১৯ লক্ষ লোকের নাম চূড়ান্ত এনআরসি থেকে বাদ পড়ে। চার বছরের পরও সেই ১৯ লক্ষ লোক বাদ পড়ার কারণই জানতে পারেননি। সম্পূর্ণ বেআইনি ভাবে নাম বাদ পড়ার আদেশের প্রত্যয়িত নকল দেওয়া হচ্ছে না। এমনকি মৌখিকভাবেও কারণ জানানো হয়নি। লিখছেন শিশির দে।
এটা সবার জানা যে ২০১৯ সালের ৩১ অগস্ট অসমে বহু আলোচিত এনআরসি-র চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। প্রশ্ন হল কে, কার নির্দেশে, কী প্রক্রিয়ায়, কোন আইনের বিধান অনুযায়ী অসমের জন্য জাতীয় নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুত এবং প্রকাশ করলেন? প্রশ্নগুলো সহজ, উত্তরও জানা। কিন্তু আরোপিত ধারণা ও বিভ্রান্তিমূলক প্রচারের জন্য সহজ বিষয়টি ইতিমধ্যে আপাত জটিল আকার ধারণ করেছে। এক সহজ ব্যাখ্যা এখানে উপস্থাপিত করা হচ্ছে।
এনআরসি বা নাগরিকপঞ্জির আইনি ভিত্তি থেকে শুরু করা যাক। ভারতের সংবিধানে নাগরিকপঞ্জির কোনও উল্লেখ নেই এবং নাগরিকত্ব আইনেও ২০০৩ এর আগে এনআরসি-র উল্লেখ ছিল না। তবুও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক নির্দেশনা অনুযায়ী ১৯৫১ সালের লোকগণনার তথ্যের ভিত্তিতে জনগণের তথ্য গ্রাম ভিত্তিক নথিভুক্ত করে অসমে এক নাগরিকপঞ্জি প্রস্তুত করা হয়েছিল। সেই নথি প্রথমে অসামরিক প্রশাসনের কাছে ছিল এবং পরবর্তীতে ১৯৫১- এর এনআরসি-র নথি পুলিশ প্রশাসনের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই ১৯৫১-র নাগরিকপঞ্জির যেমন কোনও আইনি ভিত্তি ছিল না তেমনি সেটা কোনও পাবলিক ডকুমেন্টও নয়। এর কোনও প্রত্যয়িত নকল পাওয়া যায় না এমনকি জনগণের দেখার জন্য উন্মুক্ত নয়। সেন্সাস আইনের আওতায় সংগৃহীত তথ্য ব্যবহার করায় ১৯৫১-র এনআরসি-র তথ্য আদালতে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য ছিল না। যেহেতু সেই এনআরসি-র আইনি ভিত্তি নেই, তাই বর্তমান এনআরসি-র ১৯৫১-র এনআরসি-র নবায়ন বা উন্নীতকরণ নয়, নতুনভাবে এনআরসি প্রস্তুতকরণ। ১৯৫১-র এনআরসি সংগ্রহ করে ডিজিটালাইজ করে অনলাইনে পাবলিশ করা হয় বর্তমান প্রক্রিয়ায় এবং সেই সঙ্গে ১৯৫১-র এনআরসি পাবলিক ডকুমেন্টের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত ও গ্রহণযোগ্য হয়।
অসম আন্দোলনের শেষে অসমচুক্তি হয় এবং সেই অনুযায়ী নাগরিকত্ব আইনে অসমের জন্য অতিরিক্ত ধারা ৬ক ১৯৮৫ সালে যোগ হয়েছে। কিন্তু তখনও এনআরসি-র প্রসঙ্গে কিছু বলা হয়নি। “অসম চুক্তির ভিত্তিতে এনআরসি হচ্ছে”, কথাটা এক ডাহা মিথ্যা ছাড়া অন্য কিছু নয়। অসম চুক্তিতে এনআরসি-র কোনও ধরনের উল্লেখ নেই। এনআরসি-র আইনি সূত্রপাত ২০০৩ সালে বাজপেয়ী নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারের আমলে। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০০৩-এর মাধ্যমে ধারা ১৪ক নাগরিকত্ব আইনের অন্তর্ভুক্ত করা হয় যেটা হলো এনআরসির আইনি ভিত্তি। ২০০৩-এর এই একই সংশোধনীর মাধ্যমে জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের বিধান-সহ আবেদন করে নাগরিকত্বের বিধানকেও সংকুচিত করা হয়। শুধুমাত্র তাই নয়, বিদেশি আইন থাকা সত্ত্বেও নাগরিকত্ব আইনের আওতায় ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ সংজ্ঞায়িত করা হয় এবং তাদের নাগরিকত্বের জন্য আবেদনেরও অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। বর্তমান মোদি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার ধর্মের ভিত্তিতে একাংশ অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের নাগরিকত্বের জন্য আবেদনের সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে নাগরিকত্ব দেওয়ার লক্ষ্যে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯ তৈরি করেছে যদিও, প্রয়োজনীয় নিয়মাবলি প্রস্তুত করা হয়নি।
মূল কথায় ফিরে আসা যাক। ২০০৩ সালেই সারা দেশে এনআরসি প্রস্তুতকরণের জন্য নাগরিকত্ব বিধি ২০০৩ তৈরি করা হয়। এবারে অসমের জন্য আলাদাভাবে বিশেষ প্রক্রিয়ায় এনআরসি প্রস্তুতির জন্য দাবি জানাতে থাকে অসমের জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, সংগঠনের কর্তারা। ২০০৫ সালে মনমোহন সরকারের সাথে আসুর আলোচনাও হয়। ২০০৮ সালে অসমের জন্য বিশেষ প্রক্রিয়া সমন্বিত বিধি ৪ক সংযোজনের মাধ্যমে অসমের জন্য নাগরিকত্ব বিধি ২০০৩-এর বিধি ৪ -কে প্রতিস্থাপিত করা হয়। ৪ক-এর বিধি অনুযায়ী যাদের নাম ১৯৫১ সালের এনআরসি বা ২৫ মার্চ ১৯৭১-এর পূর্ববর্তী যেকোনও ভোটার তালিকায় রয়েছে তার এবং তার পরবর্তী বংশধরদের নাম এনআরসিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী সকল নাগরিকের নাম অন্তর্ভুক্তির কোনও প্রবিধান ছিল না। বর্তমানেও নাগরিকত্ব বিধিতে সেই প্রবিধান অন্তর্ভুক্ত হয়নি, কিন্তু অতিরিক্ত ১৩টি নথির মাধ্যমে নাগরিকত্ব প্রমাণের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। নাগরিকত্ব বিধি ২০০৩-এর অধীনে নাগরিকপঞ্জির মহাপঞ্জীয়কের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী অসমের দুটি রাজস্ব চক্রে (বড়পেটা ও ছয়গাঁও) এনআরসি-র পাইলট প্রজেক্টের কাজ শুরু হয় ২০১০ সালে। সঙ্গত কারণেই গণক্ষোভ দেখা দেয়। আমসুর নেতৃত্বে বিক্ষোভ মিছিল বের হয় বড়পেটা শহরে। পুলিশের গুলিতে নিহত হন চার শহিদ। পাইলট প্রজেক্টের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। অসম সরকারের এক ক্যাবিনেট সাব কমিটি কয়েক দফা সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সাথে আলোচনা করে এক মডালিটি তৈরি করে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পাঠায়। সেই মডালিটিতে ১৯৫১-এর নাগরিকপঞ্জি এবং ১৯৭১ পর্যন্ত ভোটার তালিকা ছাড়াও আরও ১৩টি নথিকে নাগরিকত্বের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহারের প্রস্তাব দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে অসম পাবলিক ওয়ার্কাস নামের বেসরকারি সংস্থা দ্রুত এনআরসি প্রস্তুত করার দাবিতে ২০০৯ সালেই সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছে। পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় সরকার অসম সরকারের তৈরি মডালিটি অনুমোদন করে এবং তা সুপ্রিম কোর্টে দাখিল করে। অবশেষে সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর অসম রাজ্যে এনআরসি প্রস্তুতির জন্য তিন বছরের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন এনআরসি-র রেজিস্ট্রার জেনারেল। অসম সরকার আইএএস আধিকারিক প্রতীক হাজেলাকে এনআরসি-র রাজ্য সমন্বয়ক হিসেবে মনোনীত করে। কেন্দ্রীয় সরকারও প্রতীক হাজেলাকেই অসমের জন্য ডিরেক্টর অব সেন্সাস হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়। ২০০৩-এর এনআরসি বিধি অনুযায়ী রাজ্যের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডিরেক্টর অব সেন্সাস সেই রাজ্যের জন্য নাগরিকপঞ্জির মহাপঞ্জীয়কের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করবেন। এ দিকে সুপ্রিম কোর্টও প্রতীক হাজেলাকে নোডাল অফিসার হিসেবে এনআরসি-র কাজ নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে চালিয়ে যেতে নির্দেশ দেয়। হাজেলাকে অতিরিক্ত নিরাপত্তা প্রদানের নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট। এনআরসি-র কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে বদলি করা যাবে না, এমনকি অতিরিক্ত রাজ্য সমন্বয়ক নিয়োগের মাধ্যমে হাজেলার কাজে কোনও ধরনের হস্তক্ষেপেও বাধা দেয় সুপ্রিম কোর্ট। প্রতীক হাজেলাকে সরাসরি সুপ্রিম কোর্টে রিপোর্ট দাখিলের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তিনি একাধারে রাজ্য সমন্বয়ক, আরজিআই- প্রতিনিধি ছাড়াও সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত এনআরসি-র নোডাল অফিসার হিসেবে চূড়ান্ত এনআরসি প্রকাশ করেছেন এবং তার পরেই তাঁকে বদলির আদেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট (তাঁর অনুরোধেই)।
২০১৪ থেকেই কাজ শুরু হয়েছে যদিও, ১ এপ্রিল ২০১৫-র ভিত্তিতে ৩১ অগস্ট ২০১৫ পর্যন্ত এনআরসির জন্য আবেদন পত্র জমা নেওয়া হয়। অনলাইনেও আবেদনের সুযোগ ছিল। আবেদন চলাকালীন মা–বাবার সঙ্গে সম্পর্কের প্রমাণের জন্য জন্মের প্রমাণপত্র, শিক্ষার প্রমাণপত্র বা অন্যান্য নথি না-থাকা, বিশেষত বিবাহিত মহিলাদের জন্য আবেদনের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়। এর সমাধানে রাজ্য সরকারের তরফে চক্র আধিকারিক বা বিডিও’র কাউন্টার সিগনেচার-সহ পঞ্চায়েত সার্টিফিকেট ইস্যু করার ব্যবস্থা করা হয়। ভেরিফিকেশন পর্যায়ে প্রত্যেক আবেদন পত্র দাখিলকারির কাছ থেকে বংশবৃক্ষের (ফ্যামিলি ট্রি) বিবরণ নির্দিষ্ট ফরম্যাটে চেয়ে নেওয়া হয়। এতে করে এক ব্যক্তিকে নিজেদের পূর্বপুরুষ বলে আবেদন করা ভিন্ন পরিবারের সদস্যদের ভুল বা কারচুপি ধরে ফেলা হয়। প্রক্রিয়াগত নানা জটিলতার কারণে নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ হচ্ছিল না। তাই সময়ে সময়ে নাগরিকপঞ্জির মহাপঞ্জীয়ক তার ৫ ডিসেম্বর ২০১৩’র নোটিফিকেশনের মেয়াদ বৃদ্ধি করে গেছেন। মোট আট বার মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে যার শেষ বিজ্ঞপ্তি (প্রকাশিত হয় ৩১ জুলাই ২০১৯) মারফত ৩১ অগস্ট ২০১৯ পর্যন্ত এনার্সির কাজ সম্পূর্ণ করার মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। ঐ বর্ধিত মেয়াদের শেষ দিনেই অসমে চূড়ান্ত এনার্সি প্রকাশিত হয়।
উল্লেখ্য যে, সুপ্রিম কোর্ট ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখের আদেশে চূড়ান্ত এনআরসি প্রকাশের সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছিল ৩১ জানুয়ারি ২০১৬। বাস্তবায়ন সংক্রান্ত অসুবিধার জন্য সুপ্রিম কোর্টও সময়ে সময়ে সেই তারিখ বৃদ্ধি করে গেছে। ২৩ জুলাই ২০১৯-এর আদেশে সুপ্রিম কোর্ট চূড়ান্ত এনআরসি প্রকাশের তারিখ শেষ বারের মতো বৃদ্ধি করে ৩১ অগস্ট ২০১৯ নির্ধারণ করে দেয়। ১৩ অগস্ট ২০১৯ এর আদেশে সুপ্রিম কোর্ট চূড়ান্ত এনার্সি প্রকাশের জন্য পরিবার/ এআরএন ভিত্তিক সকল আবেদনকারীর তথ্য শুধুমাত্র অনলাইনে প্রকাশের নির্দেশ দেয় এবং শুধুমাত্র অন্তর্ভুক্তির তালিকা সেবাকেন্দ্রে প্রিন্টেড কপি হিসেবে প্রকাশের নির্দেশ দেয়। সেই অনুযায়ী এনআরসি-র নোডাল অফিসার তথা রাজ্য সমন্বয়ক তথা মহাপঞ্জীয়কের প্রতিনিধি প্রতীক হাজেলা চূড়ান্ত এনআরসি প্রকাশ করেন। চূড়ান্ত এনআরসি অনলাইনে সরকারি ওয়েবসাইটে উপলব্ধ আছে। উক্ত ১৩ অগস্টের নির্দেশে এনআরসি-র তথ্য আধার তথ্য সুরক্ষা ব্যবস্থার মত সুরক্ষিত করতে হবে এবং তারপরই এনআরসি-র তথ্য মহাপঞ্জীয়ক, কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারকে হস্তান্তর করা যাবে নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই গুরুত্বপূর্ণ কাজ চার বছরের পর এখনও পর্যন্ত করা হয়নি অজ্ঞাত কারণে। এনআরসি ভোটার তালিকার মতো কোনও তালিকা হবে না, যা হবে তা আধারের মত, নিজেরটা শুধু নিজে দেখা যাবে।
চূড়ান্ত এনআরসি প্রকাশের আগে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭ সালে আংশিক খসড়া, ৩০ জুলাই ২০১৮ সালে সম্পূর্ণ খসড়া প্রকাশিত হয়েছে। সম্পূর্ণ খসড়া থেকে ৪০ লক্ষ লোকের নাম বাদ যায়। তাদের প্রত্যেককে এক মাসের মধ্যে নাম বাদ পড়ার সংক্ষিপ্ত কারণ লিখিতভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং সকলের দাবি-আপত্তি পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে গ্রহণ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ২৬ জুন ২০১৯ অতিরিক্ত খসড়া বাতিল তালিকা (Additional Draft Exclusion List) প্রকাশিত হয়। এতে বাদ পড়া লক্ষাধিক লোকদেরও পুনরাবেদনের এবং শুনানির সুযোগ দিয়ে চূড়ান্ত এনআরসি প্রকাশিত হয় এবং ১৯ লক্ষ লোকের নাম চূড়ান্ত এনআরসি থেকে বাদ পড়ে। চার বছরের পরও সেই ১৯ লক্ষ লোক বাদ পড়ার কারণই জানতে পারেননি। সম্পূর্ণ বেআইনি ভাবে নাম বাদ পড়ার আদেশের প্রত্যয়িত নকল দেওয়া হচ্ছে না। এমনকি মৌখিকভাবেও কারণ জানানো হয়নি।
চূড়ান্ত এনআরসি প্রকাশই এনআরসি প্রক্রিয়ার শেষ পর্যায় নয়। নাগরিকত্ব বিধি ২০০৩-এর বিধি ৪ক দ্বারা অন্তর্ভুক্ত তপশিলের ক্লজ ৭ অনুযায়ী চূড়ান্ত এনআরসি প্রকাশিত হয়েছে। ক্লজ ৮ অনুযায়ী চূড়ান্ত এনআরসি থেকে বাদ পড়া কোনও ব্যক্তি নাম বাদ পড়ার আদেশের বিরুদ্ধে বিদেশি আদালতে আপিল করতে পারেন উক্ত আদেশের ১২০ দিনের মধ্যে। সেই আপিলের নিষ্পত্তিতে আপিলকারীর নাগরিকত্ব প্রমাণিত হলে তার নাম চূড়ান্ত এনআরসিতে অন্তর্ভুক্ত হবে। সেই অনুযায়ী বিদেশি ন্যায়াধিকরণ অধিনিয়ম ১৯৬৪ বার দুয়েক (২০১৯ এর মে এবং অগস্ট মাসে) সংশোধন করে আপিল প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু নাম বাতিলের আদেশের নকল উপলব্ধ না করার ফলে নামহীন ব্যক্তিরা আপিল জমা দিতে পারেননি এখন পর্যন্ত। সেই নামহীনরা কার্যত ভাসমান নাগরিক হিসেবে রয়েছেন। চূড়ান্ত এনআরসি প্রকাশিত হওয়ার আগে অর্থাৎ ৩১ অগস্ট ২০১৯-এর আগে নাম বাতিলের আদেশ গৃহীত হলেও বিগত চার বছরের পরও সেই আদেশগুলোর কপি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রদান করা হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আরজিআইর বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী চূড়ান্ত এনআরসি প্রকাশিত হওয়ার পর সুপ্রিম কোর্ট সরাসরি মনিটরিং বাদ দিয়ে দিয়েছে এবং পরবর্তী আপিল প্রক্রিয়ার জন্য কোনও নির্দিষ্ট আদেশ দেয়নি। এটা ধরে নেওয়া হয়েছে যে পরবর্তী প্রক্রিয়া নিয়ম অনুযায়ী চলবে। এনআরসি কো-অর্ডিনেশন কমিটির একাধিক সভায় অবিলম্বে এনআরসি থেকে নাম বাদ পড়া ব্যক্তিদের রিজেকশন স্লিপ বা রিজেকশন অর্ডারের কপি প্রদানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যদিও, কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত কার্যকরী করা হয়নি অজ্ঞাত শক্তির অবৈধ অঙ্গুলি হেলনে। এমনকি এনআরসি-র তথ্য তথা নাগরিকদের জমা দেওয়া তথ্যাদি আধারের মত সুরক্ষিত করা হয়নি, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এনার্সির সাথে জড়িয়ে পড়েছে। নাগরিকত্ব আইন বা বিধি অনুযায়ী এনার্সির সঙ্গে আধারের কোনও যোগসূত্র নেই। কিন্তু ৩০ জুলাই ২০১৮ তারিখে সম্পূর্ণ খসড়া প্রকাশিত হওয়ার পর এক শুনানিতে দাবি-আপত্তি প্রসঙ্গে আলোচনার সময় কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে জানানো হয় যে তারা দাবি-আপত্তি নিষ্পত্তির জন্য এক এসওপি তৈরি করছেন। তখন সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দেয় যে সেই এসওপি প্রস্তুতকরণের সকল পর্যায়ে নোডাল অফিসার প্রতীক হাজেলাকে অন্তর্ভুক্ত রাখতে হবে। সেই অনুযায়ী এক এসওপি তৈরি করা হয় এবং আদালতে জমা করা হয়। কোনও পক্ষই কোনও ধরনের আপত্তি বা মতামত জানাননি আদালতে। সুপ্রিম কোর্টও কোনও ধরনের আলোচনা ছাড়া সেই এসওপির ভিত্তিতে দাবি-আপত্তি পর্যায় পরিচালনায় অনুমোদন দেয়। উক্ত এসওপির প্যারা ৯-এ বলা হয় যে দাবি-আপত্তি শুনানি পর্যায়ে প্রত্যেক দাবিদার এবং যার বিরুদ্ধে আপত্তি দাখিল করা হয়েছে তাদের সকলের বায়োমেট্রিক তথ্য রাজ্য সরকার আধার কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় সংগ্রহ করবে এবং প্রত্যেকের নামে আলাদা আইডি দেওয়া হবে; যাদের নাম এনআরসিতে অন্তর্ভুক্ত হবে তাদের রেগুলার আধার ইস্যু করা হবে। এনআরসির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য আইন এবং রুলে বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহের জন্য কোনও প্রবিধান না থাকা সত্ত্বেও রাজ্য সরকার এসওপির ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের দোহাই দিয়ে মোট ২৭ লক্ষাধিক লোকের (আনুমানিক অর্ধাংশের নাম চূড়ান্ত এনআরসিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে) বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহ করে আধার আটকে রেখে দেয়। চূড়ান্ত এনআরসি প্রকাশিত হয় ৩১ অগস্ট ২০১৯। কিন্তু আজ অবধি এসওপির প্যারা ৯ এর মর্মে অন্ততপক্ষে যাদের নাম চূড়ান্ত এনআরসিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তাদেরও আধার ইস্যু বেআইনি ভাবে আজ পর্যন্ত আটকে রেখেছে রাজ্য সরকার। এর জন্য সরাসরি দায়ী রাজ্য সরকার; অন্য কোনও কর্তৃপক্ষের এমনকি সুপ্রিম কোর্টেরও কোনও প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেই। প্রকাশিত এনআরসির অন্তর্ভুক্তির তালিকা এনএসকে, সার্কেল এবং জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে উপলব্ধ আছে। এছাড়াও অনলাইনে এআরএন ভিত্তিক এনআরসি উপলব্ধ আছে। রাজ্য সরকার জেলা প্রশাসকের কার্যালয় মারফত যেভাবে বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহ করেছিল, সেই ভাবে অন্তর্ভুক্ত লোকের নামে আধার কর্তৃপক্ষকে আধার ইস্যু করার নির্দেশ দিতে বাধ্য। সেটা কিন্তু বাস্তবে হয়নি।
আধার আটকে রাখার অজুহাত হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের দোহাই (ভাসা ভাসা ভাবে, নির্দিষ্ট কোনও নির্দেশের উল্লেখ ছাড়াই) দেওয়া মিডিয়ায় দেখা যায়। এছাড়াও প্রচারিত হয় যে এই এনআরসি নাকি চূড়ান্ত হয়নি; আরজিআই নাকি বিজ্ঞপ্তি জারি করেন নি; কেউ কেউ আরও এককদম এগিয়ে বলে রাজ্য সরকার এই এনআরসি গ্রহণ করেনি। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এবং তত্ত্বাবধানে যে এই চূড়ান্ত এনআরসি ৩১ অগস্ট ২০১৯ প্রকাশিত হয়েছে সেটা জানার জন্য সুপ্রিম কোর্টের এনআরসি সংক্রান্ত মূল কেসটির যার নম্বর WP(C) 274/2009 বিভিন্ন আদেশ দেখে নিতে পারেন, বিশেষত ১৭-১২-২০১৪, ২৩-০৭-২০১৯ এবং ১৩-০৮-২০১৯ এর আদেশ। আরজিআই পাইলট প্রোজেক্ট ছাড়া ০৫-১২-২০১৩ প্রথম অসম এনার্সির জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন যা পরবর্তীতে ৮ বার সংশোধন করা হয় এবং শেষ সংশোধিত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয় ৩১-০৭-২০১৯ তারিখে যার মাধ্যমে ৩১ আগস্ট ২০১৯ এনার্সির কাজের শেষ সীমা নির্ধারিত করা হয়। এনআরসি রুলের তপশিলের ক্লজ ৭ অনুযায়ী চূড়ান্ত এনআসি প্রকাশিত হওয়ার কথা যা হয়েছেও। অতিরিক্ত কোনও বিজ্ঞপ্তির কথা আসে কোথা থেকে! তদুপরি আরজিআইর বিধিবদ্ধ প্রতিনিধি প্রতীক হাজেলা আরজিআইর পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এবং এনআরসির আইন ও রুল অনুযায়ী চূড়ান্ত এনআরসি প্রকাশ করেছেন। এনআরসি তথা নাগরিকত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন বিষয়, এতে রাজ্য সরকারের বিশেষ কিছু বলার নেই। শুধু রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারই নয়, কোনও পক্ষই কখনও অসমে এনআরসি প্রস্তুতির বিরুদ্ধে কোনও আবেদন করেনি আদালতে। সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে সকল পক্ষের সহমতের ভিত্তিতে চূড়ান্ত এনআরসি প্রকাশিত হওয়ার পর সেই এনআরসি মানি না বলার কোনও সুযোগ নেই। সেটা আদালত অবমাননার সামিল হতে বাধ্য। সেইজন্যই এনআরসির শেষ পর্যায়ে এসে অবৈধভাবে আপিলের সুযোগ আটকে রাখলেও, বেআইনি ভাবে আধার আটকে রাখলেও এই এনআরসি মানি না, রিজেকশন স্লিপ দেওয়া হবে না, এরকম কোনও সিদ্ধান্ত কোনও কর্তৃপক্ষের তরফে নেই। পক্ষান্তরে এনআরসি কো-অর্ডিনেশন কমিটির সভায় একাধিক বার অবিলম্বে রিজেকশন স্লিপ প্রদানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এই নিবন্ধটি ১০.০৯.২০২৩ তারিখে আসামের বাংলা সংবাদপত্র ‘আজকের সাময়িক প্রসঙ্গ’-এ উত্তর সম্পাদকীয় নিবন্ধ হিসেবে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।
(লেখক একজন আইনজীবী এবং ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের প্রাক্তন সদস্য।)