিদারির কাছারিতে হিন্দু-মুসলমানের মাঝে ‘জাজিম তোলা’ ফাঁক; তেমনি এক ফাঁকের স্মৃতিকথা লিখলেন নিশা বিশ্বাস।
আমার প্রিয় মা,
আজ, যখন দেশ রামময় হয়ে উঠেছে, চারিদিক উৎসাহে নাচে-গানে রমরম করছে। রাজা আসছে রামলালাকে সোনার ঘরে প্রতিষ্ঠা করতে। তোমায় খুবই মনে পড়ছে মা! এটা নয় যে তোমার-আমার মধ্যে বিশেষ মিল ছিল, অথবা আমরা খুব একটা গল্প করেছি। না তুমি আমায় পছন্দ করেছ না আমি তোমাকে। তবে কেন আজ তোমাকে এত মনে পড়ছে? তুমি তো সেই ১২ বছর আগে চলে গেছ। তার আগেও আমরা বোধহয় বছর দুই দেখা তো করিইনি, কথাও বলিনি। কথা যে বলতে চাইনি তা নয়, কিন্তু অভিমানী মন চেয়েছিল তুমি ফোন করবে, ডাকবে, দেখা করতে বলবে। তুমিও বোধহয় তাই চেয়েছিলে, কিংবা পাঁচ-পাঁচটি মেয়ের মধ্যে যদি একজন না-ই আসে, না-ই বা দেখা করে, না-ই বা কথা বলে কিছু কি যায় আসে? তাই হবে হয়তো।
তোমার কি মনে আছে, যে মাসে তারা মসজিদ ধবংস করেছিল, সেই মাসেই হাজার কিলোমিটার পেরিয়ে আমি গিয়েছিলাম তোমার সঙ্গে দেখা করতে। তুমি প্রতিবেশীর উপরে বিরক্ত ছিলে। সে রাস্তায় দেখা হলে কেমন বীরদর্পে মসজিদ ধবংসের গল্প করছিল এবং ক’টা পুরনো ইটের টুকরা মসজিদের বলে দাবি করছিল। এক মুসলিম বন্ধুর ৭-৮ বছরের ছেলের সঙ্গে অন্য ছেলেদের ক্রিকেট খেলতে বারণ করা হয়েছিল!
তাহলে আজ ১৪ বছর পরে কেন তুমি? কেন এত জমজমাট, নাচ-গান, আলো-রোশনাইয়ের মধ্যে তুমি ঘুরে ঘুরে আসছ? আর তো তোমার কাছে যাওয়ার জো নেই। কিন্তু তুমি ছাড়া কে আমায় বুঝবে? বুড়ো বয়সে বোধহয় ছোটবেলা ফিরে ফিরে আসে। মনে পড়ে বাবার ফ্যাক্টরি। ফ্যাক্টরির বাইরের দিকে তার অফিস আর পিছন দিকে আমাদের বাড়ি। তুমি দিনভর সংসারের নানান কাজে ব্যস্ত! তারই মধ্যে বাবার নানা ফাইফরমাশ। কখনও চা, অবার কখনও অতিথি কিংবা সাক্ষাৎকারীদের খাবারের আবদার! আর তুমি, সব করে গিয়েছ, গজগজ করতে করতে। আমি তোমার গজগজকে নিজ জীবনে ভিন্ন মাত্রায় তুলে চেঁচামেচিতে নিয়ে গিয়েছি মা! ঠাকুমাও থাকতেন আমাদের সঙ্গে।
তোমার দিন শুরু হত সকাল ৫টায়, ঠাকুমার ঘর পরিষ্কার করা থেকে আমাদের ঘুম থেকে তুলে স্নানে পাঠানো, টিফিন তৈরি করা, দুধের সাথে পরোটা রোল তৈরি করা, স্কুলে পাঠানো দিয়ে। স্কুল থেকে ফিরে দেখতাম তোমার ২/৩ বালতি জামাকাপড় কাচা সারা হয়ে গিয়েছে। রান্নাও শেষ। ঠাকুমা তপেশ্বরনাথ মন্দিরে পুজো দিয়ে, খেয়েদেয়ে নিজঘরে বিশ্রাম করছে। ঠাকুমা ছিলেন বেশ ডাকাবুকো। বাড়িতে তিনি পিতৃতন্ত্রের ধারক বাহক। বাহিরে তিনি ধর্মপ্রাণ। সকাল ৯টা নাগাদ ‘মন্দির যাচ্ছি’ বলে গেট পার— এই যা, ওই যা। আধ ঘণ্টা হেঁটে তপেশ্বরনাথ মন্দির। মন্দিরে পৌঁছে ঠাকুমা কুয়ো থেকে দু’বালতি জল তুলে শিবমন্দির ও মন্দিরের চারদিকের চাতাল ধুয়েমুছে পূজা- অর্চনা করতেন। শেষে চাতালের পিলারে হেলান দিয়ে গল্প করতেন। বাড়ি ফিরতেন ১২টা নাগাদ। তারপর খাওয়া ও বিশ্রাম। মন্দিরে ঠাকুমাকে দেখে মনে হবে না যে, এই বৃদ্ধা বাড়িতে তোমার মুখাপেক্ষী। তুমিও তা জানতে মা!
যাকগে সেসব কথা। বাড়ি ফিরে দেখতাম তুমি স্নানে গিয়েছ, অথবা যাচ্ছ। খেতে তুমি কোনও কালেই দাওনি। জানা ছিল মিটকেস টাইপের আলমারিতে রান্না করা খাবার রাখা আছে, খেয়ে নিতে হবে। পছন্দ মতো ডাল-তরকারি থাকলে ভালো, না হলে আচার রয়েছে, দুধ-দই-মাখন আছে, চিনি-গুড় রয়েছে যা খুশি খাও কেউ দেখবে না। কী খেলে কিংবা খেলে না। এখনকার মায়েদের দেখে মনে হয় তুমি আমাদের প্রচুর ছাড় দিয়েছিলে। আজাদির প্রথম পাঠ তোমার কাছে শেখা। তুমি স্কুল কলেজের টাইম জানতে চাওনি। বন্ধুদের নাম, তাদের ঘরবাড়ি, মহল্লা জানার দরকার মনে করনি! অন্ধকারের আগে বাড়ি ঢুকলেই তুমি নিশ্চিন্ত।
মা, শফিক মিঞাকে মনে আছে! আমাদের ফ্যাক্টরির ম্যানেজার। সকাল ৯টা/ ১০টা মধ্যে এসে যেতেন। কখনও ছুটি নিয়েছেন বলে তো মনে পড়ে না। মনে আছে বাসনের আলমারির কোনায় একটি আলাদা কাপ রাখা ছিল। এই কাপকে আমরা ‘শফিক মিঞার কাপ’ বলেই জানতাম। অফিস থেকে ফরমাস আসত, “চার কাপ চা, শফিক মিঞাও আছে।” আর তুমি বুঝে যেতে যে তিন কাপ চা রোজকার কাপে এবং এক কাপ চা যাবে শফিক মিঞার কাপে। শফিক মিঞাও তেমনি, তিনি কোনও দিন ভুল করেও অন্য কাপ তোলেননি। কেউ তাকে কাপ এগিয়েও দেয়নি। কেমন অলিখিত নিয়ম! এঁটো কাপ যেন অন্য বাসন অথবা কাপকে না ছোঁয় তাই ট্রে ফেরত এলে সবার আগে শফিক মিঞার কাপ ধুয়ে তুলে রাখতে তুমি। হঠাৎ একদিন মনে নেই কী কারণে, এঁটো কাপ তুলতে দেরি হল। আর তা ঠাকুমার চোখ এড়াতে পারেনি। ব্যাস! উঠল গেল গেল রব। এর মধ্যে বাবাকেও নালিশ করা হয়ে গেল। সবাই মিলে যখন তোমার একুল ওকুল করছে, তখন মা তুমি উঠে এঁটো কাপ তুলে সজোরে উঠোনে ছুঁড়ে ফেলে ভেঙে দিলে। স্তম্ভিত হয়ে গেলাম, কোথায় পেলে এই সাহস? শান্তি এলে, যখন শফিক মিঞার নতুন কাপ খোঁজা হছে, হঠাৎ তুমি ঘোষণা করলে, “আলাদা কাপে চা পাঠাতে পারবে না।” সব থমথমে আর চুপ। ঠাকুমা বাবার সঙ্গে আলাদা শলাপরামর্শ করছেন আর আমরা কচি-কাঁচারা বুঝতেই পারছি না কী হচ্ছে! তুমি থাকলে স্থির। পিছু হঠল ঠাকুমার ধার্মিক হিন্দু সমাজ, আর আমি প্রত্যক্ষ করলাম তোমার অসীম সাহসী ধর্মনিরপেক্ষতা। সেই ভাঙা কাপের টুকরো তুলে আমি উঠোন ধুয়েছিলাম এবং সেই দিন থেকে বাড়ির শব্দকোষ থেকে ‘শফিক মিঞার কাপ’ উধাও।
মা এইসব লেখার কারণ তোমায় ধর্মনিরপেক্ষতার পাঠ পড়ানোর জন্য ধন্যবাদ দেওয়া নয়, উদ্দেশ্য তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়া। তুমি যা আজ থেকে ৬০ বছর আগে করতে পারলে আমি তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারলাম না। আজ আমি ফিরে গেলাম সেই ৬০ বছর আগের জঞ্জালের খোঁজে। খুঁজে পেলাম ‘শফিক মিঞার কাপ’-এর ভাঙা টুকরো। জাপানি কিন্টসুগি কৌশল দিয়ে নয়, জুড়লাম অত্যন্ত অযত্নে আর সাজিয়ে দিলাম কাঁচের আলমারিতে, যাতে প্রথম দৃষ্টিতেই দেখা যায়। মা, তুমি যে শুধু আমায় শারীরিক রূপ দাওনি, আমার চিন্তা-ভাবনারও জন্মদাত্রী। আমায় অন্যরকম ভাবতে শেখালে। প্রশ্ন করতে শেখালে, অবাধ্য হতে আর আরও কত কি শিখিয়ে ছিলে, সেই আমি তোমায় হতাশ করলাম! আমায় ক্ষমা করো মা।
অপদার্থ মেয়ের ভালোবাসা নিও,
নিশে
২২/০১/২০২৪
খুব ভালো একটা গল্প এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম ! চারিদিকে ছড়িয়ে যাক এই গল্প !