মন্দির তৈরি হল – ইতিহাস মুছে গেল না


  • January 22, 2024
  • (1 Comments)
  • 663 Views

২২ জানুয়ারি সোশ্যাল মিডিয়ায় কালো ডিপি দেওয়ার, আবেগবহুল পোস্ট দেওয়ার দিন নয়, বোধহয়। …বাবরি মসজিদ ছিল, তা ঐতিহাসিক সত্য – এটা বারবার বলে যেতেই হবে। যুদ্ধটা হেরেছি, লড়াই নয়। লিখলেন সুদর্শনা চক্রবর্তী

 

মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে। মন্দির ওহি বান গয়া।

 

গত ত্রিশ বছর ধরে যে কথা চিৎকার করে বলে গেছে ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ধারক-বাহকেরা বহুদিন পর্যন্ত এ দেশের নাগরিক হিসাবে আমরা বিশ্বাস করেছিলাম, তা সত্যি হবে না। বিশ্বাস করেছিলাম ভারতের সংবিধানে লেখা ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটা এত সহজে মিথ্যে হতে দেব না আমরা। ‘মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে’ – এ কথা বাস্তবে পরিণত হতে দেব না – এ বিস্বাস কোথাও না কোথাও ছিল।

 

১৯৯২ থেকে ২০২৪ – ৩২ বছর পরে আজ ইতিহাসের যে বাঁকে এসে দাঁড়িয়েছি আমরা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রে বিশ্বাসী নাগরিকেরা, তাতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে স্বীকার করে নেওয়া ভালো – যুদ্ধটা আমরা হেরে গেছি। কিছুটা লজ্জিত হই, কিছুটা ভয় পাই না হয়। আর অনেকটা চেষ্টা করি নিজেদের রণনীতির ফাঁকফোকরগুলো বুঝে নিতে। যারা এই যুদ্ধ জিতলেন, সেই হিন্দুত্ববাদী বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ, ভারতীয় জনতা পার্টি – জিতলেন তাদের নিখুঁত রণকৌশলের জোরেই।

 

আমরা যাঁরা ‘মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে’-এর বিপরীতে দাঁড়িয়েছিলাম, তাঁরা আসলে বিশ্বাস করেছিলাম আবেগে, তাঁরা বিশ্বাস করেছিলাম আমাদের কথায় তৈরি হয়ে যাবে জনমত, ভেবেছিলাম মানুষ মনুষত্বে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির শক্তিতে বিশ্বাস রাখবে শুধু গান, কবিতার জোরে। হ্যাঁ, গান-কবিতা, যেকোনও শিল্প মাধ্যমই এই যুদ্ধে হাতিয়ার ছিল তো বটেই, কিন্তু আমরা যা খুব সহজে বাদ দিলাম, তা রাজনীতি, তা নাগরিক সমাজের রাজনৈতিক দায়িত্ব। সব যুদ্ধ আসলে আবেগ দিয়ে জেতা যায় না, এটা ভুলে গেলাম।

 

’৯২-এর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের আগে তৎকালীন ভারতীয় জনতা পার্টির সভাপতি লালকৃষ্ণ আদবাণীর নেতৃত্বে রাম রথ যাত্রা-র কথা আমরা এখন আর বলি না। শুধু বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কথা বললে আর সেই পর্যায়ে পৌঁছানো পর্যন্ত ঘটনাক্রমের কথা না বললে, আমরা আসলে ইতিহাসের পর্যায়ক্রমকে অস্বীকার করব। এই রথযাত্রা, তাকে কেন্দ্র করে সারা ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্রপাত, শুধুমাত্র বিহার-এ এই রথযাত্রা থামানোর প্রচেষ্টা এবং তারপর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি-র জয়লাভ এই দেশের হিন্দুত্ববাদী মনোভাবের প্রতি আকৃষ্ট হওয়াকে স্পষ্ট করে দিয়েছিল।

 

বাবরি মসজিদ শেষ পর্যন্ত ধ্বংস হয়েছিল, আমরা কিছুই করতে পারিনি। ২০০২-এর গোধরা কান্ড ও গুজরাট দাঙ্গা ঘটেছিল, আমরা কিছুই করতে পারিনি। ২০১৪, ২০১৯-এ কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হয়েছে বিজেপি, আমরা কিছুই করতে পারিনি। অথচ এই দেশের ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী, নাগরিকের অধিকারে বিশ্বাসী, প্রগতিশীল নাগরিক সমাজ ছিল, আছে, থাকবেও। সমস্যা হল তারা কেউই এই বিষয়গুলিকে, সংখ্যালঘু মুসলমানদের অধিকারকে রাজনৈতিক, সাংবিধানিক অধিকার হিসাবে দেখেননি, যতটা দেখেছেন আবেগের লেন্স দিয়ে।

 

ফলে কোনও রাজনৈতিক দলই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির মোকাবিলায় নিজেদেরই হিন্দুত্ববাদী হয়ে ওঠার বিরোধীতা করেননি, কোনও জোরদার কর্মসূচী নিতে পারেননি। যে ধর্মনিরপেক্ষতায় বলা হয়, সব ধর্মের মানুষই নিজেদের ধর্ম পালনের অধিকার পাবেন ও রাষ্ট্রের কোনও নির্দিষ্ট ধর্মীয় পরিচিতি থাকবে না – সেই ধর্মনিরপেক্ষতার কথা রাজনৈতিক কর্মসূচীতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। একটি ঐতিহাসিক সৌধ তাই এক পৌরাণিক চরিত্রের কাছে পরাস্ত হয়ে যায়।

 

‘আমরা হিন্দু ধর্মের বিরোধী নই’– এই কথাটি সব রাজনৈতিক দল বলেছে। কেউ সোচ্চারে, কেউ বিজেপি-র ধর্ম-সর্বস্ব রাজনীতির প্রতি পরোক্ষ সমর্থন রেখে, কেউ ধর্মীয় তোষণকেই কৌশলে ব্যবহার করে। কিন্তু কেউই সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের এই ভারতবর্ষে ঐতিহাসিক অবস্থানের কথা নিয়ে আলোচনা করেনি, তাদের রাজনৈতিক প্রভাব ও গুরুত্বের কথা ভারতের ইতিহাসে কতটা জরুরি সে কথা বলেনি। বলেনি নাগরিক সমাজও। আর সেই কারণেই তারা এই দেশে শুধু ‘সংখ্যালঘু’ পরিচয়ে পরিচিত হয়ে উঠেছেন, পরিচিতির রাজনীতির অংশ হয়ে উঠেছেন – প্রকৃত নাগরিক হয়েছেন কি না, সে প্রশ্ন রয়েই যায়।

 

হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদীরা সুকৌশলে ভারতের ইতিহাস গুলিয়ে দিচ্ছে, বৈজ্ঞানিক ইতিহাস চর্চার পথ বন্ধ করে দিচ্ছে। পাঠ্যবই থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক সমীক্ষা, গবেষণা থেকে আলোচনা সবেতেই তারা হিন্দুত্ববাদী নতুন ইতিহাস তৈরি করছেন। সম্প্রতি এক আলোচনায় ইতিহাসের প্রবীণ অধ্যাপক রত্নাবলী চট্টোপাধ্যায় বলছিলেন, “এরা তৈরি করছে এক নয়া পুরান। আজ থেকে দশ বছরের মধ্যে এরা ভুলিয়ে দেবে ওখানে কোনও মসজিদ ছিল, এবং সেই মসজিদ এ দেশের এক সম্প্রদায়ের মানুষের সভ্যতার ইতিহাসের অংশ।”

 

এই ভুলিয়ে দেওয়াটা এত সহজে মাত্র ত্রিশ বছরের মধ্যে করে ফেলা সম্ভব হল, কারণ ঐতিহাসিক সত্য, তথ্যের কথা যাঁরা বলেছেন, তাঁদের কথাগুলি সীমিত সংখ্যক মানুষের মধ্যেই আটকে থেকেছে। সেই ঐতিহাসিক, গবেষক, সাংবাদিকদের কথা আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের সামনে আনতে পারিনি। বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিসরে তুলে ধরতে পারিনি।

 

সময় এগিয়েছে, প্রযুক্তিকে যেভাবে ব্যবহার করেছে হিন্দুত্ববাদীরা, উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আমরা তা পারিনি। আমরা ভাইরাল করেছি ‘সব কুছ ইয়াদ রাখ্খা যায়েগা’, আসলে কিছুই মনে রাখিনি। আর ওরা ভাইরাল করেছে অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণের প্রতিটি সফল পদক্ষেপ। আমরা যত বেশি মিম, রিল ইত্যাদি বানিয়ে, শেয়ার করে বাহবা কুড়িয়ে, ভিউ বাড়িয়ে ভেবেছি প্রতিরোধ জোরদার হচ্ছে, উল্টোদিকে হিন্দুত্ববাদীরা নিজেদের রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডায়, কর্মসূচীতে হিন্দুত্বের প্রচার-প্রসারকে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে। রাম জন্মভূমিতে রামমন্দির প্রতিষ্ঠা দেশের সাধারণ নাগরিককে বোঝানো হয়েছে (অবশ্যই হিন্দু) তাদের অধিকার। আর এভাবে তাকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়েছে। হিন্দুরাষ্ট্র তৈরি করার একেকটি ইঁট রাখার পাশাপাশি তাই নিয়ে প্রচার সর্বস্বতায় মেতেছে। জনগন যা চোখের সামনে দেখে ক্রমাগত, তাতেই ধীরে ধীরে বিশ্বাস করে, এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তাই মুসলমান শত্রু হয়েছে, আর হিন্দুরা স্বজাতি। সেই স্বজাতির পরিচয়ে বর্ণ-জাতি-লিঙ্গ পরিচয়ের বৈষম্য, অত্যাচার সব কিছু আড়াল হয়ে গেছে।

 

ধর্মের আফিমের নেশা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বিপরীতের লড়াইটা এত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগে ভেঙে গেছে যে সেখানে জোটবদ্ধ রাজনৈতিক অবস্থান বা একাধিক শক্তিশালী তথ্যনির্ভর রাজনৈতিক সংলাপ তৈরি করা যায়নি। যারা হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন তারাই আসলে নিজেদের দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। সেখানে মুসলমানদের কথা যখন এসেছে তখন তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংখ্যালঘু তোষণের রূপ পেয়েছে। ফলে দাঙ্গা ঘটেছে, সিএএ-এনআরসি এসেছে, যার মোকাবিলা শুধু মিটিং-মিছিলে হয় না। দেশের নানা প্রান্তে নাগরিক সমাজের রাজনৈতিকভাবে সচেতন যে অংশ এর বিরুদ্ধে নানা কর্মসূচী নিচ্ছে তাদের সঙ্গে বৃহত্তর রাজনীতিকে জুড়তে না পারলে রামমন্দির-ই সত্যি হয়ে থাকবে, বাবরি মসজিদ নয়।

 

২২ জানুয়ারি সোশ্যাল মিডিয়ায় কালো ডিপি দেওয়ার, আবেগবহুল পোস্ট দেওয়ার দিন নয়, বোধহয়। একটি দেশের ইতিহাস, পুরাণের মানবিক দিক ভুলিয়ে দেওয়ার হিন্দুত্ববাদী প্রয়াসের সফল হওয়ার দিন ২২ জানুয়ারি। ‘মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে’ সত্যি করে দেওয়ার দিন। আমাদের এবার আজীবন চেষ্টাটা চালিয়ে যেতে হবে ইতিহাসকে খুঁড়ে তুলে আনার, হিন্দুত্ববাদীদের ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ভারতের ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়ার পর্বগুলি বলে যাওয়া, শুধু ‘সংখ্যালঘু’ বলে নয় দেশের ইতিহাস এবং বর্তমান ও ভবিষ্যতের অংশ হিসাবে মুসলমানদের নাগরিক হিসাবে গুরুত্বের কথা ক্রমাগত সামনে নিয়ে আসার। ভুলব না, ক্ষমা করব না – এগুলো স্রেফ কথার কথা নয়। এগুলো আগামী প্রজন্মকে ভারতবর্ষের সত্য বলে যাওয়ার প্রয়াস। বাবরি মসজিদ ছিল, তা ঐতিহাসিক সত্য – এটা বারবার বলে যেতেই হবে। যুদ্ধটা হেরেছি, লড়াই নয়।

 

Share this
Recent Comments
1
  • comments
    By: -তথাগত on January 23, 2024

    জরুরী লেখা। এখানে একটি প্রশ্ন ই রাখতে চাই। পরিচিতির রাজনীতি (তার সকল অবতারেই) হারাতে গেলে আমার ধারণা সবার আগে প্রয়োজন একটি বিকল্প সত্তার নির্মাণ। কঠিন কাজ, কিন্তু অত্যন্ত দরকারী। কিভাবে তা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে তোলা যায় সেটাই ভাবার, করার বিষয়; নতুবা “প্রতিবাদী” উচ্চারণ গুলি শেষ মেশ শাসকদের ই পুষ্ট করবে। – নমস্কার।

Leave a Comment