সিলেবাস বদলের পিছনে পড়ুয়াদের মন দখলের নিকৃষ্ট রাজনীতি


  • July 17, 2023
  • (2 Comments)
  • 1686 Views

…সমাজ, পরিবেশ, রাজনীতি, বিজ্ঞান, ইতিহাস — সবকিছুর ন্যূনতম ধারণাই একজন নাগরিককে সচেতন করে তুলতে পারে। নাগরিকের এই সচেতনতাই দেশের গণতন্ত্রের শিকড়-বাকড়। ফলে, যে ভাষা নিয়ে পড়বে তার যেমন কিছুটা বিজ্ঞান বোঝার দরকার রয়েছে, যে বিজ্ঞান নিয়ে পড়বে তারও দরকার ইতিহাসকে বোঝার, সমাজকে চেনার। চিন্তা ও বোধের সার্বিকতা না তৈরি হলে মানুষের মনে অন্ধকার তৈরি হয়। সেই অন্ধকার জায়গাতেই ওঁত পেতে থাকে, ক্ষমতা লোভী, ধর্মান্ধ, পুঁজিবাদী শাসকেরা। লিখলেন তিথি রায়  

 

 

ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশন রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং (এনসিইআরটি)-র টেক্সট বুক ডেভেলপমেন্ট কমিটি থেকে ৩৩ জন শিক্ষাবিদ কিছুদিন আগেই তাঁদের নাম সরিয়ে নিতে চেয়েছেন। ২০০৬-৭ শিক্ষাবর্ষ থেকেই এঁরা সবাই এনসিইআরটি-এর স্কুল পাঠ্য রাষ্ট্রবিজ্ঞান বই তৈরির কাজে যুক্ত। সম্প্রতি, স্কুলের রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠক্রম থেকে বিভিন্ন বিষয় বাদ পড়ার বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদ। এনসিআরটি-র ডিরেক্টর দীনেশ প্রসাদ শাকলানি-কে তাঁরা চিঠি লিখে জানিয়েছেন, “মূল বইয়ের বেশকিছু অংশ সংশোধন করা হয়েছে। যার ফলে, বইয়ের চেহারা বদলে গেছে। তাই, আমরা দাবি করতে পারি না যে এই বই আমরা তৈরি করেছি, এই বইয়ের সঙ্গে আমাদের নাম জড়াতেও চাই না।” জুন মাসের গোড়াতেই, রাষ্ট্রবিজ্ঞান সিলেবাস কমিটি থেকে নিজেদের নাম সরিয়ে নেওয়ার ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন যোগেন্দ্র যাদব এবং সুহাস পালসিকারের মতো শিক্ষাবিদরা। তারপরেই, একে একে নাম যোগ হতে থাকে সেই দলে। যদিও, যাদব ও পালসিকারের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি এনসিইআরটি কর্তৃপক্ষ।

 

গত কয়েক বছর ধরেই এনসিইআরটির পাঠক্রম থেকে বিভিন্ন বিষয় বাদ পড়ছে। এ ঘটনা নতুন কিছু নয়। তবে, পাঠক্রম তৈরির যাঁরা কারিগর তাঁরা একে একে যখন নিজের নাম সরিয়ে নিতে চাইছেন, বোঝাই যাচ্ছে যে এনসিইআরটি কর্তৃপক্ষ কমিটির সদস্যদের পরামর্শ এবং আলাপ-আলোচনা ছাড়াই সিলেবাসের রদ-বদল করছে। এবং, গুরুতর অভিজ্ঞতা যোগ কাজটা হচ্ছে আরএসএস সমর্থিত বিজেপি শাসকের পছন্দ অনুযায়ী। প্রত্যেকবারই নানা অজুহাতে তাঁরা পাঠক্রমে কাঁচি চালানোকে বৈধ করে তুলছেন।

 

যা ঘটছে, তার কার্যকারণ, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আরেকটু খুঁটিয়ে দেখা যাক। বুঝে নেওয়া যাক আসলে কি ঘটছে। কেনই বা শাসকপক্ষ এত মরিয়া হয়ে উঠছেন স্কুল স্তরের পাঠ্যসূচি বদলাতে?

 

জানার কোন শেষ নেই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই

 

হীরকের রাজার এই বুলি মনে হয় আজকের আরএসএস-বিজেপির বড্ড প্রিয়। সত্যিই তো, কত কিছুই রয়েছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে, সব কী আর স্কুলে পড়ানো যায়? তাও আবার ক্লাস টেন পাস না করে কি আর এত শেখা সম্ভব! এই যুক্তিতেই বিজেপি সরকার অনবরত স্কুলের পাঠক্রম নিয়ে কাটা-ছেঁড়া করছে। কাজ চলছে ভারতের স্কুলপাঠ্য বই এবং পাঠক্রম তৈরির নিয়ামক সংস্থা এনসিইআরটি-র মাধ্যমে। সম্প্রতি, তাঁরা দশম শ্রেণির পাঠ্যবই থেকে ছেঁটে ফেলল বেশ কিছু বিষয়। বাদ পড়ল পর্যায় সারণি বা পিরিয়ডিক টেবল। বাদ গেল পরিবেশ, প্রাকৃতিক সম্পদ ও জ্বালানির উৎস বিষয়ক কিছু অংশ। ছাড় পেল না গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সহ পরিচিত সব আন্দোলনের কথাও। এর আগে অবশ্য ডারউইনের বিবর্তনবাদ ও আরও অনেক বিষয়ই সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

 

২০১৮ সাল থেকেই এনসিইআরটি-র স্কুলের পাঠ্যবিষয় কমিয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী প্রকাশ জাভরেকর। ওই বছরই জুন মাসে, ইতিহাস বই থেকে ভারতের জরুরি অবস্থা সম্পর্কিত পাঠ্য বিষয় পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে তিনি একটি টুইট করেছিলেন। বলেছিলেন,আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে সিলেবাস পরিবর্তন করে আমরা শিক্ষার্থীদের জরুরি অবস্থার সত্যতা জানাব, যাতে ইতিহাসকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায়।” তারপর, কোভিড চলাকালীন বাছাই করা অংশ একে একে বাদ যায়। মহামারির সময়, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও স্বাস্থ্য বিষয়ক নানা সমস্যায় যখন নাজেহাল সাধারণ মানুষ, শিক্ষাক্ষেত্রে একরকম তালা পড়ে গিয়েছে এবং কোনও দিকেই যখন কারোরই মন দেওয়ার সময় নেই, ঠিক সেই সময়টিকে ব্যবহার করে বিজেপি সরকার চেষ্টা চালিয়েছিল সিলেবাসে কাটছাঁট করতে। কমানোর মতো ঘটনা দিয়ে জনগণকে (বলা ভালো, গণমাধ্যমগুলোকে) মাতিয়ে রাখতে। সেসময়, পড়াশোনার ঘাটতি দেখিয়ে চলেছিল সিলেবাস কমানোর পালা। কিন্তু, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেলেও, নতুন শিক্ষাবর্ষে বাদ পড়া অংশ আর ফিরল না। উপরন্তু, বাদ দেওয়ার ধারা অব্যাহত। এনসিইআরটি-র তরফ থেকে জানানো হয়েছে, “পাঠ্যপুস্তকে বিষয়বস্তুর যৌক্তিকতা” রক্ষার্থেই তাদের এমন সিদ্ধান্ত। প্রসঙ্গত, তারা মনে করছে, বাদ দেওয়া অংশগুলো পাঠক্রমে অপ্রাসঙ্গিক। এবং একই বিষয় ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বিভিন্ন ক্লাসে না থাকাই বাঞ্ছনীয়। শুধু তাই নয়, পাঠ্যসূচির ভার কমানোর বিষয়েই জোর দিচ্ছেন কর্তৃপক্ষ।

 

সিলেবাস কাটছাঁট করার নেপথ্যে   

 

শাসকের রাজনৈতিক মতার্দশকে কায়েম করার সবচেয়ে কার্যকরী ব্যবস্থা হল স্কুল বইয়ের পাঠক্রমকে নিজের পছন্দ অনুসারে সাজানো। সভ্যতার ইতিহাসে এ ঘটনা ঘটেছে বার বার। ঠিক এই কারণেই, সামগ্রিক জ্ঞান চর্চায় বাদ পড়া অংশের কী অবদান, বোঝা প্রয়োজন। বোঝা দরকার যে ঠিক কী কারণে, বিজেপি সরকার এই অংশগুলো বাদ দিতে চাইছে।

 

প্রথমেই ইতিহাস। বারো ক্লাসের ইতিহাস বই  থেকে মুঘল যুগ মুছে ফেলা হয়েছে। সব মিলিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে হিন্দু প্রধান এক গৌরবময় অতীত তৈরির ওপরেই ঝোঁক দেখা যাচ্ছে। দীপেশ চক্রবর্তীর মতো ইতিহাসবিদ বলছেন (সংবাদ প্রতিদিন, রোববার, ১১ জুন) “আমাদের ‘গৌরব’ বোধের জন্ম হয় এমন ইতিহাসের যোগান চাই। ইসকুলপাঠ্য সরকারি বইয়ের ইতিহাসে যা পরিবর্তন করা হচ্ছে, তা-ও মনে হয় এই গৌরববর্ধক ইতিহাসের দাবি করে।” শুধু তাই-ই নয়। দীপেশ লিখছেন, “আজকের শাসকদলপন্থীর দাবি এই যে, গৌরবগাথার যে ভারতেতিহাস তারা চায় তা সম্পূর্ণভাবে তথ্য-সমর্থিত।” “ইতিহাসের বস্তুতপক্ষে হিন্দুদের বা ‘হিন্দুত্ব’-র ইতিহাস” হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাই দীপেশ প্রকাশ করেছেন। লেখার একেবারে শেষে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, “আমরা দেশের মধ্যে ইতিহাসের মাধ্যমে বিভাজন তৈরি করি। মুসলমানদের কথা বাদই দিই। বলুনতো নাগাসমাজে যে শিশুটি এই শুনে বড় হচ্ছে যে তাঁদের, ইতিহাস ও সংস্কৃতি ‘ইন্ডিয়া’-র ইতিহাস ও সংস্কৃতির ঐতিহাসিক অংশ নয়, সে কীভাবে মুসলিম-পূর্ব ভারতের ‘গরিমা’র ইতিহাসকে নিজের বলে ভাববে?” 

 

অন্যদিকে, স্কুলে ডারউইনের তত্ত্ব পড়ানো নিয়ে সমস্যা আজকের নয়। মোটামুটিভাবে, বাইবেল, কোরান কিংবা হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী বিশ্ব ও মানুষের সৃষ্টির পিছনে রয়েছে ঈশ্বরের কার্যকলাপ। কিন্তু, উনিশ শতকে চার্লস ডারউইনের মতো বিজ্ঞানী প্রথম দেখালেন যে এই পৃথিবীতে বিবর্তনের মধ্যে দিয়েই বিভিন্ন পর্যায়ে এক প্রাণী থেকে আর এক প্রাণীর সৃষ্টি হয়েছে, এমনকি মানুষও। এবং এই সৃষ্টির মূল কাণ্ডারি কোনও ঈশ্বর নন, একেবারেই ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’। ঠিক তখন থেকেই ধর্মীয় মৌলবাদীদের চক্ষুশূল হন ডারউইন। ১৮৭১-এ প্রকাশিত, ‘দ্য ডিসেন্ট অব ম্যান” বইয়ে ডারউইন বলেছিলেন – মানুষ এবং বানর এই দুই প্রাণীর পূর্বপুরুষ একই। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন ডিজরেইলি, অক্সফোর্ডের এক বক্তৃতায় জিজ্ঞেস করেছিলেন, “মানুষ কি আসলে বানর নাকি দেবদূত? এর উত্তরে তিনি নিজেই জানিয়েছিলেন, “প্রভু, আমি তো দেবদূতের পক্ষেই।” বিবর্তনবাদ সমগ্র জীবজগতের সৃষ্টিকে জানার এক যুক্তিভিত্তিক বোধ তৈরি করে। আর তার জেরেই নাকচ করে দেওয়া সম্ভব সৃষ্টির মূলে ঈশ্বরের অবদানকে। সুতরাং, ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রনায়কদের কাছে ডারউইনের তত্ত্ব এক মহাসংকট। তাঁরা ঈশ্বরকে বাঁচাবেন না বিজ্ঞানকে? বর্তমান সময়েও, তথাকথিত গণতান্ত্রিক দেশগুলিতে যখনই রাজনীতি এবং শাসনব্যবস্থার সঙ্গে ধর্মের গাঁটছড়া তৈরি হচ্ছে, ডারউইনের বিবর্তনবাদ সংক্রান্ত তত্ত্ব নিয়ে সমস্যা নতুন করে মাথা চাড়া দিচ্ছে। ২০১৮-তেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সত্যপাল সিং বলেছিলেন, “বানর থেকে মানুষ হতে কেউ দেখেনি, তাই ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ত্ব ভুল। স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রমগুলি বদলে ফেলা উচিত”।

 

তবে, সিলেবাস থেকে ডারউইন তত্ত্বের বাদ পড়া নিয়ে ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটি-সহ ভারতের নানা প্রান্তের বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সংগঠনগুলি প্রতিবাদ জানিয়েছে। সিলেবাসে ডারউইনের তত্ত্ব ফিরিয়ে আনার দাবিতে, দেশের বিভিন্ন শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রায় ১৮০০ বিজ্ঞানী, বিজ্ঞানকর্মী ও পড়ুয়াদের স্বাক্ষরিত একটি খোলা চিঠি দেওয়া হয় কর্তৃপক্ষকে।

 

সম্প্রতি, ‘নেচার’ পত্রিকাও এই বিষয়ে আওয়াজ তুলেছে তাদের সম্পাদকীয় কলামে। তাই, ভারতের শিক্ষা-ব্যবস্থায় এনসিইআরটির কার্যকলাপ নিয়ে শুধুমাত্র দেশেই নয়, সারা দুনিয়াতেই নানা প্রশ্ন উঠছে।

 

মাথাই নেই তো আর মাথাব্যথা

 

প্রাথমিকভাবে, সিলেবাসে পর্যায় সারণি কিংবা ডারউইনের বদল নিয়ে প্রতিবাদ হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়াতে শোরগোল পড়ে গেছে। আর সেটাই স্বাভাবিক। আপাতভাবে অনেকেই বিরোধিতা করতে গিয়ে দাবি করে ফেলছেন শিক্ষা ব্যবস্থা থেকেই এসব বিষয় হাওয়া হয়ে গেছে। এখানেই পাল্টা যুক্তি দিচ্ছে এনসিইআরটি। শুধুমাত্র ক্লাস টেন থেকে বাদ পড়েছে কিছু বিষয়, ইলেভেন- টুয়েলভ বা উচ্চশিক্ষা থেকে ছেঁটে ফেলা হয়নি—এমনটাই দাবি তাদের। পাঠ্যসূচিতে বদল যে কতটা যুক্তিপূর্ণ তা বোঝাতে মাঠে নেমে পড়েছেন ইউজিসি চেয়ারম্যান এবং আরএসএস-পন্থী এম জগদেশ কুমার। শান্তিশ্রী ধূলিপুরী পণ্ডিতের মতো বহু কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং শিক্ষকরাও সেই তালে তাল রাখছেন।

 

প্রথমেই মনে রাখতে হবে বুনিয়াদি বা মাধ্যমিক স্তরের থেকে উচ্চশিক্ষার পড়াশোনার ধরন একেবারে আলাদা। মাধ্যমিক স্তরে অর্থাৎ দশম শ্রেণি পর্যন্ত, পড়ুয়াদের মধ্যে অনেকগুলি বিষয়ের বুনিয়াদি ধারণা তৈরি হয়। যা এক প্রকার সামগ্রিক জ্ঞান। তারপর তারা একাদশ শ্রেণি থেকে নিজেদের পছন্দের বিষয় পড়া শুরু করে। এখানে প্রশ্ন উঠতেই পারে, যার বিজ্ঞান পড়তে ভালো লাগে না এবং একাদশে গিয়ে যে মানববিদ্যার চর্চা করবে তার পর্যায় সারণি জানার দরকার কোথায়? সে প্রসঙ্গেই আসা যাক।

 

এনসিইআরটি-র সিলেবাস মেনে পড়ানো হয় সিবিএসই বোর্ডে। এ বছরই সিবিএসই বোর্ডের দশম শ্রেণির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রায় ২০ লাখের কিছু বেশি সংখ্যক পড়ুয়া। অথচ, দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে প্রায় ১৪ লক্ষ পড়ুয়া। বোঝার সুবিধার্থে ধরে নেওয়া যেতে পারে দ্বাদশ উত্তীর্ণ পড়ুয়ার এক তৃতীয়াংশ বিজ্ঞান শাখায় পড়াশোনা করেছে। তাহলে, যে দুই-তৃতীয়াংশ বিজ্ঞান পড়ল না এবং যে কয়েক লাখ পড়ুয়ারা দশম শ্রেণির পরই পড়াশোনার মূল ধারা থেকে হারিয়ে গেল তারা জানতে পারল না পর্যায় সারণি কিংবা ডারউইনের তত্ত্ব। শুধু বিজ্ঞান নয়, মানববিদ্যা থেকে বাণিজ্য বিভাগ প্রত্যেক ক্ষেত্রেই এ ঘটনা সত্যি। এখন কেউ দাবি করতেই পারেন, ডিজিটাল যুগে দাঁড়িয়ে কোনও বিষয়ে জানার ইচ্ছে হলে বিকল্প পদ্ধতিতেও জানা সম্ভব। ঠিক এখানেই মনে রাখতে হবে আমাদের দেশে, শিক্ষা ও জ্ঞানের সবচেয়ে বড় মাধ্যম স্কুল। এক জন বাচ্চা স্কুলে যা জানল না, অন্য উপায়ে তা জেনে নেবার অবকাশ কম। সবচেয়ে বড় কথা, তার আদৌ জানার ইচ্ছে তৈরি হবে তো? সেটাই ভেবে দেখার।

 

পাশাপাশি এও লক্ষ্য করা যায়, সামগ্রিক জ্ঞান তৈরি করার প্রচেষ্টা উঁচু ক্লাসগুলোতেই আটকে পড়ছে। কাজেই, মাধ্যমিক স্তরেই যারা পড়াশোনায় ইতি টানে, তাদের জানা-বোঝার পরিসর ক্রমশই ছোট হয়ে আসছে। মানুষের জীবিকার জন্য সমস্ত বিষয়ের ওপর দক্ষতার প্রয়োজন নাও থাকতে পারে। তবে, সমাজ, পরিবেশ, রাজনীতি, বিজ্ঞান, ইতিহাস — সবকিছুর ন্যূনতম ধারণাই একজন নাগরিককে সচেতন করে তুলতে পারে। নাগরিকের এই সচেতনতাই দেশের গণতন্ত্রের শিকড়-বাকড়। ফলে, যে ভাষা নিয়ে পড়বে তার যেমন কিছুটা বিজ্ঞান বোঝার দরকার রয়েছে, যে বিজ্ঞান নিয়ে পড়বে তারও দরকার ইতিহাসকে বোঝার, সমাজকে চেনার। চিন্তা ও বোধের সার্বিকতা না তৈরি হলে মানুষের মনে অন্ধকার তৈরি হয়। সেই অন্ধকার জায়গাতেই ওঁত পেতে থাকে, ক্ষমতা লোভী, ধর্মান্ধ, পুঁজিবাদী শাসকেরা। ইতিহাসের ন্যূনতম ধারণা যার হয়নি, বিজ্ঞান কী এবং কেন যার বোঝা হয়নি, বিভিন্ন বিষয়কে দেখার চোখ যার ফোটেনি তার মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ার একটা ফরওয়ার্ডে ভুল তথ্য চারিয়ে দেওয়া সবচেয়ে সহজ কাজ। ক্ষমতায় থাকতে গেলে আরএসএস-বিজেপির অস্ত্রই তাই।

 

সিলেবাসের বদল যেমন হচ্ছে, বিকৃত হচ্ছে ইতিহাসও। বিজ্ঞানের নামে চলছে অপবিজ্ঞানের কারবার। আর, তা নিয়ে নানা ছবি, পোস্ট, ভিডিও ভাইরাল হয়ে পড়ছে। হু হু করে এক ফোন থেকে আরেক ফোনে ঢুকে পড়ছে সেসব। আট থেকে আশি এসব বিকৃত বিষয় হজম করে চলেছে মুঠোফোনে। এভাবেই, জনসংখ্যার একটা বড় অংশের কাছে ভুল তথ্যের মান্যতা তৈরি হচ্ছে। নিজেদের অজান্তেই তাদের মস্তিষ্কের দখল নিচ্ছে ঘৃণার রাজনীতির কারবারিরা। সিলেবাসের বোঝা কমানোর আড়ালে চলছে গণতন্ত্রের শিকড় আলগা করে দেওয়ার কাজ।

 

তাই, সিলেবাসের ভিতরে এবং বাইরে, জানা-বোঝার যে কোনও পরিসর তৈরির নিরলস প্রচেষ্টা, বিজ্ঞান বোধের বিকাশ ও সামাজিক ইতিহাস চেতনার প্রসার— এই সবই সময়ের দাবি হয়ে উঠছে।

 

Share this
Recent Comments
2
Leave a Comment