গৃহযুদ্ধ!


  • July 8, 2023
  • (1 Comments)
  • 1895 Views

আমরা যাঁরা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে লাশ গুনি। ‘প্রহসনের নির্বাচন’ বলে স্ট্যাটাস দিয়ে কর্তব্য সারি। যাঁরা লিখি, পড়ি। আমরা যদি এখনই গণতন্ত্রের জন্য, শাসন ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের জন্য, ‘গ্রামের মানুষের দ্বারা, গ্রামের উন্নয়ন’-এর জন্য, নবান্নে নয়, গ্রাম সংসদ/ গ্রাম সভাতেই উন্নয়নের ফিরিস্তি রচনার জন্য মুখ না খুলি, মত বিনিময় করি, ভাবি ও ভাবাই—তবে দুয়ারে আগুন পৌঁছানো শুধু মাত্র সময়ের অপেক্ষ। লিখলেন দেবাশিস আইচ

 

পঞ্চায়েত-রাজই যখন প্রহসনে পরিণত হয়েছে, পঞ্চায়েত নির্বাচন সেখানে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হবে এমনটা ভাবাই হাস্যকর। রাজ্য পরিচালনায়, শাসন ব্যবস্থায়, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় কোথাও যখন ছিঁটেফোঁটা গণতন্ত্র নেই, এমনকি মুখোসটুকুও বাহুল্য বলে পরিত্যক্ত হয়েছে, তখন পঞ্চায়েত নির্বাচন বেশ একটা সুষ্ঠু, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আয়োজিত হবে এমনটা বোধহয় খুব বেশি লোক ভাবেন না। যাঁরা ভাবেন, তাঁরা হয়ত এই মৃত্যু মিছিলে স্তম্ভিত হন, এই ভয়ঙ্কর হিংসার উদযাপনে শিউরে শিউরে ওঠেন। প্রশ্নও তোলেন হয়ত, কেন এমনটা হবে, হয়ে চলবে? যাঁরা স্তম্ভিত হন এবং যাঁরা হন না; যাঁরা শিউরে ওঠেন কিংবা ওঠেন না—তাঁদের বড় অংশটিই তো ভোট দেন, অনেকেই হিংসা কী তা প্রত্যক্ষ করেন, আক্রান্ত হন, অপমানিত হন, এমনকি মরেও যান। কিন্তু এই হিংসার শেষ কোথায়, ‘দিন আনি দিন খাই’ অধিকাংশের এমন ভাবনা ভাবার ফুরসত মিলতে না মিলতে আরও এক নির্বাচন এসে পড়ে। আর ভাবনার রসদটাই বা জোগাবে কে?

 

এই যে পঞ্চায়েত নির্বাচন ঘিরে এত উন্মাদনা, এত টন টন নিউজ প্রিন্ট বোঝাই করা খবর, ঘণ্টার পর ঘণ্টা এয়ার টাইম অকাতরে খরচ হল, খবর আছড়ে পড়ল সাইবার দুনিয়ায়—সেখান থেকে কখনও, কেউ কি কোথাও বুঝলেন, একটি শাসন ব্যবস্থায় পঞ্চায়েত কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? নিদেনপক্ষে পঞ্চায়েত খায় না কি মাথায় দেয়— সেটা কি কোথাও, কোনও গণমাধ্যমে, কেউ কি বুঝিয়ে বলল? খবর পড়তে পড়তে, খবর দেখতে দেখতে, এঁর-ওঁর-তাঁর আলোচনা শুনতে শুনতে—যদি তাকে আদৌ আলোচনা বলা যায়— কখনও গায়ে কাঁটা দেওয়া ক্রাইম থ্রিলার পড়া বা শোনার অনুভূতি হয়। কখনও তা কলতলার ঝগড়া। শুধু হাতাহাতি, মাথা ফাটাফাটিটাই যা বাকি থাকে। সংবাদপত্রে কিংবা টেলিভিশনে চোখ রাখলেই মনে হয় পঞ্চায়েত নির্বাচনটা বোধহয় ‘ক্রাইম বিট’-এর একটা প্রধান অংশ। আর কিছুটা ‘পলিটিকাল বিট’। বিষয়টা রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রনীতির, উন্নয়নের তা বেমালুম ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।

 

অবশেষে যা পড়ে থাকে, তা অবাধ হিংসাতন্ত্র। হাই কোর্টের সাধ্য নেই—হাজার সদিচ্ছা থাকলেও—এই তাণ্ডব বন্ধ করার। হাই কোর্টের নির্দেশে বিরোধী প্রার্থীদের মনোনয়ন দাখিল করতে এসকর্ট করে নিয়ে যাচ্ছিল পুলিশ। নির্বাচনী এলাকায় ঢুকতেই শাসক দলের আক্রমণে মৃত্যু হয় এক প্রার্থীর। হাই কোর্টের নির্দেশ সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় কেন্দ্রীয় বাহিনী সঠিক সময়ে রাজ্যে পৌঁছয়নি। বাহিনীকে বুথে বুথে পৌঁছে দেওয়ার কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। নির্বাচন কমিশনার তো বটেই, জেলায় জেলায় জেলাশাসকরা বাহিনীর সঙ্গে কোনও যোগাযোগ রক্ষা করেনি বলে অভিযোগ উঠেছে। বহু বুথে মায় রাজ্য পুলিশও ছিল না। এক জন মহিলা পুলিশ কিংবা বুথের বাইরে দু’জন সিভিক ভলান্টিয়ারকে আইনশৃঙ্খলার দায় চাপিয়ে সরে পড়েছেন জেলার পুলিশ সুপার। আগেই সংবাদপত্রে ছবি বের হয়েছে, পুলিশের পোশাক পরা, বয়সের ভারে ন্যূব্জ মহিলারা রাইফেল কাঁধে ভোটের ডিউটি দিতে চলেছেন। এমন খবর কাল সকাল থেকেই চোখে পড়ছে। এ সবই যে পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক, ঠান্ডা মাথায় ভাবা তা নিয়ে কোথাও কোনও সন্দেহ থাকতে পারে না। আর কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকলেও অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোট হত এমন মনে করার কোনও কারণ নেই। শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর প্রধান সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘কাছের প্রশাসক, কাজের প্রশাসক’ রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিনহা, রাজ্য ও জেলা পুলিশ প্রশাসনকে নিয়ে যেভাবে নির্বাচন পরিচালনা করবেন স্থির করেছিলেন, প্রথম থেকেই পরিকল্পনা মাফিক তাই করে গিয়েছেন। শুধু আদালত দিয়ে গণতন্ত্র রক্ষা পায় না। যদি গণতন্ত্রের অন্য স্তম্ভগুলো এক স্বৈরাচারী শাসকের কব্জামুক্ত না করা যায়।

 

তবে, ২০১৮ সালে যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ৩৪% আসন জয়, একতরফা ভোটের সঙ্গে ২০২৩-এর পার্থক্য রয়েছে। ২০১৮ সালের মৃত্যুর সংখ্যাকে এবারের ভোট ছাপিয়ে গিয়েছে। সেবার ভোটের দিন ১০ জনের মৃত্যু হয়েছিল, বেসরকারি মতে মারা গিয়েছেন ১৩ জন। তবে, কে ভোট হিংসায়, আর কে নয়—এমন এক ধোঁয়াশা তৈরি করে মোট মৃত্যুর সংখ্যা কমানোর চেষ্টায় ব্যস্ত থাকতে দেখা গিয়েছে নির্বাচন কমিশনারকে। বিকেল অবধি ভোটে হিংসার পরিমাপ করে উঠতে পারেননি তিনি। আবার শান্তিপূর্ণ হয়েছে একথাও বলেননি। বোঝা যায়, কী বলা হবে সেই বার্তা তিনি পাননি।

 

একটি বার্তা অবশ্য দিনে দিনেই কালীঘাটে পৌঁছে যাওয়ার কথা আর তা হল, ভোট লুটের মেশিনারি অনেক জেলাতেই অন্তত কয়েকশো বুথে কাজ করেনি। হিংসাত্মক ঘটনা সেখানেই বেশি ঘটেছে। বিরোধী দল সিপিএম-কংগ্রেসের পাঁড় সমর্থক/ সদস্যরা সমাজমাধ্যমে প্রকাশ্যেই বলছেন বুথে বুথে ‘মানুষের গণপ্রতিরোধ’-এর সঙ্গে পেরে উঠতে পারেনি তৃণমূল বাহিনী। এমনটা যে হবে তার একটা ইঙ্গিত ছিল বিরোধীদের মনোনয়ন পেশের দিন থেকেই। তাঁদের কথা, ভাবভঙ্গি থেকেই স্পষ্ট, রাজনৈতিক শক্তি বাড়িয়ে তুলতে বাঁশ-লাঠি-পেশী শক্তিকেও তাঁরা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েই এগিয়েছেন। এগোতে যে পারছেন, তার প্রথম ও প্রধান কারণটি বোধহয় এ রাজ্যের সার্বিক  অর্থনৈতিক বিপর্যয়। যে বিপর্যয়ের অন্যতম নিদর্শন একটি ভয়ানক অভিযোগ, সেটি হল শিশুদের মিড-ডে মিলের খাবারের টাকা খরচ না করে, সেই তহবিল থেকে ভোটকর্মীদের ভাতা দেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রক যে অভিযোগের জবাবদিহি চেয়েছে। ভিখিরি মা-ও তাঁর শিশু সন্তানকে না খাইয়ে নিজে দাঁতে কুটুটি কাটেন না।

 

আশঙ্কা, ২০২৩-এর পঞ্চায়েত নির্বাচনে যে হিংসার আগুন ছড়াল, তা সহজে নিভবে না। অধিকাংশ আসনেই তৃণমূল কংগ্রেস জিতবে, সেখানে তো বটেই, যেখানে যেখানে মাটি হারাবে সেই অঞ্চলগুলোতে বেশি বেশি করে হিংসাত্মক হয়ে উঠবে শাসক দল। প্র‍ত্যাঘাত ঘটলে আগামী দিনে এই হিংসা কি গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে নিয়ে যাবে রাজ্যকে? আর তা যদি ঘটে তবে দায়ী থাকব আমরাও। আমরা যাঁরা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে লাশ গুনি। ‘প্রহসনের নির্বাচন’ বলে স্ট্যাটাস দিয়ে কর্তব্য সারি। যাঁরা লিখি, পড়ি। আমরা যদি এখনই গণতন্ত্রের জন্য, শাসন ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের জন্য, ‘গ্রামের মানুষের দ্বারা, গ্রামের উন্নয়ন’-এর জন্য, নবান্নে নয়, গ্রাম সংসদ/ গ্রাম সভাতেই উন্নয়নের ফিরিস্তি রচনার জন্য মুখ না খুলি, মত বিনিময় করি, ভাবি ও ভাবাই—তবে দুয়ারে আগুন পৌঁছানো শুধু মাত্র সময়ের অপেক্ষ।

 

Share this
Recent Comments
1
  • আমার মনে হয় এই যে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এর স্বপক্ষে বারবার মত প্রকাশ করা হয় এটা বেশ কিছুটা ইউটোপিয়ান মতামত বলেই মনে হয় কারণ আজ পর্যন্ত কোন ইজিম ই মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি থেকে মানুষকে মুক্ত করতে পারেনি । আমি একটা সাধারন কথা বলছি সেটা হচ্ছে মানুষের লোভ , ফলে আমরা যতই একদম নিচুস্তরের গ্রাম সভায় সিদ্ধান্ত নিয়ে উন্নয়নের কথার ভাবনায় ভাবি তো হই না কেন সেটা সবসময় লোভ দারাই নিয়ন্ত্রিত হবে আর একটা উপলব্ধি আমার খুব বেশি করে আজকাল মনে হয় অশিক্ষিত মানুষের হাতে ক্ষমতা প্রদান খুব বেশি করে বিপর্যয় ডেকে আনে ।

Leave a Comment