গ্রাউন্ডজিরো প্রতিবেদন : অনিমেষ দত্ত
কলকাতার সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের উদ্যোগে গত ১৬ ও ১৭ অক্টোবর দু’দিন ব্যাপী আয়োজন করা হল নিষিদ্ধ বই ও সিনেমার প্রদর্শনী- যার নাম দেওয়া হয়েছিল “ব্যানডওয়াগন (Banned Wagon)”। ভারত তথা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে নিষিদ্ধ হয়েছে একাধিক বই। পরবর্তীকালে দেখা গেছে এর মধ্যে অনেক বই-ই পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বই ‘ব্যান’ বা নিষিদ্ধকরণ আসলেই যে হাস্যকর ও মূর্খামির কাজ, তা-ই যেন বারবার ফুটে উঠল এই প্রদর্শনীতে।
বিভিন্ন দেশে বই নিষিদ্ধ হওয়ার ইতিহাস অনেকদিনের। নিষিদ্ধ বইয়ের তালিকাটিও বেশ লম্বা। তাতে বাদ পড়েননি উইলিয়াম শেকসপিয়ার, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, জর্জ অরওয়েল, মেরি শেলি, মিলন কুন্দেরা এমনকি আমাদের শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলামের মতো লেখক-কবিদের বইও। পরাধীন ভারতে কাজী নজরুল ইসলামের অগ্নিবীণা, শরৎচন্দ্রের পথের দাবী নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল ব্রিটিশ সরকার। শেকসপিয়ারের টুয়েলভথ নাইট, জর্জ অরওয়েলের ১৯৮৪, আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ফর হুম দ্য বেল টোলস, মিলন কুন্দেরার লাভেবল লাভস, হার্পার লি-র টু কিল আ মকিং বার্ড, তসলিমা নাসরিনের আমার মেয়েবেলা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এক সময়। সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়ে এই প্রদর্শনীতে এক সময়ে নিষিদ্ধ হওয়া বেশকিছু বইয়ের কপি প্রদর্শিত হয়েছে। এখনও অনেক বই-ই ভারতে বিক্রয়ে নিষেধাজ্ঞা আছে। সেই বইগুলির প্রচ্ছদ এঁকেছেন বিভাগের পড়ুয়ারাই।
নিষিদ্ধ বই নিয়ে এই অভিনব উদ্যোগের ভাবনা কীভাবে এল? আয়োজক ইংরেজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. সুবর্ণা মণ্ডল বলেন, “আমার এক বন্ধু টেক্সাসে এক লাইব্রেরিতে চাকরি করেন। সেখানেই ওরা প্রতি বছর ১ অক্টোবর থেকে ৭ অক্টোবর ‘ব্যানড বুক উইকস’ উদযাপন করেন। সেখান থেকেই আমরা চিন্তাভাবনা করে অক্টোবর মাসে এই দু’দিনের প্রদর্শনীর আয়োজন করি।” বর্তমান পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে এই উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন বিভাগের শিক্ষকরা। এর পাশাপাশি পড়ুয়াদের বই পড়তে ও দেশবিদেশের নানান বই সম্পর্কে ধারণা দিতেও এই উদ্যোগের ভাবনা বলে জানিয়েছেন শিক্ষকরা। সুবর্ণা মণ্ডল আরও বলেন, “আমরা চেয়েছিলাম পড়ুয়ারা নিজেরা বই ঘাটুক, সিনেমা ঘাটুক, নিজেরাই খুঁজে খুঁজে বের করুক।” বেশিরভাগ বই ও সিনেমা খুঁজে বের করা, প্রচ্ছদ আঁকা, সিডি-ডিভিডি সংগ্রহ করা, প্রদর্শনী অনুষ্ঠানটিকে সাজানো সমস্ত কাজটাই করেছেন বিভাগের পড়ুয়ারা।
কিছু ব্যক্তিবিশেষ বা সংস্থা এমনকি কোনও এক বা একাধিক রাষ্ট্রের সেই নির্দিষ্ট বই বা সিনেমা পছন্দ নয়, বা বলা ভালো অনেক ক্ষেত্রেই শাসক বিরোধী মত, তাই নিষিদ্ধকরণ। এটি একটি পদ্ধতিও বটে বিরোধী স্বরকে দমন করার যা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাষ্ট্র ব্যবহার করে এসেছে। নিষিদ্ধকরণ সুবর্ণা মণ্ডলের মতে “অযৌক্তিক, নিরর্থক।” তিনি বলেন, “নিষিদ্ধকরণের অনুশীলনটি আসলেই বোকা বোকা, অর্থহীন। কারণ এক সময়ে যে বইগুলি নিষিদ্ধ হয়েছে তার অনেকগুলিই আমরা এখন স্কুল-কলেজে পড়াচ্ছি, সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত। আর এই জিনিসটাই আমরা আমাদের পড়ুয়াদের বোঝানোর চেষ্টা করছি। আমরা অনেক সময় অনেক জিনিস বুঝতে পারি না। কিন্তু বুঝতে পারছি না মানে তাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেওয়ার তো কোনও মানে নেই। আমাদের সর্বদাই মতভেদ, ভিন্নস্বর, বিবিধ চিন্তাকে সম্মান করা উচিত।”
ঠিক যে যে কারণগুলি দেখিয়ে বিভিন্ন বই নিষিদ্ধ হয়েছে, সেই কারণগুলিকে ছোট ছোট চিরকুটে লিখে রাখা হয়েছে প্রদর্শনীতে। মেরি ও’হারার লেখা মাই ফ্রেন্ড ফ্লিকা উপন্যাস নিষিদ্ধ করা হয় এটা বলে যে সেখানে একটি মাদি কুকুরকে ‘বিচ’ বলা হয়েছে! বহুল বিতর্কিত বই অ্যারাবিয়ান নাইটসকে নিষিদ্ধ করার কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল “ইট কজড অ্য ওয়েভ অফ রেপস।” বাদ যায়নি শিশুদের বইও। ২০০৫ সালে প্রকাশিত অ্যান্ড ট্যাঙ্গো মেকস থ্রি বইটি দুটি পুরুষ পেঙ্গুইনের গল্প, যা নিষিদ্ধ করা হয় “হোমোসেক্সুয়াল পেঙ্গুইন”, “আনস্যুটেবল ফর ইয়ং চিলড্রেন” ইত্যাদি বলে। গার্থ উইলিয়ামস-এর বই র্যাবিটস ওয়েডিং দুই খরগোশের বিয়ের গল্প। নিষিদ্ধকরণের কারণ সাদা-কালোর দ্বন্দ্ব। অর্থাৎ, একটি খরগোশ সাদা ও আরেকটি কালো। ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত মার্গারেট অ্যাটউডের লেখা বহুল চর্চিত উপন্যাস দ্য হ্যান্ডমেডস টেল নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ তার বিষয়বস্তু এবং এলজিবিটিকিউ চরিত্ররা। এমন নানান বইয়ের নিষিদ্ধ হওয়ার “স্টুপিড” কারণগুলিকে সুচারুভাবে তুলে ধরেছেন বিভাগের পড়ুয়ারা।
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাতেও নিষিদ্ধ হয়েছে বই। সমরেশ বসুর প্রজাপতি -কে ‘অশ্লীল’ বলে নিষিদ্ধ করা হয়। ১৮ বছর পর সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। সম্প্রতি সেই গল্পের আদলেই ‘সমরেশ বসুর প্রজাপতি’ নামে একটি বাংলা ছবিও তৈরি হয়েছে। নিষিদ্ধ হয়েছে বুদ্ধদেব বসুর রাত ভোর বৃষ্টি। সাদাত হোসেন মান্টোর একাধিক গল্প যেমন ঠান্ডা গোস্ত, বু নিষিদ্ধকরণের শিকার হয়েছে। মান্টোর মতোই আরেক উর্দু ভাষার লেখিকা ইসমাত চুগতাইয়ের ছোটগল্প লিহাফ (চাদর) নিষিদ্ধ করা হয় ‘কামোত্তেজক’ বলে। ইসমাত চুগতাইয়ের ঘরওয়ালি, টেরহি লকির (আঁকাবাঁকা পথ) গল্পগুলি নিয়েও তৈরি হয়েছিল বিস্তর বিতর্ক। ‘যৌনতা’, ‘অশ্লীলতা’, ‘অসামাজিক সম্পর্ক’ ইত্যাদি নানান কারণগুলি এই সমস্ত বই নিষিদ্ধ হওয়ার নেপথ্যে। কিন্তু ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে কোনও বিশেষ সময়ে কিংবা কোনও সমাজে যা ‘অশ্লীল’, ‘অসামাজিক’ তকমা পেয়েছে, তা-ই পরবর্তীকালে প্রগতিশীল, এগিয়ে থাকা মত হিসেবে স্থান পেয়েছে। তাই কোনও সময়েই বই নিষিদ্ধ করে তা আটকে রাখা যায়নি।
বইয়ের পাশাপাশি সিনেমা নিষিদ্ধকরণের ইতিহাসও বেশ পুরনো। নিষিদ্ধ হওয়া সিনেমার পোস্টার, সিডি-ডিভিডি প্রদর্শিত হয়েছে এখানে। চার্লি চ্যাপলিনের হিটলারকে নিয়ে তৈরি বিখ্যাত সিনেমা ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ (১৯৪০) এর পোস্টার স্থান পেয়েছে এখানে। এছাড়াও আমরা জানি মার্টিন স্করসিসের ‘দ্য লাস্ট টেমপটেশন অফ ক্রাইস্ট’ (১৯৮৮), বার্নার্দো বার্তলুচ্চির ‘দ্য ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস’ (১৯৭২), স্ট্যানলি কিউব্রিকের ‘ আ ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ’ (১৯৭১), সার্গেই আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন’ (১৯২৫) এমনকি ডি.ডাব্লু গ্রিফিতের বহুল বিতর্কিত সিনেমা ‘বার্থ অফ আ নেশন’ (১৯১৫) -ও নিষিদ্ধ হয়েছে কোনও না-কোনও সময়ে, কোনও না-কোনও দেশে। বইয়ের গল্প থেকে সিনেমা হয়েছে এমন উদাহরণ বিশ্বে অনেক আছে। নিষিদ্ধ হওয়া বই থেকে সিনেমা হয়েছে এবং সিনেমাও নিষিদ্ধ হয়েছে তার অন্যতম উদাহরণ হল ড্যান ব্রাউনের লেখা বহুচর্চিত উপন্যাস দ্য ভিঞ্চি কোড। টম হ্যাংকস অভিনিত ‘দ্য ভিঞ্চি কোড’ সিনেমাটি বেশকিছু দেশে নিষিদ্ধ করা হয় খ্রিষ্টান ও ইসলাম ধর্মগ্রন্থে লেখা ‘সত্য’-র বিরোধিতা করার ‘দায়ে’।
পিছিয়ে নেই আমাদের ভারতবর্ষও। বইয়ের পাশাপাশি একাধিক সিনেমা নিষিদ্ধ হয়েছে এদেশে। প্রদর্শনীতে ‘লিপস্টিক আন্ডার মাই বুরখা’ (২০১৬) সিনেমাটির পোস্টারের দিকে চোখ চলে যায়। এছাড়াও ইন্দিরা গান্ধীর ইমার্জেন্সির সময়ে ‘আনধি’ (১৯৭৫) নিষিদ্ধ হয়। অনুরাগ কাশ্যপের ‘পাঁচ’ (২০০৩), ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ (২০০৪) সিনেমাগুলিও নিষিদ্ধ হয়েছিল। ভারতীয় সেন্সর বোর্ড এমন অনেক সিনেমাকেই বিভিন্ন দৃশ্য বাদ দেওয়ার পর ছবি মুক্তির অনুমতি দিয়েছে। হালের বিবিসির তথ্যচিত্র ‘ইন্ডিয়া: দ্য মোদি কোয়েশ্চেন’ (২০২৩) নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, তার পোস্টারও চোখে পড়েছে এই প্রদর্শনীতে। যদিও বর্তমান সময়ে ইন্টারনেট থাকায় কোনও বই বা সিনেমাকে নিষিদ্ধ করে খুব একটা লাভবান হচ্ছেন না নিষিদ্ধকারীরা। দ্রুত গতিতে বিভিন্ন পাইরেটেড সাইট কিংবা টেলিগ্রামে সেই সিনেমা ছড়িয়ে পড়ছে সবার মোবাইল ফোনে। বই নিষিদ্ধ হলেও তার পিডিএফ পাওয়া এখন সহজলভ্য হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার পরেও সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজিত এই প্রদর্শনী নতুন করে নিষিদ্ধকরণের রাজনীতি ও দর্শনকে একরকম প্রশ্ন করে। নিষিদ্ধ হওয়া বই ও সিনেমার প্রদর্শন আসলে নিজে থেকেই একটি বিবৃতি বটে। “চসারের দ্য ক্যান্টারবেরি টেলস এক সময় নিষিদ্ধ ছিল, এখন সিলেবাসের অংশ। আসলে শুধু টেক্সট পড়া নয়, বরং সেই টেক্সট কোন সময়ে কেন নিষিদ্ধ হয়েছে, তা জানাটাও পড়ুয়াদের জন্য জরুরি। কারণ সেই সময় সম্পর্কেও একটা ধারণা পাওয়া যায়। কোনও কিছুকেই দূরে সরিয়ে রাখা, গায়েব করে দেওয়া আসলে কোনও কাজের কথা নয়” মত সুবর্ণা মণ্ডলের৷ অন্যদিকে এমন একটি প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করতে পেরে উচ্ছ্বসিত পড়ুয়ারাও। স্নাতকোত্তরের ছাত্র শৌভিক কামিলা বলেন, “আমরা আসলে নিষিদ্ধ করার পিছনের কারণগুলিই খোঁজার চেষ্টা করেছি। আরেক ছাত্রী দেবপ্রিয়া ভট্টাচার্য বলেন, “আমরা এটাই দেখতে পাচ্ছি যে বই কিংবা সিনেমাগুলো নিষিদ্ধ করা হয়েছে তার মধ্যে বেশিরভাগই বাস্তবকে তুলে ধরছে৷ যেমন ‘ফায়ার’ (১৯৯৬) সিনেমাটা, ওখানে হোমোসেক্সুয়ালিটি দেখানো হয়েছে, যেটাকে ভারতীয় পরিবারে কীভাবে ট্যাবু হিসেবে ধরা হয় তা দেখানো হয়েছে। ফায়ার নিষিদ্ধ করাটা অর্থহীন। যা হয় আমাদের চারপাশে তা-ই দেখানো হয়েছে।”
আমরা জানি বই জ্ঞানের উন্মোচন ঘটায়। আর যখন কোনও একটা বই পড়তে কিংবা কোনো একটা সিনেমা দেখতে নিষেধ করা হয় তখন আমাদের আরও বেশি করে সে বই পড়তে কিংবা সিনেমা দেখতে উৎসাহ তৈরি হয়। প্রদর্শনীতে একটি ছোট কার্ডে লেখা ওয়াল্ডো এমারসনের উক্তি – “Every banned book enlightens the world (প্রত্যেকটি নিষিদ্ধ বই বিশ্বকে আলোকিত করে)” আসলেই আমাদের শিক্ষা দেয় আমরা কোনও একটা নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে বসে যা চিন্তাভাবনা করছি, সমাজের ‘নৈতিকতা’ বলে ধরে নিয়েছি যাকে, এবং তার ভিত্তিতে কোনওকিছুকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করছি, তা-ই ভবিষ্যতে ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়ে নতুন আলোর সন্ধান দিয়েছে। ধর্মের ধ্বজাধারীরা কিংবা রাষ্ট্র যখন কোনওকিছুকে ‘ঠিক’ বলে আমাদের বুঝিয়েছে, তাকে চ্যালেঞ্জ করেই আজকের বিশ্ব এগিয়েছে। আর এই চ্যালেঞ্জগুলি করতে গিয়ে বই ও সিনেমা মাধ্যম হয়েছে বহু মানুষের কাছে। নিষিদ্ধ করে আর যাই হোক, চিন্তাকে রোখা যায় না। তাই যেন মনে করিয়ে দিল এই প্রদর্শনী। “আইডিয়াজ আর বুলেটপ্রুফ”, সর্বদাই।