সংগঠিত অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে এবং হাজার অভিযোগের পরও পুলিশ যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না, এমন এক ব্যক্তির বাড়ি চড়াও হয়ে এক গৃহস্থ মহিলা ও একজন সাংবাদিক তাকে শারীরিক হেনস্থা করল—এমন অভিযোগ কতদূর বিশ্বাসযোগ্য! এ প্রসঙ্গে পুরপ্রধান কল্যাণী ঘোষ দ্বর্থহীন ভাষায় বলেন, এটা আদৌ ‘বিশ্বাসযোগ্য’ নয়। দেবাশিস আইচের প্রতিবেদন।
বছরের পর বছর পাড়ার ভিতর চোলাইয়ের ঠেক চলার অভিযোগ। আরও অভিযোগ, পুলিশে নালিশ জানালে উল্টে আক্রান্ত হয়েছেন অভিযোগকারীরা। আর সেই খবর প্রকাশ হওয়ার পর, জনৈক সরস্বতী সিংয়ের এক অভিযোগের উপর ভিত্তি করে, আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক দেবমাল্য বাগচী এবং অন্যতম অভিযোগকারী বাসন্তী দাসকে গ্রেফতার করেছে খড়্গপুর টাউন থানার পুলিশ। উল্লেখ্য, এই সরস্বতীর বিরুদ্ধে বেআইনি মদ বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে ‘প্রতিহিংসা’র গন্ধ পাচ্ছে খড়্গপুরের নাগরিক ও সাংবাদিক মহল।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিবরণ অনুযায়ী, বিগত দু’বছরেরও বেশি সময় ধরে খড়্গপুর শহরের ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাঁজোয়ালের পটনা পাড়ায় সাতটি বাড়িতে চোলাই মদ তৈরি ও বিক্রির কারবার চলছে। স্থানীয় বাসিন্দারা দীর্ঘকাল নানা সময়ে পুলিশ, প্রশাসন, পুরপিতাদের কাছে অভিযোগ জানালেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সম্প্রতি পরিস্থিতি চরম আকার নিলে স্থানীয় মহিলারা টাউন থানায় লিখিত অভিযোগ জানায়। শনিবার ২৬ অগস্ট পুলিশ ওই এলাকার হানা দেয়। এই অভিযানে কয়েকজন মদ্যপকে আটক করা হলেও একজনও মদ কারবারিকে পুলিশ ধরতে পারেনি। পুলিশের দাবি, এই কারবারিরা পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে পালিয়ে গিয়েছে।
২৭ অগস্ট সন্ধে থেকে ওই দুষ্কৃতীরা অভিযোগকারী মহিলাদের বাড়ি বাড়ি চড়াও হয়ে হুমকি ও শাসানি দিতে থাকে বলে অভিযোগ। ধৃত অভিযোগকারী বাসন্তী দাস, যাঁর বাড়িতেও মদ কারবারিরা হামলা করে, ওইদিন আনন্দবাজারকে জানিয়েছিলেন, “ঘটনার সময় পুলিশকে বারবার ফোন করেছি। প্রায় এক ঘণ্টা পরে যখন পুলিশ এসেছে তখন অভিযোগকারীরা অভিযোগ প্রত্যাহার করার হুমকি দিয়ে চলে গিয়েছে। ওরা বলেছে এই কারবার বন্ধ করবে না।” এই ঘটনাতেও কোনও হামলাকারীকে পুলিশ গ্রেফতার করেনি। ওইদিনই প্রতিবাদকারীরা দলবদ্ধ ভাবে পুরপ্রধান কল্যাণী ঘোষের কাছে লিখিত অভিযোগ করে। পুরপ্রধান সংবাদপত্রটিকে জানান, “পাড়ার মধ্যে যারা এইসব কারবার চালাচ্ছে তারা অভিযোগকারীদের বাড়িতে হামলা করবে সেটা কাম্য নয়। পুলিশের দেখা উচিত।”
মদ কারবারিদের দেখা দূরে থাক এই ঘটনার এক সপ্তাহের মধ্যে ৬ সেপ্টেম্বর অন্যতম অভিযুক্ত সরস্বতী সিংয়ের অভিযোগের ভিত্তিতে ভোরবেলায় বাসন্তী দাসকে বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়। একটু বেলায় দেবমাল্যর বাড়ি ঘিরে ফেলে পুলিশ। প্রতিবেশী ও অন্যান্য সাংবাদিকরা প্রশ্ন তুললে পুলিশ দেবমাল্যকে থানায় দেখা করার কথা বলে চলে যায়। সেইমতো থানায় গেলে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়।
কী অভিযোগ সরস্বতী সিংয়ের? অভিযোগ, ২৭ অগস্ট সন্ধে সাড়ে ৭টা নাগাদ তিনি বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়েছিলেন। এই সময় পাশের বাড়ির বাসন্তী দাস ও সাংবাদিক দেবমাল্য বাগচী তাঁকে ‘ছোট জাত’, আদিবাসী’, বলে কটাক্ষ করেন। এবং তিনি প্রতিবাদ জানালে মারধর করা হয়, এবং তাঁর কাপড় টেনে ছিঁড়ে দেওয়া হয়। এই দু’জন তাঁর বিরুদ্ধে মদ তৈরি করেন বলে মিথ্যা অভিযোগ করেন। ২৮ অগস্ট সন্ধ্যায় টাউন থানা এই অভিযোগ গ্রহণ করে। এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৪১/ ৩২৩/ ৩৫৪বি/ ৫০৯/ ৩৪ ধারায় এবং তফসিলি জাতি ও জনজাতি (অত্যাচার প্রতিরোধ) আইনের ৩ (১) (আর) (এস) ধারায় মামলা রুজু করে।
উল্লেখযোগ্য যে ওই ২৭ অগস্ট পুলিশ প্রথম মদ কারবারিদের বাড়ি বাড়ি হানা দিয়েছিল। এবং পুলিশ জানিয়েছিল কোনও কারবারিকে তারা হাতেনাতে ধরতে পারেনি। অথচ, অভিযোগপত্রে পুলিশকে সরস্বতী সিং জানাচ্ছেন ওইদিন তিনি সন্ধ্যায় বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। এবং বাসন্তী ও দেবমাল্য তাঁকে গালমন্দ করে। ২৮ তারিখ সন্ধেবেলা সরস্বতীর অভিযোগ থানায় জমা পড়ে। আর সেদিনই মদ কারবারিদের বিরুদ্ধে বাড়ি বাড়ি হামলা চালানোর অভিযোগ ওঠে। অর্থাৎ, পুলিশি অভিযান চলছে, পালটা অভিযুক্ত মদ কারবারিরা বাড়ি বাড়ি হামলা করছে এবং এরই মধ্যে অন্যতম এক অভিযুক্ত তাঁকে হেনস্থার অভিযোগ লিখছেন এবং থানায় গিয়ে তা জমাও করছেন।
আরও প্রশ্ন উঠেছে যে, সংগঠিত অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে এবং হাজার অভিযোগের পরও পুলিশ যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না, এমন এক ব্যক্তির বাড়ি চড়াও হয়ে এক গৃহস্থ মহিলা ও একজন সাংবাদিক তাকে শারীরিক হেনস্থা করল—এমন অভিযোগ কতদূর বিশ্বাসযোগ্য! এ প্রসঙ্গে পুরপ্রধান কল্যাণী ঘোষ দ্বর্থহীন ভাষায় বলেন, এটা আদৌ ‘বিশ্বাসযোগ্য’ নয়। এবং এমন গুরুতর অভিযোগের পরও কেন পুলিশ এক সপ্তাহ বসে রইল? প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদও করল না। অভিযুক্তদের সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে হঠাৎ করে গ্রেফতার করা হল। এবং ওইদিনই মেদিনীপুর আদালতে হাজির করা হলে আদালত ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জেল হেফাজতের নির্দেশ দেয়।
স্থানীয় নাগরিক ও সাংবাদিক মহলের বক্তব্য, মদের কারবারিদের বিরুদ্ধে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার চিত্রটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়ে পড়ায়, পুলিশ প্রভাবশালী কোনও গোষ্ঠীর মদতে ‘প্রতিহিংসাবশত মিথ্যা মামলায়’ সাংবাদিক ও একজন প্রতিবাদকারীকে গ্রেফতার করেছে। তাঁদের সন্দেহ, সব ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর ঠান্ডা মাথায় ‘ব্যাকডেটে’ এই অভিযোগ পত্র লেখানো হয়েছে।
এই গ্রেফতারিকে নিন্দা করলেও প্রতিহিংসার তত্ত্বকে আমল দিতে রাজি নন পুরপ্রধান কল্যাণী ঘোষ বলেন, “এই গ্রেফতার নিন্দনীয়। অসামাজিক কাজ চললে সাংবাদিকেরা লিখবেই। পুলিশ অভিযোগ পেলে যায়। ব্যবস্থা নেয়। এটা প্রতিহিংসার ঘটনা মনে হয় না।” তবে কেন এই গ্রেফতার? এর পিছনে কি কোনও প্রভাবশালী মহলের চক্রান্ত রয়েছে। পুরপ্রধান জানান তিনি গ্রেফতারির বিষয়টা বুঝে উঠতে পারছেন না। রাজ্যের বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরও এই ঘটনায় পুলিশের ভূমিকার নিন্দা করেছে।
এই ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে কলকাতা প্রেস ক্লাব। প্রেস ক্লাব এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী এই বিষয়ে পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপারের কাছে ঘটনার খোঁজখবর নিয়েছেন। এবং ‘সংবেদনশীলতা’র সঙ্গে বিষয়টি বিবেচনা করার কথা দিয়েছেন। ইন্ডিয়ান জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন (বর্ধমান শাখা) আজ শুক্রবার বর্ধমান শহরে প্রতিবাদ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে। দেবমাল্য বাগচীর নি:শর্ত মুক্তির দাবি জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর।