একজন গণশিল্পী গণ আন্দোলনের ফসল—এই কথাটা একটা সময়ের বিশ্বাস—এই প্রেক্ষিতে গদরকে না দেখলে, গদর আন্নাকে চেনার রাস্তাটা ভুল হবে। গদর আন্না, আমার সময়ে এক বিপ্লবী গণশিল্পী তিন হাজার গান লিখে রাষ্ট্রের দেগে দেওয়া পাঁচটি বুলেটের একটি জীবনের শেষ পঁচিশ বছর মেরুদণ্ডে বয়ে নিয়ে ঘুমাতে গেলেন। লিখলেন অমিতাভ সেনগুপ্ত।
প্রিয় কমরেড গদর আন্না।
তেলেঙ্গানার অরুণদয় সংস্কৃতিকা মণ্ডলী’র কমরেড বিমলাক্কার সঙ্গে যদি দেখা হয়—যার গলার সুরে বসে আছো তুমি—আমরা কথা বলতে থাকব, তারপর চোখের জল লুকিয়ে সরে যাব। হাত মুঠো করে তুলে বিমলা ‘অরুণা পাথাকামা চে গুনমা রেড সাললুট… শ্রমজীবী কা তু প্রতীক তুঝকো হি রেড স্যালুট”
আমাদের বাংলায় মিডিয়া খবর করার মতো জরুরি মনে করেনি, দক্ষিণ ভারতের বিখ্যাত উর্দু কাগজ ‘সিয়াসত’ এর সম্পাদক জাহিরুদ্দিন আলি খান মারা গেলেন। ঠিক গদর মারা যাওয়ার পরের দিন। সাংবাদিক মহলে খুব জনপ্রিয় ছিলেন। কী অদ্ভুত ব্যাপার, জাহিরুদ্দিন সাহেব গদরের শেষ বয়সের সবচেয়ে কাছের মানুষদের মধ্যে একজন। গদর মারা যাওয়ার পর সারাদিন মরদেহের কাছ থেকে নড়েননি। শেষ যাত্রায় পুরোটা থেকে বাড়ি ফিরেছিলেন। তারপরই তাঁর পরিবারের লোক তাঁকে মৃত অবস্থায় দেখে। আমার কাছে বন্ধু বিচ্ছেদের শোকের ধাক্কাই এটা।
দু’দিন আগে অন্ধ্রপ্রদেশ সিভিল লিবার্টিজ কমিটির অন্যতম মুখ প্রফেসর জি হরগোপাল কলকাতায় এসেছিলেন, দেখা করে জিজ্ঞাসা করছিলাম গদরের কথা, কত কথা এল। গদরের প্রায় চার দশকের বন্ধু। বলছিলেন, “এক পুরনো স্বাধীনতা সংগ্রামী মোহনলাল কে চেনো নিশ্চয়ই, পদ্মভূষণ। মোহনলাল গদর সম্পর্কে সেদিন বলছিল, গান্ধী ছাড়া আমি আর একজন মানুষকে এই মাপের ক্রাউড পুলার হিসাবে মনে রাখতে পেরেছি, সে হলো গদর। তুলনাটায় আমি হেসে ফেলেছিলাম গান্ধী থেকে গদর—আপাত ভাবে দুই মেরুর, কিন্ত মানুষকে ছুঁতে পারার হিসেবে হয়তো মদনলাল সোজা সরল মনে ঠিকই বলেছেন।”
আমার সঙ্গে? দেখা হয়েছে অনেকবার। প্রথমবার দেখেছিলাম এআইএলআরসি (অল ইন্ডিয়া লিগ অফ রেভেল্যুশনারি কালচার)-র একটা প্রকাশ্য সমাবেশে।’ আগাডু আগাডু’ গাইতে গাইতে ঐ হঠাৎ হাতের লাঠি ঠুকে লাফিয়ে উঠে দমকা ‘হাআঃ’ সিংহ গর্জনে! তারপর সামনের অগুনতি মাথাকে দিয়ে গাইয়ে নেওয়া কল্লোল, “এই গ্রাম আমাদের ইয়ে দেশ হামারা!” তারপর নকশালবাড়ির ৩০ বছরে কলকাতায় শহিদ মিনারে। তারপর বোম্বেতে অল ইন্ডিয়া পিপলস রেজিস্ট্যান্স ফোরামের অধিবেশনে জেকেএলএফ-এর ইয়াসিন মালিক, আব্দুল গনি লোন, নর্মদার মেধাজি’দের সঙ্গে এক মঞ্চে। তারও পর ৯৭-এর এপ্রিলের ৬ তারিখ নিজের বাড়িতে গুলি খাওয়ার (‘গ্রে হাউন্ড এরই কাজ এটা’—গদর) কিছুদিন পর।
আবার, ২০০৪ ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরামের সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়ে মুম্বাই রেজিস্টান্স ফোরামের মঞ্চে। অল্প সময় একটুক্ষণ সিপিএন (এম) নেপাল-এর কভার অর্গানাইজেশনের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আর বদরুদ্দিন উমরের সঙ্গে যখন কথা বলছেন দাঁড়িয়ে। তারপর ২০০৪-এই আবার যখন রামকৃষ্ণরা বেরিয়ে এসে সরকারের সঙ্গে ‘পিস টক’-এ বসল। তার আগে চন্দ্রবাবু নাইডু সরকার হেরে গেল। সেবার অন্ধ্রের ভোটে পিডব্লু -র ‘নো ভোট টু চন্দ্রবাবু’ বিরাট প্রভাব ফেলেছিল। যুদ্ধ বিরতিতে নতুন কংগ্রেস সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী জনার্দন রেড্ডির সঙ্গে পিপলস ওয়ারের তরফে ভারভারা রাও, কল্যাণ রাও, গদর আর কনসার্নড সিটিজেন কমিটির তরফে কান্নাবিরান, বালাগোপাল, শঙ্করন-কথা চালাচ্ছিলেন। শেষ বার দেখেছি ‘অপারেশন গ্রিন হান্ট’ নিয়ে বলতে এসেছেন কলকাতায়।
বিপ্লবী গণসাংস্কৃতিক শিল্পী গদরকে আমি জিজ্ঞেস করে ফেলেও ছিলাম একবার—সেটা বোধ হয় নকশালবাড়ির ৩০ বছর ছিল— সম্ভজি ভগত আর জন নাট্য মণ্ডলী-র টিমটা আসেনি সঙ্গে। বারাসাতে কলোনি মোড়ে খোলা মঞ্চে ‘নিশান্তিকা’-র অল্পবয়সি বাঙালি ছেলেমেয়েদের দলটাকে একটা অদ্ভুত প্রফেশনালিজম দিয়ে ওই সামান্য রিহার্সালে তৈরি করে নিচ্ছিলেন নিজের সঙ্গে। জিজ্ঞেস করেছিলাম যে ‘একবার কোনও একটা মেইনস্ট্রিম তেলেগু সিনেমায় কাজ করার জন্য পার্টি আপনার সাথে দূরত্ব বাড়িয়েছিল’? ওখান থেকে কথাটা স্বচ্ছন্দে গড়িয়ে নিয়ে গেছিলেন, “জানো তো নিশ্চয়ই, পার্টি কে এস-কেও এক্সপেল করেছিল।” (কোন্ডাপল্লী সীতারামাইয়া অন্ধ্রে ১৯৮০তে সিপিআই এমএল (পিপলস ওয়ার)- এর মূল প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন, পরে বহিষ্কৃত হন মতাদর্শগত বিরোধে)। কী অদ্ভুত ভাবে তার ক’বছর বাদে ‘নির্বাচনে অংশগ্রহণ না বয়কট’ এই প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে উনি বললেন, “মেইনস্ট্রিম শব্দটা-র মানে কি? কে ঠিক করে দিল কোনটা মেইনস্ট্রিম? ভোটের লাইনটা মূলস্রোত আর এই ভুয়ো ইলেকটোরাল পলিটিক্সটাকে বর্জন করলে তুমি আউটস্ট্রিম!” এটাই গদর। একদিন ওয়ারেঙ্গল ইউনিভার্সিটির ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছেড়ে দলিত আন্দোলনে লড়তে আসা গদর আন্না, ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইতে পঞ্জাবের ‘গদর’ পার্টির ভূমিকাকে সশ্রদ্ধায় নিজের নামের সঙ্গে জড়িয়ে নেন গুম্মারি ভীট্টলরাও।
দ্বিতীয় বারের মুখোমুখি বসাতেই আমাকে বলেছিলেন, “সহজ ভাবে কথা বলো, আপনি বোলো না, তুমি বলো, আমরা সহজেই তুমিতে চলে আসার দেশের লোক তাই না?’
৮০-র দশকের মাঝামাঝি ‘মালা’ আর ‘মাদিনা’ দলিত জনজাতির আন্দোলনের চোখের মণি হয়ে উঠেছিলেন গদর। দলিত কামারের ছেলে ছোটবেলায় কোনও একটা মন্দিরে ঢুকতে না দেওয়ার কথা নিজেই বলতেন। পরে শেষ বয়সে সেই মন্দিরে পুরোহিতের কাছে মাথা পেতেছেন— এই ছবিটা আবার অন্ধ্র পুলিশ ব্যবহারও করেছে— “দেখো এই তোমাদের গদরআন্না।” মুখোমুখি কথা বলার সুযোগ হলে, প্রথম কয়েকবারের পর প্রস্তুত করে রাখতাম নিজেকে, যে লোকটার সঙ্গে দেখা হবে— সে নিজেই সবসময়ই ঘটে চলা নানা নাটকীয় আকস্মিকতা—যা অস্বীকার করা যাবে না সেটা হল, এই যে তিনি নিজেই আঙ্গুল দিয়ে চিনিয়ে দিচ্ছেন তাঁর হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটা। কথায় গানে মিশিয়ে সুরের ওঠাপড়ায় মুখের পেশী, ভুরুর কাঁপনে, লাল কাপড়টা ছুঁড়ে দিয়ে আবার মাতৃক্রোড়ে শিশুর মতো আদরে লুফে নিতে নিতে অসম্ভব পারফর্মেটিভ নিজেই প্রতিটি কথায় বলতেন ‘জন নাট্য মণ্ডলী ‘-র কথাই আসলে গদরের কথা। যখন নব্বই-এর দশকে হাজারও জনতার মাঝে মঞ্চে আসতেন শক্ত মুঠিতে লাল পতাকা উঁচিয়ে ধরে ‘জোহার অমরা বীরকু – নক্সালাইটেলু দেশভক্তলু’ আওয়াজ তুলে, সেই রাজনৈতিক মানুষটির ‘বিইং’টা ‘বিকামিং’টুকু থেকে বাদ দিয়ে দেখলে — শুধু একজন যশ আর মিডিয়ার আলো পাওয়া বিপুল জনপ্রিয় পারফর্মারের ছবিটায় বিভ্রান্ত হব। নিজের জীবনের কথা বলতে বসলে শুরু করতেন সেই ‘৭০ দশকের ‘বুড়া কথা’ গ্রুপের কথা দিয়ে। দলিত লোককথাগুলোকে দলিতের জীবন বদলানোর গানে রূপ দেওয়া ‘বাপুজি বুড়া কথা’ গ্রূপে সাংস্কৃতিক কাজকর্ম শুরু করার পর বি নরসিং রাও গদার এর জীবন বদলে দিয়েছিলেন।
তখনই গুম্মারি ভীট্টলরাও-এর ‘গদর’ নাম নেওয়া। ঐ জন্য সবসময় নজর আর সুব্বারাও পাণিগ্রাহীর কথা, শ্রীকাকুলামের লড়াইয়ের কথা, তাঁর পায়ের নিচের শিকড় দলিত আখ্যানের কথা বলে চলতেন গদরআন্না। বলে চলতেন উঁচু বর্ণের জমির মালিকের পায়ের তলা থেকে উঠে দাঁড়াতে চাওয়া রায়তি কুলির কথা গানে গানে। গাইতে থাকতেন ‘রায়ত কুলি সংঘম’-এর গান।
“দলিতা পুলুলাম্মা, আরে কর্মচেরুরু, আমরা দলিত বাঘেরা কর্মচেরুর জমিদারের বিরুদ্ধে লড়ছি”— গুন্টুরে কর্মচেরু দলিত আন্দোলনের গান আজও গদরআন্নাকে সবার ঠোঁটে বসিয়ে রেখেছে। ১৯৮৫-তে এক কাম্মা জমিদার করমাচেডুতে খুন করে দলিত কৃষকদের। প্রতিবাদে জোট বাঁধার গান বাঁধেন গদর। তারপর চুন্দুরুতে রেড্ডি জমিদারের গণহত্যায় প্রাণ যায় ৮ দলিত মানুষের। গদরের গলায় ‘চুন্দুরু দলিতান্না ‘ নাকাড়ার আওয়াজের মতো ঢেউ তোলে।
একজন গণশিল্পী গণ আন্দোলনের ফসল—এই কথাটা একটা সময়ের বিশ্বাস—এই প্রেক্ষিতে গদরকে না দেখলে, গদর আন্নাকে চেনার রাস্তাটা ভুল হবে।
নিজের কথা উঠলেই বলতেন, “এই আমি গদর আর আমার জন নাট্য মণ্ডলী বিশ্বাস তৈরি করেছি— ‘ফ্রম দা মাসেস টু দ্য মাসেস’-এ। কী ভাষায় গায় দেখো জন নাট্য মণ্ডলী। সংস্কৃত ঘেঁষা উঁচু বর্ণের বই পুঁথির তেলেগুতে নয়, তেলেঙ্গানা ডায়লেক্ট-এ মিশিয়ে দেওয়া সহজ দলিত জীবনের প্রজালা জীবিতম প্রজালা বাণী (কথা) পপালুকু বারি (মুখ চলতি শব্দ)। কী নিয়ে গান বাঁধতেন গদর—যা আজও মুখে মুখে ফেরে তেলেঙ্গানার দলিত মানুষদের মুখে—চপ্পল, জঞ্জাল, পায়খানা নিয়ে গান আর তাতে মাখা দলিত দিবারাত্রির কাব্য। অথচ বুর্জোয়া রাষ্ট্র, নয়া গণতন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদ, শ্রেণিহীন সমাজ এই শব্দ বন্ধগুলো গাইতে গাইতে বারবার উচ্চারণ করা—কিন্তু তোমার কানে আলটপকা মনে হবে না, এত সহজে যে উপর চাপানো নয়। তাই কখনো কি ভুলতে পারব—শহিদ রামকৃষ্ণের গ্রাম মুগলীচেরলার জনসভায় আতা-পাতা-মাতা (নাচ-গান-কথা) মিশিয়ে নিতে নিতে জন সমুদ্রের মাথায় দুলতে থাকছিলেন গদরআন্না।
আপাদমস্তক একজন পারফর্মার। নকশাল বাড়ির ৩০ বছরে কলকাতায় এসে একদল ছাত্র রাজনীতি করা ছেলেমেয়েকে ওয়ার্কশপ করাচ্ছিলেন— ‘তুমি তো শুধু গাইছ না, লোকে দেখছে তোমায়। কখনও ছাড়বে না ডাপ্পু আর ঢোলক।” খালি গা, কাঁধে কম্বল পরনে খাটো ঘোচি (ধুতি)। দৌড়ে মঞ্চে আসতে থাকে, সুর ভাসিয়ে দিয়েছে ‘রেলা রে এ এ, ‘গলা মিলিয়ে নিয়েছে জন নাট্য মণ্ডলীর সাথিরা হাতে ঐ লাঠিটা ঘোরাচ্ছেন আর পায়ে তাল ধরে রাখছেন গাজেলু (ঘুঙুর )। হঠাৎ মসৃণতা ভেঙে সেই ধাক্কা ‘হাআআঃ’! লাল পতাকা নিমেষে তুলে ধরা মুঠিতে ‘হাম কিসিসে ঝুঁকতা নেহি’। তারপর আবার দু’হাত জনতার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে ‘জাগোরে ‘! অভিব্যক্তি আর মতাদর্শ, মিলিয়ে মিশিয়ে বল্লাদির গদর। এমন গণশিল্পী মহা নট আমার জীবনে আর কখনও দেখিনি গদর আন্না।
এবার এই জায়গায় এসে একথাটা বলে নেওয়াই ভালো— বিশেষত যারা কালচার আর কালেকটিভটা চেষ্টা করছো প্র্যাক্সিসে। এই সময়টাই খারাপ যাচ্ছে। বুঝলাম! কিন্তু ইন্টিমেট স্পেস, অ্যাবসার্ডিটি আর এক্সপেরিমেন্টালের গুষ্টির কেদ্দানি মেরে ফেলবার পরে এই সমসময়-কে তুমি যতই ‘লোচ্চাবাদ’ (অবক্ষয় না বলে decadence-এর এটাই বাংলা করলাম এখানে) এর যুগ বলো আর পোস্ট ট্রুথ এর হ্যাজ নামাও—যাদের নিয়ম করে ঐ কসমেটিক সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের ‘হামাকে দ্যাকো’ করতে হয় তাদের পচা জলের পাতকোয় মানে ‘পাতি (বুর্জোয়া!) কুঁয়ো’য় কমরেড গদরকে নিয়ে কথা বলাই অবান্তর।
‘তেলেঙ্গানা প্রজা ফ্রন্ট’কে নতুন তেলেঙ্গানা সরকার ব্যান করার পরে আর দেখা হয়নি গদরের সঙ্গে। তবে হ্যাঁ এটা মনে রাখছি, জনগণের শিল্পী মানে জনগণের শিল্পীই। গদর আন্না, আমার সময়ে এক বিপ্লবী গণশিল্পী তিন হাজার গান লিখে রাষ্ট্রের দেগে দেওয়া পাঁচটি বুলেটের একটি জীবনের শেষ পঁচিশ বছর মেরুদণ্ডে বয়ে নিয়ে ঘুমাতে গেলেন।