পরিবর্তন ঘটছে, এগিয়ে আসছেন শ্রমজীবী মেয়েরা


  • January 3, 2024
  • (1 Comments)
  • 1269 Views

রন্ধনকর্মীদের মূল সমস্যা কী? কিসের বিরুদ্ধে তাঁদের লড়াই করতে হচ্ছে? একটি শব্দে চিহ্নিত করতে হলে, তার নাম: প্রতারণা। কুৎসিত এবং ভয়ঙ্কর প্রতারণা, যে কোনও যথার্থ সভ্য সমাজে যা অবিশ্বাস্য বলে মনে হবে। কিন্তু তেমন সভ্যতা আমাদের সমাজের ধাতে নেই, আর তা নেই বলেই সেই প্রকাণ্ড তঞ্চকতাকে ‘অবিশ্বাস্য’ বলবার কোনও উপায় নেই। তা কেবল বিশ্বাস্য নয়, কঠোর বাস্তব। বছরের পর বছর সেই অন্যায় ঘটে চলেছে। লিখলেন অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় 

 

২৯ ডিসেম্বর, ২০২৩। একের পর এক মিছিল এসে জড়ো হচ্ছিল কলকাতা শহরের ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট–এর সামনে। প্রায় সম্পূর্ণত মেয়েদের মিছিল। রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তাঁরা সে দিন নিজেদের দাবি নিয়ে সমবেত হয়েছিলেন কলেজ স্কোয়ারের উত্তর-পূর্ব প্রান্তের ওই পরিসরটিতে। ওঁরা পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ও সরকার পোষিত স্কুলের মিড-ডে মিল-এর রন্ধনকর্মী। সে দিন ওই ইনস্টিটিউটের ঐতিহাসিক হলটিতে এক নতুন ইতিহাস তৈরি হল। অ্যাসোসিয়েশন অব মিড-ডে মিল অ্যাসিস্ট্যান্টস (সংক্ষেপে— আম্মা), পশ্চিমবঙ্গ মিড-ডে মিল কর্মী ইউনিয়ন (সি আই টি ইউ), পশ্চিমবঙ্গ সংগ্রামী রন্ধনকর্মী (মিড-ডে মিল) ইউনিয়ন (এ আই সি সি টি ইউ), পশ্চিমবঙ্গ  স্বরোজগারী ও রাঁধুনি ইউনিয়ন (এস এম এস) এবং সারা বাংলা মিড-ডে মিল কর্মী ইউনিয়ন (এ  আই ইউ টি ইউ সি)— রন্ধনকর্মীদের পাঁচটি সংগঠন সমবেতভাবে একটি কনভেনশনের আয়োজন করেছিলেন। তাঁদের স্বাতন্ত্র ধরে রেখে, সেই স্বাতন্ত্রকে সম্মান জানিয়েই তৈরি হল ‘মিড ডে মিল কর্মী ঐক্য মঞ্চ, পশ্চিমবঙ্গ’। এই দিনই সেখানে যোগ দিলেন আরও একটি সংগঠন। হাতে হাত রেখে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রামের ডাক দিল এই নতুন মঞ্চটি।

 

সংগ্রাম কেন অত্যন্ত জরুরি, বস্তুত অপরিহার্য, সেটা কনভেনশনের খসড়া প্রস্তাবে অল্প কথায় প্রাঞ্জলভাবে এবং মূল্যবান তথ্য-পরিসংখ্যান সহযোগে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, যে প্রস্তাবের প্রতিলিপি এই প্রতিবেদনের সঙ্গে থাকল। সমবেত লড়াইয়ের গুরুত্ব সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল ওই দিনের প্রায় আড়াই ঘণ্টা ব্যাপী সভার আলোচনা থেকেও। আলোচনায় যোগ দিলেন সংগঠনগুলির প্রতিনিধিরা, কেবল নেতৃত্বে যাঁরা আছেন তাঁরাই নন, কথা বললেন বেশ কয়েক জন রন্ধনকর্মীও, যাঁদের আরও অনেকের কথা এবং আরও অনেকটা কথা শুনতে পারলে আরও ভাল হত। পাশাপাশি, সভায় আমন্ত্রিত ছিলেন কয়েক জন সহনাগরিক, যাঁরা মিড-ডে মিল কর্মীদের— এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মরত অগণন শ্রমজীবী মানুষের— সমস্যা ও সংগ্রাম নিয়ে ভাবছেন, বলছেন, লিখছেন, কাজ করছেন। আলাদা আলাদা করে আলোচনাসভার প্রত্যেকের বক্তব্য জানানোর অবকাশ এখানে নেই, তার প্রয়োজনও নেই। কথাগুলোকে একসঙ্গে করলে সমস্যার চেহারাটা সহজেই বোঝা যায়।

 

 

রন্ধনকর্মীদের মূল সমস্যা কী? কিসের বিরুদ্ধে তাঁদের লড়াই করতে হচ্ছে? একটি শব্দে চিহ্নিত করতে হলে, তার নাম: প্রতারণা। কুৎসিত এবং ভয়ঙ্কর প্রতারণা, যে কোনও যথার্থ সভ্য সমাজে যা অবিশ্বাস্য বলে মনে হবে। কিন্তু তেমন সভ্যতা আমাদের সমাজের ধাতে নেই, আর তা নেই বলেই সেই প্রকাণ্ড তঞ্চকতাকে ‘অবিশ্বাস্য’ বলবার কোনও উপায় নেই। তা কেবল বিশ্বাস্য নয়, কঠোর বাস্তব। বছরের পর বছর সেই অন্যায় ঘটে চলেছে। দরিদ্র মানুষকে তাঁর অভাবের সুযোগ নিয়ে এবং তার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর স্বাভাবিক মানবিকতারও সুযোগ নিয়ে যৎসামান্য— প্রায়শই অকিঞ্চিৎকর— টাকা দিয়ে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করিয়ে নেওয়ার অন্যায়। মিড ডে মিল প্রকল্পের রন্ধনকর্মীদের যে টাকা দেওয়া হয়, অন্য অনেক রাজ্যের তুলনায় তা অনেক কম, এবং সেই টাকার অঙ্ক গত দশ বছরের মধ্যে এক পয়সাও বাড়েনি। পেনশন, নির্ধারিত ছুটি, কাজের নিরাপত্তা ইত্যাদির তো কোনও প্রশ্নই নেই। এমন বহু কর্মী আছেন যাঁরা মাসে গড়পড়তা দশ-পনেরো টাকার বেশি পান না— দিনে নয়, মাসে! এই প্রবঞ্চনার ‘যুক্তি’ হিসেবে সরকারিভাবে বলা হয়ে আসছে, তাঁরা স্বেচ্ছাসেবী। এখন, স্বেচ্ছাসেবী মানে কর্মী নয়, শ্রমিক নয়, তাই ন্যূনতম মজুরিটুকুও তাঁদের প্রাপ্য নয়, হাতে যা খুশি ধরিয়ে দিয়ে কার্যত বেগার খাটিয়ে নেওয়া যায়!

 

দীর্ঘদিন ধরে এই অন্যায় চলে এসেছে কার্যত বিনা প্রতিবাদে এবং বিনা প্রতিরোধে। তার পিছনে সামাজিক ঔদাসীন্যের একটা বড় ভূমিকা আছে, এক গভীর ও অপার চিন্তাহীনতা যে ঔদাসীন্যের জন্ম দেয় ও তাকে লালন করে। আমাদের সমাজে মেয়েদের কাজকে সম্মান দেওয়ার রীতি নেই, কর্মী মেয়েদের কর্মী হিসেবে দেখার অভ্যেস নেই, বছরে তিনশো পঁয়ষট্টি দিন সকাল থেকে রাত্রি অবধি খেটে চলার পরেও অসংখ্য নারী ‘হাউজওয়াইফ’ থেকে যান, সামাজিক ঐতিহ্যের প্রবল পরম্পরায় সেই তকমা তাঁরা নিজেরাও আত্মস্থ করে নেন, ‘আপনি কী করেন’ জানতে চাইলে উত্তর দেন: ‘আমি তো কিছু করি না।’ এই সমাজে যখন— অনেক লড়াইয়ের চাপে— স্কুলে স্কুলে মিড-ডে মিল দেওয়ার প্রকল্প  তৈরি হয়, তখন সেই খাবার রান্না করার জন্য গ্রামের মেয়েদের প্রায় নিখরচায় কাজে লাগানোর কথা ভেবে নিতে নীতিকারদের কোনও অসুবিধে হয় না। তাঁরা ভাবেন, সমাজও ভাবে, ওই মেয়েরা তো এমনিতে কিছু করে না, রেঁধে দেবে, বাড়িতেও রান্নার কাজ করে, স্কুলেও করবে! অনেকেই আবার বলেন, ‘মায়ের জাত, বাচ্চাদের জন্য রাঁধা-বাড়ার কাজ তো ওরাই ভাল করতে পারে।’ অতএব, কেবল রান্না নয়, তার সমস্ত জোগাড়যন্ত্র থেকে শুরু করে, খাওয়ার সময় বাচ্চাদের তদারকি করা, ছোটদের অনেক সময় খাইয়ে দেওয়া, তার পরে সমস্ত বাসনপত্র পরিষ্কার করে রাখা অবধি যাবতীয় কাজও তাঁদের জন্যই বরাদ্দ হয়েছে, মায়ের জাত তো! স্কুলের মাস্টারমশাইদের জন্য সময়ে অসময়ে চা বানিয়ে দেওয়াটাও নাকি কোথাও কোথাও মায়ের জাতের কাজের মধ্যেই পড়ে।

 

রন্ধনকর্মীদের প্রাপ্য টাকা বাড়ানোর দাবি অনেক দিন ধরেই শোনা গিয়েছে। কিন্তু সেই দাবিতে বিশেষ কেউ কান পাতেননি। এমনকি এ নিয়ে কথা বলতে গেলে বামফ্রন্ট আমলে নারীর অধিকার বিষয়ে সচেতন ও সরব সমাজনেত্রীদের মুখেও শোনা গিয়েছে বিচিত্র জবাব: ‘হ্যাঁ, ওরা টাকাটা কম পাচ্ছে, তবু তো কিছু পাচ্ছে!’ এই জবাবের পিছনেও স্পষ্টতই কাজ করেছে যুগযুগলালিত সামাজিক ধারণা, যার কবল থেকে নামজাদা নারীবাদীদেরও রেহাই নেই। এই বাস্তবই জানিয়ে দেয়, হাল ফেরাতে গেলে জোট বাঁধতে হবে, জোট বেঁধে লড়াই করতে হবে, গণতান্ত্রিক লড়াই। বছর দুয়েক আগে সেই জরুরি কাজটিই শুরু করেছিলেন ‘আম্মা’-র উদ্যোগীরা, তাঁদের উদ্যোগেই একের পর এক সমাবেশ মিছিল জনসভা আয়োজিত হয়েছে কলকাতা-সহ রাজ্যের নানা অঞ্চলে, সরকারি আধিকারিকদের কাছে সমবেতভাবে দাবিপত্র রেখে এসেছেন তাঁরা। তাঁদের সভায় ও মিছিলে সামনের সারিতে থেকে কথা বলেছেন এবং স্লোগান দিয়েছেন রন্ধনকর্মীরা নিজেরা।

 

এই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়েই তাঁরা ক্রমশ পরিণত হয়েছেন, তাঁদের কণ্ঠস্বরে প্রত্যয় প্রবলতর হয়েছে। গত বছর দক্ষিণ কলকাতায় এক সভায় তাঁদের পাশাপাশি অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, আশা কর্মী, খেতমজুর, একশো দিনের কর্মী ইত্যাদি বিভিন্ন বর্গের নিপীড়িত শ্রমজীবীরা সমবেত হয়েছিলেন, সেখানে রন্ধনকর্মীদের মুখে তাঁদের সমস্যার কথা শুনেছিলাম, শুনেছিলাম সংগ্রামের কথাও। তার কিছু দিন পরে এক প্রতিবাদী মিছিল শেষে সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁরা নিজেদের দাবিদাওয়ার কথা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছিলেন। এবার, রন্ধনকর্মীদের ঐক্যমঞ্চ থেকে শোনা গেল আরও সংগঠিত এবং আরও জোরদার দাবি, সেই দাবি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্কল্প, এগিয়ে যাওয়ার সুস্পষ্ট কর্মসূচি হিসেবে সম্মানজনক প্রাপ্য এবং কর্মীর স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির নির্দিষ্ট সময়-বাঁধা অঙ্গীকার।

 

এই উদ্যোগ আমাদের ভরসা দেয়। ২৯ তারিখের সভায় এক বিবেকবান এবং অভিজ্ঞ সহনাগরিক একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বললেন। প্রেক্ষাগৃহে সমবেত পাঁচশোর বেশি রন্ধনকর্মীর উদ্দেশে শোনা গেল  তাঁর স্পষ্ট উচ্চারণ: মঞ্চে যারা বসে আছি, আপনারা তাদের ওপর বেশি ভরসা করবেন না, আপনাদের লড়াইটা আপনাদেরই লড়তে হবে। নিজেদের লড়াই নিজেরা লড়ার এই সঙ্ঘবদ্ধ উদ্যোগের প্রমাণ দিচ্ছে রন্ধনকর্মীদের সাম্প্রতিক আন্দোলন। শ্রমিক সংগঠনের চেনা ছকে বাঁধা থাকছে না তার গতিপ্রকৃতি। বিশেষত আম্মা-র আন্দোলনে শরিক হওয়া মেয়েরা ক্রমশই নিজেদের কথাগুলোকে আরও জোরের সঙ্গে বলছেন, সরকার তাঁদের দাবি না-মানলে আরও বড় আন্দোলনের ডাক দিচ্ছেন। এই একই আত্মশক্তির পরিচয় মিলেছে সারা দেশ জুড়ে আশা কর্মীদের আন্দোলনেও, অধুনা অঙ্গনওয়াড়ির কর্মী মেয়েদের সংগঠিত কর্মকাণ্ডেও যার মূল্যবান সঙ্কেত মিলছে। মেয়েরা, শ্রমিক শ্রেণির বিন্যাসে সর্ব অর্থেই একেবারে পিছনের সারিতে থাকা মেয়েরা তাঁদের প্রতিবাদী ভূমিকার অনুশীলনে ক্রমশ এগিয়ে আসছেন, সেই অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে তাঁদের চেতনাও। আরও অনেক পথ যেতে হবে। মঞ্চের ওপর থেকে, মিছিলের সামনে থেকে সংগঠনের পুরুষ নেতারা ধারাপাত শেখানোর ভঙ্গিতে স্লোগান উচ্চারণ করছেন আর কর্মী মেয়েরা তোতাপাখির মতো তার পুনরাবৃত্তি বা প্রতিধ্বনি করছেন— এমন দৃশ্য এখনও বিস্তর দেখা যাচ্ছে, সে দিন ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটের সামনে কোনও কোনও সংগঠনের মিছিলেও দেখা গেল। এক দিনে পুরো ছবিটা বদলাবে না। কিন্তু নীচের তলার চাপে পরিবর্তন ঘটছে, সেটা অনস্বীকার্য।

 

এই পরিবর্তনে যে যেভাবে পারি আমাদের সকলের শামিল হওয়া অত্যন্ত জরুরি। বিশেষত এই সময়ে। সামনে নির্বাচনী দক্ষযজ্ঞ। তার প্রস্তুতি এবং প্যাঁচ-পয়জার শুরু হয়ে গেছে পুরোদমে। সেই যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার তাণ্ডবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সত্যিকারের সমস্যাগুলো আরও বেশি করে চাপা দেওয়ার তৎপরতা চলবে যথারীতি। মর্যাদার সঙ্গে সুস্থ সমর্থ জীবনে বাঁচার দাবিকে আড়াল করে মাথা তুলবে  রকমারি বিভাজনের দানবপ্রতিমা এবং তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গড়ে তোলা হবে ধর্মীয় উন্মাদনার রকমারি দেবমূর্তি। দেবদানবের এই বন্ধুত্বমূলক প্রতিযোগিতায় ভেসে যাবে সাধারণ মানুষের স্বার্থ। এই প্রবণতা এবং তার পরিণতিকে আটকানোর একমাত্র উপায় তাঁদের দাবিদাওয়াগুলোকে নিরন্তর সমাজের সামনে নিয়ে আসা, দাবি পূরণের জন্য ক্ষমতাবানদের চাপ দেওয়া, তাঁদের চাপিয়ে দেওয়া অ্যাজেন্ডার বদলে দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের যথার্থ কল্যাণে অ্যাজেন্ডা নিয়ে কথা বলতে, সেই কল্যাণ সাধনের  অঙ্গীকার করতে এবং সেই অঙ্গীকার পালন করতে তাঁদের বাধ্য করা। রন্ধনকর্মীদের ঐক্য মঞ্চের সভায় বসে এই কথাটাই প্রবলভাবে মনে হচ্ছিল।

 

 

পড়ুন: নির্লজ্জ সরকার, তাই পথে মেয়েরা

 

Share this
Recent Comments
1
  • comments
    By: দুলাল সেন on January 4, 2024

    অনেক অজানা তথ্য আপনার লেখায় বেরিয়ে এলো। মিড্ ডে মিল কর্মী সংগঠনের সমস্ত দাবী যুক্তিসঙ্গত। তাদের দাবী আদায়ের সংগ্ৰামে পূর্ণ সমথৰ্ন জানাই।

Leave a Comment