ভারত ‘মাতা’ নয়, ভারতের ‘বেটি’ নয় – উত্তর চায় ভারতের নাগরিক মেয়েরা


  • July 21, 2023
  • (0 Comments)
  • 821 Views

গ্রাউন্ডজিরো প্রতিবেদন : সুদর্শনা চক্রবর্তী

 

প্রাণের ভয় না সম্মানটুকু কোনওক্রমে যদি রক্ষা করা যায় – সেইটুকুর ভাবনা? নগ্ন হয়ে প্রকাশ্যে শত শত মানুষের চোখের সামনে হাঁটার সময়ে ঠিক কী কাজ করছিল অই তিন মাঝবয়সী মণিপুরী মহিলার মনে? কখনও যদি এমন ঘটে আমার সঙ্গে? আমার মেয়ে-বন্ধুদের সঙ্গে – এমন দুঃস্বপ্ন তাড়া করে বেড়ায়ে।

 

যখন যৌন হেনস্থার প্রমাণস্বরূপ ভিডিও, ছবি চাওয়া হয় যৌন হেনস্থা হয়েছে এমন মহিলার কাছে, ঠিক কতটা অসহায় বোধ করেন তিনি? মাসের পর মাস কেটে যায় ক্ষমতার ঘনিষ্ঠ হেনস্থাকারীর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে। আর তারপর জনস্মৃতি থেকে ধীরে ধীরে আবছা হয়ে যেতে থাকে এ দেশের পদকজয়ী কুস্তিগীর মেয়েদের অবস্থান-প্রতিবাদ, পুলিশের হাতে শারীরিক হেনস্থা, কান্নায় ভেঙে পড়ে পদক বিসর্জনের ইচ্ছে। আলোচনায় চলে আসে রাজনীতির সমীকরণ। তারমধ্যে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় অভিযুক্ত হেনস্থাকারী। জামিন পেয়ে যায় অতি সহজে, বিনা প্রশ্নে।

 

ভারত ‘মাতা’। ভারতের ‘বেটি’। কোন ভারত? কার ভারত? একটা দেশ মানে শুধুই ভৌগলিক পরিসর নয় নিশ্চয়। দেশ মানে তো দেশের নাগরিক। এই দেশের ‘নাগরিক’ মেয়েরা তাহলে ভারতকে নিজের দেশ বলতে পারবেন বিনা দ্বিধায়? এখনও? বছরের পর বছর চলে যায়। ক্ষমতার হস্তান্তর হতে থাকে। রাজনীতির আপোষে নির্দিষ্ট বছর অন্তর গদিতে আসীন মুখগুলো বদলাতে থাকে। শুধু কুনান-পোশপরা, মণিপুর, গুজরাট, পশ্চিমবঙ্গ, রাজস্থান, দিল্লি, তামিলনাড়ু, পাঞ্জাব-হরিয়ানা – রাজ্যের পর রাজ্যে এ দেশের মেয়েদের উপর ঘটতে থাকা নিরন্তর অসহনীয় সহিংসতার ঘটনার মাত্রা ও সংখ্যা বাড়তে থাকে কেবলই। শুধু সংখ্যা, শুধু কিছু প্রতিবেদন হয়ে রয়ে যান এই মেয়েরা। আর তারপর নতুন কোনও ঘটনা, পুরনোর জায়গা নিয়ে নেয়।

 

মণিপুরে মেইতেই-কুকি জনগোষ্ঠীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার যে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, সেখানে সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘুর মধ্যে দশকের পর দশক ধরে চলা যে বিবাদ এবং তা সামলাতে রাজ্য তথা কেন্দ্র সরকারের যে সামগ্রিক ব্যর্থতা তা এখনকার এই ভয়ঙ্কর অবস্থার জন্য নিঃসন্দেহে দায়ী। সে বিষয়ে বহু আলোচনা, বহু তর্ক-বিতর্ক চলবে আর চলা উচিতও। কিন্তু আমাদের স্মৃতি থেকে কি সহজে মুছে যেতে পারে মণিপুরের মায়েদের ‘ইন্ডিয়ান আর্মি রেপ আস’ প্রতিবাদ? ভুলে যাব কেন, ভারতীয় সেনার কোন মাত্রার যৌন অত্যাচারের প্রেক্ষিতে সেই নগ্ন প্রতিবাদ করেছিলেন মণিপুরের মায়েরা?

 

রাষ্ট্রর চেহারা আসলে এটাই। নির্মম, নৃশংস দমন-পীড়ন, সন্ত্রাসের জন্য নারী শরীরের চেয়ে বেশি উপযুক্ত কিছুই মনে করে না তারা। ইতিহাসের পাতার পর পাতায় রয়েছে এর উদাহরণ। তাই ভারত অধীকৃত কাশ্মীরে উগ্রপন্থা দমনের জন্যও মহিলাদের ধর্ষণ করতে হয়, মণিপুরে সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণের নামে মহিলাদের ধর্ষণ করতে হয়। রাষ্ট্রের পিতৃতান্ত্রিক, নারীর প্রতি বৈষম্য করা, নারীর শরীরকে ক্ষমতা দখলে রাখার জমি বলে গন্য করা চেহরাটাই প্রতি পাঁচ বছরে ক্ষমতা দখল করতে থাকা সরকারের চরিত্রে প্রতিফলিত হতে থাকে। ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকেরা স্বভাবতই সরকার তথা রাষ্ট্রের মনোভাব অনুসরণ করবেন তাতে আর অবাক হওয়ার কী আছে।

 

ক্ষমতায় থাকলে কেউ বলে ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’, কেউ আনে ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ – কিন্তু তাতে মহিলাদের উপর আক্রমণ কমে না। বরং যত বেশি মেয়ে-মহিলা মাঠে-ময়দানে, রাজনীতিতে, নারীবাদী আন্দোলনে, বিবিধ আন্দোলনের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক তৈরিতে নিজেদের দৃশ্যমানতা বাড়াচ্ছেন, বিশেষত শহর-গ্রাম-মফস্বলের সুবিধাবঞ্চিত আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে বেরিয়ে এসে লিঙ্গ বৈষম্য, লিঙ্গ ও যৌন হিংসার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের স্বর মজবুত করছেন, জোটবদ্ধ হচ্ছেন পারিবারিক-সামাজিক-পেশাগত পরিসরে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে, নিজেদের প্রতিনিধিত্ব দাবি করছেন – তত বেশি তাঁদের শরীর ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। প্রকাশ্যে নগ্ন করে, ধর্ষণ করে, নির্মমতম উপায়ে তাঁর নারী শরীরটিকে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে – ক্ষমতা দখলে নারীরা কেবলই যোনি-সর্বস্ব ঘুঁটি।

 

মণিপুরের ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে ভুল হবে। এ রাষ্ট্রের চরিত্র। আজ ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। এবং সেই ভিডিও ভাইরাল হওয়া ও ভাইরাল করার মধ্যে, আরও বেশি ভয়-নিরাপত্তাহীনতা-সন্ত্রাস ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে যে রাজনীতির খেলা রয়েছে তা বুঝতে খুব বেশি সময় লাগে না। কেন্দ্র না কি বলেছে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে এই ভিডিও ‘ডিলিট’ করে দিতে হবে, এক অভিযুক্ত না কি গ্রেফতার হয়েছে – তাতে কি এই তিন মহিলার আজীবনের ভয়াবহতা মুছে ফেলা যাবে? কাদের উৎসাহে, পিঠ চাপড়ানিতে অভিযুক্তরা এরকম ঘটনা ঘটিয়ে যেতে পারে, যার অধিকাংশই আমাদের অজানা রয়ে যায়, তা স্পষ্ট। সুপ্রিম কোর্ট ভিডিও ভাইরালের ঘটনার পর জানিয়েছে – কেন্দ্র বা রাজ্য পদক্ষেপ না নিলে, সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ব্যবস্থা নেবে। এতদিন পর? কিসের জন্য এই অপেক্ষা? দিনের পর দিন সরকারের অকর্মণ্যতা, দাঙ্গা থামানোর অনীহা দেখেও!

 

আমরা, বিলকিস বানো ভুলে যাব? আর কিছুদিন পর শুনানি। গুজরাট দাঙ্গায় বিলকিস বানোকে গণধর্ষণ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের খুনে অভিযুক্তরা মুক্ত। এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন বিলকিস। বিচারব্যবস্থার উপর আস্থা রেখেছেন। ভারতের বিচারব্যবস্থা এরপরে কী রায় দেন – তার উপরে আমাদের এ দেশের নাগরিক মেয়েদের চিন্তা-চেতনার অনেকটাই নির্ভর করবে। নির্ভর করবে আগামী দিনের লড়াইয়ের পন্থা।

 

দিল্লির নির্ভয়া কান্ডের পর সারা দেশের আন্দোলনের ফলে ধর্ষণের সংজ্ঞা ও শাস্তিতে বদল আসে। যে আইনজীবিরা লড়েছিলেন দোষীদের শাস্তির দাবীতে, তাঁদের মধ্যে একজন ভারতের কুস্তি ফেডারেশানের সভাপতি ও বিজেপি সাংসদ যৌন হেনস্থায় অভিযুক্ত ব্রিজভূষণ শরণ সিং-এর জামিন পাওয়ার মামলায় লড়েছেন। আইনিভাবে দেখলে অভিযুক্তর আইনি সহায়তা পাওয়ার অধিকার আছে। বাস্তব এটাই। তবে কোন্‌ আইনজীবী কোন্‌ মামলায় লড়ছেন এবং কোন্‌ দল ক্ষমতাসীন তাতে এও বোঝা যায় অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ার পরেও কীভাবে অভিযুক্ত দিনের পর দিন আইনের থেকে রক্ষাকবচ পেয়ে থাকেন।

 

ব্রিজভূষণ শুধু যে যৌন হেনস্থার মামলায় অতি সহজে জামিন পেয়ে গেলেন, দীর্ঘদিন তিনি যে আইনের হাতের বাইরে রয়ে গেলেন তাই নয়, তাঁর যে ঔদ্ধত্য, তাঁর শরীরিভাষা, তাঁর যে মহিলাদের অভিযোগগুলিকে নস্যাৎ করে দেওয়ার হাবভাব তা এটাই স্পষ্ট করে দিয়েছিল ক্ষমতায় থাকা দল তাঁর পক্ষে, তাঁকে আশ্রয় দিচ্ছে এবং মহিলাদের যৌন হয়রানি আদৌ গুরুত্ব দেওয়ার মতো কোনও বিষয়ই নয়।

 

কুস্তিগীর মহিলাদের আন্দোলন নারীবাদী, রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল। কীভাবে রাজনৈতিক চাপান-উতোরে তা আপাতত স্থগিত, আগামীতে তার দিশা কী – এসব এখন আবার নতুন করে ভাবার সময় হয়েছে। কোন্‌ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে যৌন হয়রানির শাস্তি নিয়ে সোচ্চার মহিলা ক্রীড়াবিদেরা এখন চুপ করতে বাধ্য হয়েছেন তা ভেবে দেখার বিষয়। কেন নাবালিকা কুস্তিগীর বয়ান বদলান সে প্রশ্ন বারেবারে করে যেতে হবে। যেভাবে পিতৃতান্ত্রিক, মনুবাদী সরকারের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে লড়ছিলেন সমস্ত আন্দোলনের কর্মীরা তার রেশ জিইয়ে রাখাটাই চ্যালেঞ্জ – বিশেষত ব্রিজভূষণ শরণ সিং-এর জামিন মকুবের পরে। কারণ সরকার, অভিযুক্তর আঁতাত এই মুহূর্তে প্রশ্নাতীত। ভুললে চলবে না কুস্তিগীরদের এই আন্দোলন ক্রীড়াক্ষেত্রে মহিলাদের যৌন হেনস্থার বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এসেছিল। পরবর্তীতে এই আন্দোলন অবশ্যই বহু ক্রীড়াবিদ মহিলাকে নিজেদের অধিকার ও নিজেদের সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পথ দেখাতে পারে।

 

এই কথাও ভুললে চলবে না, রাজনীতির যে সমীকরণ কেন্দ্র ও বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে চলে তাতে বারেবারেই দাবার বোড়ে হয়ে রয়ে যান মহিলারা – কারণ তাঁরা নারী শরীর নিয়ে জন্মেছেন। সেইসঙ্গে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী-প্রতিবন্ধকতা-যৌন পরিচিতি এই সমস্ত যত ভিন্ন ভিন্ন পরিচিতি তাঁদের থাকে, ততই তাঁদের প্রতি সহিংসতা, বৈষম্যের মাত্রা বাড়তে থাকে।

 

ব্রিজভূষণের জামিন, মণিপুরের ঘটনা তাই বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত নয়। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে মেয়েদের উপর বর্বরোচিত আক্রমণের ইতিহাসেরই অংশ। তাই ইতিহাস বিকৃতি, ইতিহাস ভুলিয়ে দিতে চাওয়ার খেলাটা সমঝে চলতে হবে। উত্তর দাবি করে যেতে হবে। তথ্য মজুত রাখতে হবে নিজেদের কাছে। অশ্রুসজল চোখে ক্ষতবিক্ষত নারী শরীরকে জাতীয় পতাকায় ঢেকে তাঁকে সম্মান জানানোর আঁকা ছবি বা ইন্ডিয়া-র সঙ্গে ভারতের লড়াই কোনওটাই এ দেশে মেয়েদের সুরক্ষা দেয় না। যে সুরক্ষা দেশের নাগরিক হিসাবে তাঁর প্রাপ্য, অধিকার। সেইজন্যই, সরকারে মুখ বদলাবে, নারীর আন্দোলনের অভিমুখ না বদলানোটাই কাম্য।

 

Share this
Leave a Comment