Groundxero : October 6, 2023
আসুন প্রশ্ন করি পরিবেশ ও জীবন-জীবিকা ধ্বংসকারী অপ-উন্নয়নকে
স্মরণাতীত কালে এত বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়েননি সিকিমবাসী। যে বিপর্যয়কে বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছে ন্যাশনাল হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার কর্পোরেশন (এনএইচপিসি)-র তিস্তা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধগুলি। যার ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে পশ্চিমবঙ্গের পাহাড়ি এলাকা-সহ চার জেলা এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে। অতিবৃষ্টি, উষ্ণায়নের ফলে দ্রুত বরফ গলে যাওয়া, সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের জের—দক্ষিণ লোনাক হ্রদ ভাঙা বন্যার পিছনে যে এক বা একাধিক কারণই থাক না, একটি বিষয় এখানে সুস্পষ্ট। আর তা হল বিশেষজ্ঞ সংস্থা ও ব্যক্তিবর্গের আগাম সতর্কবার্তা এবং ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শে না কান দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার, না রাজ্য সরকার। এমনকি এনএইচপিসিও।
৩ তারিখ রাতে হ্রদ ভেঙে প্রবল গতিতে নেমে আসা বরফগলা জল, পাথর, বড় বড় বোল্ডার, কাদামাটি ঘুমের মধ্যেই ভাসিয়ে নিয়ে গেল ‘অতন্দ্রপ্রহরী’ সেনা জওয়ান, তাঁদের গোলাবারুদ, আগ্নেয়াস্ত্র, গাড়ি-সহ আস্ত সেনাশিবির। কেউ টেরও পায়নি। চুংথাং জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাঁধের লকগেট খোলার সময় পাননি কর্তব্যরত কর্মীরা। একে বাঁধ ভরা তার উপর ধেয়ে আসা জল, বোল্ডারের ধাক্কায় ২৫ হাজার কোটি টাকার নির্মাণ মুহূর্তে ধুয়ে দিল তিস্তা। ডেকচু জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রেরও ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু কী, কতটা তার হিসেবই করে ওঠা যায়নি। হিসেব নেই তিস্তার এই বাঁধভাঙা গতিপথে মানুষ, ঘরবাড়ি, পশুপক্ষী, বনভমির মোট ক্ষয়ক্ষতির।
৬ অক্টোবর, শিলিগুড়ি প্রেসক্লাবে সিকিম, কালিম্পং, ডুয়ার্স, শিলিগুড়ির পরিবেশকর্মী, সামাজিক সংগঠন, তিস্তায় বাঁধ নির্মাণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত সিকিম, পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের সংগঠন ফের তাদের উদ্বেগ, ক্ষোভ, দাবিদাওয়া নিয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিল। বিগত দু’দশক ধরেই এই সংগঠনগুলি এই তিস্তা বাঁধ প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন, মামলা-মোকদ্দমা, অনশন আন্দোলন করে এসেছে। তাদের বর্তমান বয়ানে স্পষ্ট, এই বিপর্যয় একদিনে ঘটেনি। বাঁধ নির্মাণের সময় থেকে তিস্তার দুই পারের জনজীবন, বন-প্রকৃতি বিপর্যস্ত। বিগত ২০ বছরে বার বার ঘনিয়ে এসেছে বিপর্যয়। ৩ ও ৪ অক্টোবরের ভয়াবহ বিপর্যয় অপেক্ষা করেই ছিল। সংগঠনগুলির ভাষায়— সব কিসিমের, সব দলের মন্ত্রী, রাজনীতিক, নির্মাণ সংস্থা, ঠিকাদার, এনএইচপিসি-র মতো সংস্থাগুলির বর্বর লোভ এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। এই বিপর্যয় রাজনীতিক ও মুনাফাবাজ মানুষের তৈরি।
আমরা সংগঠনগুলির দাবিদাওয়া সম্বলিত প্রেস বিবৃতিটির পূর্ণ বয়ান এখানে তুলে দিলাম।
তিস্তা বিপর্যয়ের জন্য দায়ী কে?
আসুন প্রশ্ন করি পরিবেশ ও জীবন-জীবিকা ধ্বংসকারী অপ-উন্নয়নকে
‘উন্নয়ন’ শব্দটি ইদানীং ঐশ্বরিক, প্রশ্নাতীত। উন্নয়নের নামে যা ইচ্ছে করা যায়। যা হচ্ছে, তার ফল কী দাঁড়াবে, এ নিয়ে কথা ওঠানো সরকারের চোখে দেশবিরোধিতার নামান্তর। ফলে, পরিবেশের ক্ষতি, নিসর্গ ধ্বংস হয়ে যাওয়া, স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকা বিপর্যস্ত হয়ে পড়া, উচ্ছেদ-অত্যাচার-মিথ্যাভাষণ-মিথ্যাভাষণ, সবই গা সওয়া হয়ে যায়। খুব বড় ধরনের বিপর্যয় না ঘটলে খবরও তৈরি হয় না। খবর যখন তৈরি হয়, বিপর্যয় ঘটেই গেছে, প্রতিকারের অবকাশ নেই বললেই চলে। যেমন, তিস্তা উপত্যকা জুড়ে গত কয়েক দিনে যে বিপর্যয় নেমে এসেছে, তার ফলে মোট ক্ষতির পরিমাণ এখনও নির্ধারিত হয়নি। কত মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, কত বাড়ি ধসে পড়েছে ও ভেসে গেছে তার হিসেব নেই। তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে সিকিমে চুংথাং এলাকার জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বিধ্বস্ত। ১০ নম্বর রাষ্ট্রীয় সড়ক ভেঙে নদীতে পড়ে গেছে। যে মানুষেরা ঘরবাড়ি ছেড়ে ত্রাণশিবিরে বাস করছেন, তাঁরা কবে কীভাবে নিজের ঘরে ফিরবেন জানা নেই। বহু ক্ষেত্রে ঘরই নেই।
এই বিপর্যয় প্রত্যাশিতই ছিল। বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে যে জলবায়ু বদল, তার অভিঘাতে সমগ্র হিমালয়ের তুষার এলাকা হ্রাস পাচ্ছে, হিমবাহ ক্রমশ ছোট হচ্ছে। হিমবাহের বরফ গলা জলের যে হ্রদ, তার জলের পরিমাণও নিরবচ্ছিন্ন বরফ গলার জন্য বেড়েই যাচ্ছে। ফলে, হিমবাহ হ্রদের দেয়াল জলের চাপে ভেঙে পড়ে বন্যা হতে পারে, সে বিপদ থেকেই যাচ্ছে। দেশের সরকার এই তথ্য জানেন। দেশের রাজ্য সরকাগুলিও জানেন। হিমবাহ হ্রদ ভাঙা বন্যা বা glacial lake outburst flood (GLOF)-র সম্ভাব্য, হয়তো বা অনিবার্য বিপদের কথা বিন্দুমাত্র স্মরণে না রেখে, হিমালয়ের নদী উপত্যকাগুলিতে বড় বড় নির্মাণ প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। উত্তরাখণ্ড থেকে কাশ্মীর হয়ে হিমাচল প্রদেশ, একের পর এক নদী উপত্যকা আচমকা বন্যায় ভেসেছে গত দশ বছরে। তিস্তা উপত্যকায় এ ঘটনা ঘটবেই, একথা এলাকার একাধিক গণ সংগঠন ও সংস্থা গত দু’দশক ধরে বলে আসছে। সেসবে কর্ণপাত না করে, একের পর এক বড় বাঁধ বানানো হয়েছে, পাহাড় কেটে রাস্তা বানানো ও চওড়া করা হচ্ছে। নতুন রেললাইন বসানো হয়েছে। বিপর্যয় যখন ঘটল, এই সব প্রকল্পের বেশির ভাগকেই চূড়ান্ত আর্থিক ক্ষতির সামনে পড়তে হল, কিছু কিছু প্রকল্প আর চালু করা যাবে কিনা সন্দেহ। তিস্তা উপত্যকায় বেশ কয়েকটি এলাকা ক্রমাগত বসে যাচ্ছে, মাটির তলা দিয়ে জলের স্রোত বইছে। সংলগ্ন পাহাড়ি ঢালে চিড় ও ফাটল দেখা দিচ্ছে, মাটিপাথর সরছে, পুরো পাহাড় ধসে পড়বে দেখা দিচ্ছে এমন সম্ভাবনাও।
বহু আগে থেকেই স্থানীয় মানুষ এবং পরিবেশকর্মীরা বারবার বলেছেন, হিমালয়ের মতো নবীন পাহাড়ে যথেচ্ছ নির্মাণের ফল ভয়ঙ্কর হতে পারে। কর্ণপাত না করে একের পর এক নদীতে বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প করা হয়েছে, পাহাড় ফাটিয়ে বিশাল রাস্তা বানানো চলছে, এবং সম্প্রতি পাহাড়ি ঢালে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে রেলপথ তৈরি হচ্ছে। ২০১৩-র পরেও একাধিক বন্যা হয়েছে ওই এলাকায়, নিয়মিত ধস নেমেছে, পাহাড়ের পর পাহাড়ে চিড় বা ফাটল ধরেছে। বড় উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলেছে স্বভাব-ভঙ্গুর ঢালে তথাকথিত নগরায়ন ও পর্যটন-বিকাশের কাজ, কোন জমিতে বা কোন ঢালে কি ধরণের নির্মাণ করা যায় তার তোয়াক্কা না করে বহুতল হোটেল, মল ও ফ্ল্যাটবাড়ি উঠছেই। গোটা পাহাড় খুঁড়ে খুঁড়ে ফাঁপা করে ফেলা হয়েছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যথেচ্ছ এবং প্রায়শই অবৈধ ঘরবাড়ি তোলা।
গত প্রায় দু-তিন দশক ধরে পশ্চিমবঙ্গ ও সিকিমের বিভিন্ন এলাকায় নদীর স্বাভাবিক চলাচলের পথ আটকে নানান জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে উঠেছে, আরও প্রকল্পের কাজ চলছে। যেখানে সেখানে নদীকে আটকে রাখার মানে তাকে একরকম মেরে ফেলাই—নদীগর্ভ এখন উঁচু হয়ে ওঠে বা নদীর জলস্তর কমে বাড়ে প্রাকৃতিক কারণে নয়, কোন বাঁধে কতক্ষণ কি পরিমাণ জল ধরে রাখা হচ্ছে, কতটা পলি পড়ছে, সেই অনুযায়ী। নদী-লাগোয়া ভূভাগে বসবাসকারী মানুষেরা চিরকাল লড়ে আসছেন নদীর খামখেয়ালিপনার সঙ্গে। কোন নদী কখন খাত বদলাবে আর পাড় ভাঙবে তার স্থিরতা নেই। তিস্তা উপত্যকার ক্ষেত্রে এখন তার সঙ্গে যোগ হয়েছে নদীর উজানে তৈরি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ও গজলডোবার সেচবাঁধ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। হিমালয়ে বর্ষার গতিপ্রকৃতি বদলে যাচ্ছে দ্রুত। কী পাহাড়ে কী সমতলে, তিস্তাপাড়ের মানুষেরা দিন কাটাচ্ছেন চির-অনিশ্চয়তায়। বৃষ্টি কত হল, জল কতটা বাড়ল? তার চাইতেও বড় কথা, কোন বাঁধ থেকে কত জল ছাড়া হল? কবে, কখন নদী ধেয়ে আসছে উন্মত্ত জলকল্লোলে, টেনে নিচ্ছে ঘরবাড়ি চাষজমি পাহাড় জঙ্গল? অথবা, নিঃশব্দে মাটি ভেঙে ভেঙে গোটা পাড়া, মহল্লা, গ্রাম তলিয়ে যাচ্ছে নদীগর্ভে?
যে যে জায়গায় তিস্তা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ হয়েছে, ঠিক সেই সেই জায়গায় প্রতি বছর নিয়ম করে ধস নামছে। ২৫ কিলোমিটার এলাকায় কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্থা এনএইচপিসি-র দু’টি প্রকল্পের কাজ শেষ, আরও তিনটি প্রস্তাবিত। বাঁধ বা তজ্জনিত নির্মাণকাজ শুরু হবার আগে থেকেই কালিম্পং কী সিকিম যাবার রাস্তার আশেপাশের পাহাড় ছিল ভঙ্গুর, ধস নামাটা প্রতি বর্ষায় নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বাঁধ দেবার পর, অর্থাৎ পাহাড় ফাটিয়ে নির্মাণ শুরু হবার পর থেকেই, ধসের ঘটনা বেড়ে গেছে বহুগুণ। কালিঝোরায় এনএচপিসির প্রথম বাঁধ, অর্থাৎ তিস্তা নিচু বাঁধ প্রকল্প-৪ থেকে দ্বিতীয় বাঁধ, অর্থাৎ ২৭ মাইলে তিস্তা নিচু বাঁধ প্রকল্প-৩ পর্যন্ত রাস্তায় অন্তত ১৬-২০ টা ধস, যার ১০টা নতুন, ২০০৪-এ বাঁধ বানানো শুরু হবার পর থেকে তৈরি। একাধিক জায়গায়, পুরো পাহাড় ধসে পড়ছে, পাথরের দেয়াল তুলে কোনওক্রমে তা ঠেকানোর চেষ্টা চলছে, যেমন তিস্তা নিচু বাঁধ প্রকল্প-৩-এর ঠিক সামনের পাহাড়টায়। বাঁধের আশেপাশের খাড়া পাহাড়ে যে গ্রামগুলো, যথা ২৭ মাইলের উপরে দেওরালি, কী কালিঝোরার উপরে কারমাট, সেখানেও বাঁধ বানানো আর রাস্তা চওড়া করার জন্য ডিনামাইট ফাটানোয় ঘরের দেয়াল ফাটছে, পাহাড়ে নতুন করে ফাটল ধরছে। ২৭ মাইল থেকে তিস্তা নিচু বাঁধ প্রকল্প-৩-এর জন্য তিস্তা অবরুদ্ধ, জলাধারে প্রতি বৃষ্টিতে জলের পরিমাণ বাড়ছে। ২৯ মাইল বস্তির নীচেই ধাক্কা মারছে জল, যে কোনও দিন ২৯ মাইল আর তার পরের গেইলখোলা বস্তি সমেত জাতীয় সড়ক ৩১-এ নদীতে চলে যাবে। অনেকটা ইতিমধ্যেই গিয়েছে।
২৭ মাইল থেকে তিস্তাবাজার অবধি রাস্তায় বাড়ি করে আছেনই প্রায় ৩৫০ পরিবার, ২৭ মাইল বাঁধের নীচেই আছে রিয়াং বস্তি, সেখানে আরো ৮০টি। সেভক থেকে কালিঝোরা হয়ে তিস্তাবাজার মল্লি রংপো পর্যন্ত রাস্তার ধারে ও দুপাশের পাহাড়ে আছেন বেশ কয়েক হাজার পরিবার। আরও বেশি বৃষ্টি হলে, এবার যেমন হল, ওপর থেকে জল নামলে এবং ২৭ মাইল এবং কালিঝোরা জলাধারে জল বাড়লে, যে কোনও।দিন এই মানুষেরা পাহাড়চাপা পড়ে মরবেন, বা ভেসে যাবেন। এই মানুষদের কী হবে? কী হবে পাহাড় আর নদীখাতের ঘন জঙ্গলের বাসিন্দা পশুপাখীউদ্ভিদের?
তিস্তা নিচু বাঁধ প্রকল্প ৩ ও ৪ এর ইআইএ প্রতিবেদনে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাঁধ তৈরি হচ্ছে ভূমিকম্পপ্রবণ ভঙ্গুর পাহাড়ে, যেখানে এ জাতীয় বড় নির্মাণকাজ ভয়ঙ্কর বিপদ ডেকে আনতে পারে, পাহাড় ফাটানো ও রাস্তা তৈরিতে বাড়তে পারে ধসের বিপদ, পুরোনো ঘুমন্ত ধস আবার জেগে উঠতে পারে, সৃষ্টি হতে পারে নতুন ধসেরও। এই ইআইএ-র অংশ হিসেবে ভূতাত্বিক সমীক্ষার কাজটি করেন ভারত সরকারের ভূতত্ব সর্বেক্ষণের পূর্ব অঞ্চল শাখা, তাঁদের প্রতিবেদনে ধসের বিপদ নিয়ে বিস্তারিত বলা হয়। ভূতাত্বিক প্রতিবেদনটি ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় বাঁধ বানানো নিয়েও সতর্কবাণী দেয়, বলে, নদীতে বাঁধ দিয়ে যে জলাধার তৈরি হবে তা দুপাশের পাহাড়কে আরও নড়বড়ে করে তুলবে, কেননা জমা জল দীর্ঘদিন ধরে মাটির ছিদ্র দিয়ে ছিদ্রবহুল (porous)। পাহাড়ি ঢালের মধ্যে চারিয়ে যাবে। ঠিক তাইই ঘটছে, পাহাড়ে জল ঢুকে পাহাড় ভাঙছে, ফলে ১০ নম্বর মহাসড়ক এবং নদীর উজানে অন্যান্য রাস্তাও ভাঙছে।
গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো, সেভক থেকে সিকিম সীমান্তের রংপো পর্যন্ত ব্রডগেজ রেলপথ বানানোর কাজ শুরু হয়েছে। বাঁধ বানানো, জলাধার তৈরি, এসবের সঙ্গে সঙ্গে রেলপথ নির্মাণের প্রয়োজনে পাহাড় খোঁড়া যদি চলতেই থাকে, ভঙ্গুর পাহাড়ের দশা কী হতে পারে ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। রেল কর্তৃপক্ষ বলছেন, মাটির অনেক গভীর দিয়ে তারা সুড়ঙ্গ খুঁড়ছেন, ওপরে কিছু হবে না। এ কথার মানে তো হয়ই না, বৈজ্ঞানিক যুক্তিও নেই। যেখানে যেখানে সুড়ঙ্গ খোঁড়া হচ্ছে সে এলাকার পাহাড় বৃক্ষশূন্য, নতুন ফাটল দেখা দিচ্ছে ঢাল জুড়ে। নতুন ধসও নামছে। পাহাড় বসে যাচ্ছে একাধিক এলাকায়। এ ছাড়া, ৪০ কিমি সুড়ঙ্গ খুঁড়ে যে মাটি-পাথর বেরুচ্ছে সেগুলো পড়ছে গিয়ে নদীতে, যে নদী বাঁধের জন্য এমনিতেই আর বইছে না।
তথাকথিত উন্নয়নের নামে বড় বড় নির্মাণ কাজের মাধ্যমে উত্তরবঙ্গের আর সিকিমের পাহাড়কে তছনছ করা হচ্ছে। ২০১৫-র ধসে অন্তত চল্লিশ জন মানুষ প্রাণ হারান, সম্পত্তির ক্ষতিও প্রচুর। পরের বছরগুলোতেও একের পর এক ধসের ঘটনা ঘটছে। দার্জিলিং কার্শিয়াং, কালিম্পং, মিরিক, সোনাদা শহরাঞ্চল-সহ প্রায় সমস্ত জনবসতি বেআইনি কংক্রিটের জঙ্গলে ঢেকে গেছে।
সিকিমেও ১২০০ মেগাওয়াটের তিস্তা ৩ আর ৫০০ মেগাওয়াটের তিস্তা ৬ প্রকল্পগুলি দীর্ঘদিন যাবত আটকে আছে, মূলত অঞ্চলের মানুষের প্রতিরোধের কারণে। সেভক-রংপো রেলপথের কাজে ছাড়পত্র দিতে রাজি হননি উত্তরবঙ্গে তিস্তা এলাকার বাসিন্দারা, কেননা এলাকার বনভূমি নদীপ্রকৃতির ওপর তাঁদের আইনি অধিকার এখনও সরকারি স্বীকৃতি পায়নি। সেই ছাড়পত্র ছাড়াই, প্রকল্পের কাজ এখন শেষের মুখে।
বারবার বলা হয়েছে হিমালয়ের এই এলাকায় তথা উত্তরবঙ্গের ভূ-প্রাকৃতিক গঠন ও পরিবেশ কংক্রিটের বহুতল নির্মান বা বড় জলবিদ্যুৎ ও রেল প্রকল্পজনিত নির্মাণ ধারণ করার মত শক্তিশালী নয়। পাহাড়ি ঢালগুলোতে সুড়ঙ্গ খোঁড়া এবং রাস্তা চওড়া করা ভূমি ও বন-জঙ্গলের ক্ষতি না করে সম্ভব নয়। একইরকম ভাবে যেখানে সেখানে নদীর গতিপথকে আটকে বাঁধ দেওয়ার অর্থ তাকে অস্বাভাবিক করে তোলা। এতে ভূমিক্ষয় এতটাই বেড়ে যায়, নদীবক্ষ ভরাট ও উঁচু হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে আজ হিমালয়-সংলগ্ন উত্তরবঙ্গে যাবতীয় উন্নয়ন প্রকল্পগুলির বিশদ নিরপেক্ষ পর্যালোচনার প্রয়োজন। প্রয়োজন আন্তঃরাজ্য, (যেমন পশ্চিমবঙ্গ, সিকিম) এবং আন্তর্জাতিক (যেমন ভুটান, বাংলাদেশ, নেপাল) এই বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতকেও এই পর্যালোচনার আওতায় রাখা, সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে কথাবার্তা চালানো।
আমাদের সরকারগুলো, সরকারি সংস্থারা এ সব নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখাচ্ছে না। উত্তরাখণ্ডে, হিমাচলপ্রদেশে বা জম্বু-কাশ্মীরে ভয়াবহ বিপর্যয়ের ঘটনাবলিকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার জিটিএ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সংস্থা এনএইচপিসি তিস্তার বুকে আরও বাঁধ তৈরি করতে উদ্যোগী। ভুটানেও এই কাজ হচ্ছে। নতুন নতুন প্রকল্পের কথা শোনা যাচ্ছে। এসব চলছে ইতিমধ্যেই চিহ্নিত ভূকম্পপ্রবন এলাকায়। ভেঙে যাওয়া, নষ্ট হয়ে যাওয়া ১০ নম্বর সড়ককে বাড়িয়ে ফোর লেন করা হবে, সরকারি তরফে এ কথা ইতিমধ্যেই বিজ্ঞাপিত।
যখন সরকার অপারগ, তখন জনসাধারণকেই বিশেষ উদ্যোগ নিতে হয়। আমাদের সবার দায়িত্ব, রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারকে, পাহাড়ের গোর্খা আঞ্চলিক প্রশাসন (জিটিএ)-কে আলোচনায় বসতে বাধ্য করা। বিপর্যয় এলে কী হবে সেই আলোচনার চাইতে অনেক বেশি জরুরি বিপর্যয় আটকানো, যে যে কারণে বিপর্যয় ঘটতে পারে, ঘটছে, তার প্রতিকার।
নদী,পাহাড়,বনময় উত্তরবঙ্গে কী সিকিমে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বিপদ, কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে জনমত গড়ে তুলতে, পরিবেশসম্মত, দীর্ঘমেয়াদী এবং বৈষম্যহীন উন্নয়নের মডেল নিয়ে পারস্পরিক মত বিনিময় শুরু হোক, প্রয়োজনে গণ-আন্দোলন।
আলোচনার সূত্রপাত ঘটানোর জন্য আপাতত কিছু দাবিকে সামনে রাখছি:
প্রথম দাবি, বর্তমান বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সমস্ত পরিবারকে উপযুক্ত পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এছাড়া,
১) দার্জিলিং ও সিকিম হিমালয়ে সবরকমের নির্মীয়মাণ ও প্রস্তাবিত মাঝারি ও বড় বাঁধের কাজ বন্ধ করতে হবে। তৎসহ ভবিষ্যতে সমতলেও চালু, নির্মীয়মাণ বা তৈরি হতে চলেছে এমন যাবতীয় নদীবাঁধ প্রকল্পকে, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন নিরপেক্ষ কমিটি দ্বারা পুনর্বিবেচনা করতে হবে। নির্মাণ কাজে সব ধরনের বিষ্ফোরক ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। ভঙ্গুর পাহাড়ি ঢালে সুড়ঙ্গ খুঁড়তে দেওয়া যাবে না। ভূ-প্রকৃতিগত ভাবে অস্থির এলাকায় কোনও রকম নতুন বড় বাড়িঘর তৈরির অনুমতি দেওয়া চলবে না।
২) ভবিষ্যতে অতি বর্ষনের সম্ভাবনায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে, বৃষ্টি-পরিমাপক (Rain Gauge) যন্ত্র বসাতে হবে এলাকা জুড়ে।
৩) প্রত্যেক নদী বাস্তুতন্ত্রের প্রকৃত জলধারণ ক্ষমতা নির্নয় করতে হবে।
৪) লালটং থেকে চুঙথাং এবং মেল্লি থেকে রঙ্গিতের উর্ধ্বস্রোতা অবধি এলাকাকে সংবেদনশীল বাস্তুতান্ত্রিক এলাকা (Eco Sensitive Zone) ঘোষণা করতে হবে।
৫) নদী এলাকায় নিয়ন্ত্রন বিধি চালু করতে হবে, যেমন নদীর পাড় থেকে ১০০ মিটার এলাকায় স্থায়ী নির্মাণ করা চলবে না।
৬) স্থানীয় মানুষ ও গণসংগঠনের সঙ্গে এলাকার উন্নয়ন, জলবায়ুর পরিবর্তন, স্থানীয় অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন এবং সম্ভাব্য কর্মসংস্থান সম্পর্কে আলোচনার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
৭) গ্রামসভার মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব বনের সৃষ্টি করতে হবে যাতে দেশজ বৃক্ষ রোপন করা যায়। উত্তরবঙ্গের ২৫০-র বেশি বনগ্রামের গ্রামসভা এ ধরনের কাজে যথেষ্ঠ অভিজ্ঞ।
৮) বিপজ্জনক পাহাড়ি ঢাল এবং নদীপাড় রক্ষায় প্রয়োজনীয় ভূতত্বসম্মত প্রযুক্তি গ্রহণ করতে হবে।
মায়ালমিত লেপচা, অ্যাফেক্টটেড সিটিজেনস ফর তিস্তা (অ্যাক্ট)
সৌমিত্র ঘোষ, উত্তরবঙ্গ বন-জন শ্রমজীবী মঞ্চ ও নেসপন
জ্যোতি পাল, শিলিগুড়ি ওয়েলফেয়ার অঅর্গানাইজেশন
লীলাকুমার গুরুং, হিমালয়ান ফরেস্ট ভিলেজার্স অর্গানাইজেশন।
প্রকৃতিকে হত্যার তীব্র প্রতিবাদ জানাই। এই অমানবিক কাজ কর্ম অবিলম্বে বন্ধ হোক।