ডেডলাইন বজায় রাখতে ঘোর বর্ষার মরশুমে, ঘন বনে ঢাকা দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় খরস্রোতা নদীর উপর সেতু নির্মাণের কাজে ছেদ দেয়নি ‘ব্রেথওয়েট বার্ন অ্যান্ড জেশপ কন্সট্রাকশন কোম্পানি’ বা বিবিজে। এই বর্ষায় জন্তু-জানোয়ার, সাপ-জোঁক, পোকামাকড় ভর্তি জঙ্গলে কেন যান কাজ করতে? সালেম বললেন, “কী বলব স্যার, পেটের দায়!” দেবাশিস আইচের প্রতিবেদন।
ফিরছেন সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া শ্রমিকরা। মিজোরামে ভয়াবহ রেলসেতু দুর্ঘটনায় মৃত স্বজন, সহকর্মী, বন্ধুদের নিয়ে। দুপুর একটা নাগাদ পুখুরিয়ার চৌদুয়ারের সালেম ফোন ধরতেই সাইরেনের তীব্র আওয়াজ ভেসে এল। সালেম জানালেন, প্রায় মিজোরাম পৌঁছে গিয়েছি। পুরো রাস্তা এভাবেই ফিরব। ১৮ জনের জন্য ১৮টা অ্যাম্বুলেন্স দিয়েছে। সামনে পুলিশের গাড়ি দিয়েছে। কাল সকালে পৌঁছে যাব মালদা। ১৮ জন কেন? ২৩ জন মারা গিয়েছেন বলে প্রশাসন জানিয়েছে যে। সালেম জানালেন, পাঁচ জন নিখোঁজ ছিলেন, খোঁজ চলছে।
বৃহস্পতিবার আইজলের জেলাশাসক নাজ়ুক কুমার সংবাদসংস্থাকে জানান, মোট ১৮ জনের দেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়াও তিন জনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। তাঁদের চিকিৎসা চলছে হাসপাতালে। এঁরা সকলেই মালদহের বাসিন্দা। তবে, দুর্গম এই অঞ্চলে আরও কেউ আটকে আছেন কি না তা খোঁজার কাজ চলছে বলেও তিনি জানান। সন্ধে ৭টা নাগাদ সালেম জানালেন, পাঁচ জন নিখোঁজ ছিলেন, এক জনকে পাওয়া যায়নি। জেসিবি আনার পর চার জনের খোঁজ মিলেছে। তাঁদের পোস্টমর্টেম হচ্ছে। তখন তাঁদের অ্যাম্বুল্যান্সের কনভয় প্রায় গুয়াহাটি ঢোকার মুখে। আগামিকাল সকাল ১০টা নাগাদ মালদহে ঢোকার কথা পরিযায়ী শ্রমিকদের লাশভরা কনভয়ের।
প্রায় দিন ৪০ দিন হল মিজোরামের বৈরবি ও সাইরাংয়ের মধ্যে রেলসেতু নির্মাণের কাজ করছিলেন এই শ্রমিকরা। এই পর্বে প্রথমে এসেছিলেন ১৪/১৫ জন তারপর বাকিরা। মোট ৩৪ জন। প্রত্যেকেই মালদহের। এর আগে একে একে পিলারের উপর ৭টি স্প্যান বসানো হয়ে গিয়েছিল। বুধবার এই যাত্রাপথের সবচেয়ে উঁচু, প্রায় ১০৪ মিটার উচ্চতার পিলারের উপর ইস্পাতের কাঠামোটি বসাতে গিয়ে ঘটে গেল চরম ঘটনাটি। কাঠামো-সহ ওই উচ্চতা থেকে আছড়ে পড়লেন শ্রমিকরা। মোট ২৫ জন ছিলেন। ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি দু’জন।
মালদহের পুখুরিয়া থানার চৌদুয়ার গ্রামের বাসিন্দা সালেম। আর এই চৌদুয়ার গ্রামেরই ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এবং ওই থানা এলাকার বিভিন্ন গ্রামের মৃতের সংখ্যা ১৬ জন। সে কথা উঠতেই সালেম জানালেন, এই থানার বাসিন্দারাই ব্রিজের কাজ বেশি করে। সেই জন্যই যাওয়া। বহরমপুরের এক ঠিকাদারের অধীনে সবাই কাজে গিয়েছিলেন। উত্তর-পূর্বের সবকটি রাজ্যকে রেলপথের আওতায় আনার জন্য পাহাড়-বন পেরিয়ে রেলসেতু, সুরঙ্গ তৈরির কাজ করছে ‘ব্রেথওয়েট বার্ন অ্যান্ড জেশপ কন্সট্রাকশন কোম্পানি’ বা বিবিজে। এ বছর ডিসেম্বর মাসের মধ্যে মিজোরামের রাজধানী আইজলকে রেল মানচিত্রে নিয়ে আসার সময় নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। ডেডলাইন বজায় রাখতে ঘোর বর্ষার মরশুমে, ঘন বনে ঢাকা দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় খরস্রোতা নদীর উপর সেতু নির্মাণের কাজে ছেদ দেয়নি বিবিজে। এই বর্ষায় জন্তু-জানোয়ার, সাপ-জোঁক, পোকামাকড় ভর্তি জঙ্গলে কেন যান কাজ করতে? সালেম বললেন, “কী বলব স্যার, পেটের দায়!”
ঠিকাদারের তস্য ঠিকাদারের মাধ্যমে আসা এই পরিযায়ী শ্রমিকদের মজুরি মাসিক ২০ থেকে ২৪ হাজার টাকা। থাকা সাইটের কাছে জঙ্গলের ধারে, পাহাড়ের কোলে টিনের অস্থায়ী ক্যাম্পে। খাওয়াদাওয়ার খরচ শ্রমিকদের নিজেদের। গ্রামে নিয়মিত কাজ নেই, জমিজমা নেই। দেশে কাজ মিললেও টানা ছ’আট মাস এমন বিশ-চব্বিশ হাজার টাকা মিলবেই বা কোথায়? তাই দলে দলে দেশান্তরী পুখুরিয়ার সালেম কিংবা ইংরেজবাজারের প্রতাপ সরকাররা।
এমনই রোজগারের টানে ইংরেজবাজার থানার সাত্তারি গ্রামের একই পরিবারের চার জন গিয়েছিলেন মিজোরামে। এঁরা হলেন ঝল্লু সরকার ও তাঁর ছেলে জয়ন্ত সরকার, রণজিৎ সরকার ও তাঁর ছেলে সুমন সরকার। পরিবারের এই চার জনকেই হারিয়েছেন সারথি সরকার। সম্পর্কে যথাক্রমে মৃতেরা হলেন তাঁর স্বামী, ছেলে, জামাই ও নাতি। বাড়ির রোজগেরে সকলকে হারিয়ে দিশেহারা সারথিদেবী। মৃত ঝল্লু সরকারের প্রতিবেশী প্রতাপ সরকার জানান, “জেঠু বলতাম।” আর কোনও কথা বলতে পারলেন না তিনি।
পুখুরিয়ার চৌদুয়ার গ্রামের একই পরিবারের ছ’জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃতেরা হলেন দুই খুড়তুতো ভাই সাইদুর রহমান (৩০) ও মোজাফফর আলি (৩০)। তাঁদের দুই ভাইপো ওয়াসিম শেখ (২০), সেবু শেখ (২০)। এবং সাইদুর রহমানের দুই ভাগ্নে আনসারুল শেখ (১৯) এবং মোশারফ শেখ (২০)।
মালদা জেলা প্রশাসন এই দুর্ঘটনায় মৃতদের যে তালিকা প্রকাশ করেছে তার মধ্যে রয়েছেন পুখুরিয়া থানার চৌদুয়ার গ্রামের সামিরুল হক, নাসিম রহমান, সেনাউল হক, মোজ্জামেল হক, সইদুর রহমান, মোজাফফর আলি, আসিম আলি, শাহিন আখতার, কাশিম শেখ, শফিকুল শেখ, সাকিরুল শেখ; এছাড়াও ওই পুখুরিয়া থানার কুতুবগঞ্জ গ্রামের আনসারুল হক ও কোকলামারির মণিরুল নাদাপ, নাগরাইয়ের রহিম শেখ, পরানপুরের মাসকেরুল ও সুলতানগঞ্জের নুরুল হকও এই দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন। ইংরেজবাজারের সাত্তারি গ্রামের ঝাল্লু সরকার, জয়ন্ত সরকার, রঞ্জিত সরকার, সুমন সরকার ও নব চৌধুরীর মৃত্য হয়েছে। তাছাড়া গাজোলের আলিনগর গ্রামের সেবুল হক এবং কালিয়াচকের মহম্মদ জাহিদুল শেখও এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৷
পড়ুন: মিজোরামে নির্মীয়মাণ সেতু ভেঙে মৃত বাংলার ২৩ শ্রমিক, মালদহের গ্রামে গ্রামে অকাল অমাবস্যা