ক্ষমতার মদমত্ততায় জাতির সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের ইতিহাস, সে সংগ্রামীদের হৃদয় নিংড়ানো দেশবন্দনাও এমন ইতিহাসবোধহীন শাসকের কাছে হয়ে ওঠে জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতির হাতিয়ার। দেশের ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণের রচনাও সে সংকীর্ণ রাজনীতির মাপমতো কেটেছেঁটে নিতে পিছপা নন তাঁরা। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ হলেও নয়। লিখলেন দেবাশিস আইচ।
ধরাকে সরা জ্ঞান করেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর ইচ্ছায় সংকীর্ণ সরণিও হয়ে ওঠে বিপুলা ধরণী। তিল হয় তাল। মর্জিমাফিক, যা কিছু করার এক বাতিকগ্রস্ততা যেন তাঁকে তাড়া করে সারাক্ষণ। ক্ষমতার মদমত্ততায় জাতির সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের ইতিহাস, সে সংগ্রামীদের হৃদয় নিংড়ানো দেশবন্দনাও এমন ইতিহাসবোধহীন শাসকের কাছে হয়ে ওঠে জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতির হাতিয়ার। দেশের ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণের রচনাও সে সংকীর্ণ রাজনীতির মাপমতো কেটেছেঁটে নিতে পিছপা নন তাঁরা। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ হলেও নয়। একমাত্র মানসিক বিকারগ্রস্ত শাসকই নিজের সম্বন্ধে এমন উচ্চধারণা পোষণ করার স্পর্ধা দেখাতে পারেন যে, একমেবাদ্বিতীয়ম তিনি, নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী তিনি, স্রষ্টার সৃষ্টির অঙ্গচ্ছেদ করতে তাঁর বুক কাঁপে না। অথচ, ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ এমনই এক গান যা রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করেছিলেন বাংলার অঙ্গচ্ছেদের প্রতিবাদে, বাংলার ও বাঙালির সার্বিক একতা, ঐক্যবদ্ধতা ও পুণ্য কামনায়।
‘রবিজীবনী’কার প্রশান্ত পাল আমাদের জানিয়েছেন, ১১ আশ্বিন [বুধ ২৭ সেপ্টেম্বর] রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে সাবিত্রী লাইব্রেরি স্বধর্ম সাধন সমিতির একটা বিশেষ অধিবেশন ডাকা হয়েছিল। সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, সুরেশচন্দ্র সমাজপতি, বিহারীলাল সরকার, অমৃতলাল বসুরা। সেই সভায় অন্যতম যে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল তা হল, ১৬ অক্টোবর যদি বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয়, তবে সমগ্র পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার সমস্ত জনগণের ওইদিনটিকে ঐক্যবদ্ধতার দিন হিসেবে উদ্ যাপন করা উচিত। এবং অবশ্যই ওই দিনটিকে পূর্ব ও পশ্চিমবাংলার মানুষের মধ্যে হলুদ সুতো বিনিময়ের মধ্য দিয়ে রাখীবন্ধন ও বার্ষিকী হিসেবে পালন করতে হবে। প্রশান্ত পাল আরও জানাচ্ছেন, “রাখীবন্ধনের প্রস্তাব সম্ভবত এই সভাতেই প্রথম ঘোষিত হল। রবীন্দ্রনাথ এই উপলক্ষে তাঁর বিখ্যাত ‘রাখীসঙ্গীত’ ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’…রচনা করেন।” এবং একই সূত্র থেকে আমরা জানতে পারছি, ১১ অক্টোবর, বুধবার ২৫ আশ্বিন ‘বেঙ্গলী পত্রিকায়’ বঙ্গাক্ষরে ‘রাখী সংক্রান্তির ব্যবস্থা’ ঘোষিত হয়।
……………….
ঘোষণা:
দিন। এই বৎসর ৩০শে আশ্বিন ১৬ই অক্টোবর
আগামী বছর হইতে আশ্বিনের সংক্রান্তি।
ক্ষণ। সূর্য্যোদয় হইতে রাত্রি প্রথম প্রহর পর্য্যন্ত।
নিয়ম। উক্ত সময় সংযম পালন।
উপকরণ। হরিদ্রাবর্ণের তিন সূতার রাখী।
মন্ত্র। ভাই ভাই এক ঠাঁই, ভেদ নাই ভেদ নাই।
অনুষ্ঠান। উচ্চ নীচ হিন্দু মুসলমান খৃষ্টান বিচার না করিয়া ইচ্ছামত বাঙ্গালী মাত্রেই ডান হাতে রাখী বাঁধা। অনুপস্থিত ব্যক্তিকে সঙ্গে মন্ত্রটি লিখিয়া ডাকে বা লোকের হাতে রাখী পাঠাইলেও চলিবে।
……………….
১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গের দিন কলকাতায় স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে বহু প্রথিতযশা ও সাধারণ মানুষ একযোগে গঙ্গার তীরে সমবেত হয়ে স্নান সেরে পরস্পরের হাতে রাখি বাঁধেন। এই ‘মিলনের সাধনা’ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ সজনীকান্ত দাসকে বলেছিলেন, “সামনে যাকে পেতাম, তারই হাতে বাঁধতাম রাখি। সরকারী পুলিশ ও কন্ স্টেবলদেরও বাদ দিতাম না। মনে পড়ে, একবার একজন কনস্টেবল হাতজোড় ক’রে বলেছিল, মাফ করবেন হুজুর, আমি মুসলমান (প্রশান্তকুমার পাল, রবিজীবনী, পঞ্চম খণ্ড, আনন্দ পাবলিশার্স ১৯৯০, কলকাতা)।”
বাংলার এক সঙ্কটকালে, ১৯০৫ সালে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার বাংলার অঙ্গচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিলে তার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, সেই বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে বিলিতি ভোগ্যপণ্য বয়কট, স্বদেশী শিল্পের সংগঠন ও প্রচার এবং সেই উদ্দেশ্যে জাতীয় ধনভাণ্ডার স্থাপনের মতো কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। লর্ড কার্জনের দেশভাগের প্রস্তাবে বিচলিত রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন— আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি, ও আমার দেশের মাটি, এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে, যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক, যদি তোর ডাক শুনে কেউ, আমাদের যাত্রা হল শুরু, এখন ওগো কর্ণধার, ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবের মতো গভীর আশা, উদ্দীপনা ও দেশবন্দনায় মথিত স্বদেশী গান—তেমনই এক গান, বাংলার মাটি বাংলার জল।
১ বৈশাখকে পশ্চিমবঙ্গ দিবস এবং বাংলার মাটি বাংলার জল গানটিকে রাজ্য সংগীত হিসেবে পালনের ভাবনা এবং এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের পিছনে রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার ও বিজেপির একটি অনৈতিহাসিক ও হিন্দুত্ববাদী পদক্ষেপ। বেশ কয়েক বছর ধরে নমো নমো করে হলেও ২০ জুন তারিখটিকে কেন্দ্রীয় সরকারের মদতে ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ হিসেবে পালন করছিল বিজেপি ও বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। ২০২৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকার রীতিমতো নির্দেশ জারি করে যে, দেশের প্রতিটি রাজ্য সরকারকে ২০ জুন ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ পালন করতে হবে। স্বাভাবিক ভাবেই রাজ্য সরকার এই নির্দেশের বিরোধিতা করলেও, রাজভবনে রাজ্যপালের পৌরহিত্যে রীতিমতো জাঁকজমকপূর্ণ এক আনন্দানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
১৯৪৭ সালের ২০ জুন অবিভক্ত বাংলার প্রাদেশিক আইনসভায় বাংলা ভাগের পক্ষে বিপক্ষে ভোটাভুটি হয়। দেশভাগের এই মর্মান্তিক সিদ্ধান্তের দিনটিকে আনন্দ ও হিন্দু্ত্বের জয় হিসেবেই চিহ্নিত করেছে বিজেপি। কেননা তাঁদের সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক ইতিহাস চেতনা বলে, হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্যই পশ্চিমবঙ্গকে পৃথক করে ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত করা সম্ভব হয়েছিল। এ হচ্ছে বিজেপির কাছে পশ্চিমবঙ্গের ‘ভারতভুক্তি’র দিন। অথচ এমন এক সিদ্ধান্তে ১০ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিলেন। ছিন্নমূল হয়েছিলেন প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ।
প্রতিক্রিয়ায় রাজ্য সরকার আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নির্দিষ্ট ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’-এর দিনক্ষণ স্থির করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই মর্মে বিধানসভার অধ্যক্ষ বিমান বন্দ্যোপাধায় একটি কমিটি গঠন করেন। তার উপদেষ্টা হিসেবে ছিলেন ইতিহাসবিদ সুগত বসু। বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক বসু বলেন, “একটি রাজনৈতিক দল পশ্চিমবঙ্গ দিবস হিসেবে ২০শে জুন দিনটিকে উদযাপন করেছে। ব্রিটিশরা ৩রা জুন, ১৯৪৭-এই দেশভাগের পরিকল্পনা ঘোষণা করে দিয়েছিল। তাই ২০শে জুন দিনটি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক দুঃখজনক পাদটীকা মাত্র।”
“এর কোনও রাজনৈতিক তাৎপর্য নেই। তাই আমরা কমিটিতে ভাবনা চিন্তা করে ঠিক করলাম যে রাজ্যের জন্য কোনও বিশেষ একটি দিন যদি বাছতেই হয়, সেরকম একটা শুভদিন আমাদের বাংলার নববর্ষ, পহেলা বৈশাখই হওয়া উচিত।”
“এছাড়াও আমরা দেখলাম যে অনেক রাজ্যেরই নিজস্ব রাজ্য-সঙ্গীত আছে। আমি সুপারিশ করি যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানটি বেছে নেওয়া যেতে পারে। গানটি রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন ১৯০৫ সালের ভাদ্র মাসে, বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে যে স্বদেশী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, সেই সময়।”
এর পর ২৯ অগস্ট মুখ্যমন্ত্রী একটি সর্বদলীয় সভা ডাকেন। রাজ্যের কোনও বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা সে সভায় যোগ না দিলেও,রাজ্য বিধানসভার অধ্যক্ষ বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়, জয় গোস্বামী, নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি, শুভাপ্রসন্ন, আবুল বাশার, সুবোধ সরকারের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন সাংবাদিক এবং মহিলা, শিশু, সংখ্যালঘু কমিশনের প্রতিনিধিরা, পুলিশ ও প্রশাসনের উচ্চ আধিকারিক এবং বিভিন্ন সম্প্রদায় ও সামাজিক গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা। সভায় অধ্যাপক সুগত বসু রাজ্য দিবস ও রাজ্য সঙ্গীত বিষয়ে প্রস্তাব পেশ করেন। প্রায় সর্বসম্মতিক্রমেই তা গৃহীত হয়। এর পর মুখ্যমন্ত্রীর অনুরোধে সকলে মিলে বাংলার মাটি বাংলার জল গানটিও গান।
এই পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। গোল বাঁধল গান শেষ হওয়ার পরই। মুখ্যমন্ত্রী সকলকে ধন্যবাদ দিয়ে বলে উঠলেন, “আমার একটা ছোট্ট প্রস্তাব থাকবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন এই গানটা লিখেছিলেন রাখি বন্ধনের সময়, তখন তিনি শুধু বাঙালিদের জন্য প্রোগ্রামটা করেছিলেন, যাতে (একটু থমকে), সব সমাজকে নিয়েই, যারা বাংলায় কথা বলে। যেহেতু, বাংলায় বিভিন্ন রকমের লোক আজকে বাস করে, বিভিন্ন জাতি, বিভিন্ন উপজাতি, বিভিন্ন সম্প্রদায়, বিভিন্ন ধর্ম…” এর পর তিনি জোরের সঙ্গে ঘোষণা করেন, “আজকে তিনি [রবীন্দ্রনাথ] বেঁচে থাকলে, তিনি এটা বলতেন, তিনি বাংলার বলতেন।”
পরক্ষণেই তাঁর শিহরণ তোলা প্রস্তাব, “বাঙালির প্রাণ বাঙালির মনটার জায়গায় আমরা (পড়ুন আমি) বাংলার প্রাণ বাংলার মন বাংলার ঘরে যত ভাইবোন এটা ইউজ করতে পারি কি না আমি আপনাদের মতামত চাইব। যদি আপনারা ইয়েস করেন, আমি মনে করি— আমরা সব ধর্মকে, সব বর্ণকে, সব সম্প্রদায়কে, সব সমাজকে, সব ভাষাকে একটা ছাতার তলায় নিয়ে আসতে পারব। এইটুকু সংযোজন তো আজকের দিনে অনেকেই করে।“
কারও যদি মনে হয়, এমন প্রেক্ষিতবিহীন, অনৈতিহাসিক হাস্যকর যুক্তি; মাত্র ১১৮ বছর আগের বাংলার জনবিন্যাসে বিভিন্ন জাতি, জনজাতি, ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উপস্থিতি বিষয়ে এমন অসীম অজ্ঞতা, সর্বোপরি “এইটুকু সংযোজন তো আজেকের দিনে অনেকেই করে” বলার মতো চরম ঔদ্ধত্য আসলে এক অস্বাভাবিক অহংমন্যতা— তা হলে তাকে বোধহয় দোষ দেওয়া যাবে না। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী কেউ কেউ এই প্রস্তাবে সমর্থন জানালেও অনেকেই এই প্রস্তাব মেনে নিলেন না। বিনীতভাবে অনেকেই জানালেন, রবীন্দ্রনাথের গানের কথা এভাবে বদলানো যায় না। কেউ বললেন, এভাবে গানের কথা বদলে দিলে অযথা বিতর্কের সৃষ্টি হবে। যা এমন এক ভাল কাজে কাম্য নয়। তাঁর প্রস্তাব পাশ না হওয়ায় দৃশ্যত বিচলিত মুখ্যমন্ত্রী সকলকে অনুরোধ করলেন, যাঁর যা মত তা যেন বিধানসভার অধিবেশনের আগে ৫ সেপ্টেম্বর লিখিতভাবে জানানো হয়। সভা ভঙ্গ হল। ৭ সেপ্টেম্বর বিধানসভায় পাশ হয়ে গেল ‘পশ্চিমবঙ্গ রাজ দিবস’ ও ‘রাজ সংগীত’ বিষয়ক বিল। কোনও শব্দ না বদলিয়ে, যথোচিত মর্যাদায় গাওয়া হল বাংলার মাটি বাংলার জল। কেন এমন বিল আনতে হল, ২০ জুনের প্রসঙ্গ তুলে তার ব্যাখ্যাও দিলেন মুখ্যমন্ত্রী।
কিন্তু, তিনি তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, এ রাজ্যে তাঁর কথাই তো শেষ কথা ‘এইটুকু সংযোজন’ যা ‘আজকের দিনে অনেকেই করে’ তাঁর এমন এক প্রস্তাবে যে অধিকাংশের সম্মতি মিলল না— তা কেমন করে মেনে নেওয়া সম্ভব! ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রদর্শিত হল। বেছে নেওয়া হল ৮ ডিসেম্বর কলকাতা আন্তর্জাতিক চল্চ্চিত্র উৎসবের দিনটিকে। চরম অবজ্ঞায় উপেক্ষিত হল বিধানসভার অধ্যক্ষের মনোনীত উপদেষ্টা কমিটির প্রস্তাব, বিদ্বজ্জন ও নাগরিক সমাজের মতামত, আইনসভায় গৃহীত হওয়া বিল। তারকাখচিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত দর্শকদের বলা হল রাজ্য সংগীত হবে উঠে দাঁড়ান। বিল তো আইনে পরিণত হয়নি, তবে কীভাবে বলা গেল ‘রাজ্য সংগীত হবে? সে প্রশ্ন তোলাই থাকল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেনের নেতৃত্বে শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায়, রূপঙ্কর, মনোময় ভট্টাচার্য, ইমন চক্রবর্তী, অদিতি মুন্সীরা মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছা চরিতার্থ করলেন। “বাঙালীর পণ বাঙালীর আশা’, বাঙালীর কাজ বাঙালীর ভাষা’, বাঙালীর মন বাঙালীর প্রাণ”, সব ‘বাঙালী’ বদলে গাওয়া হল ‘বাংলার’।
শেষ বয়সে, ২০ ডিসেম্বর ১৯৩৮ সালে জানকীনাথ বসুকে লেখা এক চিঠিতে নিজের গানের ‘পরের মুখে নষ্ট’ হওয়ার আক্ষেপ থেকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “এখন এমন হয় যে, আমার গান শুনে নিজের গান কিনা বুঝতে পারি না। মনে হয় কথাটা যেন আমার, সুরটা যেন নয়। নিজে রচনা করলুম, পরের মুখে নষ্ট হচ্ছে, এ যেন অসহ্য। মেয়েকে অপাত্রে দিলে যেমন সব-কিছু সহ্য করতে হয় এও যেন আমার পক্ষে সেরকম।“
“আজকালকার অনেক রেডিয়োগায়কও অহংকার করে বলে থাকেন তাঁরা আমার গানের উন্নতি করে থাকেন। মনে মনে বলি পরের গানের উন্নতি সাধনে প্রতিভার অপব্যয় না করে নিজের গানের রচনায় মন দিলে তাঁরা ধন্য হতে পারতেন। সংসারে যদি উপদ্রব করতেই হয় তবে হিটলার প্রভৃতির ন্যায় নিজের নামের জোরে করাই ভালো।“
নিজের গান, সে গানের সুর, গায়কী নিয়ে অসম্ভব স্পর্শকাতর ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই চিঠিতে তারই প্রকাশ ঘটেছে। শুধু গানের সুর নয়, তাঁর প্রতিটি রচনা, বইয়ের সম্পাদনা, ছাপা, প্রচ্ছদ বিষয়ে তিনি ছিলেন অত্যন্ত খুঁতখুঁতে ও সংবেদনশীল। সেই তাঁরই গানের বাণীও যে ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে, বঙ্গবাসীকে ‘এক ছাতার তলায় নিয়ে’ আসার অজুহাতে কেউ বদলে দিতে পারেন এমনটা বোধহয় তিনি কখনও দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি।