গ্রাউন্ডজিরো প্রতিবেদন : অনিমেষ দত্ত
ঘটনাটি ঘটেছে গত ১৯ জুলাই। সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ক্লাস চলছিল। পড়ানোর সময়ই হঠাৎই নাকি এক অধ্যাপিকা ক্যুইয়ার থিওরির প্রসঙ্গ টেনে এনে এলজিবিটিকিউআইএ+ কমিউনিটিকে আক্রমণ করেন বলে অভিযোগ পড়ুয়াদের। সেই ক্লাসেই উপস্থিত ছিলেন নিজেকে ক্যুইয়ার হিসাবে পরিচয় দেওয়া এক পড়ুয়া। অভিযোগ, তিনি অসম্মানিত বোধ করেন এবং ক্লাস থেকে বেরিয়ে যান। এবং তিনি আরও জানান, এর পরেই তাঁর ‘প্যানিক অ্যাটাক’ হয়। অভিযুক্ত অধ্যাপিকা এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের তরফ থেকে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়েছে।
স্নাতকোত্তরের সেই পড়ুয়ার নাম ঈশিতা দাস। গত বুধবার ক্লাস নিচ্ছিলেন ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মৌসুমি সেন ভট্টাচার্য। পড়ানোর বিষয় ছিল মার্ক্সবাদ। ঘটনার সূত্রপাত এই পড়ানোর সময়েই। ঈশিতা বলেন, “উনি আমাদের মার্ক্সবাদ পড়াতে পড়াতে বলেন মার্ক্স কমিউনিটি বলতে একটি ‘হেটেরোনরমেটিভ’ পরিবারের কথা বলেছেন। তখন আমি বলি যে মার্ক্স তো পরিবার ব্যবস্থাকে সমর্থন করেননি। তখন উনি প্রসঙ্গটা নিয়ে যান ক্যুইয়ার থিয়োরিতে এবং ‘ক্যুইয়ার থিওরি ইজ অ্য স্যাম’ এই বাক্যটি ব্যবহার করে ক্যুইয়ার সমাজকে আক্রমণ করতে থাকেন। তিনি ক্যুইয়ার মানুষদের ‘সাইকোটিক’, ‘ডিফেক্টিভ’ আখ্যা দেন তাঁর মতে ক্যুইয়ার মানুষেরা সন্তান উৎপাদন করতে পারেন না ইত্যাদি।”
ঈশিতা জানান, এমন আক্রমণাত্মক কথা শুনে তিনি আতঙ্কিত (ট্রিগারিং) ও অসম্মানিত বোধ করেন। তিনি আরও বলেন, “ক্যুইয়ার মানুষেরা যে এমনটা নয় সেটা বলার আগেই আমার প্যানিক অ্যাটাক হয় এবং আমি ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাই। আমি এই ধরনের ‘ক্যুইয়ারোফোবিক’ ক্লাসে আর ফিরে যাইনি।” এরপরে তিনি বিভাগীয় প্রধানের কাছে অভিযোগ জানান। গত রবিবার ঈশিতা দাস বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, রেজিস্ট্রারের কাছে লিখিত অভিযোগপত্রও জমা দেন যেখানে তিনি উল্লেখ করেন অভিযোগটি যাতে আইসিসির আওতাভুক্ত করা হয়। ঈশিতা বলেন, “আমি ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরে আমার সহপাঠীদের থেকে জানতে পারি তিনি (অধ্যাপিকা) পুরো ক্লাসটাতেই এই ব্যাপারে বলতে থাকেন।” সেই ক্লাসে উপস্থিত বেশ কিছু পড়ুয়ার দাবি, ক্লাসের শেষে সেই অধ্যাপক ঈশিতাকে ইঙ্গিত করে বলেছেন যে, তাঁর বাবা ওঁকে ফোন করে বলেছেন যে সে ভুল পথে চলে যাচ্ছে। ঈশিতার দাবি এই রকম কোনও ফোনই তাঁর বাবার দিক থেকে অধ্যাপিকাকে করা হয়নি।
গত রবিবার লিখিতভাবে অভিযোগ জানানো হলেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ-এর তরফ থেকে এখনও পর্যন্ত কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি বলে অভিযোগ পড়ুয়াদের। ইংরেজি বিভাগের কিছু পড়ুয়া আজ পোস্টার, প্ল্যাকার্ড, রামধনু পতাকা নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে ক্লাস থেকে বেরিয়ে আসেন। ক্লাসের বাইরে অন্যান্য বিভাগ থেকেও পড়ুয়ারা সামিল হয়ে সেই অধ্যাপিকাকে লক্ষ্য করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকেন। অপরদিকে অধ্যাপিকা মৌসুমি সেন ভট্টাচার্য-এর দাবি, “আমি ক্লাসে পড়াচ্ছিলাম প্লেটোর রিপাবলিক এবং মার্ক্সবাদ, মূল আলোচনার বিষয় ছিল পরিবার। সেখান থেকে কী করে যে ক্যুইয়ার থিওরিতে চলে গেল আমি জানি না৷ আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো করা হচ্ছে তা একবারেই মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র পঠনপাঠনের পরিবেশকে বিঘ্নিত করার চেষ্টা করছে। এমনকি আমাকে আজ এক ছাত্র অ্যাবিউজ করেছে। বিষয়টা যদি আইসিসির বিচারাধীন হয় তাহলে সেখানেই প্রমাণ হয়ে যাবে কে সত্যি বলছে আর কে মিথ্যা বলছে।”
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর বিষয়টাকে বিভাগের মধ্যেই মিটিয়ে নেওয়ার জন্য কথাবার্তা চলছে। ইংরেজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. সুবর্ণা মণ্ডল বলেন, “আমাদের বিভাগে একটি অভিযোগ জমা পড়েছে। যেখানে অভিযোগকারী জানিয়েছেন যে বিষয়টা যেন আইসিসির আওতাভুক্ত করা হয়। যদি সেটা আইসিসির কাছে চলে যায় তাহলে এটা আর বিভাগের ইস্যু নয়, বৃহত্তর ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। আমরা এটাই চাই যে বিষয়টার একটা ঠিকঠাক তদন্ত হোক। অবশ্যই আমরা যেকোনো রকমের বৈষম্যের বিরোধী এবং সমতায় বিশ্বাসী।”
অন্যদিকে পড়ুয়াদের দাবি বিষয়টা আর বিভাগের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ব্যক্তিগত ভাবে কেউ ক্যুইয়ার সমাজের মানুষদের পছন্দ না-ই করতে পারেন, কিন্তু যখন একটা ক্লাসরুমে একাধিক পড়ুয়ার সামনে ঘটছে, তখন সেটা আর ব্যক্তিগত পর্যায়ে থাকে না। সংস্কৃত বিভাগের স্নাতকোত্তরের পড়ুয়া ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের সংগঠন ‘শিক্ষার্থী ঐক্য মঞ্চের’ সদস্য সমন্বয় ব্যানার্জি নিজেও একজন ক্যুইয়ার। তিনি বলেন, “এই ঘটনাটা আসলেই সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তিকে কালিমালিপ্ত করে। উনি ক্লাসে বলেছেন যারা ক্যুইয়ার মানুষ তারা ডিফেক্টিভ, তারা কুপথে চলে যাচ্ছে। এইটাকে আমরা নীতিপুলিশি মনে করছি। কে কী করবে না করবে, কার সঙ্গে সম্পর্কে থাকবে, কাকে ভালোবাসবে এইটা একান্তই তার ব্যক্তিগত বিষয়। সেখানে এসে যেকোনো ব্যক্তিরই মন্তব্য করার অধিকার নেই। আমরা যারা ক্যুইয়ার এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছি তাদের কাছে এটা খুবই বৈষম্যমূলক।”
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর পড়ুয়ারা অধ্যাপিকার কাছে ক্ষমা চাওয়ার কথা বললেও অধ্যাপিকা ক্ষমা চাননি। সমন্বয় বলেন, “কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তাঁরাও মিটিং করে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করছে। আমরা আজকে সরাসরি জানিয়েছি, উনি (অধ্যাপিকা) কোনওরকম প্রতিক্রিয়া দেননি।” আজই সেমেস্টারের ক্লাস শেষ হয়েছে। কিছুদিন বাদেই পরীক্ষা। পড়ুয়ারা কলেজে আসবেন না। এ বিষয়ে সমন্বয় বলেন, “আমরা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে আমাদের আন্দোলন জারি রাখব এবং অবশ্যই পরীক্ষার পর আবারও শারীরিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়ে আন্দোলন করব। এর মধ্যে যদি বিরূপ পরিস্থিতি তৈরি হয়, সেটা সেই অনুসারে ভাবা হবে। কোনওরকম দলীয় রাজনৈতিক শক্তির সহায়তা না নিয়েই আমরা আমাদের আন্দোলনটা চালিয়ে যাব।”
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য গত জুন মাস ছিল প্রাইড মান্থ। সেই উপলক্ষেই ২৮ জুন সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ঐক্য মঞ্চ একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। যেখানে দেখানো হয়েছিল র্যাভেনশ বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধ করে দেওয়া সমলিঙ্গ বিবাহের প্রেক্ষাপটে নির্মিত দেবলীনা মজুমদার পরিচালিত তথ্যচিত্র ‘গে ইন্ডিয়া ম্যাট্রিমনি’। ছবি দেখানোর পাশাপাশি আলোচনাতেও অংশ নেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, পড়ুয়ারা। কিছুদিন আগেই কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে বন্ধ করে দেওয়া হয় আলোচনা সভা এবং ছবির প্রদর্শনী। ঠিক এক মাসের ব্যবধানেই সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কী ভূমিকা নেয় এখন সেটাই দেখার।