স্টুডেন্টস ইউনিয়নের নির্বাচনের দাবিতে সুর চড়াচ্ছেন জেএনইউ’র পড়ুয়ারা


  • October 15, 2023
  • (0 Comments)
  • 714 Views

বিগত ৪ বছর দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানে পাঠরত শিক্ষার্থীদের থেকে বিভিন্ন অজুহাতে ইউনিয়নের অধিকার কেড়ে নেওয়ার প্রবল প্রয়াস চলছে। 

 

— তীর্থদীপ

 

 

ভগ্ন গণতন্ত্রের ফাটলে বেড়ে ওঠা ফ্যাসিবাদী বিষবৃক্ষের বিস্তৃত শাখা-প্রশাখার কবলে পড়েনি এমন সংস্থা দেশে নেই, ব্যতিক্রম নয় জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ও; বরং, শাসকের চক্ষুশূল হওয়ার যাবতীয় মূল্য দিতে হচ্ছে প্রতি মুহুর্তে। বিগত ৪ বছর দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানে পাঠরত শিক্ষার্থীদের থেকে বিভিন্ন অজুহাতে ইউনিয়নের অধিকার কেড়ে নেওয়ার প্রবল প্রয়াস চলছে। বিবিধ অজুহাতে স্থগিত রাখা হয়েছে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সঙ্ঘ (জেএনইউএসইউ)-এর নির্বাচনী প্রক্রিয়া।

 

এই প্রেক্ষিতে গত ১১ অক্টোবর ইউনিয়ন বিশ্ববিদ্যালয় ধর্মঘটের ডাক দেয়। কিন্তু কোভিডের পরে সময় সমাজ বদলেছে, একই সাথে বদলেছে ক্যাম্পাস-রাজনীতি। যে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রাজনৈতিক উত্তাপ প্রায় সমার্থক, সেখানেও ধর্মঘট সফল করার পথ আশঙ্কা বা অনিশ্চয়তামুক্ত ছিল না। একদিকে কর্তৃপক্ষের দ্বিচারিতা, অন্যদিকে কর্তৃপক্ষের দোসর ও দালাল সংগঠন এবিভিপি-র শিক্ষার্থী-বিরোধী রাজনীতি — সব মিলিয়ে ধর্মঘটকে অসফল করার ও ইউনিয়নকে ব্যর্থ প্রমাণ করার প্রয়াস কিছু কম হয়নি। তা সত্ত্বেও, সকলের সক্রিয় ও ব্যাপক অংশগ্রহণের মাধ্যমে সম্পূর্ণভাবে সফল হল ধর্মঘট। একদিনের জন্য শিক্ষার্থীরা কর্তৃপক্ষের চোখে চোখ রেখে অচল করে দিল বিশ্ববিদ্যালয়, বয়কট করা হল সব ক্লাস।

 

অথচ, দ্য হিন্দু সংবাদপত্রে পরেরদিন হেডলাইনে লেখা হল: “লেফট গ্রুপস বয়কট ক্লাসেস, ডিমান্ড জেএনইউ স্টুডেন্ট বডি পোল অ্যাট দি আরলিয়েস্ট”। অগণিত ছাত্রছাত্রী সমস্বরে যখন “আজাদি”, “হল্লা বোল” বা “জেএনইউ বন্ধ হায়” স্লোগান দিতে দিতে সারা ক্যাম্পাসে মিছিলে হাঁটছে, ক্লাস থেকে স্বেচ্ছায় বেরিয়ে আসছে অধ্যাপক/অধ্যাপিকার সামনে থেকে, বন্ধ করে দিচ্ছে একাধিক স্কুল, তখন দেশের নামজাদা কাগজে লেখা হচ্ছে এটা গুটিকতক শিক্ষার্থীর ধর্মঘট। সংবাদপত্র দ্বারা কর্তৃপক্ষের জবানির আত্তীকরণ সম্পূর্ণভাবে নিন্দাজনক।

 

এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচনের দাবি শুধু নির্বাচনের দাবি নয়, স্বাধীন ইলেকশন কমিশন-এর মাধ্যমে নির্বাচনের দাবি। সারা ভারতে জেএনইউ বাদে সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাচনে কর্তৃপক্ষ মনোনীত আধিকারিকরা ইলেকশন কমিশন গঠন করে নির্বাচনী প্রক্রিয়া পরিচালনা করে থাকে। এক্ষেত্রে এই বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতিক্রমী। ছাত্রছাত্রীদের দ্বারা প্রথমে এখানে ইলেকশন কমিশন নির্বাচিত হয়, তারপর সেই কমিশন সম্পূর্ণ নির্বাচনী প্রক্রিয়া পরিচালনা করে। বারংবার এবিষয়ে বর্তমান কর্তৃপক্ষ তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। এবারেও কর্তৃপক্ষের প্রবল প্রয়াস যাতে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার রশি শেষমেশ তাদের হাতে এসে পৌঁছায়। উদ্দেশ্য একটাই, শিক্ষার্থী-বিরোধী দালালদের হাতে ইউনিয়ন তুলে দেওয়া। যে ইউনিয়ন ২০১২ সালে নির্ভয়া আন্দোলনকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিল সেই ইউনিয়নে ব্রিজভূষণের সাঙ্গপাঙ্গকে জায়গা করে দেওয়া। যে ইউনিয়ন ২০১৯ সালে ফি-বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন করে ক্ষমতাশীন প্রধানমন্ত্রীকে তার সীমাবদ্ধতা চিনিয়ে দিয়েছিল, সেই আন্দোলন চলাকালীন যেসব গুন্ডারা উপাচার্যের সাথে বসে মিষ্টিমুখ করেছিল তাদের ইউনিয়নের মুখ করে তোলা। ১১ তারিখের ধর্মঘটে শিক্ষার্থীরা এই সমস্ত অভিসন্ধিকে তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।

 

এর আগে ১৮ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ সভাতে প্রায় দীর্ঘ ৭ ঘণ্টা আলোচনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সিদ্ধান্ত নেয় যে, এই বছরের মধ্যেই নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। কর্তৃপক্ষের কাছে এই জনমত পৌঁছে দেওয়ার পরও তাদের পক্ষ থেকে কোনো গ্রহণযোগ্য প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। বিগত দু’বছরে কর্তৃপক্ষ কখনও জানায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরের ভর্তি-প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর নির্বাচন হবে, সে পর্ব মিটলে জানায় পিএইচডি-র ভর্তি শেষ হলে নির্বাচন হবে। এভাবেই ভর্তির গোলকধাঁধায় নির্বাচন বেপাত্তা হয়ে যায়।

 

কয়েক সপ্তাহ আগে ডিন অফ স্টুডেন্টস ছাত্র ইউনিয়ন বা কোনো ছাত্র সংগঠনের সাথে আলোচনায় অংশগ্রহণ না করে, কেবল এবিভিপি-র সাথে ৬ ঘণ্টা মিটিং করে জানায় যে, পিএইচডি-র ভর্তি শেষ হলে নির্বাচন হবে, যা জানুয়ারির আগে শেষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। জেএনইউএসইউ-এর সংবিধান অনুযায়ী, ভর্তি শেষ হওয়ার ৬ থেকে ৮ সপ্তাহের মধ্যে নির্বাচন প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। ছাত্রছাত্রীদের আশঙ্কা, ততদিনে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের মডেল কোড অব কন্ডাক্ট দেশে লাগু হয়ে যাবে, ফলত নির্বাচন সম্ভব নয়। একটি অগণতান্ত্রিক কর্তৃপক্ষ ও একটি দেউলিয়া-হয়ে-যাওয়া সংগঠন যথেচ্ছ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করে সমস্ত বিরুদ্ধতার স্বরকে, গণতান্ত্রিক অধিকারকে, চিন্তার স্বাধীনতাকে নিঃশেষ করার যে উন্মাদনা সৃষ্টি করেছে তা একটি মৃতপ্রায় ব্যবস্থার লক্ষণ। মৃতপ্রায় ব্যবস্থা মরে না, মারে।

 

ভুললে চলবে না, গণতন্ত্র শুধু একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা নয়, একটি চিন্তা ব্যবস্থাও। এই ব্যবস্থায় নির্বাচন কেবল প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার নয়, চিন্তা নির্বাচনের অধিকার। বর্তমান উপাচার্য শান্তিশ্রী ধুলিপুডি পণ্ডিত, যিনি আরএসএস-এর স্বঘোষিত অনুগামী, এই ক্যাম্পাসে চিন্তার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ সর্বতোভাবে চেষ্টা করছেন। কখনও “গর্ভসংস্কার” কর্মসূচিতে উপস্থিত থেকে (যেখানে বলা হয়, গর্ভবতী নারীর গর্ভে কন্যাভ্রুণ থাকলে সে যদি পুত্র কামনা করে তাহলে সন্তান সমকামী হবে; গর্ভকে মন্ত্র দ্বারা শুদ্ধ করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি), কখনও জলের দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের পুলিশের ভয় দেখিয়ে বা কখনও মোহন ভাগবতের পাশে বসে, তিনি বারবারই ক্যাম্পাসকে আশ্বস্ত করেছেন যে, জগদীশ মামিদালার উত্তরসূরি হিসাবে তিনিও এই বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংস করার ভারপ্রাপ্ত। দুর্ভাগ্যবশত, ছাত্র-আন্দোলনের ইট-বালি-সুড়কিতে তৈরি বিশ্ববিদ্যালয় কখনও কর্পোরেট হিন্দুত্বের ধাক্কাধাক্কিতে ভেঙে পড়ে না।

 

তবে, শিক্ষার্থী ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অরাজনৈতিকরণের ইতিহাস কেবল বিগত ৯ বছরের ইতিহাস নয়। ৯০-এর দশকে নয়া-উদারনীতিকরণের পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়কে বাজারমুখী করে তোলার রাষ্ট্রীয় প্রয়াস বিভিন্ন শিক্ষানীতিতে প্রতিফলিত হচ্ছে। অন্যান্য পণ্যের মতোই শিক্ষার বাজারিকরণ প্রথমেই আর্থ-সামাজিকভাবে বঞ্চিত সমাজের বৃহত্তর অংশকে শিক্ষার অধিকার থেকে পুনরায় বঞ্চিত করে। ঐতিহাসিকভাবে, যে শ্রেণীর স্বার্থে এই দেশে জাতি-পরিচয় ও পুঁজি-সঞ্চয়কে অবলম্বন করে বৈষম্যমূলক সমাজ গড়ে তোলা হয়েছে, শিক্ষার পণ্যায়ন কেবল তাদের সেই অসম স্বার্থকে পরিপুষ্ট করার পরোক্ষ উপায়মাত্র। স্বাভাবিকভাবেই, রাজনৈতিক চেতনা ও প্রতিরোধ এধরনের কর্পোরেট স্বার্থের বিরোধী। ২০০০ সালে আম্বানি-বিড়লা রিপোর্টে সুস্পষ্টভাবে ক্যাম্পাসকে রাজনীতি-মুক্ত করার কথা বলা হয়। বর্তমান সরকার অলিখিতভাবে সেই পথেই হাঁটছে। এই পরিস্থিতিতে, বৈষম্যের প্রযুক্তিকরণের যুগে ছাত্র-রাজনীতিই একমাত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে।

 

যেভাবে ধীরে ধীরে ট্রেড ইউনিয়ন, কৃষক ইউনিয়ন, অসংগঠিত ক্ষেত্রে ইউনিয়ন তৈরি ও পরিচালনা করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় দমননীতির মুখোমুখি হচ্ছে, ছাত্র ইউনিয়নের প্রশ্নটিকেও তার সাথে জুড়ে দেখা প্রয়োজন। রাষ্ট্র মাত্রেই তা জনগণ বিরোধী হতে বাধ্য। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র আরেক ধাপ এগিয়ে থাকে, তা জনগণের বিরোধীতারও বিরোধী। আমাদের দেশে শ্রমিক-কৃষক-শিক্ষার্থীদের সংগঠিত সংঘর্ষ আজ এরকমই একটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে — এমন এক ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র যা গণতন্ত্রকে শেষ করে নয় বরং গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে নিজেকে ক্ষমতাশালী করে চলেছে। এমতাবস্থায়, রাজনৈতিক ঔদাসীন্য আত্মঘাতী। “পড়তে এসেছি, পড়ব, চলে যাব”, “আমি রাজনীতির মধ্যে থাকি না” — এমন ভাবনা আজকের দিনে স্বেচ্ছামৃত্যুর ঘোষণা মাত্র। ক্যাম্পাস রাজনীতিতে সব চাইতে বড়ো সমস্যা এই উদারবাদী ঔদাসীন্য। রাজনৈতিক চেতনা ও রাজনৈতিক সক্রিয়তার পরিপন্থী ব্যক্তিকেন্দ্রীক এই সরল অথচ গভীর এই মতাদর্শের মোকাবিলা করাই ছাত্রসংগঠনগুলির প্রধান লক্ষ হওয়া উচিত। বুঝতে হবে, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক স্তরে, বামপন্থী রাজনীতির বিপ্রতীপে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির বিকাশ হচ্ছে এরকমটা নয়, বরং স্লাভয় জিজেক যেমন কিছু বছর আগে তাঁর “লিভিং ইন দ্য এন্ড টাইমস” গ্রন্থে নির্দেশ করেছেন সেই সূত্র ধরে আমরা বলতে পারি, বর্তমান বিশ্বে বামপন্থী রাজনীতি আজ দক্ষিণপন্থী উত্তর-রাজনীতি বা পোস্ট-পলিটিকস-এর সম্মুখীন হয়েছে। তাই, ক্যাম্পাস থেকে কারখানা পর্যন্ত রাজনৈতিকরণ সুনিশ্চিত না করলে, কৃষক-শ্রমিকের আন্দোলনের সাথে কৃষক-শ্রমিকের সন্তানদের শিক্ষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আন্দোলনকে সংযুক্ত না করলে, শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধ শেষমেশ গণতান্ত্রিক সমঝোতায় প্রতিপন্ন হবে।

 

(তীর্থদীপ জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র)

 

Share this
Leave a Comment